আন্তর্জাতিক-মধ্যপ্রাচ্যের ধাক্কা, ব্রিটেনও উত্তাল by ফারুক যোশী
মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ডের ক্ষেপণাস্ত্রে লিবিয়ার জনজীবন যেমন বিপর্যস্ত হচ্ছে একদিকে, ঠিক তেমনি অন্যদিকে এ ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর জোগান দিতে হচ্ছে উন্নত দেশগুলোর মানুষকে। ব্রিটেনের জনজীবনে পড়েছে এর ব্যাপক প্রভাব।
বাড়ছে ট্যাক্স পৃথিবীজুড়েই চলছে এক অস্থির সময়। এ অস্থিরতার মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যেন তরুণরা নতুন জীবনের দিশা পেয়েছে। উত্তাল হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্য। যে মধ্যপ্রাচ্য, যেখানে নিঃশ্বাস নিতে রাজতন্ত্রের অনুমতি লাগে সেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যেন তাসের ঘরের মতো ভেঙে যাচ্ছে। তিউনিসিয়া থেকে শুরু। জ্বলে উঠল মিসর। তারপর বাহরাইন, জর্ডান, ইয়েমেন, ওমান, এমনকি সৌদি আরবের মতো কট্টর ইসলামিক দেশটিও এর বাইরে নয়, যেখানে মৌলিক অধিকার নেই। তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকদের এসব দেশে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হওয়া প্রতিদিনের ঘটনা। এমনকি ইসলামের শিক্ষা নিয়েও মানবতাবাদী মানুষ এখানে দাঁড়াতে পারছে না তাদের পক্ষে। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই ইতিহাসের অনিবার্য ধারায় অমোঘ নিয়মে এক সময় মানুষ প্রতিবাদী হবেই। হয়তো তাই হয়েছেও। যুগ যুগ ধরে একনায়কতান্ত্রিক শাসন-শোষণের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের শেখদের বিলাসী জীবনের জন্য সে দেশের মানুষ ধুঁকছে বেকারত্বে। এর পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে সেখানে একটা নিঃস্ব শ্রেণী। খুব স্বাভাবিকভাবেই ইতিহাসের অনিবার্যতা নিয়ে নিঃশেষিত শ্রেণী জেগে ওঠে এবং জেগেছে তাই। কিন্তু লিবিয়া! লিবিয়ায় মরছে মানুষ। গাদ্দাফিমুক্ত স্বাধীন লিবিয়া প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে লড়ছে মানুষ। বিদ্রোহী কিংবা গাদ্দাফির ভাষায় দেশদ্রোহী মানুষ লড়ছে। মরছে মানুষ। এরই মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো ঠিকই জায়গা করে নিচ্ছে। লিবিয়া হয়ে যাচ্ছে আরেকটি ইরাক, আরেকটি আফগানিস্তান। সেখান থেকে তিল তিল করে শূন্য হয়ে যাবে সব। এ শূন্যতা সৃষ্টি করতে গিয়েই চলছে এখন যুদ্ধের উন্মাদনা।
যুদ্ধ উন্মাদনা সারা পৃথিবীতেই নিয়ে আসছে এক নৈরাজ্যিক পরিবেশ। মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ডের ক্ষেপণাস্ত্রে লিবিয়ার জনজীবন যেমন বিপর্যস্ত হচ্ছে একদিকে, ঠিক তেমনি অন্যদিকে এ ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর জোগান দিতে হচ্ছে উন্নত দেশগুলোর মানুষকে। ব্রিটেনের জনজীবনে পড়েছে এর ব্যাপক প্রভাব। বাড়ছে ট্যাক্স। সারা পৃথিবীর মতোই বাড়ছে এখানে জ্বালানি তেলের দাম। মানুষের প্রতিদিনের বাজেটের একটি অংশ জ্বালানি তেল। লিটারপ্রতি এ তেলের দাম ব্রিটেনে ১.৩৯ পাউন্ড হয়ে গেছে। চ্যান্সেলর জর্জ অসবর্ন তার ২০১১-১২-এর বাজেটে তেলের দাম এক পেন্স কমানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। খুব স্বাভাবিকভাবে। এটি কোনো সুখবর নয়। ব্রিটিশ পত্রপত্রিকা তেলের দাম কমানোর এ পদক্ষেপ ব্রিটিশ অর্থনীতিকে পতনের হাত থেকে বাঁচানোর চ্যান্সেলরের শেষ সুরবাজনা হিসেবে আখ্যায়িত করছে। ক্রমেই ব্রিটেন সরকার জড়িয়ে যাচ্ছে ঋণের জালে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৫ সালের মধ্যে সরকারকে ৪৫ বিলিয়ন পাউন্ডের বাড়তি ঋণ নিতে হবে। ঋণের জালে আটকা পড়া মানেই জাতীয় জীবনে সংকট। এ সংকটের প্রভাবে জনজীবন তো বিপর্যস্ত হতে বাধ্য। এ কারণেই হ্রাস পাচ্ছে ব্রিটেনে মানুষের বিবিধ সুযোগ। সরকারের ভাতা ব্যবস্থায় আসছে পরিবর্তন। আগের মতো ঢালাও ভাতা প্রদান বন্ধ হচ্ছে। ব্রিটেনের দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীতে হতাশা বাড়ছে। দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের, এমনকি স্থানীয় কাউন্সিলগুলোর নির্বাহী পদগুলোতে পর্যন্ত চলছে ছাঁটাই। পুলিশের চাকরি যাচ্ছে অর্থাৎ জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় চলছে ছাঁটাই। অথচ আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার নামে যেন ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে সব। একটা বড় ধরনের অর্থের শ্রাদ্ধ হচ্ছে ওইসব তথাকথিত আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায়। ব্রিটেনের একটা গর্ব করার মতো পদ্ধতি হলো ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস)। সব নাগরিকের স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত ছিল এ পদ্ধতির মধ্যে। ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের (টিইউসি) ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েই দিয়েছে, এনএইচএস বিক্রি যে হবে এটি কোনো হাসি-তামাশা করে উড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপার নয়। সরকার এ পথেই এগোচ্ছে। এনএইচএস ব্যক্তিগত খাতে দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বলতে গেলে হয়ে গেছে সরকারের। এনএইচএস নিয়ে সরকারের বর্তমান সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক সেবার মধ্যে আর আবদ্ধ থাকবে না। এটি বাণিজ্য হয়ে যাবে। সে কারণে এ নিয়ে ইতিমধ্যে গত ৩১ মার্চ হেলথ সেক্রেটারির অফিসের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে। বলতে গেলে ব্রিটেনের সমাজ ব্যবস্থায় এক বড় ধাক্কা লেগেছে এখন। ওয়েলফেয়ার স্টেট হিসেবে খ্যাত ব্রিটেনে এখন চলছে মানুষের জীবনে এক চরম হতাশা। চাকরির বাজার মন্দা। বড় দ্রুতই মানুষ চলে যাচ্ছে বেকরত্বের দ্বারপ্রান্তে। বেকারত্ব পথে দাঁড় করাচ্ছে না ঠিকই কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের চলমান বিলাসিতায় হোঁচট খাচ্ছে মানুষ। এ নিয়ে তৈরি হচ্ছে চরম হতাশা।
এ হতাশা থেকেই পুঞ্জীভূত হচ্ছে ক্ষোভ। ক্ষোভ আর হতাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে এখন ব্রিটেনে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা স্মরণকালের সমাবেশ করেছিলেন গত বছরের ১০ নভেম্বর। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের টিউশন ফি বার্ষিক ৯ হাজার পাউন্ডে বাড়িয়ে দেওয়ার সরকারি ঘোষণা নিয়ে বড় রকমের হট্টগোল হয় ওইদিন। এরই ধারাবাহিকতায় লন্ডনে আরেকটি বিক্ষোভ হয়ে গেল গত ২৬ মার্চ। ব্রিটেনের ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের (টিইউসি) ডাকে এ বিক্ষোভে জমায়েত হয় আড়াই লাখ মানুষ। টিইউসির লাল পতাকায় ছেয়ে গিয়েছিল ওইদিন লন্ডনের হাইড পার্ক। মিছিলে বক্তব্য রাখেন বিরোধীদলীয় নেতা লেবার পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ড। ধারণা করা হচ্ছে, ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধবিরোধী গণমিছিলের পর এটিই ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ। বিক্ষোভে হয়েছে ভাংচুর-হামলা। মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত মানুষ কনডেম কোয়ালিশন সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ওইদিন পুলিশসহ আহত হয়েছে অন্তত ৮৪ জন, গ্রেফতার হয়েছে ২১১ জন। নিঃসন্দেহে এ এক বার্তা। সরকারের ব্যর্থতার। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে পরিচিত ব্রিটেনের মতো দেশের জন্য এ এক দুঃসংবাদ। দীর্ঘদিন থেকে গ্রহণ করা সুযোগ-সুবিধা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেলে মানুষের কাজ না থাকলে ফুঁসে ওঠা অস্বাভাবিক নয়।
ব্রিটেন, যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত সেখানে অধিকার রক্ষায় এ সরকার কতটুকু সার্থক তা প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেকার আর নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বর্তমান দ্রব্যমূল্যের বাজারে কুলিয়ে ওঠা অনেকটা কষ্টকর হয়ে উঠেছে। সরকারের ব্যর্থতা ক্রমেই যেন বেশি করে জনসমক্ষে আসছে। ফলে বিক্ষোভের ঢেউ লেগেছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যই নয়। মধ্যপ্রাচ্যের ধাক্কা সামাল দিতে হবে এখন ডেভিড ক্যামেরনকেও কিংবা লিবারেল ডেমোক্র্যাটের নিক ক্লেগকেও। হয়তো সরকার পরিবর্তনের জন্য জনগণ উঠেপড়ে লাগবে না। বিরোধী দলও মধ্যবর্তী নির্বাচনের স্বপ্ন দেখতে চাইবে না এখন। কারণ তারা জানে, বর্তমান ব্রিটেনের এ অবস্থার জন্য লেবার দলই মূলত দায়ী। কিন্তু জনগণ কি পেছনে তাকাবে? জনগণ বর্তমানই দেখে। ব্রিটেনের বর্তমান এখন কনজারভেটিভ পার্টির অনুকূলে বলা যাবে না। তাই তো এড মিলিব্যান্ড প্রস্তুত হচ্ছেন। লেবার দল নিজেদের তৈরি করছে আবার। সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির বিরোধিতা করে আড়াই লাখ মানুষের সমাবেশে তিনি বক্তব্য রেখেছেন, দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন সরকারের ব্যর্থতা।
মধ্যপ্রাচ্যের ধাক্কা মূলত একটি প্রচলিত সনাতন সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রত্যয়। মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার নিয়েই তাদের রাজপথ দখল। মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তন আসছে, আসবেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে। কিন্তু কাঁকড়া সরে গিয়ে এ দেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদী শকুনরা যদি ছায়া ফেলে তবে তারা ঠুকরে ঠুকরেই খাবে ওই দেশগুলোর খনিজসম্পদ। ব্রিটেন কিংবা পশ্চিমা দেশগুলোর এ শঙ্কা না থাকলেও সরকারকে জনগণ নিয়ে ভাবতে হবে। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে এগিয়ে থাকা এ দেশের মানুষও না পাওয়ার বেদনায় কাতর হয়, ক্ষেপে যায়। ভাংচুর তারাও করে। এখানেও যতই সভ্যতার কথা বলা হোক না কেন, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী কিন্তু গদ্যময়। অতি সাম্প্রতিক ব্রিটেনের রাজনীতি তো তা-ই জানিয়ে দিয়ে যায়।
ফারুক যোশী : কলাম লেখক
faruk.joshi@gmail.com
যুদ্ধ উন্মাদনা সারা পৃথিবীতেই নিয়ে আসছে এক নৈরাজ্যিক পরিবেশ। মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ডের ক্ষেপণাস্ত্রে লিবিয়ার জনজীবন যেমন বিপর্যস্ত হচ্ছে একদিকে, ঠিক তেমনি অন্যদিকে এ ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর জোগান দিতে হচ্ছে উন্নত দেশগুলোর মানুষকে। ব্রিটেনের জনজীবনে পড়েছে এর ব্যাপক প্রভাব। বাড়ছে ট্যাক্স। সারা পৃথিবীর মতোই বাড়ছে এখানে জ্বালানি তেলের দাম। মানুষের প্রতিদিনের বাজেটের একটি অংশ জ্বালানি তেল। লিটারপ্রতি এ তেলের দাম ব্রিটেনে ১.৩৯ পাউন্ড হয়ে গেছে। চ্যান্সেলর জর্জ অসবর্ন তার ২০১১-১২-এর বাজেটে তেলের দাম এক পেন্স কমানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। খুব স্বাভাবিকভাবে। এটি কোনো সুখবর নয়। ব্রিটিশ পত্রপত্রিকা তেলের দাম কমানোর এ পদক্ষেপ ব্রিটিশ অর্থনীতিকে পতনের হাত থেকে বাঁচানোর চ্যান্সেলরের শেষ সুরবাজনা হিসেবে আখ্যায়িত করছে। ক্রমেই ব্রিটেন সরকার জড়িয়ে যাচ্ছে ঋণের জালে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৫ সালের মধ্যে সরকারকে ৪৫ বিলিয়ন পাউন্ডের বাড়তি ঋণ নিতে হবে। ঋণের জালে আটকা পড়া মানেই জাতীয় জীবনে সংকট। এ সংকটের প্রভাবে জনজীবন তো বিপর্যস্ত হতে বাধ্য। এ কারণেই হ্রাস পাচ্ছে ব্রিটেনে মানুষের বিবিধ সুযোগ। সরকারের ভাতা ব্যবস্থায় আসছে পরিবর্তন। আগের মতো ঢালাও ভাতা প্রদান বন্ধ হচ্ছে। ব্রিটেনের দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীতে হতাশা বাড়ছে। দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের, এমনকি স্থানীয় কাউন্সিলগুলোর নির্বাহী পদগুলোতে পর্যন্ত চলছে ছাঁটাই। পুলিশের চাকরি যাচ্ছে অর্থাৎ জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় চলছে ছাঁটাই। অথচ আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার নামে যেন ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে সব। একটা বড় ধরনের অর্থের শ্রাদ্ধ হচ্ছে ওইসব তথাকথিত আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায়। ব্রিটেনের একটা গর্ব করার মতো পদ্ধতি হলো ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস)। সব নাগরিকের স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত ছিল এ পদ্ধতির মধ্যে। ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের (টিইউসি) ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েই দিয়েছে, এনএইচএস বিক্রি যে হবে এটি কোনো হাসি-তামাশা করে উড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপার নয়। সরকার এ পথেই এগোচ্ছে। এনএইচএস ব্যক্তিগত খাতে দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বলতে গেলে হয়ে গেছে সরকারের। এনএইচএস নিয়ে সরকারের বর্তমান সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক সেবার মধ্যে আর আবদ্ধ থাকবে না। এটি বাণিজ্য হয়ে যাবে। সে কারণে এ নিয়ে ইতিমধ্যে গত ৩১ মার্চ হেলথ সেক্রেটারির অফিসের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে। বলতে গেলে ব্রিটেনের সমাজ ব্যবস্থায় এক বড় ধাক্কা লেগেছে এখন। ওয়েলফেয়ার স্টেট হিসেবে খ্যাত ব্রিটেনে এখন চলছে মানুষের জীবনে এক চরম হতাশা। চাকরির বাজার মন্দা। বড় দ্রুতই মানুষ চলে যাচ্ছে বেকরত্বের দ্বারপ্রান্তে। বেকারত্ব পথে দাঁড় করাচ্ছে না ঠিকই কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের চলমান বিলাসিতায় হোঁচট খাচ্ছে মানুষ। এ নিয়ে তৈরি হচ্ছে চরম হতাশা।
এ হতাশা থেকেই পুঞ্জীভূত হচ্ছে ক্ষোভ। ক্ষোভ আর হতাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে এখন ব্রিটেনে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা স্মরণকালের সমাবেশ করেছিলেন গত বছরের ১০ নভেম্বর। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের টিউশন ফি বার্ষিক ৯ হাজার পাউন্ডে বাড়িয়ে দেওয়ার সরকারি ঘোষণা নিয়ে বড় রকমের হট্টগোল হয় ওইদিন। এরই ধারাবাহিকতায় লন্ডনে আরেকটি বিক্ষোভ হয়ে গেল গত ২৬ মার্চ। ব্রিটেনের ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের (টিইউসি) ডাকে এ বিক্ষোভে জমায়েত হয় আড়াই লাখ মানুষ। টিইউসির লাল পতাকায় ছেয়ে গিয়েছিল ওইদিন লন্ডনের হাইড পার্ক। মিছিলে বক্তব্য রাখেন বিরোধীদলীয় নেতা লেবার পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ড। ধারণা করা হচ্ছে, ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধবিরোধী গণমিছিলের পর এটিই ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ। বিক্ষোভে হয়েছে ভাংচুর-হামলা। মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত মানুষ কনডেম কোয়ালিশন সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ওইদিন পুলিশসহ আহত হয়েছে অন্তত ৮৪ জন, গ্রেফতার হয়েছে ২১১ জন। নিঃসন্দেহে এ এক বার্তা। সরকারের ব্যর্থতার। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে পরিচিত ব্রিটেনের মতো দেশের জন্য এ এক দুঃসংবাদ। দীর্ঘদিন থেকে গ্রহণ করা সুযোগ-সুবিধা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেলে মানুষের কাজ না থাকলে ফুঁসে ওঠা অস্বাভাবিক নয়।
ব্রিটেন, যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত সেখানে অধিকার রক্ষায় এ সরকার কতটুকু সার্থক তা প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেকার আর নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বর্তমান দ্রব্যমূল্যের বাজারে কুলিয়ে ওঠা অনেকটা কষ্টকর হয়ে উঠেছে। সরকারের ব্যর্থতা ক্রমেই যেন বেশি করে জনসমক্ষে আসছে। ফলে বিক্ষোভের ঢেউ লেগেছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যই নয়। মধ্যপ্রাচ্যের ধাক্কা সামাল দিতে হবে এখন ডেভিড ক্যামেরনকেও কিংবা লিবারেল ডেমোক্র্যাটের নিক ক্লেগকেও। হয়তো সরকার পরিবর্তনের জন্য জনগণ উঠেপড়ে লাগবে না। বিরোধী দলও মধ্যবর্তী নির্বাচনের স্বপ্ন দেখতে চাইবে না এখন। কারণ তারা জানে, বর্তমান ব্রিটেনের এ অবস্থার জন্য লেবার দলই মূলত দায়ী। কিন্তু জনগণ কি পেছনে তাকাবে? জনগণ বর্তমানই দেখে। ব্রিটেনের বর্তমান এখন কনজারভেটিভ পার্টির অনুকূলে বলা যাবে না। তাই তো এড মিলিব্যান্ড প্রস্তুত হচ্ছেন। লেবার দল নিজেদের তৈরি করছে আবার। সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির বিরোধিতা করে আড়াই লাখ মানুষের সমাবেশে তিনি বক্তব্য রেখেছেন, দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন সরকারের ব্যর্থতা।
মধ্যপ্রাচ্যের ধাক্কা মূলত একটি প্রচলিত সনাতন সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রত্যয়। মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার নিয়েই তাদের রাজপথ দখল। মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তন আসছে, আসবেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে। কিন্তু কাঁকড়া সরে গিয়ে এ দেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদী শকুনরা যদি ছায়া ফেলে তবে তারা ঠুকরে ঠুকরেই খাবে ওই দেশগুলোর খনিজসম্পদ। ব্রিটেন কিংবা পশ্চিমা দেশগুলোর এ শঙ্কা না থাকলেও সরকারকে জনগণ নিয়ে ভাবতে হবে। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে এগিয়ে থাকা এ দেশের মানুষও না পাওয়ার বেদনায় কাতর হয়, ক্ষেপে যায়। ভাংচুর তারাও করে। এখানেও যতই সভ্যতার কথা বলা হোক না কেন, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী কিন্তু গদ্যময়। অতি সাম্প্রতিক ব্রিটেনের রাজনীতি তো তা-ই জানিয়ে দিয়ে যায়।
ফারুক যোশী : কলাম লেখক
faruk.joshi@gmail.com
No comments