পরামর্শকের পেছনে হাতি পোষার ব্যয় by আরিফুর রহমান
উন্নয়ন প্রকল্পে 'পরামর্শক' পদটি বেশ লোভনীয়। পরামর্শকদের সম্মানী আক্ষরিক অর্থেই আকাশছোঁয়া। কোনোভাবে এই পদ বাগাতে পারলে বাজিমাত। টাকাকড়িতে পকেট ভারী, সুযোগ-সুবিধাও রমরমা। তাই পরামর্শকের দায়িত্ব পেতে চলে নানা তদবির।
বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পে যত গণ্ডগোল, তা এই পরামর্শক নিয়োগ করা নিয়েই। দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দুই সাবেক মন্ত্রী এখন বেকায়দায়। মামলায় পড়েছেন সাত কর্মকর্তা।
দু-একটি নয়, দেশের অনেক প্রকল্পেই পরামর্শক খাতে বরাদ্দ অর্থ খরচে কোনো স্বচ্ছতা বা জবাবদিহি থাকে না। বড় কিছু প্রকল্পের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পরামর্শকদের সম্মানী বাবদ অস্বাভাবিক এবং প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট চলমান প্রকল্পগুলোতে মোট অর্থের এক-তৃতীয়াংশই উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার পছন্দের পরামর্শকের পেছনে খরচ হচ্ছে। এসব অর্থ ঘুরেফিরে বিদেশেই চলে যাচ্ছে। আর ঋণের বোঝা বইতে হচ্ছে সরকারকে।
বড় বড় প্রকল্পের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো ঋণ ও অনুদান দেওয়ার সময় শর্ত বেঁধে দেয় যে তাদের দেশ বা সংস্থা থেকেই প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ দিতে হবে। এভাবে তাদের টাকা তারাই অনেকটা হাতিয়ে নেয়। আবার স্টাডি ট্যুরের নামে দেশি কর্মকর্তাদের ভ্রমণ খাতে অর্থ ব্যয়েও অনিয়ম করা হচ্ছে। যেসব প্রকল্পে কোনো ধরনের স্টাডি ট্যুর প্রয়োজন নেই, সেখানেও এই খাতের নামে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অর্থ খরচ করছেন।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, দুর্যোগকালীন জীবন রক্ষার্থে টেকসই অবকাঠামো নির্মাণ এবং জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গত মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় 'কোস্টাল ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার' শীর্ষক একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ২৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ২৫৬ কোটি টাকা জোগান দেওয়া হবে। বাকি ৯৭৪ কোটি টাকা বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ঋণ ও অনুদান দিচ্ছে।
এ প্রকল্পের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এতে পরামর্শক সেবা খাতেই ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ভ্রমণ ব্যয় বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় এক কোটি টাকা। একই সঙ্গে স্টাডি ট্যুরসহ বেশ কিছু 'অপ্রয়োজনীয়' খাতেও অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে এ প্রকল্পে পরামর্শক সেবা, ভ্রমণ ব্যয়, স্টাডি ট্যুরসহ আরো কয়েকটি খাতে মোট ১১৫ কোটি টাকার মতো বরাদ্দ রাখা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা এ বরাদ্দকে মাত্রাতিরিক্ত বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় পরামর্শক বাবদ এত অর্থ বরাদ্দের কোনো প্রয়োজন নেই। এ প্রকল্পে যারা ঋণ দিচ্ছে, তারাই এ টাকাগুলো নিয়ে যাবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), স্ট্র্যাটেজিক ক্লাইমেট ফান্ড, ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট এবং কেএফডাব্লিউ এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।
একই দিন একনেক বৈঠকে ঢাকার যানজট নিরসনে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রো রেল (এমআরটি) প্রকল্পটিরও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। আর জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (জাইকা) এ প্রকল্পে ঋণ দেবে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, এ প্রকল্পে 'পরামর্শক সম্মানী' বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ১১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জেনারেল কনসালট্যান্সি (ডিজাইন, সুপারভিশন ও ম্যানেজমেন্ট) খাতে এক হাজার ৬৩ কোটি আর ইনস্টিটিউশনাল ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্সিতে ৩৪ কোটি, রিসেটেলমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট কনসালট্যান্সিতে ১১ কোটি এবং টেকনিক্যাল কনসালট্যান্সিতে দুই কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সব যন্ত্রপাতি ও পণ্য জাপান থেকে সরবরাহ করা হবে।
ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, মেট্রো রেল প্রকল্পের পরামর্শক দলের প্রধানের মাসিক সম্মানী কমবেশি ২২ লাখ টাকা ধরা হয়েছে।
বতর্মান মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সাবেক ইআরডি সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞার কাছে জানতে চাওয়া হলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বা দেশ আপনাকে ঋণ দেবে। এ সময় শর্তও জুড়ে দেবে। এটা তাদের ব্যবসা। তারা কোনো চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান নয়।' তিনি বলেন, চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) এ ধরনের কঠিন শর্ত দিয়ে থাকে। পরামর্শক সেবাসহ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও পণ্য ওই সব দেশ ও সংস্থা থেকে সরবরাহের শর্ত দেওয়া থাকে।
এক কর্মকর্তা জানান, সাধারণত অনুদানের অর্থ কঠিন হয়। এ অর্থ তাদের পছন্দ অনুযায়ী খরচ হয়। আর ব্যবসা না হলে কোনো উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশ ঋণ দেবে না। তিনি আরো বলেন, 'অনেক ক্ষেত্রে পরামর্শক নিয়োগে আমরা কোনো প্রস্তাব দিই না। এটা আমাদের দুর্বলতা। আর উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা সে সুযোগ নেয়। অথচ আমাদের দেশে অনেক যোগ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা বিদেশে সুনামের সঙ্গে কাজ করছে।'
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব আরাস্তু খান কালের কণ্ঠকে বলেন, সাধারণত অনুদান ও কারিগরি সহায়তা প্রকল্পে শর্ত বেশি থাকে। এসব প্রকল্পে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পরামর্শক নিয়োগ দিতে হয়। আর তাঁদের সম্মানী একটু বেশি। ঋণচুক্তির সময় তা মেনে নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না।
জাইকার বাংলাদেশ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, অনুদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশ ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার ব্যক্তিদের সুযোগ করে দিতে এসব শর্ত দেওয়া হয়। তবে ঋণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়। এখানে কোনো পক্ষপাতিত্ব করা হয় না। মেট্রো রেলে পরামর্শক বাবদ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ সম্পর্কে সূত্র জানায়, নকশা প্রণয়ন, প্রকল্পের বাস্তবায়ন পদ্ধতি ঠিক করতে একটু বেশি অর্থ খরচ হবেই। কারণ জাইকা চায় প্রকল্পটি অত্যন্ত ভালোভাবে বাস্তবায়িত হোক।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দাতাদের শর্তানুযায়ী অনেক প্রকল্পেই দুর্বল পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাঁদের কারণে প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাউজানে ৪২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটি চীনের অর্থায়নে বাস্তবায়িত হয়েছিল। এ প্রকল্পে পরামর্শকসহ সব কিছু তদারক করেছিল চীন। কিন্তু বাস্তবায়নের পর থেকে এ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে সমস্যা লেগেই আছে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে কেনা ২৫৫টি বাস এক বছর না যেতেই বিকল হয়ে যাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এসব বাস কোরিয়ার শর্তে সে দেশ থেকে সরবরাহ করা হয়েছে।
আরো জানা গেছে, সেতু বিভাগের তিনটি প্রকল্পে পরামর্শক সম্মানী বাবদ ৬১৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রকল্পগুলো হচ্ছে- পদ্মা সেতু প্রকল্প, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং পদ্মা বহুমুখী সেতুর ডিটেইল ডিজাইন স্টাডি প্রকল্প। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিভিন্ন নামে পরামর্শক ব্যয়ের খাত রাখা হয়েছে। নির্মাণ তদারকি পরামর্শকের জন্য ৩৪৫ কোটি, ব্যবস্থাপনা পরামর্শকের জন্য ১৫২ কোটি, সিনিয়র পরামর্শক খাতে পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে পরামর্শক ফি বাবদ ১০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং প্যানেল বিশেষজ্ঞ ফি খাতে ধরা হয়েছে আট কোটি টাকা। আর পদ্মা বহুমুখী সেতুর ডিটেইল ডিজাইন স্টাডি প্রকল্পে দেশি পরামর্শক খাতে ৯ কোটি টাকা, বিদেশি পরামর্শকদের সম্মানী ৭৪ কোটি, আউট অব পকেট এঙ্পেনসেস খাতে মোট ২০ কোটি ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পেও ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিদেশি পরামর্শক খাতে।
প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে গৃহীত রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন (রস্ক) প্রকল্পে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ ও প্রশিক্ষণ বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪১ কোটি টাকা। প্রকল্পটি গত মঙ্গলবার একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, রস্ক প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ১৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশ ভ্রমণে পাঁচ কোটি টাকা এবং কর্মশালা, সেমিনার ও সভা বাবদ আট কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আর দেশে প্রশিক্ষণ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ কোটি টাকা।
দু-একটি নয়, দেশের অনেক প্রকল্পেই পরামর্শক খাতে বরাদ্দ অর্থ খরচে কোনো স্বচ্ছতা বা জবাবদিহি থাকে না। বড় কিছু প্রকল্পের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পরামর্শকদের সম্মানী বাবদ অস্বাভাবিক এবং প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট চলমান প্রকল্পগুলোতে মোট অর্থের এক-তৃতীয়াংশই উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার পছন্দের পরামর্শকের পেছনে খরচ হচ্ছে। এসব অর্থ ঘুরেফিরে বিদেশেই চলে যাচ্ছে। আর ঋণের বোঝা বইতে হচ্ছে সরকারকে।
বড় বড় প্রকল্পের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো ঋণ ও অনুদান দেওয়ার সময় শর্ত বেঁধে দেয় যে তাদের দেশ বা সংস্থা থেকেই প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ দিতে হবে। এভাবে তাদের টাকা তারাই অনেকটা হাতিয়ে নেয়। আবার স্টাডি ট্যুরের নামে দেশি কর্মকর্তাদের ভ্রমণ খাতে অর্থ ব্যয়েও অনিয়ম করা হচ্ছে। যেসব প্রকল্পে কোনো ধরনের স্টাডি ট্যুর প্রয়োজন নেই, সেখানেও এই খাতের নামে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অর্থ খরচ করছেন।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, দুর্যোগকালীন জীবন রক্ষার্থে টেকসই অবকাঠামো নির্মাণ এবং জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গত মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় 'কোস্টাল ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার' শীর্ষক একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ২৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ২৫৬ কোটি টাকা জোগান দেওয়া হবে। বাকি ৯৭৪ কোটি টাকা বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ঋণ ও অনুদান দিচ্ছে।
এ প্রকল্পের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এতে পরামর্শক সেবা খাতেই ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ভ্রমণ ব্যয় বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় এক কোটি টাকা। একই সঙ্গে স্টাডি ট্যুরসহ বেশ কিছু 'অপ্রয়োজনীয়' খাতেও অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে এ প্রকল্পে পরামর্শক সেবা, ভ্রমণ ব্যয়, স্টাডি ট্যুরসহ আরো কয়েকটি খাতে মোট ১১৫ কোটি টাকার মতো বরাদ্দ রাখা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা এ বরাদ্দকে মাত্রাতিরিক্ত বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় পরামর্শক বাবদ এত অর্থ বরাদ্দের কোনো প্রয়োজন নেই। এ প্রকল্পে যারা ঋণ দিচ্ছে, তারাই এ টাকাগুলো নিয়ে যাবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), স্ট্র্যাটেজিক ক্লাইমেট ফান্ড, ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট এবং কেএফডাব্লিউ এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।
একই দিন একনেক বৈঠকে ঢাকার যানজট নিরসনে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রো রেল (এমআরটি) প্রকল্পটিরও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। আর জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (জাইকা) এ প্রকল্পে ঋণ দেবে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, এ প্রকল্পে 'পরামর্শক সম্মানী' বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ১১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জেনারেল কনসালট্যান্সি (ডিজাইন, সুপারভিশন ও ম্যানেজমেন্ট) খাতে এক হাজার ৬৩ কোটি আর ইনস্টিটিউশনাল ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্সিতে ৩৪ কোটি, রিসেটেলমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট কনসালট্যান্সিতে ১১ কোটি এবং টেকনিক্যাল কনসালট্যান্সিতে দুই কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সব যন্ত্রপাতি ও পণ্য জাপান থেকে সরবরাহ করা হবে।
ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, মেট্রো রেল প্রকল্পের পরামর্শক দলের প্রধানের মাসিক সম্মানী কমবেশি ২২ লাখ টাকা ধরা হয়েছে।
বতর্মান মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সাবেক ইআরডি সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞার কাছে জানতে চাওয়া হলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বা দেশ আপনাকে ঋণ দেবে। এ সময় শর্তও জুড়ে দেবে। এটা তাদের ব্যবসা। তারা কোনো চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান নয়।' তিনি বলেন, চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) এ ধরনের কঠিন শর্ত দিয়ে থাকে। পরামর্শক সেবাসহ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও পণ্য ওই সব দেশ ও সংস্থা থেকে সরবরাহের শর্ত দেওয়া থাকে।
এক কর্মকর্তা জানান, সাধারণত অনুদানের অর্থ কঠিন হয়। এ অর্থ তাদের পছন্দ অনুযায়ী খরচ হয়। আর ব্যবসা না হলে কোনো উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশ ঋণ দেবে না। তিনি আরো বলেন, 'অনেক ক্ষেত্রে পরামর্শক নিয়োগে আমরা কোনো প্রস্তাব দিই না। এটা আমাদের দুর্বলতা। আর উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা সে সুযোগ নেয়। অথচ আমাদের দেশে অনেক যোগ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা বিদেশে সুনামের সঙ্গে কাজ করছে।'
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব আরাস্তু খান কালের কণ্ঠকে বলেন, সাধারণত অনুদান ও কারিগরি সহায়তা প্রকল্পে শর্ত বেশি থাকে। এসব প্রকল্পে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পরামর্শক নিয়োগ দিতে হয়। আর তাঁদের সম্মানী একটু বেশি। ঋণচুক্তির সময় তা মেনে নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না।
জাইকার বাংলাদেশ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, অনুদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশ ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার ব্যক্তিদের সুযোগ করে দিতে এসব শর্ত দেওয়া হয়। তবে ঋণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়। এখানে কোনো পক্ষপাতিত্ব করা হয় না। মেট্রো রেলে পরামর্শক বাবদ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ সম্পর্কে সূত্র জানায়, নকশা প্রণয়ন, প্রকল্পের বাস্তবায়ন পদ্ধতি ঠিক করতে একটু বেশি অর্থ খরচ হবেই। কারণ জাইকা চায় প্রকল্পটি অত্যন্ত ভালোভাবে বাস্তবায়িত হোক।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দাতাদের শর্তানুযায়ী অনেক প্রকল্পেই দুর্বল পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাঁদের কারণে প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাউজানে ৪২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটি চীনের অর্থায়নে বাস্তবায়িত হয়েছিল। এ প্রকল্পে পরামর্শকসহ সব কিছু তদারক করেছিল চীন। কিন্তু বাস্তবায়নের পর থেকে এ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে সমস্যা লেগেই আছে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে কেনা ২৫৫টি বাস এক বছর না যেতেই বিকল হয়ে যাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এসব বাস কোরিয়ার শর্তে সে দেশ থেকে সরবরাহ করা হয়েছে।
আরো জানা গেছে, সেতু বিভাগের তিনটি প্রকল্পে পরামর্শক সম্মানী বাবদ ৬১৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রকল্পগুলো হচ্ছে- পদ্মা সেতু প্রকল্প, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং পদ্মা বহুমুখী সেতুর ডিটেইল ডিজাইন স্টাডি প্রকল্প। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিভিন্ন নামে পরামর্শক ব্যয়ের খাত রাখা হয়েছে। নির্মাণ তদারকি পরামর্শকের জন্য ৩৪৫ কোটি, ব্যবস্থাপনা পরামর্শকের জন্য ১৫২ কোটি, সিনিয়র পরামর্শক খাতে পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে পরামর্শক ফি বাবদ ১০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং প্যানেল বিশেষজ্ঞ ফি খাতে ধরা হয়েছে আট কোটি টাকা। আর পদ্মা বহুমুখী সেতুর ডিটেইল ডিজাইন স্টাডি প্রকল্পে দেশি পরামর্শক খাতে ৯ কোটি টাকা, বিদেশি পরামর্শকদের সম্মানী ৭৪ কোটি, আউট অব পকেট এঙ্পেনসেস খাতে মোট ২০ কোটি ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পেও ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিদেশি পরামর্শক খাতে।
প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে গৃহীত রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন (রস্ক) প্রকল্পে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ ও প্রশিক্ষণ বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪১ কোটি টাকা। প্রকল্পটি গত মঙ্গলবার একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, রস্ক প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ১৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশ ভ্রমণে পাঁচ কোটি টাকা এবং কর্মশালা, সেমিনার ও সভা বাবদ আট কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আর দেশে প্রশিক্ষণ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ কোটি টাকা।
No comments