গণভোট- মিসরে অনিশ্চয়তা সহজে কাটছে না by কাবেরী গায়েন
মিসরে এসেছি ১৬ ডিসেম্বর, ব্রিটিশ ইউনিভার্সিটি অব ইজিপ্টের আমন্ত্রণে। দেশে প্রায় সব শুভানুধ্যায়ীই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এই জ্বলন্ত মিসরে আসার ব্যাপারে। আর পরিবারের ছিল উৎকণ্ঠিত নিষেধ। যে কারণে এই উৎকণ্ঠা আর নিষেধ, আসার আগ্রহ যেন সে কারণেই আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল।
প্রাচীন সভ্যতা আর ইতিহাসে যখন নতুন ইতিহাস তৈরি হচ্ছে রাজনীতির, তখন এই আমন্ত্রণকে সুযোগ বলেই মনে করার কারণ থাকে সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যেমন, সামাজিক বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষক হিসেবেও। আল-শেরুক সিটিতে ব্রিটিশ ইউনিভার্সিটি অব ইজিপ্টের ক্যাম্পাস কায়রো এয়ারপোর্ট থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে। প্রফেসর জন অ্যাডামস গাড়ি পাঠিয়েছেন এয়ারপোর্টে তাঁর বন্ধুসম ড্রাইভার সাল্লাকে দিয়ে। অমায়িক এই ভদ্রলোক খানিকটা ভাঙা ইংরেজিতে শুরুতেই জানিয়ে দিলেন যে রাস্তার গরমের মতোই শহরও গরম। মাঝখানে মাত্র এক দিন, তার পরই বিক্ষোভ ‘তাহরির মিয়দানে’। ভালো সময়ে এসেছি বলে জানালেন। কারণ, এমন বিক্ষোভ দেখার সুযোগ সবার নাকি হয় না। তিনি ‘না’ ভোটের একজন। কারণ হিসেবে বললেন, মুরসি ভালো লোক নয়, জুন মাসে ক্ষমতায় এসে নভেম্বরেই নিজের জন্য অতিরিক্ত ক্ষমতার ব্যবস্থা করেছেন। শরিয়া আইন করতে চান। দেশের ভালো হবে না। জানালেন, তিনি নিজেও মুসলমান, কিন্তু দেশটাকে তিনি সবার জন্য সমান দেখতে চান।
ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ঢুকলে বুঝতে কষ্ট হয় না, এটা কায়রোর ভেতরে অন্য এক কায়রো। আমেরিকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আদলে বানানো। ধনী ঘরের ছেলেমেয়েদের চলাফেরা চারপাশে। সবাই ইংরেজি বলছে, পোশাকে কেতা-দুরস্ত। ইউরোপের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের দেখে অভ্যস্ত আমার চোখ সহজেই বুঝতে পারে, এসব ছেলেমেয়ে ফ্যাশনে ছাড়িয়েছে ইউরোপের মধ্যবিত্তকে। সবার গাড়ি আছে। মেয়েদের মুখে প্রায় সবারই চড়া মেকআপ, পোশাকে পাশ্চাত্যই জুড়ে আছে, কারও কারও মাথায় হিজাব আছে, সেই হিজাব একরঙা নয়, সেখানেও বিত্ত-বৈভবের ছাপ পরিষ্কার। সব জায়গাতেই উত্তেজিত আলোচনা এই রেফারেন্ডাম ঘিরে। অর্থনীতি বিভাগের দুই তরুণ শিক্ষক রেহাম রিজক আর শাদওয়া জাহের খুব পরিষ্কার করেই জানালেন, বলা ভালো উত্তেজিতভাবে জানালেন, এই রেফারেন্ডাম পাস হলে কেবল নারীরা পিছিয়ে যাবে এমন নয়, বরং গোটা মিসরেই বিপর্যয় নেমে আসবে, মোবারকবিরোধী রেভল্যুশনের স্পিরিট ধ্বংস হয়ে যাবে। রেহাম বরং আমার কাছে এবং প্রফেসর অ্যাডামসের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন আমার আলোচনায় থাকতে পারছেন না বলে। কারণ, তাঁকে এই বিক্ষোভ বিষয়ের কর্মসূচি নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য ছুটতে হচ্ছে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে। জন অ্যাডামস তাঁকে পরামর্শ দিলেন মাথায় একটা হেলমেট পরে যাওয়ার জন্য। রেহাম ও শাদওয়া দুজনই কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছেন এবং দুজনেই হিজাব পরেন। আলোচনা গড়াতে থাকে। একপর্যায়ে প্রশ্ন করেন ওই বিভাগের শিক্ষক ড. আবদুল্লাহ, গোটা আরব-বসন্তে প্রগতিশীল অংশের কোনো প্রবল নেতৃত্ব কেন উঠে আসেনি, সে প্রসঙ্গে। তিনিও ‘না’ ভোটারদের একজন। বলে নেওয়া ভালো, মেয়েদের মধ্যে যাঁদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাঁরা কেউ-ই ‘হ্যাঁ’ ভোটের নন। অনেকটা যেন তাঁদের জীবন-মরণ-স্বাধীনতার প্রশ্ন, যেখানে তাঁরা কিছুতেই ছাড় দিতে প্রস্তুত নন; পুরুষদের মধ্যে বরং মতদ্বৈধতা আছে।
১৮ তারিখ ওয়ার্কশপ শেষ হলে আল-শেরুকের পাট চুকিয়ে ফিরে যাচ্ছি কায়রোতে, হোটেল সেমিরামাস ইন্টারকন্টিনেন্টালে। কায়রোতে সেদিন প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যাম, সব রাস্তা মিলেছে তাহরির স্কয়ারের দিকে, সব রাস্তা তাই বন্ধ। অনেক কষ্টে ড্রাইভার সাল্লা হোটেলে পৌঁছে দিলেন। হোটেলের ২০০ গজের মধ্যে তাহরির স্কয়ার। হোটেলের চৌদ্দ তলায় আমার রুম থেকে দিব্যি দেখা যাচ্ছিল—সবাই একটু একটু করে জড়ো হচ্ছেন। গান ভেসে আসছে, স্লোগানের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। হোটেল লবিতে জিজ্ঞেস করে আমিও পৌঁছে গেলাম আরও কয়েকজনের সঙ্গে তাহরির স্কয়ারে। অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে ছোট ছোট দলে, গান হচ্ছে একপাশে, চায়ের দোকান বসেছে। ভাষা এক বড় সমস্যা। তাহরির স্কয়ারের দেয়াললিখনগুলো খুব রঙিন। পড়তে পারলাম না। এরই মধ্যে ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্টের নানা দল বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে হাজির হয়েছে। মূল মঞ্চ থেকে স্লোগান তুলেছে সবাই মিলে, ‘রেভল্যুশন, রেভল্যুশন ফর দ্য সেক অব কনস্টিটিউশন’, আরেকটি স্লোগান ‘লিভ, লিভ ইউ কাওয়ার্ড’।
ছোট-বড় দলে হাজার মানুষ এল, ক্রুশ নিয়ে ক্রিশ্চিয়ান অ্যালায়েন্সও এসেছে। আমি ছবি তুলতে তুলতে পৌঁছে গেছি মূল মঞ্চের দিকে। ২৫-২৬ বছরের এক ছেলে আমাকে জায়গা ছেড়ে দিলেন ছবি তোলার জন্য, তাঁর নাম আহমেদ, কাজ করেন একটি কম্পিউটারের দোকানে। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কী চান। তিনি জানালেন, এই কনস্টিটিউশন তিনি সমর্থন করেন না, কিন্তু দেশের স্থিতাবস্থা চান। তিনি চান মুরসি থাকুক, চার বছর পরে জনগণ তাঁকে নামিয়ে দেবে। কারণ, মোবারকের শাসন আর তারপর নানা বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে। এই অনিশ্চয়তা থাকলে দেশ আগাবে কীভাবে? আগে তো খাওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। বিক্ষোভরত দল ও গ্রুপগুলো দুবার তাহরির স্কয়ার ঘুরে চলে গেল রাস্তায়। মূল বিক্ষোভ মিছিল ছিল বড়জোর কুড়ি মিনিটের।
হোটেলের দিকে রওনা দিয়েছি, আহমেদ তখনো আমার সঙ্গে আছেন। এরই মধ্যে দেখি, জনা সাত-আটের একটি গ্রুপ হাতে লেখা দুটি পোস্টার আর একটি মিসরের জাতীয় পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তখনো। আমি এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিতেই সবাই বাংলাদেশকে চিনলেন। তাঁদের পোস্টারে কী লেখা আছে জানতে চাইলে একজন প্রথমে আরবিতে এবং পরে ইংরেজিতে লিখলেন, ‘ইউ সে উই আর নন গুড পিপল, জাস্ট গিভ আজ ফুড’। নিজেদের পরিচয় লিখে দিলেন তাঁরা মি. মাজেদ, মি. মামদো ও মি. ওয়ায়েল নামে। তাঁদেরও উৎকণ্ঠা মিসরের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে। ততক্ষণে আমার ক্যামেরার ব্যাটারির চার্জ শেষ, তাই আমার মোবাইলে তাঁদের পতাকা হাতে নিয়ে তাঁদের সঙ্গে ছবি তুলে যখন ফিরে যাচ্ছি হোটেলের দিকে, রাস্তা তখন মিছিলে মিছিলে সয়লাব। আরবি জানি না বলে আফসোস হলো এই প্রথম।
ইতিমধ্যে আরও তিন দিন পেরিয়ে গেছে। আগামীকাল সংবিধানের প্রশ্নে দ্বিতীয় ও শেষ রেফারেন্ডাম অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। গত শনিবার, ঠিক এক সপ্তাহ আগে অনুষ্ঠিত প্রথম রেফারেন্ডামে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছে ৫৭ শতাংশ, যদিও ভোটদাতাদের অংশগ্রহণ ছিল খুবই কম, মাত্র ৩০ শতাংশের মতো। গুরুতর অভিযোগ উঠেছে ভোট কারচুপির। পদত্যাগ করেছেন প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর, অন্য অনেক বিচারপতিই রেফারেন্ডাম পরিচালনায় অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। জনগণের চাপের মুখে সরকার প্রথম রেফারেন্ডামে কারচুপির অভিযোগ তদন্ত করে দেখার আদেশ দিয়েছে এমন সময়ে, যখন পরবর্তী রেফারেন্ডামের ৪৮ ঘণ্টাও বাকি নেই। এদিকে মাত্র ২৫ শতাংশ ভোটে জয়ী হয়ে আসা ইসলামি ব্রাদারহুড মোর্চাও শনিবারের ভোটকে ‘হ্যাঁ’ ভোটের দিকে নিয়ে আসার জন্য গণ-র্যা লির আয়োজন করেছে। ইসলামিক ব্রাদারহুডের অবস্থান হলো, যদি ৫০ শতাংশ+১-ও হয় ভোটের রেজাল্ট, তবে তারা এই সংবিধান বহাল রাখবে। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী ঐক্যজোট—যার মধ্যে প্রগতিশীল, বামপন্থী ও ক্রিশ্চিয়ান কোয়ালিশন রয়েছে—সেই ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্ট কিছুতেই এই খসড়া সংবিধান পাস হতে দিতে রাজি নয়। তারা এই সংবিধান প্রতিহত করার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। উল্লেখ্য, সংবিধানসংক্রান্ত সহিংসতায় ইতিমধ্যে আটজন নিহত হয়েছে। গত সপ্তাহে আলেকসান্দ্রিয়ার কায়েদ ইব্রাহিম মসজিদ রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার প্রেক্ষাপটে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ইসলামি দলগুলো এবং তারা ‘আল্লাহর বিধান’ বহাল রাখার জন্য যে প্রতিশ্রুতি নিয়েছে, তারই মুখোমুখি আজ ফের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে আলেকসান্দ্রিয়ায়।
এদিকে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুন সুষ্ঠুভাবে শনিবারের রেফারেন্ডাম শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে ‘আরব-বিশ্বের হূৎপিণ্ডের ভেতর গণতন্ত্রের পিরামিড’ তৈরির আশাবাদ ব্যক্ত করলেও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, বিষয়টি কাঙ্ক্ষিত হলেও অধরাই থেকে যাচ্ছে সম্ভবত। কারণ, সংবিধানের প্রশ্নে জাতি কার্যতই ৫০:৫০ শতাংশে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। শহরের উদার, প্রগতিশীল, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত জনগণ যেমন এই সংবিধানকে প্রতিহত করতে চায়; তেমনি গ্রামের ধর্মভীরু, দরিদ্র, শহরের তুলনায় কম শিক্ষিতরা বরং ‘আল্লাহর আইন’ মানতেই আগ্রহী। আর রয়েছে কিছু দোদুল্যমান মানুষ, যারা এই সংবিধান বা ইসলামিক ব্রাদারহুডকে না চাইলেও দীর্ঘ অচলাবস্থার অবসান চায়, অর্থনৈতিক সচলতা চায়। যেমন ১৯ তারিখ গিজার পিরামিড দেখাতে নিয়ে গেলেন যে ট্যাক্সি ড্রাইভার মাদেত বা আজ লকসরে পৌঁছানোর পরে যে ট্যুরিস্ট গাইড আমাকে দেখালেন লকসর টেম্পল, তাঁর নাম হেসাম শরফ। তিনিও এই অচলাবস্থার অবসান চান। তাঁর মতে, না ভোট জিতলে ফের নির্বাচন, ফের বিক্ষোভ। তার চেয়ে শান্তি দরকার। তাই আগামীকালের গণভোটে ‘হ্যাঁ’ ভোট জয়ী হওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রশ্ন হলো, এরপর কী? একটি বিষয়ে সবাই বীতশ্রদ্ধ, আর তা হলো, কেউ-ই সামরিক শাসন চায় না। অথচ মোবারককে হটানো মিসরে যা দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, তা হলো মূলত আদর্শিক যুদ্ধ। এর প্রথম প্রকাশ দেখা যায় ইসলামিক ব্রাদারহুড নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরই। হাজার হাজার মানুষ কায়রোর রাস্তায় নেমে হাতে হাতে মানববন্ধন তৈরি করেছিল কায়রো মিউজিয়ামের সামনে, মিউজিয়াম রক্ষা করার জন্য। গতকাল কায়রো মিউজিয়ামে দেখলাম সম্রাট রামসেসের বিশাল মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ধার্মিকেরা নামাজ পড়ে নিচ্ছেন। আফ্রো-আরবের বিশাল ঐতিহ্যের অধিকারী মিসরীয় জনগণ তাদের এই মতাদর্শিক বিভাজন পেছনে ফেলে ভবিষ্যৎ তৈরি করতে কী পদক্ষেপ নেয়, তার আভাস পাওয়া যাবে হয়তো আগামীকালের গণভোট শেষে। কিন্তু মীমাংসা যে হচ্ছে না আপাতত, সেটি পরিষ্কার।
কায়রো থেকে, ২২ ডিসেম্বর
ড. কাবেরী গায়েন: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ঢুকলে বুঝতে কষ্ট হয় না, এটা কায়রোর ভেতরে অন্য এক কায়রো। আমেরিকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আদলে বানানো। ধনী ঘরের ছেলেমেয়েদের চলাফেরা চারপাশে। সবাই ইংরেজি বলছে, পোশাকে কেতা-দুরস্ত। ইউরোপের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের দেখে অভ্যস্ত আমার চোখ সহজেই বুঝতে পারে, এসব ছেলেমেয়ে ফ্যাশনে ছাড়িয়েছে ইউরোপের মধ্যবিত্তকে। সবার গাড়ি আছে। মেয়েদের মুখে প্রায় সবারই চড়া মেকআপ, পোশাকে পাশ্চাত্যই জুড়ে আছে, কারও কারও মাথায় হিজাব আছে, সেই হিজাব একরঙা নয়, সেখানেও বিত্ত-বৈভবের ছাপ পরিষ্কার। সব জায়গাতেই উত্তেজিত আলোচনা এই রেফারেন্ডাম ঘিরে। অর্থনীতি বিভাগের দুই তরুণ শিক্ষক রেহাম রিজক আর শাদওয়া জাহের খুব পরিষ্কার করেই জানালেন, বলা ভালো উত্তেজিতভাবে জানালেন, এই রেফারেন্ডাম পাস হলে কেবল নারীরা পিছিয়ে যাবে এমন নয়, বরং গোটা মিসরেই বিপর্যয় নেমে আসবে, মোবারকবিরোধী রেভল্যুশনের স্পিরিট ধ্বংস হয়ে যাবে। রেহাম বরং আমার কাছে এবং প্রফেসর অ্যাডামসের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন আমার আলোচনায় থাকতে পারছেন না বলে। কারণ, তাঁকে এই বিক্ষোভ বিষয়ের কর্মসূচি নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য ছুটতে হচ্ছে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে। জন অ্যাডামস তাঁকে পরামর্শ দিলেন মাথায় একটা হেলমেট পরে যাওয়ার জন্য। রেহাম ও শাদওয়া দুজনই কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছেন এবং দুজনেই হিজাব পরেন। আলোচনা গড়াতে থাকে। একপর্যায়ে প্রশ্ন করেন ওই বিভাগের শিক্ষক ড. আবদুল্লাহ, গোটা আরব-বসন্তে প্রগতিশীল অংশের কোনো প্রবল নেতৃত্ব কেন উঠে আসেনি, সে প্রসঙ্গে। তিনিও ‘না’ ভোটারদের একজন। বলে নেওয়া ভালো, মেয়েদের মধ্যে যাঁদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাঁরা কেউ-ই ‘হ্যাঁ’ ভোটের নন। অনেকটা যেন তাঁদের জীবন-মরণ-স্বাধীনতার প্রশ্ন, যেখানে তাঁরা কিছুতেই ছাড় দিতে প্রস্তুত নন; পুরুষদের মধ্যে বরং মতদ্বৈধতা আছে।
১৮ তারিখ ওয়ার্কশপ শেষ হলে আল-শেরুকের পাট চুকিয়ে ফিরে যাচ্ছি কায়রোতে, হোটেল সেমিরামাস ইন্টারকন্টিনেন্টালে। কায়রোতে সেদিন প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যাম, সব রাস্তা মিলেছে তাহরির স্কয়ারের দিকে, সব রাস্তা তাই বন্ধ। অনেক কষ্টে ড্রাইভার সাল্লা হোটেলে পৌঁছে দিলেন। হোটেলের ২০০ গজের মধ্যে তাহরির স্কয়ার। হোটেলের চৌদ্দ তলায় আমার রুম থেকে দিব্যি দেখা যাচ্ছিল—সবাই একটু একটু করে জড়ো হচ্ছেন। গান ভেসে আসছে, স্লোগানের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। হোটেল লবিতে জিজ্ঞেস করে আমিও পৌঁছে গেলাম আরও কয়েকজনের সঙ্গে তাহরির স্কয়ারে। অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে ছোট ছোট দলে, গান হচ্ছে একপাশে, চায়ের দোকান বসেছে। ভাষা এক বড় সমস্যা। তাহরির স্কয়ারের দেয়াললিখনগুলো খুব রঙিন। পড়তে পারলাম না। এরই মধ্যে ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্টের নানা দল বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে হাজির হয়েছে। মূল মঞ্চ থেকে স্লোগান তুলেছে সবাই মিলে, ‘রেভল্যুশন, রেভল্যুশন ফর দ্য সেক অব কনস্টিটিউশন’, আরেকটি স্লোগান ‘লিভ, লিভ ইউ কাওয়ার্ড’।
ছোট-বড় দলে হাজার মানুষ এল, ক্রুশ নিয়ে ক্রিশ্চিয়ান অ্যালায়েন্সও এসেছে। আমি ছবি তুলতে তুলতে পৌঁছে গেছি মূল মঞ্চের দিকে। ২৫-২৬ বছরের এক ছেলে আমাকে জায়গা ছেড়ে দিলেন ছবি তোলার জন্য, তাঁর নাম আহমেদ, কাজ করেন একটি কম্পিউটারের দোকানে। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কী চান। তিনি জানালেন, এই কনস্টিটিউশন তিনি সমর্থন করেন না, কিন্তু দেশের স্থিতাবস্থা চান। তিনি চান মুরসি থাকুক, চার বছর পরে জনগণ তাঁকে নামিয়ে দেবে। কারণ, মোবারকের শাসন আর তারপর নানা বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে। এই অনিশ্চয়তা থাকলে দেশ আগাবে কীভাবে? আগে তো খাওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। বিক্ষোভরত দল ও গ্রুপগুলো দুবার তাহরির স্কয়ার ঘুরে চলে গেল রাস্তায়। মূল বিক্ষোভ মিছিল ছিল বড়জোর কুড়ি মিনিটের।
হোটেলের দিকে রওনা দিয়েছি, আহমেদ তখনো আমার সঙ্গে আছেন। এরই মধ্যে দেখি, জনা সাত-আটের একটি গ্রুপ হাতে লেখা দুটি পোস্টার আর একটি মিসরের জাতীয় পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তখনো। আমি এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিতেই সবাই বাংলাদেশকে চিনলেন। তাঁদের পোস্টারে কী লেখা আছে জানতে চাইলে একজন প্রথমে আরবিতে এবং পরে ইংরেজিতে লিখলেন, ‘ইউ সে উই আর নন গুড পিপল, জাস্ট গিভ আজ ফুড’। নিজেদের পরিচয় লিখে দিলেন তাঁরা মি. মাজেদ, মি. মামদো ও মি. ওয়ায়েল নামে। তাঁদেরও উৎকণ্ঠা মিসরের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে। ততক্ষণে আমার ক্যামেরার ব্যাটারির চার্জ শেষ, তাই আমার মোবাইলে তাঁদের পতাকা হাতে নিয়ে তাঁদের সঙ্গে ছবি তুলে যখন ফিরে যাচ্ছি হোটেলের দিকে, রাস্তা তখন মিছিলে মিছিলে সয়লাব। আরবি জানি না বলে আফসোস হলো এই প্রথম।
ইতিমধ্যে আরও তিন দিন পেরিয়ে গেছে। আগামীকাল সংবিধানের প্রশ্নে দ্বিতীয় ও শেষ রেফারেন্ডাম অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। গত শনিবার, ঠিক এক সপ্তাহ আগে অনুষ্ঠিত প্রথম রেফারেন্ডামে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছে ৫৭ শতাংশ, যদিও ভোটদাতাদের অংশগ্রহণ ছিল খুবই কম, মাত্র ৩০ শতাংশের মতো। গুরুতর অভিযোগ উঠেছে ভোট কারচুপির। পদত্যাগ করেছেন প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর, অন্য অনেক বিচারপতিই রেফারেন্ডাম পরিচালনায় অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। জনগণের চাপের মুখে সরকার প্রথম রেফারেন্ডামে কারচুপির অভিযোগ তদন্ত করে দেখার আদেশ দিয়েছে এমন সময়ে, যখন পরবর্তী রেফারেন্ডামের ৪৮ ঘণ্টাও বাকি নেই। এদিকে মাত্র ২৫ শতাংশ ভোটে জয়ী হয়ে আসা ইসলামি ব্রাদারহুড মোর্চাও শনিবারের ভোটকে ‘হ্যাঁ’ ভোটের দিকে নিয়ে আসার জন্য গণ-র্যা লির আয়োজন করেছে। ইসলামিক ব্রাদারহুডের অবস্থান হলো, যদি ৫০ শতাংশ+১-ও হয় ভোটের রেজাল্ট, তবে তারা এই সংবিধান বহাল রাখবে। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী ঐক্যজোট—যার মধ্যে প্রগতিশীল, বামপন্থী ও ক্রিশ্চিয়ান কোয়ালিশন রয়েছে—সেই ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্ট কিছুতেই এই খসড়া সংবিধান পাস হতে দিতে রাজি নয়। তারা এই সংবিধান প্রতিহত করার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। উল্লেখ্য, সংবিধানসংক্রান্ত সহিংসতায় ইতিমধ্যে আটজন নিহত হয়েছে। গত সপ্তাহে আলেকসান্দ্রিয়ার কায়েদ ইব্রাহিম মসজিদ রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার প্রেক্ষাপটে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ইসলামি দলগুলো এবং তারা ‘আল্লাহর বিধান’ বহাল রাখার জন্য যে প্রতিশ্রুতি নিয়েছে, তারই মুখোমুখি আজ ফের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে আলেকসান্দ্রিয়ায়।
এদিকে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুন সুষ্ঠুভাবে শনিবারের রেফারেন্ডাম শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে ‘আরব-বিশ্বের হূৎপিণ্ডের ভেতর গণতন্ত্রের পিরামিড’ তৈরির আশাবাদ ব্যক্ত করলেও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, বিষয়টি কাঙ্ক্ষিত হলেও অধরাই থেকে যাচ্ছে সম্ভবত। কারণ, সংবিধানের প্রশ্নে জাতি কার্যতই ৫০:৫০ শতাংশে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। শহরের উদার, প্রগতিশীল, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত জনগণ যেমন এই সংবিধানকে প্রতিহত করতে চায়; তেমনি গ্রামের ধর্মভীরু, দরিদ্র, শহরের তুলনায় কম শিক্ষিতরা বরং ‘আল্লাহর আইন’ মানতেই আগ্রহী। আর রয়েছে কিছু দোদুল্যমান মানুষ, যারা এই সংবিধান বা ইসলামিক ব্রাদারহুডকে না চাইলেও দীর্ঘ অচলাবস্থার অবসান চায়, অর্থনৈতিক সচলতা চায়। যেমন ১৯ তারিখ গিজার পিরামিড দেখাতে নিয়ে গেলেন যে ট্যাক্সি ড্রাইভার মাদেত বা আজ লকসরে পৌঁছানোর পরে যে ট্যুরিস্ট গাইড আমাকে দেখালেন লকসর টেম্পল, তাঁর নাম হেসাম শরফ। তিনিও এই অচলাবস্থার অবসান চান। তাঁর মতে, না ভোট জিতলে ফের নির্বাচন, ফের বিক্ষোভ। তার চেয়ে শান্তি দরকার। তাই আগামীকালের গণভোটে ‘হ্যাঁ’ ভোট জয়ী হওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রশ্ন হলো, এরপর কী? একটি বিষয়ে সবাই বীতশ্রদ্ধ, আর তা হলো, কেউ-ই সামরিক শাসন চায় না। অথচ মোবারককে হটানো মিসরে যা দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, তা হলো মূলত আদর্শিক যুদ্ধ। এর প্রথম প্রকাশ দেখা যায় ইসলামিক ব্রাদারহুড নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরই। হাজার হাজার মানুষ কায়রোর রাস্তায় নেমে হাতে হাতে মানববন্ধন তৈরি করেছিল কায়রো মিউজিয়ামের সামনে, মিউজিয়াম রক্ষা করার জন্য। গতকাল কায়রো মিউজিয়ামে দেখলাম সম্রাট রামসেসের বিশাল মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ধার্মিকেরা নামাজ পড়ে নিচ্ছেন। আফ্রো-আরবের বিশাল ঐতিহ্যের অধিকারী মিসরীয় জনগণ তাদের এই মতাদর্শিক বিভাজন পেছনে ফেলে ভবিষ্যৎ তৈরি করতে কী পদক্ষেপ নেয়, তার আভাস পাওয়া যাবে হয়তো আগামীকালের গণভোট শেষে। কিন্তু মীমাংসা যে হচ্ছে না আপাতত, সেটি পরিষ্কার।
কায়রো থেকে, ২২ ডিসেম্বর
ড. কাবেরী গায়েন: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments