প্রবাসী শ্রমিক কল্যাণ-স্বল্প খরচে বিদেশে কর্মসংস্থান ও আইএলও by মেসবাহউদ্দীন আহমেদ
বাাংলাদেশের তরুণরা সরকারের উদ্যোগে স্বল্প খরচে মালয়েশিয়ায় যাবে কাজ করতে, খুবই আশার ও ভালো লাগার সংবাদ। এর সঙ্গে আরেকটি শুভ সংবাদ হলো, সরকার অভিবাসী শ্রমিকদের বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়া ও প্রত্যাবর্তনের পর তাদের সুরক্ষার জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে।
বৈদেশিক কর্মসংস্থান, অভিবাসী কর্মী অধিকার আইন ২০১৩ নামে আইন তৈরির প্রক্রিয়ায় আইএলও সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ সরকারকে। আইনটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, চাকরি নিয়ে বিদেশ যেতে খরচ যেন বেশি না হয়, নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিদেশ যাওয়া ও চুক্তি মোতাবেক কাজ পাওয়ার জন্য আইন ও সরকারের করণীয় নির্ধারণ। আইএলও বেশ কয়েক বছর থেকেই সুইজারল্যান্ড সরকারের আর্থিক অনুদান ও সাহায্যে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রমিকদের মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এশিয়ায় অভিবাসন প্রক্রিয়া ও কর্মনিরাপত্তা বিষয়ে চেষ্টা চালিয়ে আসছে।
আইএলওর অনেকগুলো কনভেনশন আছে, যেমন_ ৮৭, ৯৮ এবং ১৪৩ নম্বর কনভেনশন প্রযোজ্য হবে ও জাতিসংঘের কনভেনশন আছে অভিবাসী শ্রমিক ও পরিবারের সুরক্ষার জন্য। যেগুলোতে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেছে। যদিও আইএলও কনভেনশন ৯৭ এখনও বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেনি। এসব কনভেনশন অভিবাসী শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষা ও কর্মনিরাপত্তা_ সেটা মজুরি, কর্মক্ষেত্রে শারীরিক নিরাপত্তা, অর্থ দেশে পাঠানোর সুব্যবস্থা, আবাস, চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধার জন্য দরকষাকষিতে সাহায্য করবে। আমাদের শ্রমিকরা বিদেশে যায় চুক্তি ভিত্তিতে এবং তাদের একটি বড় অংশ যায় গৃহকর্মী হিসেবে। যেসব দেশে আমাদের শ্রমিকরা যায় তাদের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক স্থানেই চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক ও গৃহকর্মীদের জন্য কোনো শ্রম আইন নেই বা তারা শ্রম আইনের আওতাভুক্ত নয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সব দেশেই অতিথি শ্রমিকদের জন্য আইন হোক। বাংলাদেশকে আইএলওর সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে ওই উদ্যোগে তৎপর হওয়ার দরকার। তা হলেই বিদেশে কর্মরত আমাদের দেশের শ্রমিকরা সুরক্ষা পাবে। কিন্তু অন্যদের যখন উপদেশ দেব আইন করার জন্য, তার আগে তো আমাদের করতে হবে সেসব আইন, যেখানে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক ও গৃহকর্মীদের সুরক্ষা আছে। তা হলেই আমরা অন্যদের চাপ দিতে পারব।
এক সময় ছিল যে বিদেশি নিয়োগ কর্তাই আসা-যাওয়ার বিমানের সব খরচ ও সেখানে বাসস্থান দিতেন। এখন রিক্রুটিং এজেন্টদের মধ্যে এমন প্রতিযোগিতা যে কে কত কম মজুরিতে লোক পাঠাতে পারে। অভিযোগের তীর বাংলাদেশের দিকে বেশি। এই প্রতিযোগিতায় মজুরিও কমেছে, সুযোগ-সুবিধাও কমেছে। নিয়োগকারীরা তো চায় কম মজুরিতে শ্রমিক নিয়োগ করতে। তাই যেসব রাষ্ট্র থেকে বিদেশে শ্রমিক যায় তাদের মধ্যে সমঝোতা দরকার যেন মজুরির ও কর্মপরিবেশের মান উন্নয়ন করা যায়। যেসব দেশ থেকে শ্রমিকরা যায় আর যেখানে বিদেশি শ্রমিক কাজে নিয়োজিত করে_ এই দেশগুলোর ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলো শ্রমিক স্বার্থ রক্ষায় একসঙ্গে কাজ করলে অভিবাসী শ্রমিকদের অনেক সমস্যা তারাই সমাধান করতে পারবে। এমনকি সরকার বা দূতাবাসের চেয়েও ঢের বেশি। ট্রেড ইউনিয়ন থেকে কিছু উদ্যোগ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। যেমন মালয়েশিয়ার ট্রেড ইউনিয়নগুলো উদ্যোগ নিয়েছে সেখানে বিদেশি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায়। আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলো এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে।
এ দেশের তরুণরা কতখানি অদম্য বিদেশে যাওয়ার জন্য যে সাগর-নদী, সীমান্ত, পাহাড়-পর্বর্ত ও তীব্র তুষারপাত বা সাহারার মতো তীব্র গরমও তাদের ঠেকাতে পারে না।
কিছুদিন আগে টিভির সংবাদে দেখেছি, পত্রিকায়ও পড়েছি, বাংলাদেশের কিছু তরুণ জীবন-জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিল দেশ ছেড়ে দুটি জেলে নৌকায় করে। তাদের লক্ষ্য ছিল মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডে যাওয়া। তাদের সলিলসমাধি ঘটে বঙ্গোপসাগরে। এরপর আর কোনো কথা কারও মুখে শুনিনি। না সরকার, না জনপ্রতিনিধি বা রাজনৈতিক দল বা কোনো সামাজিক সংগঠন_ কারও থেকে নয়। এর আগেও থাইল্যান্ডের নিরাপত্তা রক্ষীদের ফিরিয়ে দেওয়া এক নৌকায় ফিরে আসার পথে খাদ্য ও পানি ফুরিয়ে যাওয়ার ফলে ক্ষুধায় মারা গেছে অর্ধেক যাত্রী। নৌকার ইঞ্জিনের তেল ফুরিয়ে গেলে নৌকাও ভাসতে থাকে। একসময় জীবিত যাত্রীরা দেখতে পায় আন্দামানের এক ছোট দ্বীপ। জীবনের আশায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে জীবিতরা। সেখানে ভারতীয় জেলেরা তাদের প্রথম দেখতে পায়। তাদের নিয়ে আসে আন্দামানের এক দ্বীপে, সেখান থেকে ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসে।
কয়েক বছর আগে একদল তরুণের কথা পত্রিকায় পড়েছিলাম, তারা যাচ্ছিল ইউরোপে। মানব পাচারকারী দালাল প্রথমে তাদের নিয়ে যায় মধ্যপ্রাচ্যে, তারপর পশ্চিম আফ্রিকায় এবং ডিঙি নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে স্পেন যাওয়ার কথা। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে শেষে ভূমধ্যসাগরে পথ হারিয়ে অনাহারে তাদের অধিকাংশ মারা গেছে। দু'একজন ফিরে এসেছে অর্ধমৃত হয়ে। কেন এই করুণ পরিণাম আমার দেশের তরুণের? জাতির ভবিষ্যতের!
খবরটা পড়তে পড়তে আমার মনে আসছিল মালির আবহাওয়ার স্মৃতি। একটা কাজ উপলক্ষে এক যুগেরও বেশি আগে আলজিয়ার্স হয়ে মালি গিয়েছিলাম। আমি জানি এই সাব-সাহারা অঞ্চলে কী কঠিন খরতাপ। সূর্য যেন গনগনিয়ে ওঠে। সাহারা মরুভূমির বালু রোদে চিকচিক করে চোখ ঝলসে যায়, মুখ পুড়ে যায়। লিটারের পর লিটার পানি খেয়েও এয়ারকন্ডিশন করা আরামদায়ক ল্যান্ডরোভার জিপে তেষ্টা মেটে না। এক যুগ আগে সেখানকার অনেকেই বাংলাদেশের নামও শোনেনি। বামাকো বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের লোকদের কাগজপত্র ঘেঁটে বাংলাদেশ নামটি খুঁজে পেতে সময় লেগেছিল। তারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেখে বিস্মিত। এক ইমিগ্রেশন অফিসার আরেকজনকে দেখায়। এভাবে আমার পাসপোর্ট হাতবদল হতে থাকে। পশ্চিম আফ্রিকার যেখানেই গিয়েছি বুরকিনা ফাসোর ওগাডুগু, পাশের রাষ্ট্র টোগো, আইভরি কোস্টের একই পরিস্থিতি_ কেউ চেনে না। ঘানায় অবশ্য এমন দু'একজন স্থানীয়কে পেয়েছি যারা বাংলাদেশকে জানে ফুটবল খেলার সুবাদে। একজন তো আমাকে এসে অনুরোধ করেছিল, তাকে বাংলাদেশের কোনো ফুটবল দলের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে। সে বাংলাদেশে ফুটবল খেলতে চায়। অনুরোধটি শুনে ভালো লেগেছিল যে, কেউ কাজের সন্ধানে বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছে। এখন নিশ্চয়ই এসব রাষ্ট্রে স্বদেশীদের দেখা হলে আশ্চর্য হবো না।
জার্মানিতে বাঙালি অনেক তরুণের কাছে গল্প শুনেছি, তারা মস্কো বা বেলারুশে মাসের পর মাস অপেক্ষা করে তেলের ট্যাঙ্কারের ভেতর ১৭ দিন একটানা জার্নি করে জার্মান সীমান্ত শহর ফ্রাঙ্কফুর্ট ওডারে পোল্যান্ড হয়ে পেঁৗছেছে। কী দুঃসাহস তাদের! অবাক লেগেছে তাদের কথা শোনে। কীভাবে একজন ১৭ দিন কাটিয়েছে তেলের খালি ট্যাঙ্কারের ভেতর। আমি তো পাঁচ মিনিটও থাকতে পারব না। তাদের সম্বল ছিল মাত্র কয়েক লিটার পানি ও অল্প রুটি। রাতের বেলায় ট্যাঙ্কারটি থামে কোনো বনজঙ্গলের ধারেকাছে_ ওদের নামিয়ে দেয় কিছুক্ষণের জন্য প্রাকৃতিক কাজ সারা ও খাওয়ার জন্য। জীবন নিরাপত্তার কোনো তোয়াক্কা না করে এসব তরুণের অনেক করুণ পরিণতির কথা জানি_ ইউরোপে অনেকের কাছে শুনেছি। পোল্যান্ডের সীমান্ত দিয়ে জার্মানিতে ঢোকার সময় বরফে জমে এক তরুণের অবশ হয়ে পড়ে থাকা নিথর দেহ জার্মান সীমান্তরক্ষী পুলিশ উদ্ধার করে। তরুণটির জীবন রক্ষা পেলেও ঠাণ্ডায় অবশ হয়ে যাওয়া একটি পা কেটে বাদ দিতে হয়। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার মাংস বহনকারী লরিতে করে দিনের পর দিন যাত্রা করে তাদের অনেকে এসে পেঁৗছেছে পশ্চিম ইউরোপে। ঢাকা থেকে পূর্ব ইউরোপ, তারপর নানা পথে পশ্চিম ইউরোপ। মস্কোসহ অন্যান্য বিমানবন্দরে দেখেছি অসংখ্য বাংলাদেশের তরুণকে যারা অবৈধ পন্থায় বিদেশে যেতে গিয়ে ধরা পড়ে জেল খেটে ফেরত যাচ্ছে বা ঢুকতে না পেরে ফেরত যাচ্ছে। ফেরত ফ্লাইটে স্থান পাওয়ার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করছে বিমানবন্দরের লাউঞ্জে।
আমাদের জাতীয় আয়ের বড় অংশ তো প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ। তারা যদি বৈধভাবে সহজে স্বল্প খরচে বিদেশে যেতে পারে তাহলে তারা অবৈধভাবে জেলে নৌকায় বিদেশ পাড়ি দেবে না। বন্ধ করা যাবে বিদেশে চাকরি দেওয়ার নামে মুম্বাই বা ব্যাঙ্কককে ফেলে রেখে আসা প্রতারকদের কর্মকাণ্ড বা নারী শ্রমিকদের কাজ দেওয়ার নাম করে ভারতের কোনো পতিতালয়ে বিক্রি করা। এজন্য বৈদেশিক কর্মসংস্থান, অভিবাসী কর্মী অধিকার আইন ২০১৩ প্রণয়ন জরুরি। এই আইন ড্রাফট প্রক্রিয়ায় আইএলও এবং সরকার বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন। এসব কনসালটেশনে ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আমি ও আমার সহকর্মীরা অনুভব করেছি, প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা সকলেই চায়, এ বিষয়ে কাজ করার আগ্রহ আন্তরিক। প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য বিদেশ যাওয়া সহজ ও দুর্নীতিমুক্ত করা প্রয়োজন। উন্নততর কাজে সক্ষমতার জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া আবশ্যক। যেসব রাষ্ট্র থেকে শ্রমিক বিদেশে যায় তাদের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যাতে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে সুযোগ-সুবিধা কমে না যায়। এই উদ্যোগটি আমাদের নিতে হবে। কারণ, আমাদের প্রয়োজন অনেক বেশি। তারাই আমাদের জিডিপির ৩০ শতাংশ অবদান রাখে।
মেসবাহউদ্দীন আহমেদ :শ্রমিক নেতা ও লেখক
mesbaha@dhaka.net
আইএলওর অনেকগুলো কনভেনশন আছে, যেমন_ ৮৭, ৯৮ এবং ১৪৩ নম্বর কনভেনশন প্রযোজ্য হবে ও জাতিসংঘের কনভেনশন আছে অভিবাসী শ্রমিক ও পরিবারের সুরক্ষার জন্য। যেগুলোতে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেছে। যদিও আইএলও কনভেনশন ৯৭ এখনও বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেনি। এসব কনভেনশন অভিবাসী শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষা ও কর্মনিরাপত্তা_ সেটা মজুরি, কর্মক্ষেত্রে শারীরিক নিরাপত্তা, অর্থ দেশে পাঠানোর সুব্যবস্থা, আবাস, চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধার জন্য দরকষাকষিতে সাহায্য করবে। আমাদের শ্রমিকরা বিদেশে যায় চুক্তি ভিত্তিতে এবং তাদের একটি বড় অংশ যায় গৃহকর্মী হিসেবে। যেসব দেশে আমাদের শ্রমিকরা যায় তাদের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক স্থানেই চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক ও গৃহকর্মীদের জন্য কোনো শ্রম আইন নেই বা তারা শ্রম আইনের আওতাভুক্ত নয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সব দেশেই অতিথি শ্রমিকদের জন্য আইন হোক। বাংলাদেশকে আইএলওর সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে ওই উদ্যোগে তৎপর হওয়ার দরকার। তা হলেই বিদেশে কর্মরত আমাদের দেশের শ্রমিকরা সুরক্ষা পাবে। কিন্তু অন্যদের যখন উপদেশ দেব আইন করার জন্য, তার আগে তো আমাদের করতে হবে সেসব আইন, যেখানে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক ও গৃহকর্মীদের সুরক্ষা আছে। তা হলেই আমরা অন্যদের চাপ দিতে পারব।
এক সময় ছিল যে বিদেশি নিয়োগ কর্তাই আসা-যাওয়ার বিমানের সব খরচ ও সেখানে বাসস্থান দিতেন। এখন রিক্রুটিং এজেন্টদের মধ্যে এমন প্রতিযোগিতা যে কে কত কম মজুরিতে লোক পাঠাতে পারে। অভিযোগের তীর বাংলাদেশের দিকে বেশি। এই প্রতিযোগিতায় মজুরিও কমেছে, সুযোগ-সুবিধাও কমেছে। নিয়োগকারীরা তো চায় কম মজুরিতে শ্রমিক নিয়োগ করতে। তাই যেসব রাষ্ট্র থেকে বিদেশে শ্রমিক যায় তাদের মধ্যে সমঝোতা দরকার যেন মজুরির ও কর্মপরিবেশের মান উন্নয়ন করা যায়। যেসব দেশ থেকে শ্রমিকরা যায় আর যেখানে বিদেশি শ্রমিক কাজে নিয়োজিত করে_ এই দেশগুলোর ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলো শ্রমিক স্বার্থ রক্ষায় একসঙ্গে কাজ করলে অভিবাসী শ্রমিকদের অনেক সমস্যা তারাই সমাধান করতে পারবে। এমনকি সরকার বা দূতাবাসের চেয়েও ঢের বেশি। ট্রেড ইউনিয়ন থেকে কিছু উদ্যোগ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। যেমন মালয়েশিয়ার ট্রেড ইউনিয়নগুলো উদ্যোগ নিয়েছে সেখানে বিদেশি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায়। আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলো এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে।
এ দেশের তরুণরা কতখানি অদম্য বিদেশে যাওয়ার জন্য যে সাগর-নদী, সীমান্ত, পাহাড়-পর্বর্ত ও তীব্র তুষারপাত বা সাহারার মতো তীব্র গরমও তাদের ঠেকাতে পারে না।
কিছুদিন আগে টিভির সংবাদে দেখেছি, পত্রিকায়ও পড়েছি, বাংলাদেশের কিছু তরুণ জীবন-জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিল দেশ ছেড়ে দুটি জেলে নৌকায় করে। তাদের লক্ষ্য ছিল মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডে যাওয়া। তাদের সলিলসমাধি ঘটে বঙ্গোপসাগরে। এরপর আর কোনো কথা কারও মুখে শুনিনি। না সরকার, না জনপ্রতিনিধি বা রাজনৈতিক দল বা কোনো সামাজিক সংগঠন_ কারও থেকে নয়। এর আগেও থাইল্যান্ডের নিরাপত্তা রক্ষীদের ফিরিয়ে দেওয়া এক নৌকায় ফিরে আসার পথে খাদ্য ও পানি ফুরিয়ে যাওয়ার ফলে ক্ষুধায় মারা গেছে অর্ধেক যাত্রী। নৌকার ইঞ্জিনের তেল ফুরিয়ে গেলে নৌকাও ভাসতে থাকে। একসময় জীবিত যাত্রীরা দেখতে পায় আন্দামানের এক ছোট দ্বীপ। জীবনের আশায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে জীবিতরা। সেখানে ভারতীয় জেলেরা তাদের প্রথম দেখতে পায়। তাদের নিয়ে আসে আন্দামানের এক দ্বীপে, সেখান থেকে ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসে।
কয়েক বছর আগে একদল তরুণের কথা পত্রিকায় পড়েছিলাম, তারা যাচ্ছিল ইউরোপে। মানব পাচারকারী দালাল প্রথমে তাদের নিয়ে যায় মধ্যপ্রাচ্যে, তারপর পশ্চিম আফ্রিকায় এবং ডিঙি নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে স্পেন যাওয়ার কথা। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে শেষে ভূমধ্যসাগরে পথ হারিয়ে অনাহারে তাদের অধিকাংশ মারা গেছে। দু'একজন ফিরে এসেছে অর্ধমৃত হয়ে। কেন এই করুণ পরিণাম আমার দেশের তরুণের? জাতির ভবিষ্যতের!
খবরটা পড়তে পড়তে আমার মনে আসছিল মালির আবহাওয়ার স্মৃতি। একটা কাজ উপলক্ষে এক যুগেরও বেশি আগে আলজিয়ার্স হয়ে মালি গিয়েছিলাম। আমি জানি এই সাব-সাহারা অঞ্চলে কী কঠিন খরতাপ। সূর্য যেন গনগনিয়ে ওঠে। সাহারা মরুভূমির বালু রোদে চিকচিক করে চোখ ঝলসে যায়, মুখ পুড়ে যায়। লিটারের পর লিটার পানি খেয়েও এয়ারকন্ডিশন করা আরামদায়ক ল্যান্ডরোভার জিপে তেষ্টা মেটে না। এক যুগ আগে সেখানকার অনেকেই বাংলাদেশের নামও শোনেনি। বামাকো বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের লোকদের কাগজপত্র ঘেঁটে বাংলাদেশ নামটি খুঁজে পেতে সময় লেগেছিল। তারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেখে বিস্মিত। এক ইমিগ্রেশন অফিসার আরেকজনকে দেখায়। এভাবে আমার পাসপোর্ট হাতবদল হতে থাকে। পশ্চিম আফ্রিকার যেখানেই গিয়েছি বুরকিনা ফাসোর ওগাডুগু, পাশের রাষ্ট্র টোগো, আইভরি কোস্টের একই পরিস্থিতি_ কেউ চেনে না। ঘানায় অবশ্য এমন দু'একজন স্থানীয়কে পেয়েছি যারা বাংলাদেশকে জানে ফুটবল খেলার সুবাদে। একজন তো আমাকে এসে অনুরোধ করেছিল, তাকে বাংলাদেশের কোনো ফুটবল দলের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে। সে বাংলাদেশে ফুটবল খেলতে চায়। অনুরোধটি শুনে ভালো লেগেছিল যে, কেউ কাজের সন্ধানে বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছে। এখন নিশ্চয়ই এসব রাষ্ট্রে স্বদেশীদের দেখা হলে আশ্চর্য হবো না।
জার্মানিতে বাঙালি অনেক তরুণের কাছে গল্প শুনেছি, তারা মস্কো বা বেলারুশে মাসের পর মাস অপেক্ষা করে তেলের ট্যাঙ্কারের ভেতর ১৭ দিন একটানা জার্নি করে জার্মান সীমান্ত শহর ফ্রাঙ্কফুর্ট ওডারে পোল্যান্ড হয়ে পেঁৗছেছে। কী দুঃসাহস তাদের! অবাক লেগেছে তাদের কথা শোনে। কীভাবে একজন ১৭ দিন কাটিয়েছে তেলের খালি ট্যাঙ্কারের ভেতর। আমি তো পাঁচ মিনিটও থাকতে পারব না। তাদের সম্বল ছিল মাত্র কয়েক লিটার পানি ও অল্প রুটি। রাতের বেলায় ট্যাঙ্কারটি থামে কোনো বনজঙ্গলের ধারেকাছে_ ওদের নামিয়ে দেয় কিছুক্ষণের জন্য প্রাকৃতিক কাজ সারা ও খাওয়ার জন্য। জীবন নিরাপত্তার কোনো তোয়াক্কা না করে এসব তরুণের অনেক করুণ পরিণতির কথা জানি_ ইউরোপে অনেকের কাছে শুনেছি। পোল্যান্ডের সীমান্ত দিয়ে জার্মানিতে ঢোকার সময় বরফে জমে এক তরুণের অবশ হয়ে পড়ে থাকা নিথর দেহ জার্মান সীমান্তরক্ষী পুলিশ উদ্ধার করে। তরুণটির জীবন রক্ষা পেলেও ঠাণ্ডায় অবশ হয়ে যাওয়া একটি পা কেটে বাদ দিতে হয়। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার মাংস বহনকারী লরিতে করে দিনের পর দিন যাত্রা করে তাদের অনেকে এসে পেঁৗছেছে পশ্চিম ইউরোপে। ঢাকা থেকে পূর্ব ইউরোপ, তারপর নানা পথে পশ্চিম ইউরোপ। মস্কোসহ অন্যান্য বিমানবন্দরে দেখেছি অসংখ্য বাংলাদেশের তরুণকে যারা অবৈধ পন্থায় বিদেশে যেতে গিয়ে ধরা পড়ে জেল খেটে ফেরত যাচ্ছে বা ঢুকতে না পেরে ফেরত যাচ্ছে। ফেরত ফ্লাইটে স্থান পাওয়ার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করছে বিমানবন্দরের লাউঞ্জে।
আমাদের জাতীয় আয়ের বড় অংশ তো প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ। তারা যদি বৈধভাবে সহজে স্বল্প খরচে বিদেশে যেতে পারে তাহলে তারা অবৈধভাবে জেলে নৌকায় বিদেশ পাড়ি দেবে না। বন্ধ করা যাবে বিদেশে চাকরি দেওয়ার নামে মুম্বাই বা ব্যাঙ্কককে ফেলে রেখে আসা প্রতারকদের কর্মকাণ্ড বা নারী শ্রমিকদের কাজ দেওয়ার নাম করে ভারতের কোনো পতিতালয়ে বিক্রি করা। এজন্য বৈদেশিক কর্মসংস্থান, অভিবাসী কর্মী অধিকার আইন ২০১৩ প্রণয়ন জরুরি। এই আইন ড্রাফট প্রক্রিয়ায় আইএলও এবং সরকার বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন। এসব কনসালটেশনে ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আমি ও আমার সহকর্মীরা অনুভব করেছি, প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা সকলেই চায়, এ বিষয়ে কাজ করার আগ্রহ আন্তরিক। প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য বিদেশ যাওয়া সহজ ও দুর্নীতিমুক্ত করা প্রয়োজন। উন্নততর কাজে সক্ষমতার জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া আবশ্যক। যেসব রাষ্ট্র থেকে শ্রমিক বিদেশে যায় তাদের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যাতে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে সুযোগ-সুবিধা কমে না যায়। এই উদ্যোগটি আমাদের নিতে হবে। কারণ, আমাদের প্রয়োজন অনেক বেশি। তারাই আমাদের জিডিপির ৩০ শতাংশ অবদান রাখে।
মেসবাহউদ্দীন আহমেদ :শ্রমিক নেতা ও লেখক
mesbaha@dhaka.net
No comments