কয়েকটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড-এ কোথায় এসে দাঁড়ালাম আমরা?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের কথা। পৃথিবী তখনও আজকের মতো নিষ্ঠুর হয়ে ওঠেনি। এক মনীষী লিখেছিলেন, পৃথিবীতে এমন একদিনও আসবে যখন মানুষ সকালবেলা নাশতার টেবিলে বসে খবরের কাগজে নির্মম সব হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পড়বে আর তাতে কোনো ভাবান্তর ঘটবে না তার মনে।
তেমনি নির্মম ও নিষ্ঠুর দিন এসেছে কি-না তা হয়তো নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কিন্তু সকালবেলার নাশতার টেবিলে বসে যে অসংখ্য নির্মম হত্যাকাণ্ডের সংবাদ আমাদের প্রায়ই পড়তে হয়, তা সত্য। তবে মানুষ বোধহয় অতটা নিষ্ঠুর হয়ে ওঠেনি। এখনও হত্যা, নৃশংসতা ও নির্মমতার খবরে মানুষ শিহরিত, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও আতঙ্কিত হয়। যে কোনো অমানবিক ঘটনায় মানুষ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। সমাজে যখন অপরাধপ্রবণতা ছড়িয়ে পড়ে তখনও লোকে প্রতিবিধানের উপায় খোঁজে, রাষ্ট্রকে যেমন তাগিদ দেয়, তেমনি সমাজের মধ্যে সচেতন তৎপরতাও চলতে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ঘটনা এমন করে নাগরিকদের আবার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলেছে। সর্বসাম্প্রতিক ঘটনাটি কামরুন নাহার নাদিয়ার। প্রেম করে সংসার বেঁধেছিলেন এ তরুণী। কিন্তু সংসার গড়ার পরপরই নাদিয়ার স্বপ্নভঙ্গ ঘটে। স্বামীর নিষ্ঠুরতা, অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত প্রাণ দিতে হলো তাকে। অত্যন্ত নিন্দনীয় হলেও স্বামীর অত্যাচারে, আঘাতে স্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনা এ দেশে নতুন নয়। কিন্তু নাদিয়ার স্বামী মৃত স্ত্রীকে গাড়িতে বসিয়ে যেভাবে ঘটনাকে অন্যখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছে তাতে ঘাতক রেজাউলের নির্মম আচরণ সকলকে বিস্মিত করবে। ঠাণ্ডা মাথা অত্যন্ত নিষ্ঠুর খুনি ছাড়া এমন পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ও হত্যা-পরবর্তী আচরণ কি কেউ করতে পারে? নাদিয়ার মৃত্যুর কয়েকদিন আগে দীর্ঘদিনের বন্ধুর হাতে খুন হলেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্র রাসেল। যে বন্ধুদের সঙ্গে হাতে হাত রেখে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া, অনেক লেনদেন ও সম্পর্কের বিপুল স্মৃতি সে বন্ধুর বুকে যখন বন্ধুই ছুরি হানে তখন একে কী বলা যায়? সাবি্বর হত্যার পর তার বন্ধুরা লাশ গুম করার এবং লাশ নিয়ে যে নির্মমতার পরিচয় দিয়েছে তার সঙ্গে কোনো অমানবিকতার তুলনা চলে না। এর আগের ঘটনাও রাজশাহীরই। সেখানে অপহরণের পর মুক্তিপণ নিয়েও ব্যবসায়ী আমিনুল হককে হত্যা করে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয় লাশ। বহুল আলোচিত এমন সব হত্যাকাণ্ডের খবরের আড়ালে আছে আরও নানা হত্যাকাণ্ড, অত্যাচার ও নির্মমতার খবর। অপঘাত, আহত-নিহত হওয়ার খবর। এসব ঘটনা দেখে, স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্কে শিউরে উঠছেন অনেকে। প্রশ্ন করছেন, এ কোথায় এসে দাঁড়ালাম আমরা। যখন স্বামী স্ত্রীর বুকে চেপে ধরছে অস্ত্র, যখন বন্ধু বন্ধুর বুকে মারছে ছুরি, যখন অবুঝ শিশুও নির্মমতার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না, যখন প্রেমিক প্রেমিকার বাসায় গিয়ে হত্যা করছে প্রেমিকাকে এবং একটি নয়, দুটি নয়_ একের পর এক অনেক নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা যখন প্রায়ই আমাদের বিব্রত-বিহ্বল করে তুলছে তখন তো এ প্রশ্ন সঙ্গত যে, এ কোথায় এসে দাঁড়ালাম আমরা? সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, সমাজে মূল্যবোধের ভীষণ অবক্ষয় ঘটেছে। সুকুমার প্রবৃত্তির বদলে জায়গা করে নিয়েছে লোভ-লালসা, হিংসা-ঈর্ষা ও বিদ্বেষ। রাজনীতির পচন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত করছে গলিত বিষবাষ্প। ফলে অনেকের মধ্যেই আর মানবিকতাবোধ নেই। অমানুষ হয়ে পরম প্রিয় মানুষের ওপর হামলে পড়ছে ঘনিষ্ঠ বলে কথিত ব্যক্তিরা। পারস্পরিক অবিশ্বাস গাঢ় হচ্ছে। কিন্তু কোনো উপশম নেই, প্রশান্তি খুঁজে নেওয়ার কোনো পথ নেই। সামাজিক এসব কারণের বাইরে আছে অপরাধী-সন্ত্রাসীদের পার পেয়ে যাওয়ার নানা ঘটনা। আইনের শাসনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধের অবনমন ঘটেছে। ফলে আইন ভাঙার প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেড়ে গেছে। সমাজবিজ্ঞানীদের এসব পর্যবেক্ষণ এখন অবশ্যই আমাদের আমলে নিতে হবে। সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা অমানবিকতা, নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতা দূর করতে সমাজের শক্তিগুলোকে তৎপর হতে হবে। নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলোর দ্রুত বিচার হতে হবে। সন্ত্রাস, আতঙ্ক, ভীতি দূর করে পারস্পরিক বিশ্বাস ও নির্ভরতার সমাজ গড়তে সরকার, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, এসব ঘটনা নিয়ে আলোচনা করে এর পেছনের কারণগুলো বের করতে হবে। আমরা কেউ-ই চাই না, আবারও কোনো নির্মমতার ঘটনা আমাদের শিহরিত করে তুলুক। আমরা চাই বিশ্বাস, আস্থা ও নির্ভরতার নতুন দিন।
No comments