চিরকুট- ইয়ার্কির সংস্কৃতি by শাহাদুজ্জামান
সম্প্রতি একটি ভুয়া টেলিফোন কলের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটেনে এক নার্সের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সে দেশে বেশ তোলপাড় চলছে। দেশের নানা খবরের চাপে আন্তর্জাতিক এসব খবরের প্রতি মনোযোগ হয়তো আমাদের খুব বেশিক্ষণ থাকে না। তবু এ খবরটি নানা দিক থেকে তাৎপর্যের দাবি রাখে।
যাঁরা খবরটি অনুসরণ করেননি, তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিই। সপ্তাহ খানেক আগে ব্রিটেনের রাজপুত্র উইলিয়ামের স্ত্রী কেট গর্ভবতী হয়ে হাসাপাতালে ভর্তি হলে সেখানে অস্ট্রেলিয়ার একটি রেডিও স্টেশনের এক পুরুষ এবং এক নারী রেডিও জকি একজন উইলিয়ামের বাবা প্রিন্স চার্লস এবং আরেকজন রানি এলিজাবেথের কণ্ঠ নকল করে ওই হাসপাতালে একটা প্রাঙ্ক কল (ভুয়া ফোন কল) করে। সেখানে যে নার্সটি ফোন ধরেন তিনি রানির কণ্ঠ শুনে ফোনটি কেটের সেবাদানকারী নার্সটিকে ট্রান্সফার করেন। সেবাদানকারী নার্স তখন কেটের শারীরিক অবস্থার বিস্তারিত বর্ণনা দেন, যা রেডিওতে সরাসরি প্রচারিত হয়। দারুণ এক মজা হলো ভেবে রেডিও জকি দুজন ফোন রেখে দেন। কিন্তু এরপর রাজপরিবারের একজনের এমন ব্যক্তিগত খবরাদি গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ায় বিলাতে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ঘটনা নাটকীয় মোড় নেয় যখন জেসিন্তা নামের ভারতীয় বংশোদ্ভূত যে নার্সটি ফোন রিসিভ করেছেন এবং অন্য নার্সকে ট্রান্সফার করেছেন তিনি আত্মহত্যা করেন। তাঁর এই আত্মহত্যা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। সেই রেডিও জকি দুজনকে জেসিন্তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়। কিছু ক্ষুব্ধ শ্রোতা তাদের হত্যা করারও হুমকি দেয়। সেই রেডিও জকি দুজন এখন বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গৃহবন্দী জীবন যাপন করছেন। আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে রেডিও জকি দুজন বলছেন, পুরো ব্যাপারটা তাঁরা নেহাত ঠাট্টা হিসেবে করেছেন এবং তাঁরা তা হরহামেশা করে থাকেন। এমন একটি ঠাট্টায় কেন একজন আত্মহত্যা করবেন কিছুতেই তাঁদের তা বোধগম্য হচ্ছে না। সমস্যার বীজ এই ভাবনা প্রক্রিয়ার ভেতরেই আছে বলে মনে করি।
পশ্চিমা দেশে এবং তার অনুকরণ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজকাল একধরনের ইয়ার্কির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। পূর্বাপর বিবেচনা না করে স্রেফ মজা করার একটা প্রবণতা সর্বব্যাপী। ‘লেট আস হ্যাভ ফান’ তরুণদের কাছে খুব জনপ্রিয় কথা আজকাল। এই ‘ফান’ নিজের ওপর বা অন্যের ওপর কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে সেটা ধর্তব্যের মধ্যে আনার কোনো প্রয়োজন বোধ করে না তারা। বিশেষ করে অন্যকে বোকা বানিয়ে মজা করার নানা চর্চা পশ্চিমা গণমাধ্যমে আছে। আমাদের দেশে ‘রং নাম্বার’ বলে একটা ব্যাপার চালু আছে। ল্যান্ড ফোনের প্রাধান্যের যুগে এর চল ছিল বেশি। ভুল করে বা ইচ্ছা করে কোনো অপরিচিতের ফোন নাম্বারে ফোন করে তার সঙ্গে মশকরা করা হতো। পশ্চিমা বহু দেশের গণমাধ্যমে এ ব্যাপারটির একটি প্রাতিষ্ঠানিক এবং প্রকাশ্য রূপ দেওয়া হয়েছে। এখানকার রেডিও লাইফ অনুষ্ঠানের রেডিও জকিরা প্রায়ই এ রকম ভুয়া ফোন কল করে শ্রোতাদের সঙ্গে মজা করেন। মশকরা করার জন্য তাঁরা দেশের নানা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ভূমিকায় অভিনয় করেন। এমনকি এ কাজে দেশের প্রেসিডেন্ট, রানি সাজতেও পিছপা হন না। আমরা সম্প্রতি লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেখেছি ব্রিটেনের রানি সেজে একজন জেমস বন্ডের সঙ্গে মিলে হেলিকপ্টার থেকে ঝাঁপ দিচ্ছেন। কিছুকাল আগে আমেরিকার নির্বাচনে টি-পার্টির নেত্রী সারাহ পলিনকে এক রেডিও জকি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সারকোজি সেজে ফোন করে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে বোকা বানান। কথা হচ্ছে, একটি বিশেষ সমাজে গড়ে ওঠা এ ইয়ার্কির সংস্কৃতি এ বিশ্বায়নের যুগে কোথায়, কার ওপর কী ধরনের অভিঘাত তৈরি করবে, সেটা বলা মুশকিল। আমি নিজে ব্রিটেনে এ ধরনের প্রাঙ্ক ফোন কলের শিকার হয়েছি। বিদেশ বিভুঁইয়ে বসে এ ধরনের মশকরার শিকার হওয়ার নেতিবাচক মানসিক অভিজ্ঞতাটি আমার জানা আছে। আত্মহত্যাকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূত নার্স জেসিন্তা খুব বেশি দিন হয়নি ব্রিটেনে অভিবাসী হয়েছেন। এটি খুবই সম্ভব যে তিনি এ সর্বব্যাপী ইয়ার্কি, মশকরার সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত নন। তা ছাড়া তিনি এমন একটি সংস্কৃতির ভেতর বড় হয়েছেন, যেখানে উচ্চ, নীচ ভেদজ্ঞান খুব প্রবল। ফলে কেউ যখন রানি সেজে তাঁকে ফোন করেছেন এবং রাজবধূর অসুস্থতার মতো একটি গুরুতর ব্যাপার সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন তখন তিনি এটাকে একটা ঠাট্টার অংশ হিসেবে ভাবার কোনো কারণই দেখেননি। কিন্তু তাঁর এ সাংস্কৃতিক দূরত্ব তাঁকে একটা ফাঁদে ফেলে দিয়েছে। আত্মহত্যার আগে লিখে যাওয়া চিঠিতে জেসিন্তা জানিয়েছেন, সরল বিশ্বাসে ফোন কলটি ট্রান্সফার করার কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে অভিযুক্ত করে দুর্ব্যবহার করেছে। জেসিন্তা নিশ্চয়ই অপমানিত বোধ করেছেন, ভয় পেয়েছেন, ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় ভুগেছেন। যেকোনো অভিবাসী ভিনদেশে নানা নাজুক অবস্থার মধ্যে সংগ্রাম করেন। জেসিন্তাও করছিলেন। ভারতের নিম্নবিত্ত একটি পরিবারের সন্তান তিনি। তাঁর স্বামী এবং সন্তানেরা থাকতেন ভিন্ন একটা শহরে। জীবিকার কারণে তিনি একা থাকতেন লন্ডনে। ধারণা করি, ব্রিটেনে এসে অর্থনৈতিকভাবে সংগ্রাম করছিলেন তিনি। ভারতের গ্রামে তাঁর বাবা-মা, অন্য শহরে তাঁর স্বামী-সন্তান, নিজে একা আরেক শহরে—এই সব বাস্তবতাকে যখন সামাল দিচ্ছেন, তখন কোনো এক দূর দেশের জনৈক রেডিও জকির মজা মারার নিরীহ শিকার হয়ে গেলেন হঠাৎ। অন্য এক দেশের দরিদ্র এক প্রেক্ষাপট থেকে আসা নেহাতই ক্ষুদ্র এক নার্স ঘটনাচক্রে হয়ে গেছেন ব্রিটিশ রাজপরিবারের মতো প্রবল পরাক্রমশালী একটি শক্তির অঘটনের জন্য দায়ী, পরিণত হয়েছেন সারা পৃথিবীর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এত বড় ঘটনায় তাঁর জীবন, জীবিকা, পরিবার, সন্তানের ওপর কী অভিঘাত সৃষ্টি করবে ভেবে জেসিন্তা আতঙ্কিত হয়েছেন নিশ্চয়ই। স্বভাবতই এ বিরাট ঘটনার চাপ তাঁর মতো একজন সাধারণ অভিবাসী নারীর পক্ষে আর বহন করা সম্ভব হয়নি। নেহাতই কাকতালীয়ভাবে ঘটনাটি জেসিন্তার ওপর এসে পড়লেও আবারও বলতে চাই, জেসিন্তা একটি সর্বব্যাপী ইয়ার্কির সংস্কৃতিরই শিকার। আমাদের দেশের সমাজজীবনে এবং গণমাধ্যমেও অনেক সময়ই দায়িত্বজ্ঞানহীন, অর্থহীন নানা ধরনের ইয়ার্কির মাধ্যমে বিনোদন দেওয়ার বা পাওয়ার প্রবণতা দেখতে পাই। জীবন আনন্দময় হয়ে উঠবে সেটাই তো কাম্য। কিন্তু কোনো ধরনের ‘ফান’ নিজের ব্যক্তিজীবনে, অন্যের জীবনে কিংবা বৃহত্তর সমাজজীবনে কী ধরনের অভিঘাত তৈরি করতে পারে, তা বিবেচনায় রাখাও খুব জরুরি।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.om
পশ্চিমা দেশে এবং তার অনুকরণ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজকাল একধরনের ইয়ার্কির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। পূর্বাপর বিবেচনা না করে স্রেফ মজা করার একটা প্রবণতা সর্বব্যাপী। ‘লেট আস হ্যাভ ফান’ তরুণদের কাছে খুব জনপ্রিয় কথা আজকাল। এই ‘ফান’ নিজের ওপর বা অন্যের ওপর কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে সেটা ধর্তব্যের মধ্যে আনার কোনো প্রয়োজন বোধ করে না তারা। বিশেষ করে অন্যকে বোকা বানিয়ে মজা করার নানা চর্চা পশ্চিমা গণমাধ্যমে আছে। আমাদের দেশে ‘রং নাম্বার’ বলে একটা ব্যাপার চালু আছে। ল্যান্ড ফোনের প্রাধান্যের যুগে এর চল ছিল বেশি। ভুল করে বা ইচ্ছা করে কোনো অপরিচিতের ফোন নাম্বারে ফোন করে তার সঙ্গে মশকরা করা হতো। পশ্চিমা বহু দেশের গণমাধ্যমে এ ব্যাপারটির একটি প্রাতিষ্ঠানিক এবং প্রকাশ্য রূপ দেওয়া হয়েছে। এখানকার রেডিও লাইফ অনুষ্ঠানের রেডিও জকিরা প্রায়ই এ রকম ভুয়া ফোন কল করে শ্রোতাদের সঙ্গে মজা করেন। মশকরা করার জন্য তাঁরা দেশের নানা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ভূমিকায় অভিনয় করেন। এমনকি এ কাজে দেশের প্রেসিডেন্ট, রানি সাজতেও পিছপা হন না। আমরা সম্প্রতি লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেখেছি ব্রিটেনের রানি সেজে একজন জেমস বন্ডের সঙ্গে মিলে হেলিকপ্টার থেকে ঝাঁপ দিচ্ছেন। কিছুকাল আগে আমেরিকার নির্বাচনে টি-পার্টির নেত্রী সারাহ পলিনকে এক রেডিও জকি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সারকোজি সেজে ফোন করে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে বোকা বানান। কথা হচ্ছে, একটি বিশেষ সমাজে গড়ে ওঠা এ ইয়ার্কির সংস্কৃতি এ বিশ্বায়নের যুগে কোথায়, কার ওপর কী ধরনের অভিঘাত তৈরি করবে, সেটা বলা মুশকিল। আমি নিজে ব্রিটেনে এ ধরনের প্রাঙ্ক ফোন কলের শিকার হয়েছি। বিদেশ বিভুঁইয়ে বসে এ ধরনের মশকরার শিকার হওয়ার নেতিবাচক মানসিক অভিজ্ঞতাটি আমার জানা আছে। আত্মহত্যাকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূত নার্স জেসিন্তা খুব বেশি দিন হয়নি ব্রিটেনে অভিবাসী হয়েছেন। এটি খুবই সম্ভব যে তিনি এ সর্বব্যাপী ইয়ার্কি, মশকরার সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত নন। তা ছাড়া তিনি এমন একটি সংস্কৃতির ভেতর বড় হয়েছেন, যেখানে উচ্চ, নীচ ভেদজ্ঞান খুব প্রবল। ফলে কেউ যখন রানি সেজে তাঁকে ফোন করেছেন এবং রাজবধূর অসুস্থতার মতো একটি গুরুতর ব্যাপার সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন তখন তিনি এটাকে একটা ঠাট্টার অংশ হিসেবে ভাবার কোনো কারণই দেখেননি। কিন্তু তাঁর এ সাংস্কৃতিক দূরত্ব তাঁকে একটা ফাঁদে ফেলে দিয়েছে। আত্মহত্যার আগে লিখে যাওয়া চিঠিতে জেসিন্তা জানিয়েছেন, সরল বিশ্বাসে ফোন কলটি ট্রান্সফার করার কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে অভিযুক্ত করে দুর্ব্যবহার করেছে। জেসিন্তা নিশ্চয়ই অপমানিত বোধ করেছেন, ভয় পেয়েছেন, ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় ভুগেছেন। যেকোনো অভিবাসী ভিনদেশে নানা নাজুক অবস্থার মধ্যে সংগ্রাম করেন। জেসিন্তাও করছিলেন। ভারতের নিম্নবিত্ত একটি পরিবারের সন্তান তিনি। তাঁর স্বামী এবং সন্তানেরা থাকতেন ভিন্ন একটা শহরে। জীবিকার কারণে তিনি একা থাকতেন লন্ডনে। ধারণা করি, ব্রিটেনে এসে অর্থনৈতিকভাবে সংগ্রাম করছিলেন তিনি। ভারতের গ্রামে তাঁর বাবা-মা, অন্য শহরে তাঁর স্বামী-সন্তান, নিজে একা আরেক শহরে—এই সব বাস্তবতাকে যখন সামাল দিচ্ছেন, তখন কোনো এক দূর দেশের জনৈক রেডিও জকির মজা মারার নিরীহ শিকার হয়ে গেলেন হঠাৎ। অন্য এক দেশের দরিদ্র এক প্রেক্ষাপট থেকে আসা নেহাতই ক্ষুদ্র এক নার্স ঘটনাচক্রে হয়ে গেছেন ব্রিটিশ রাজপরিবারের মতো প্রবল পরাক্রমশালী একটি শক্তির অঘটনের জন্য দায়ী, পরিণত হয়েছেন সারা পৃথিবীর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এত বড় ঘটনায় তাঁর জীবন, জীবিকা, পরিবার, সন্তানের ওপর কী অভিঘাত সৃষ্টি করবে ভেবে জেসিন্তা আতঙ্কিত হয়েছেন নিশ্চয়ই। স্বভাবতই এ বিরাট ঘটনার চাপ তাঁর মতো একজন সাধারণ অভিবাসী নারীর পক্ষে আর বহন করা সম্ভব হয়নি। নেহাতই কাকতালীয়ভাবে ঘটনাটি জেসিন্তার ওপর এসে পড়লেও আবারও বলতে চাই, জেসিন্তা একটি সর্বব্যাপী ইয়ার্কির সংস্কৃতিরই শিকার। আমাদের দেশের সমাজজীবনে এবং গণমাধ্যমেও অনেক সময়ই দায়িত্বজ্ঞানহীন, অর্থহীন নানা ধরনের ইয়ার্কির মাধ্যমে বিনোদন দেওয়ার বা পাওয়ার প্রবণতা দেখতে পাই। জীবন আনন্দময় হয়ে উঠবে সেটাই তো কাম্য। কিন্তু কোনো ধরনের ‘ফান’ নিজের ব্যক্তিজীবনে, অন্যের জীবনে কিংবা বৃহত্তর সমাজজীবনে কী ধরনের অভিঘাত তৈরি করতে পারে, তা বিবেচনায় রাখাও খুব জরুরি।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.om
No comments