টেন্ডুলকারের অর্ধেক বিদায়েই বিবর্ণ ক্রিকেট by মোস্তফা মামুন
কাল দুপুরের পর ছবি ঘাঁটাঘাঁটি শুরু হয়েছে। সঙ্গে স্মৃতি ঘাঁটাঘাঁটিও। শচীন টেন্ডুলকারের শেষ ওয়ানডে ম্যাচটা তো ঢাকায় ছিল! ওটার ছবি আছে তো? শেষ দিন ঠিক কিভাবে মাঠ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন!
রঙিন জার্সি পরে ওটাই শেষ, ওই ছবি আর কোনো দিন তৈরি হবে না, পৃথিবীর কোনো ড্রেসিং রুম থেকে আর নীল শার্ট পরে বেরোবেন না তিনি। ২৩ বছর ধরে মানবীয় চেহারায় দুনিয়া মাতিয়ে বেরিয়েছিলেন প্রায় ঐশ্বরিক শক্তির এক অতিমানুষ। কাল ঘটল তাঁর সূর্যাস্ত। এবার তিনি ক্লান্ত। বিশ্রাম নেবেন। তা তিনি নেবেন, কিন্তু আমরা? অর্ধেক বিদায়, ওয়ানডে ছেড়েছেন শুধু, টেস্ট আরো কিছুদিন খেলবেন, কিন্তু তাতেই ক্রিকেটকে কেমন যেন অনাথ দেখাচ্ছে কাল থেকে। তার সবচেয়ে বড় বীরকে হারিয়ে বিবর্ণ যেন। রং হারিয়ে রিক্তপ্রায়।
আমরা যারা খাঁটি বাংলাদেশি, মানে বাংলাদেশ হওয়ার পর যাদের জন্ম, তাদের ক্রীড়াবোধের বিকাশ আশির দশকে। আমাদের সেই কৈশোর তোলপাড় করে দিতে এলেন দুইজন। প্রথমজন অবশ্যই ম্যারাডোনা, তাঁর ঐশ্বরিক পায়ে দেশ-কাল-সময়ের ভেদাভেদ উড়ে বাংলাদেশ হয়ে গেল প্রায় আর্জেন্টিনা। এই দেশে সমর্থকসংখ্যায় ব্রাজিল ছিল একচেটিয়া, তাঁর একার পায়ে সেটা ভাগাভাগি হয়ে প্রায় সমান সমান হয়ে এলো। তারপর তিনি, শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। ইমরান, গাভাস্কার, কপিল, রিচার্ডস এমন আরো কত কীর্তিমান ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের গণ্ডি ছিল। তিনি এলেন সব ব্যবধান তুলে দিতে। ঘোর ভারতবিরোধী বহু মানুষকে দেখেছি শুধু টেন্ডুলকারের ব্যাটিংয়ের সময় ভারতপন্থী হয়ে যেতে। এবং সেই সময় যারা ক্রিকেট বুঝতে বা দেখতে শুরু করেছে, তারা আগে টেন্ডুলকারের ভক্ত, সেই সূত্রে তাঁর দল বা ভারতের ভক্ত। আশির দশকে ভারত-পাকিস্তানের সমর্থনের যে অনুপাত ছিল ১০:৯০, সেটাও যে এখন সমান সমান, তা-ও বোধহয় টেন্ডুলকারের কীর্তি। এই প্রজন্ম তাঁর মধ্যে এতটাই নিজেদের খুঁজে পেয়েছে। তাঁর ব্যাটে এতটাই নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছে! ম্যারাডোনার সঙ্গে তাঁর অমিল অনেক জায়গায়, তবু টাইম ম্যাগাজিন প্রথম যখন কোনো ক্রিকেটার হিসেবে তাঁকে প্রচ্ছদে আনে তখনো ম্যারাডোনা আর তাঁকে একীভূত করেছিল এভাবে, দুজনই আগে আবেগে, পরে খেলার মাঠে। ক্রিকেটের ছোট দুনিয়া পেরিয়ে বৃহত্তর পৃথিবীতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন খেলাটির প্রতীক। অনেক দেশে, অনেক সমাজে টেন্ডুলকার ক্রিকেটেরই প্রতিশব্দ। সেই টাইম ম্যাগাজিন আবার বিশ্লেষণে লিখছে, তিনি যখন শুরু করেন তখন সাম্প্রাস একটাও গ্র্যান্ড স্লাম জেতেননি, ফেদেরারকে কেউ চেনে না, লিওনেল মেসি কোলের শিশু। পরের ২২ বছর তাঁরা সবাই কীর্তিমান হলেন, বিদায়ও নিলেন অনেকে, রয়ে গেলেন তিনি। অত দূরে যাই কেন, লারা-দ্রাবিড়-সৌরভ-ইনজামামরাও তো সব তাঁর পরে এসেছেন, জগৎজয়ী হয়েছেন, আবার বিদায় নিয়ে সংসার-ধর্মকর্মে ঢুকে মোটামুটি প্রবীণ। তিনি তখনো তারুণ্যের উদ্দাম জোয়ারে। তখনো কিশোরের স্বপ্নের সারথী। তখনো নতুন শিশুর সঙ্গে ক্রিকেটের ভালোবাসা তৈরির সেতু।
তাতে করে মাঝেমধ্যে মনে হতো, তাঁর ক্ষেত্রে কি বয়স-সময় এসব জাগতিক নিয়ম প্রযোজ্য হবে না! শেষ পর্যন্ত নিয়মগুলো খাটতে শুরু করল। বয়সের প্রভাবে ফুটওয়ার্কে কিছু সমস্যা, রিফ্লেক্সও কমে গিয়ে থাকবে, ব্যাটটা আগে যেমন ছিল পোষ মানা পাখি, এখন কিছু অবাধ্যতা দেখাচ্ছিল। রান নেই কিছুদিন, সমালোচনার বিষাক্ত তীর ধেয়ে আসছে, টেন্ডুলকারকে কেমন যেন বিপর্যস্ত দেখাত। দুঃখের কথা কিন্তু তা দেখে মনে হতো, একদিক থেকে এটাই তো ঠিক। শেষ পর্যন্ত তিনি মানুষ, মানুষের নিয়মই খাটবে, বয়সের কাছে হারবেন, যাবেন। আর তাতে করে প্রমাণিত হবে মানুষের নিয়মে থেকে, মানুষের ক্ষমতা নিয়েই তিনি ঐশ্বরিক কীর্তি করেছেন। প্রতিভায়, পরিশ্রমে, সাধনায়, চেষ্টায় তিনি নিজেকে ঈশ্বর করেছেন। ঈশ্বর হয়ে জন্মাননি।
কিছুদিন আগে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাই সম্ভবত পারফেক্ট ফুটবলারের একটা কল্পিত বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর মতে, তাঁকে হতে হবে রোনালদোর মতো গোলবুভুক্ষু, মেসির মতো প্রতিভাবান, ফ্যালকাওয়ের মতো ফিনিশার ইত্যাদি ইত্যাদি। ধরা যাক, ক্রিকেটে কেউ এ রকম একজন পারফেক্ট ক্রিকেটার চান। তাঁর হাতেও অনেক সুযোগ আছে। অর্ডার দিতে পারেন লারার মতো প্রতিভা, রিচার্ডসের মতো খুনে মেজাজ, ইমরানের ব্যক্তিত্ব; আরো বহুকিছু আছে। কিন্তু খুব সম্ভব এ সবকিছুতে যেতে হবে না। পারফেক্ট ক্রিকেটারের জীবন্ত মডেল হয়ে যে তিনি আছেন! প্রতিভা ছিল তাঁর, সবচেয়ে বেশিই সম্ভবত এবং আমাদের সাধারণ নিয়মে প্রতিভাবানরা একটু খেয়ালি হবেন। উদাসী অহংকারে নিজের প্রতিভার অপচয় করবেন আর তাঁকে নিয়ে তৈরি হবে দিস্তা দিস্তা কাগজের দুঃখগাথা! ইশ্, যদি আরেকটু যত্নবান হতেন, তাহলে যে কী হতো! লারার ক্ষেত্রে যেমনটা আমরা করেছি। কিন্তু প্রতিভার অহংকার তিনি করেননি, অন্তর্গত উন্নাসিকতায় তাঁর বাজে খরচ হয়নি একদম। সবচেয়ে প্রতিভাবান অথচ সবচেয়ে পরিশ্রমীও। খেয়ালি প্রতিভাবানদের নিয়মকে উল্টে দিয়ে তিনি দেখিয়ে গেলেন প্রতিভার সঙ্গে পরিশ্রমের যোগাযোগ ঘটাতে হয়। দুটো মিললেই তৈরি হয় বিশ্বজয়ী। মাঠের মানুষকে ভুলে মাঠের বাইরে আসুন। শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে, চলতি নিয়মকে তুচ্ছ করে নিজেকে জানান দেওয়ার কোনো ঘটনাই নেই তাঁর জীবনে। ম্যাচ পাতানোর কালোজল ক্রিকেটকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, তাঁর সতীর্থদের কতজনের নাম এসেছে সেসবে, তার মধ্যেও তিনি থেকেছেন স্বমহিমায়। প্রতিভায়-সাধনায়, মাঠে-বাইরে, টেস্টে-ওয়ানডেতে। না, এই জিনিস দ্বিতীয়বার তৈরি হবে না! একশটি সেঞ্চুরি, পায়ে লুটিয়ে থাকা হাজারও রেকর্ড, অনুপম সব ইনিংস, বিধ্বংসী সব কাণ্ড, অক্লান্ত ধারাবাহিকতা, শেষ বিচারে এ সবকিছু আসলে শুধু কিছু সংখ্যাই। আসল টেন্ডুলকার আছেন সেখানে, যেখানে ক্রিকেট সম্পূর্ণতার চেহারা পায়। এখানে এসেই ক্রিকেট হয়ে ওঠে জীবন এবং জীবনের চেয়েও বড় গল্প। প্রথম দুই ইনিংসে তিনি শূন্য করেন তবু বিদায়ের সময় তিনি ওয়ানডে কীর্তির সব মিনারের চেয়েও উঁচুতে। একটা সেঞ্চুরির জন্য কত দিনের, কী দীর্ঘ অপেক্ষা অথচ শেষে সংখ্যাটা এমন জায়গায় যায় যা দেখে বাকিরা লজ্জা পায়। এই কনট্রাস্টের চেয়ে বড় গল্প জীবনে কী আর হয়! তাঁর ক্ষেত্রে এলাম-দেখলাম-জয় করলাম হয়েছে (টেস্টে), আবার অপেক্ষা, ধৈর্য, তারপর মিষ্টি ফল (ওয়ানডেতে) সে-ও হয়েছে। তিনিই তো ক্রিকেটের সম্পূর্ণতা। তাঁর কাছে এসেই ক্রিকেট পূর্ণ হয়ে ওঠে।
১৭ বছর আগে যখন ক্রীড়া সাংবাদিকতায় আসি তখন অনেক লোভের মধ্যে এটাও একটা লোভ ছিল যে, এই সুযোগে একদিন কাছ থেকে টেন্ডুলকারকে দেখতে পাব। সেই ১৯৯৫ সালে সে ছিল প্রায় স্বপ্নের মতো ব্যাপার, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে না, ক্রিকেট তারকারা দূর আকাশের মানুষই তখন। সে সময় বাংলাদেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক উৎপল শুভ্র সিঙ্গাপুরে তাঁর একটা সাক্ষাৎকার নিয়ে ফেললেন। তিনি টেন্ডুলকারের যত বড় সাক্ষাৎকার নিলেন ফেরার পর আমি তার চেয়েও বড় সাক্ষাৎকার নিলাম তাঁর। টেন্ডুলকার কেমন করে কথা বলেন, খুব অহংকারী কি না! মিনি রেকর্ডারটা ধার নিয়ে কতবার যে সেই সাক্ষাৎকারটা শুনেছি! মাত্র তিন বছরের মধ্যে স্বপ্ন হলো সত্যি। টেন্ডুলকার ঢাকায়। দেখা পাওয়ার জন্য সকাল থেকে গিয়ে এয়ারপোর্টে বসে আছি। ভারতীয় দলের ফ্লাইট পেছায়। সকাল থেকে দুপুর হয়। দুপর থেকে সন্ধ্যা। তারপর রাতে যখন নামলেন তখন পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম মুগ্ধ বিস্ময়ে। পৃথিবী যেন তাঁর সবটা সৌন্দর্য নিয়ে এখন আমার হাতের মুঠোয়। টুকটাক কথা বলার চেষ্টা করলাম। গলা কাঁপল। শব্দচয়ন সঠিক হলো না। কম্পিত হাতে একটা কার্ড বের করে দিলাম। সেটা দেখে পকেটে ভরলেন। পরের কয়েক দিন মাঠে-হোটেলে-ড্রেসিং রুমের সামনে চলল নিরন্তর জ্বালাতন। সঙ্গে লবিংও; একটা সাক্ষাৎকার পেতে, একান্তে কিছু সময় কথা বলতে! লবিং আর সাধনা সফল হয়েছিল কিন্তু সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েও গলা কাঁপছিল।
আজ এত বছর পর বিদায়ের কথা লিখতে গিয়েও হাত কাঁপছে। মন আজ বেদনাক্রান্ত। হৃদয় রক্তাক্ত। আর কিছু আফসোসও খোঁচাচ্ছে। শেষটা হয়ে গেল চোখের সামনে, এই ঢাকায়, সেটাই শেষ ইনিংস জানলে আরো নিবিড়ভাবে, আরো হৃদয় দিয়ে দেখতাম। পাকিস্তানের সঙ্গে ৫২ রানে ফেরার সময় তো বুঝিনি ওয়ানডেতে এই শেষবার! বুঝলে প্রতিটা পদক্ষেপের ছবি মনে গেঁথে রাখতাম। স্মৃতির সোনালি খণ্ড হয়ে থাকত একেকটা মুহূর্ত, আজ স্মৃতি হাতড়ানোর সময় উঠে আসত ফুলেল ছবি হয়ে। ঢাকা বা বাংলাদেশ বিদায়ের সুরটা বাজাত আরো আবিষ্ট হয়ে। এত বড় ইতিহাসের সাক্ষী হলাম, কিন্তু টের পেলাম না। আফসোস! কিন্তু বড় আফসোসটা অন্য জায়গায়। টেন্ডুলকার আর ওয়ানডে খেলবেন না। অর্ধেকটা শেষ হয়ে গেল। বাকিটা শেষ হওয়াও সময়ের ব্যাপার শুধু। তারপর?
এমন জিনিস তো এই জীবনে আর দ্বিতীয়টি তৈরি হবে না!
আমরা যারা খাঁটি বাংলাদেশি, মানে বাংলাদেশ হওয়ার পর যাদের জন্ম, তাদের ক্রীড়াবোধের বিকাশ আশির দশকে। আমাদের সেই কৈশোর তোলপাড় করে দিতে এলেন দুইজন। প্রথমজন অবশ্যই ম্যারাডোনা, তাঁর ঐশ্বরিক পায়ে দেশ-কাল-সময়ের ভেদাভেদ উড়ে বাংলাদেশ হয়ে গেল প্রায় আর্জেন্টিনা। এই দেশে সমর্থকসংখ্যায় ব্রাজিল ছিল একচেটিয়া, তাঁর একার পায়ে সেটা ভাগাভাগি হয়ে প্রায় সমান সমান হয়ে এলো। তারপর তিনি, শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। ইমরান, গাভাস্কার, কপিল, রিচার্ডস এমন আরো কত কীর্তিমান ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের গণ্ডি ছিল। তিনি এলেন সব ব্যবধান তুলে দিতে। ঘোর ভারতবিরোধী বহু মানুষকে দেখেছি শুধু টেন্ডুলকারের ব্যাটিংয়ের সময় ভারতপন্থী হয়ে যেতে। এবং সেই সময় যারা ক্রিকেট বুঝতে বা দেখতে শুরু করেছে, তারা আগে টেন্ডুলকারের ভক্ত, সেই সূত্রে তাঁর দল বা ভারতের ভক্ত। আশির দশকে ভারত-পাকিস্তানের সমর্থনের যে অনুপাত ছিল ১০:৯০, সেটাও যে এখন সমান সমান, তা-ও বোধহয় টেন্ডুলকারের কীর্তি। এই প্রজন্ম তাঁর মধ্যে এতটাই নিজেদের খুঁজে পেয়েছে। তাঁর ব্যাটে এতটাই নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছে! ম্যারাডোনার সঙ্গে তাঁর অমিল অনেক জায়গায়, তবু টাইম ম্যাগাজিন প্রথম যখন কোনো ক্রিকেটার হিসেবে তাঁকে প্রচ্ছদে আনে তখনো ম্যারাডোনা আর তাঁকে একীভূত করেছিল এভাবে, দুজনই আগে আবেগে, পরে খেলার মাঠে। ক্রিকেটের ছোট দুনিয়া পেরিয়ে বৃহত্তর পৃথিবীতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন খেলাটির প্রতীক। অনেক দেশে, অনেক সমাজে টেন্ডুলকার ক্রিকেটেরই প্রতিশব্দ। সেই টাইম ম্যাগাজিন আবার বিশ্লেষণে লিখছে, তিনি যখন শুরু করেন তখন সাম্প্রাস একটাও গ্র্যান্ড স্লাম জেতেননি, ফেদেরারকে কেউ চেনে না, লিওনেল মেসি কোলের শিশু। পরের ২২ বছর তাঁরা সবাই কীর্তিমান হলেন, বিদায়ও নিলেন অনেকে, রয়ে গেলেন তিনি। অত দূরে যাই কেন, লারা-দ্রাবিড়-সৌরভ-ইনজামামরাও তো সব তাঁর পরে এসেছেন, জগৎজয়ী হয়েছেন, আবার বিদায় নিয়ে সংসার-ধর্মকর্মে ঢুকে মোটামুটি প্রবীণ। তিনি তখনো তারুণ্যের উদ্দাম জোয়ারে। তখনো কিশোরের স্বপ্নের সারথী। তখনো নতুন শিশুর সঙ্গে ক্রিকেটের ভালোবাসা তৈরির সেতু।
তাতে করে মাঝেমধ্যে মনে হতো, তাঁর ক্ষেত্রে কি বয়স-সময় এসব জাগতিক নিয়ম প্রযোজ্য হবে না! শেষ পর্যন্ত নিয়মগুলো খাটতে শুরু করল। বয়সের প্রভাবে ফুটওয়ার্কে কিছু সমস্যা, রিফ্লেক্সও কমে গিয়ে থাকবে, ব্যাটটা আগে যেমন ছিল পোষ মানা পাখি, এখন কিছু অবাধ্যতা দেখাচ্ছিল। রান নেই কিছুদিন, সমালোচনার বিষাক্ত তীর ধেয়ে আসছে, টেন্ডুলকারকে কেমন যেন বিপর্যস্ত দেখাত। দুঃখের কথা কিন্তু তা দেখে মনে হতো, একদিক থেকে এটাই তো ঠিক। শেষ পর্যন্ত তিনি মানুষ, মানুষের নিয়মই খাটবে, বয়সের কাছে হারবেন, যাবেন। আর তাতে করে প্রমাণিত হবে মানুষের নিয়মে থেকে, মানুষের ক্ষমতা নিয়েই তিনি ঐশ্বরিক কীর্তি করেছেন। প্রতিভায়, পরিশ্রমে, সাধনায়, চেষ্টায় তিনি নিজেকে ঈশ্বর করেছেন। ঈশ্বর হয়ে জন্মাননি।
কিছুদিন আগে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাই সম্ভবত পারফেক্ট ফুটবলারের একটা কল্পিত বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর মতে, তাঁকে হতে হবে রোনালদোর মতো গোলবুভুক্ষু, মেসির মতো প্রতিভাবান, ফ্যালকাওয়ের মতো ফিনিশার ইত্যাদি ইত্যাদি। ধরা যাক, ক্রিকেটে কেউ এ রকম একজন পারফেক্ট ক্রিকেটার চান। তাঁর হাতেও অনেক সুযোগ আছে। অর্ডার দিতে পারেন লারার মতো প্রতিভা, রিচার্ডসের মতো খুনে মেজাজ, ইমরানের ব্যক্তিত্ব; আরো বহুকিছু আছে। কিন্তু খুব সম্ভব এ সবকিছুতে যেতে হবে না। পারফেক্ট ক্রিকেটারের জীবন্ত মডেল হয়ে যে তিনি আছেন! প্রতিভা ছিল তাঁর, সবচেয়ে বেশিই সম্ভবত এবং আমাদের সাধারণ নিয়মে প্রতিভাবানরা একটু খেয়ালি হবেন। উদাসী অহংকারে নিজের প্রতিভার অপচয় করবেন আর তাঁকে নিয়ে তৈরি হবে দিস্তা দিস্তা কাগজের দুঃখগাথা! ইশ্, যদি আরেকটু যত্নবান হতেন, তাহলে যে কী হতো! লারার ক্ষেত্রে যেমনটা আমরা করেছি। কিন্তু প্রতিভার অহংকার তিনি করেননি, অন্তর্গত উন্নাসিকতায় তাঁর বাজে খরচ হয়নি একদম। সবচেয়ে প্রতিভাবান অথচ সবচেয়ে পরিশ্রমীও। খেয়ালি প্রতিভাবানদের নিয়মকে উল্টে দিয়ে তিনি দেখিয়ে গেলেন প্রতিভার সঙ্গে পরিশ্রমের যোগাযোগ ঘটাতে হয়। দুটো মিললেই তৈরি হয় বিশ্বজয়ী। মাঠের মানুষকে ভুলে মাঠের বাইরে আসুন। শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে, চলতি নিয়মকে তুচ্ছ করে নিজেকে জানান দেওয়ার কোনো ঘটনাই নেই তাঁর জীবনে। ম্যাচ পাতানোর কালোজল ক্রিকেটকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, তাঁর সতীর্থদের কতজনের নাম এসেছে সেসবে, তার মধ্যেও তিনি থেকেছেন স্বমহিমায়। প্রতিভায়-সাধনায়, মাঠে-বাইরে, টেস্টে-ওয়ানডেতে। না, এই জিনিস দ্বিতীয়বার তৈরি হবে না! একশটি সেঞ্চুরি, পায়ে লুটিয়ে থাকা হাজারও রেকর্ড, অনুপম সব ইনিংস, বিধ্বংসী সব কাণ্ড, অক্লান্ত ধারাবাহিকতা, শেষ বিচারে এ সবকিছু আসলে শুধু কিছু সংখ্যাই। আসল টেন্ডুলকার আছেন সেখানে, যেখানে ক্রিকেট সম্পূর্ণতার চেহারা পায়। এখানে এসেই ক্রিকেট হয়ে ওঠে জীবন এবং জীবনের চেয়েও বড় গল্প। প্রথম দুই ইনিংসে তিনি শূন্য করেন তবু বিদায়ের সময় তিনি ওয়ানডে কীর্তির সব মিনারের চেয়েও উঁচুতে। একটা সেঞ্চুরির জন্য কত দিনের, কী দীর্ঘ অপেক্ষা অথচ শেষে সংখ্যাটা এমন জায়গায় যায় যা দেখে বাকিরা লজ্জা পায়। এই কনট্রাস্টের চেয়ে বড় গল্প জীবনে কী আর হয়! তাঁর ক্ষেত্রে এলাম-দেখলাম-জয় করলাম হয়েছে (টেস্টে), আবার অপেক্ষা, ধৈর্য, তারপর মিষ্টি ফল (ওয়ানডেতে) সে-ও হয়েছে। তিনিই তো ক্রিকেটের সম্পূর্ণতা। তাঁর কাছে এসেই ক্রিকেট পূর্ণ হয়ে ওঠে।
১৭ বছর আগে যখন ক্রীড়া সাংবাদিকতায় আসি তখন অনেক লোভের মধ্যে এটাও একটা লোভ ছিল যে, এই সুযোগে একদিন কাছ থেকে টেন্ডুলকারকে দেখতে পাব। সেই ১৯৯৫ সালে সে ছিল প্রায় স্বপ্নের মতো ব্যাপার, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে না, ক্রিকেট তারকারা দূর আকাশের মানুষই তখন। সে সময় বাংলাদেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক উৎপল শুভ্র সিঙ্গাপুরে তাঁর একটা সাক্ষাৎকার নিয়ে ফেললেন। তিনি টেন্ডুলকারের যত বড় সাক্ষাৎকার নিলেন ফেরার পর আমি তার চেয়েও বড় সাক্ষাৎকার নিলাম তাঁর। টেন্ডুলকার কেমন করে কথা বলেন, খুব অহংকারী কি না! মিনি রেকর্ডারটা ধার নিয়ে কতবার যে সেই সাক্ষাৎকারটা শুনেছি! মাত্র তিন বছরের মধ্যে স্বপ্ন হলো সত্যি। টেন্ডুলকার ঢাকায়। দেখা পাওয়ার জন্য সকাল থেকে গিয়ে এয়ারপোর্টে বসে আছি। ভারতীয় দলের ফ্লাইট পেছায়। সকাল থেকে দুপুর হয়। দুপর থেকে সন্ধ্যা। তারপর রাতে যখন নামলেন তখন পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম মুগ্ধ বিস্ময়ে। পৃথিবী যেন তাঁর সবটা সৌন্দর্য নিয়ে এখন আমার হাতের মুঠোয়। টুকটাক কথা বলার চেষ্টা করলাম। গলা কাঁপল। শব্দচয়ন সঠিক হলো না। কম্পিত হাতে একটা কার্ড বের করে দিলাম। সেটা দেখে পকেটে ভরলেন। পরের কয়েক দিন মাঠে-হোটেলে-ড্রেসিং রুমের সামনে চলল নিরন্তর জ্বালাতন। সঙ্গে লবিংও; একটা সাক্ষাৎকার পেতে, একান্তে কিছু সময় কথা বলতে! লবিং আর সাধনা সফল হয়েছিল কিন্তু সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েও গলা কাঁপছিল।
আজ এত বছর পর বিদায়ের কথা লিখতে গিয়েও হাত কাঁপছে। মন আজ বেদনাক্রান্ত। হৃদয় রক্তাক্ত। আর কিছু আফসোসও খোঁচাচ্ছে। শেষটা হয়ে গেল চোখের সামনে, এই ঢাকায়, সেটাই শেষ ইনিংস জানলে আরো নিবিড়ভাবে, আরো হৃদয় দিয়ে দেখতাম। পাকিস্তানের সঙ্গে ৫২ রানে ফেরার সময় তো বুঝিনি ওয়ানডেতে এই শেষবার! বুঝলে প্রতিটা পদক্ষেপের ছবি মনে গেঁথে রাখতাম। স্মৃতির সোনালি খণ্ড হয়ে থাকত একেকটা মুহূর্ত, আজ স্মৃতি হাতড়ানোর সময় উঠে আসত ফুলেল ছবি হয়ে। ঢাকা বা বাংলাদেশ বিদায়ের সুরটা বাজাত আরো আবিষ্ট হয়ে। এত বড় ইতিহাসের সাক্ষী হলাম, কিন্তু টের পেলাম না। আফসোস! কিন্তু বড় আফসোসটা অন্য জায়গায়। টেন্ডুলকার আর ওয়ানডে খেলবেন না। অর্ধেকটা শেষ হয়ে গেল। বাকিটা শেষ হওয়াও সময়ের ব্যাপার শুধু। তারপর?
এমন জিনিস তো এই জীবনে আর দ্বিতীয়টি তৈরি হবে না!
No comments