চারদিক- সেদিন রক্তে ভেসেছিল কোহিনুর ভিলা by তৌহিদী হাসান
কুষ্টিয়া শহরের ১৯ নম্বর রজব আলী চৌধুরী লেনের দেশওয়ালীপাড়ার বাড়িটির নাম কোহিনুর ভিলা। বাড়িতে থাকত রবিউল হক ও আরশেদ আলী নামের দুই ভায়ের যৌথ পরিবার। মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর আগে তারা ভারতের হুগলি জেলা থেকে এ দেশে এসেছিল।
বাড়ির ভেতরে তন্দুর তৈরি করে রুটি-বিস্কুটের ব্যবসা শুরু করে। অল্প কয়েক দিনে তাদের ব্যবসার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। কথাগুলো বলছিলেন কোহিনুর ভিলার প্রতিবেশী বৃদ্ধ জব্বার শেখ। অগোছালো কথাগুলো বলতে গিয়ে একপর্যায়ে তিনি থেমে পড়েন। কিছুটা বাকরুদ্ধ।
দেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনারা কুষ্টিয়া শহরে কারফিউ জারি করে। শহরের আড়ুয়াপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেন। রবিউলের পরিবার রাতের আঁধারে ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিস্কুট সরবরাহ করত। বিভিন্ন সময়ে খাবার দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করত। কোহিনুর ভিলার ওপর নজর পড়ে স্থানীয় বিহারিদের। মুখে কিছু বলে না। সুযোগ খুঁজতে থাকে। পাকিস্তানি সেনাদের ভয়ে শহরের অধিকাংশ মানুষ বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আলবদর আর আলশামস বাহিনী রাতের আঁধারে চুরি, খুন করে চলেছে। বিহারিরা রাতে মানুষের বাড়িতে ঢুকে অত্যাচার চালাচ্ছে। একদিন রবিউলের পরিবার সদর উপজেলার কমলাপুর গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। স্থানীয় সুলতান, কোরবান বিহারিসহ আরও কয়েকজন মিলে রবিউলকে তাঁর পরিবার নিয়ে বাড়ি ফিরে আসার কথা বলে। সরল বিশ্বাসে তারা বাড়ি ফিরে আসে।
১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। দেশওয়ালীপাড়ায় তখন কয়েক ঘর মাত্র মানুষ রয়েছে। বেশির ভাগ মানুষ চলে গেছে গ্রামে। রাত তখন সাড়ে ১০টা। কোহিনুর ভিলার সবাই ঘুমিয়ে ছিল। বাড়িতে দুজন অতিথিও ছিল সেই রাতে। বাড়ির দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা। উর্দুতে বকাঝকা। পায়ের লাথিতে খুলে যায় কাঠের দরজা। ভেতরে ঢুকে হত্যাযজ্ঞ চালায় তারা। নারীদের ওপর চলে নির্যাতন। পুরুষ সদস্যদের হাত-পা-মুখ বেঁধে জবাই করা হয়। এক শিশুকে জীবন্ত অবস্থায় পা ধরে পার্শ্ববর্তী পুুকুরে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়। পানিতে মরে ভাসতে থাকে শিশুটি। রবিউলের এক স্ত্রী ও আরশেদের স্ত্রী গর্ভবতী ছিলেন। বাড়িতে গোসলখানার ভেতরে তাদের পেট চিরে লাশ কুয়ার ভেতর ফেলে দেয় বিহারিরা। এমন হত্যাযজ্ঞের পর সেদিন রাতে বিহারিরা বাড়ির ভেতরে রান্না করে আনন্দ উল্লাস করেছিল।
রবিউল হক, তাঁর দুই স্ত্রী, ছেলে আবদুল হান্নান, আবদুল মান্নান, ভাই আরশেদ আলী, আরশেদ আলীর স্ত্রী, রিজিয়া, বাতাসী, জরিনা, রেজাউল, রাজু, আনু, আফরোজা, আশরাফ, আসাদ—এই ১৬ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যার পর ভোরের আজানের সময় তারা চলে যায়। রক্তে ভেসে থাকে কোহিনুর ভিলা। সকাল হলে জব্বার শেখ ওই বাড়িতে যান। ছড়ানো-ছিটানো অঙ্গ দেখে স্তব্ধ হয়ে যান তিনি। রক্তে ভেসে গেছে পুরো বাড়ি। রূপজান বেওয়া নামের এক প্রতিবেশী লাশের গোসল করান। বাড়ির পেছনে গণকবর দেয় স্থানীয়রা।
জব্বার শেখের মতে, ‘অন্যায় করে একটি পরিবারকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। যারা এ দেশকে পাকিস্তান বানাতে চেয়েছিল, সেই সব দোসর রাজাকারের ১০০ বার বিচার হওয়া উচিত।’
দীর্ঘদিনের পুরোনো কোহিনুর ভিলা বিস্মৃতির রাত নিয়ে জরাজীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কথা হয় রবিউলের ভাতিজা একমাত্র উত্তরসূরি হালিম মল্লিকের সঙ্গে। স্বাধীনতার পর বেদখল হওয়া বাড়িটি দশ বছর আগে উদ্ধার করেন তিনি। বাড়ির ভেতরের ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে। যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার দিয়ে সহায়তা করার জন্য একটি পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
স্বাধীনতার ৪১ বছরেও সেই পরিবারের একমাত্র উত্তরসূরির খোঁজখবর নেওয়া হয় না, ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন হালিম। বর্তমানে হালিম বাড়ির বাইরে ভাঙা ঘরের মধ্যে এমব্রয়ডারির কাজ করে সংসার চালান। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত মাত্র এক টন গম পেয়েছেন। গণকবরটিও রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন।
হালিম মল্লিক বলেন, স্বাধীন দেশে রাজাকারের বিচার হচ্ছে। চাচার পরিবারের সদস্যদের যারা মেরেছে, তাদেরও বিচার হওয়া উচিত।
তৌহিদী হাসান
দেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনারা কুষ্টিয়া শহরে কারফিউ জারি করে। শহরের আড়ুয়াপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেন। রবিউলের পরিবার রাতের আঁধারে ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিস্কুট সরবরাহ করত। বিভিন্ন সময়ে খাবার দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করত। কোহিনুর ভিলার ওপর নজর পড়ে স্থানীয় বিহারিদের। মুখে কিছু বলে না। সুযোগ খুঁজতে থাকে। পাকিস্তানি সেনাদের ভয়ে শহরের অধিকাংশ মানুষ বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আলবদর আর আলশামস বাহিনী রাতের আঁধারে চুরি, খুন করে চলেছে। বিহারিরা রাতে মানুষের বাড়িতে ঢুকে অত্যাচার চালাচ্ছে। একদিন রবিউলের পরিবার সদর উপজেলার কমলাপুর গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। স্থানীয় সুলতান, কোরবান বিহারিসহ আরও কয়েকজন মিলে রবিউলকে তাঁর পরিবার নিয়ে বাড়ি ফিরে আসার কথা বলে। সরল বিশ্বাসে তারা বাড়ি ফিরে আসে।
১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। দেশওয়ালীপাড়ায় তখন কয়েক ঘর মাত্র মানুষ রয়েছে। বেশির ভাগ মানুষ চলে গেছে গ্রামে। রাত তখন সাড়ে ১০টা। কোহিনুর ভিলার সবাই ঘুমিয়ে ছিল। বাড়িতে দুজন অতিথিও ছিল সেই রাতে। বাড়ির দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা। উর্দুতে বকাঝকা। পায়ের লাথিতে খুলে যায় কাঠের দরজা। ভেতরে ঢুকে হত্যাযজ্ঞ চালায় তারা। নারীদের ওপর চলে নির্যাতন। পুরুষ সদস্যদের হাত-পা-মুখ বেঁধে জবাই করা হয়। এক শিশুকে জীবন্ত অবস্থায় পা ধরে পার্শ্ববর্তী পুুকুরে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়। পানিতে মরে ভাসতে থাকে শিশুটি। রবিউলের এক স্ত্রী ও আরশেদের স্ত্রী গর্ভবতী ছিলেন। বাড়িতে গোসলখানার ভেতরে তাদের পেট চিরে লাশ কুয়ার ভেতর ফেলে দেয় বিহারিরা। এমন হত্যাযজ্ঞের পর সেদিন রাতে বিহারিরা বাড়ির ভেতরে রান্না করে আনন্দ উল্লাস করেছিল।
রবিউল হক, তাঁর দুই স্ত্রী, ছেলে আবদুল হান্নান, আবদুল মান্নান, ভাই আরশেদ আলী, আরশেদ আলীর স্ত্রী, রিজিয়া, বাতাসী, জরিনা, রেজাউল, রাজু, আনু, আফরোজা, আশরাফ, আসাদ—এই ১৬ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যার পর ভোরের আজানের সময় তারা চলে যায়। রক্তে ভেসে থাকে কোহিনুর ভিলা। সকাল হলে জব্বার শেখ ওই বাড়িতে যান। ছড়ানো-ছিটানো অঙ্গ দেখে স্তব্ধ হয়ে যান তিনি। রক্তে ভেসে গেছে পুরো বাড়ি। রূপজান বেওয়া নামের এক প্রতিবেশী লাশের গোসল করান। বাড়ির পেছনে গণকবর দেয় স্থানীয়রা।
জব্বার শেখের মতে, ‘অন্যায় করে একটি পরিবারকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। যারা এ দেশকে পাকিস্তান বানাতে চেয়েছিল, সেই সব দোসর রাজাকারের ১০০ বার বিচার হওয়া উচিত।’
দীর্ঘদিনের পুরোনো কোহিনুর ভিলা বিস্মৃতির রাত নিয়ে জরাজীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কথা হয় রবিউলের ভাতিজা একমাত্র উত্তরসূরি হালিম মল্লিকের সঙ্গে। স্বাধীনতার পর বেদখল হওয়া বাড়িটি দশ বছর আগে উদ্ধার করেন তিনি। বাড়ির ভেতরের ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে। যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার দিয়ে সহায়তা করার জন্য একটি পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
স্বাধীনতার ৪১ বছরেও সেই পরিবারের একমাত্র উত্তরসূরির খোঁজখবর নেওয়া হয় না, ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন হালিম। বর্তমানে হালিম বাড়ির বাইরে ভাঙা ঘরের মধ্যে এমব্রয়ডারির কাজ করে সংসার চালান। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত মাত্র এক টন গম পেয়েছেন। গণকবরটিও রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন।
হালিম মল্লিক বলেন, স্বাধীন দেশে রাজাকারের বিচার হচ্ছে। চাচার পরিবারের সদস্যদের যারা মেরেছে, তাদেরও বিচার হওয়া উচিত।
তৌহিদী হাসান
No comments