মুক্তিযোদ্ধার বাঁচার লড়াই-দেশমাতৃকার জন্য যাঁরা যুদ্ধে নেমেছিলেন তাঁদের অনেকেই আজ লড়ছেন দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য। তাঁদের জীবনচিত্র নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন-রিকশার পেডেল ঘুরলেই আহার জোটে মনিরের by এম আবদুল্লাহ্ আল মামুন
মুক্তিযুদ্ধের আগে নৌকার মাঝি ছিলেন মনির আলী। একাত্তরে তাঁদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা। প্রাণ বাঁচাতে তখন আশ্রয় নেন ভারতে। এরপর প্রশিক্ষণ, যুদ্ধ এবং বিজয়। তবে স্বাধীন দেশে জীবনযুদ্ধে জয়ের মুখ দেখা হলো না তাঁর।
প্রতিদিন রিকশার পেডেল ঘুরিয়েও তিনি নিজের ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পারছেন না। চার দশক আগে যে বসতভিটা ফাঁকা করে দিয়েছিল হানাদার বাহিনী, সেই ভিটায় আর ঘর তোলা হলো না তাঁর। শরীরে পানি জমে গেছে, ঋণে জর্জরিত, তবুও এই মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রের কাছে বৈষয়িক কিছু চান না। তাঁর চাওয়া কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার।
মনিরের বাড়ি সিলেটের জকিগঞ্জ পৌর এলাকায়। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। এই মুক্তিযোদ্ধার পেটে দানা পড়ে কেবল রিকশার চাকা ঘুরলেই। নিজের ঘর না থাকায় থাকেন ভাইয়ের ঘরে। স্ত্রী রেখা বেগম তিন সন্তান নিয়ে থাকেন বাবার বাড়ি। অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ যেন আর শেষ হতে চায় না তাঁর। তাই আক্ষেপ করে তিনি বলেন, 'একাত্তর সালে মইরা গেলে বালা অইত। দেশোর লাগি শহীদ অইতাম। বাঁচার চিন্তা কইরা যুদ্ধে যাই নাই। বাইচ্চা বিপদ অইছে। চাইরটা পোলাপাইন লইয়া জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতাছি।'
মনির আলী বলেন, 'যুদ্ধে যাওনের আগে আছলাম মাঝি, এবলা রিশকাচালক। বয়স বাড়ি গেছে। প্যাড (পেটে) পানি জমি গেছে। রিশকা চালইতাম পারি না। নিজের জায়গা জমি বলতে ছোড একটা বিডা। ট্যাকার লাগি গর (ঘর) বানাইতাম পারি না। অহন তত্ততালাশও কেউ নেইন না। ছোড বাইর গরো তাকিয়ার। বাতার (ভাতার) ট্যাকায় বাতই (ভাতই) অয় না।' তিনি আরো বলেন, 'এর পরও সব দুঃখ-কষ্ট বুলি শান্তি মতো মরতাম পারমু; যুদি পশুদের বিচার অয়, যুদ্ধাপরাধীদের পাশি (ফাঁসি) অয়।'
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট- কত সংগঠন! কত উদ্যোগ! কিন্তু মনির আলীদের দিন বদলায় না। মনির আলী বলেন, 'ইতা সবই যেন ডিসেম্বর আর মার্চ মাসের লাগি। ডিসেম্বর মাস আইলে সাংবাদিকরাও লেখইন। বাকি সময় কেউ আমরার খবর নেয় না।' তবে কয়েক বছর আগে হাফছা মজুমদার মহিলা কলেজ থেকে মনির আলীসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তখন কিছু টাকা ও একটি পাঞ্জাবি পাওয়ার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন মনির।
১৯৭১ সালের যুদ্ধ দিনের কথা বলতে গিয়ে মনির আলী বলেন, 'তহন আমি কুশিয়ারা নদীর গাডে নৌকার মাঝি ছিলাম। পাঞ্জাবিরা আইয়া আমরার গরবাড়ি জ্বালাইয়া দেয়। ডরাইয়া নৌকা থইয়া (রেখে) ভারতে যাইগি। করিমগঞ্জ টাউনো গেলে আবদুল লতিফ এমপি সাব আমারে জিগার করইন (জিজ্ঞাসা করেন) যুদ্ধত্ যাইমুনি। আমি কই যাইমু। ভারতের লোহারবনে তিন মাস ট্রেনিং করি। ৪ নম্বর সেক্টরে জালালপুর সাব-সেক্টরে মেজর সিআর দত্তের আন্ডারে যুদ্ধ করি। গুপ্ত হামলা, সামনাসামনি যুদ্ধ সবই করি। মরণের ঝুঁকি লইয়া আটগ্রাম, আমলশীদ, বেউর, সোনাপুর লোবাছড়াসহ বিভিন্ন অফারেশনে যাই। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খলিল উদ্দিন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মোস্তাকিম হায়দর, শুক্কুর আলী, আবদুল মলিক, জদই আলী, রইছ আলী, ছইব আলী, সিরাজ উদ্দিনসহ অনেকের সঙ্গে যুদ্ধ করছি।' আটগ্রাম রেস্ট হাউসে অপারেশনে হবিগঞ্জের কমান্ডার নিজামসহ সাত সহযোদ্ধাকে হারানোর কথা বলতে গিয়ে কাপড়ে চোখ মুছেন মনির আলী। পরক্ষণেই বীরের মতো বলে উঠেন, 'আমরা সেই অপারেশনে ১৪ পাকিস্তানি সেনাকে খতম করছি।'
বীর মুক্তিযোদ্ধা মনির জানান, জকিগঞ্জ থানা ছিল হানাদার বাহিনীর বন্দি শিবির। স্থানীয় দালাল ও রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের মনোরঞ্জনের জন্য যুবতী মেয়েদের জোরপূর্বক ধরে এনে সরবরাহ করত। তিনি দুই যুবতীকে বর্বরদের হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন ৭১ সালে। সে জন্য নিজেকে গর্বিত মনে করেন মনির।
মনির আলীর বড় ছেলে জামাল আহমদ বলেন, "তিন বাচ্চা নিয়ে আমি নিজেই চলতে পারি না। বাবা একটা ভাঙা ঘরে থাকেন। ঘরের বেড়া, চাল, দরজা- সবই ভাঙা। তবে মানুষ যখন আমাকে 'মুক্তির পোলা' বলে ডাকে; তখন বাবা রে লইয়া খুব গর্ব লাগে। সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে যাই।"
মনির আলী বলেন, 'বড় পোলা আলাদা সংসার করে। তার হুরুতা (বাচ্চাকাচ্ছা) লইয়া সে-ই চলতে পারে না। যে হাতে রাইফেল-এসএলআর চালাইয়া পাকিস্তানি সেনাদের খতম করছি, সেই হাত দিয়া এবলা রিশকা চালাইয়ার। তাও আবার পরের রিশকা। শরীর দুর্বল। রিশকার প্যাডেল মারতে ফারি না আগের মতো।' তিনি জানান, মাসে দুই হাজার টাকা করে ছয় মাস পরপর ভাতা পান।
মনিরের বাড়ি সিলেটের জকিগঞ্জ পৌর এলাকায়। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। এই মুক্তিযোদ্ধার পেটে দানা পড়ে কেবল রিকশার চাকা ঘুরলেই। নিজের ঘর না থাকায় থাকেন ভাইয়ের ঘরে। স্ত্রী রেখা বেগম তিন সন্তান নিয়ে থাকেন বাবার বাড়ি। অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ যেন আর শেষ হতে চায় না তাঁর। তাই আক্ষেপ করে তিনি বলেন, 'একাত্তর সালে মইরা গেলে বালা অইত। দেশোর লাগি শহীদ অইতাম। বাঁচার চিন্তা কইরা যুদ্ধে যাই নাই। বাইচ্চা বিপদ অইছে। চাইরটা পোলাপাইন লইয়া জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতাছি।'
মনির আলী বলেন, 'যুদ্ধে যাওনের আগে আছলাম মাঝি, এবলা রিশকাচালক। বয়স বাড়ি গেছে। প্যাড (পেটে) পানি জমি গেছে। রিশকা চালইতাম পারি না। নিজের জায়গা জমি বলতে ছোড একটা বিডা। ট্যাকার লাগি গর (ঘর) বানাইতাম পারি না। অহন তত্ততালাশও কেউ নেইন না। ছোড বাইর গরো তাকিয়ার। বাতার (ভাতার) ট্যাকায় বাতই (ভাতই) অয় না।' তিনি আরো বলেন, 'এর পরও সব দুঃখ-কষ্ট বুলি শান্তি মতো মরতাম পারমু; যুদি পশুদের বিচার অয়, যুদ্ধাপরাধীদের পাশি (ফাঁসি) অয়।'
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট- কত সংগঠন! কত উদ্যোগ! কিন্তু মনির আলীদের দিন বদলায় না। মনির আলী বলেন, 'ইতা সবই যেন ডিসেম্বর আর মার্চ মাসের লাগি। ডিসেম্বর মাস আইলে সাংবাদিকরাও লেখইন। বাকি সময় কেউ আমরার খবর নেয় না।' তবে কয়েক বছর আগে হাফছা মজুমদার মহিলা কলেজ থেকে মনির আলীসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তখন কিছু টাকা ও একটি পাঞ্জাবি পাওয়ার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন মনির।
১৯৭১ সালের যুদ্ধ দিনের কথা বলতে গিয়ে মনির আলী বলেন, 'তহন আমি কুশিয়ারা নদীর গাডে নৌকার মাঝি ছিলাম। পাঞ্জাবিরা আইয়া আমরার গরবাড়ি জ্বালাইয়া দেয়। ডরাইয়া নৌকা থইয়া (রেখে) ভারতে যাইগি। করিমগঞ্জ টাউনো গেলে আবদুল লতিফ এমপি সাব আমারে জিগার করইন (জিজ্ঞাসা করেন) যুদ্ধত্ যাইমুনি। আমি কই যাইমু। ভারতের লোহারবনে তিন মাস ট্রেনিং করি। ৪ নম্বর সেক্টরে জালালপুর সাব-সেক্টরে মেজর সিআর দত্তের আন্ডারে যুদ্ধ করি। গুপ্ত হামলা, সামনাসামনি যুদ্ধ সবই করি। মরণের ঝুঁকি লইয়া আটগ্রাম, আমলশীদ, বেউর, সোনাপুর লোবাছড়াসহ বিভিন্ন অফারেশনে যাই। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খলিল উদ্দিন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মোস্তাকিম হায়দর, শুক্কুর আলী, আবদুল মলিক, জদই আলী, রইছ আলী, ছইব আলী, সিরাজ উদ্দিনসহ অনেকের সঙ্গে যুদ্ধ করছি।' আটগ্রাম রেস্ট হাউসে অপারেশনে হবিগঞ্জের কমান্ডার নিজামসহ সাত সহযোদ্ধাকে হারানোর কথা বলতে গিয়ে কাপড়ে চোখ মুছেন মনির আলী। পরক্ষণেই বীরের মতো বলে উঠেন, 'আমরা সেই অপারেশনে ১৪ পাকিস্তানি সেনাকে খতম করছি।'
বীর মুক্তিযোদ্ধা মনির জানান, জকিগঞ্জ থানা ছিল হানাদার বাহিনীর বন্দি শিবির। স্থানীয় দালাল ও রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের মনোরঞ্জনের জন্য যুবতী মেয়েদের জোরপূর্বক ধরে এনে সরবরাহ করত। তিনি দুই যুবতীকে বর্বরদের হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন ৭১ সালে। সে জন্য নিজেকে গর্বিত মনে করেন মনির।
মনির আলীর বড় ছেলে জামাল আহমদ বলেন, "তিন বাচ্চা নিয়ে আমি নিজেই চলতে পারি না। বাবা একটা ভাঙা ঘরে থাকেন। ঘরের বেড়া, চাল, দরজা- সবই ভাঙা। তবে মানুষ যখন আমাকে 'মুক্তির পোলা' বলে ডাকে; তখন বাবা রে লইয়া খুব গর্ব লাগে। সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে যাই।"
মনির আলী বলেন, 'বড় পোলা আলাদা সংসার করে। তার হুরুতা (বাচ্চাকাচ্ছা) লইয়া সে-ই চলতে পারে না। যে হাতে রাইফেল-এসএলআর চালাইয়া পাকিস্তানি সেনাদের খতম করছি, সেই হাত দিয়া এবলা রিশকা চালাইয়ার। তাও আবার পরের রিশকা। শরীর দুর্বল। রিশকার প্যাডেল মারতে ফারি না আগের মতো।' তিনি জানান, মাসে দুই হাজার টাকা করে ছয় মাস পরপর ভাতা পান।
No comments