আলোর ইশারা-দোহা জলবায়ু সম্মেলন কেমন হলো? by আইনুন নিশাত
আমাকে কেউ যদি প্রশ্ন করেন, দোহা জলবায়ু সম্মেলন কেমন হলো, তাহলে বলব_ খুব একটা খারাপ হয়নি। আমি গত ২১ নভেম্বর সমকালের পাতায় লিখেছিলাম, 'অতি আশাবাদী না হওয়াই ভালো।' বলতে চেষ্টা করেছিলাম, দোহাতে কী হতে পারে। আমার ধারণাগুলো মোটামুটি সঠিক হয়েছে।
কাজেই যারা দোহায় বিরাট কিছু আশা করেছিলেন, তারা আশাহত হলেও আমরা বরং বেশ কিছু সাফল্য দেখছি।
সম্মেলনটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ৭ ডিসেম্বর শুক্রবার বিকেল নাগাদ। কয়েকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত না হওয়ায় ইনফরমাল কনসালটেশনের নামে দরকষাকষি চলতে থাকে। মাঝরাত পেরিয়ে যায়। ভোরে ঠিক করা হয়। ৮ ডিসেম্বর অর্থাৎ শনিবারেও আলোচনা চলবে। শনিবারের মাঝরাতে গিয়ে আলোচনা শেষ হলো।
জলবায়ু পরিবর্তনের সম্মেলনগুলো যারা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন, তারা জানেন যে সম্মেলনের শেষ দু'দিনে তীব্র বাদানুবাদ হতে থাকে। সিদ্ধান্তগুলো আটকে যায়। এক থেকে দেড় দিন বাড়তি সময় হাতে নেওয়া হয় এবং সব শেষে সমঝোতা হয়। এটি ২০০৭ সালে বালিতে হয়েছে। ২০০৯ সালে কোপেনহেগেন। ২০১০ সালে কানকুনের সভা তার ব্যতিক্রম ছিল না, ২০১১ সালে ডায়বানেও তার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। ২০১২ সালে দোহাতেও একই ঘটনা ঘটেছে। তবে এর আগের বার্ষিক সভাগুলোতে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা ৪০-৪৫ হাজার ছাড়িয়েছিল। এবারে কাতার সরকারের হিসাব অনুযায়ী ১৬ হাজারের কিছু বেশি হয়েছিল। অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যার বড় অংশ হচ্ছে বেসরকারি সংগঠন বা এনজিও প্রতিনিধি। আগের সম্মেলনের তুলনায় দোহাতে সংখ্যা কমায় বোঝা যায় যে, বেসরকারি সংস্থাগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল আশা করেনি।
একজন পাঠক স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন করলে পারেন যে, এত লোক কি আলোচনায় সরাসরি অংশগ্রহণ করে থাকে? উত্তর হচ্ছে, তারা মূলত ওই বৈশ্বিক সম্মেলনগুলোকে উপলক্ষ করে যে বহু সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়, তারা তাতে উপস্থিত থাকেন বা অংশগ্রহণ করেন। আরও কিছু সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় এ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে। সেগুলোতেও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও এনজিও কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। মূল নেগোসিয়েশনে অংশ নিতে হলে সরকারের প্রতিনিধি হতে হয়। ১৯৫টি দেশের পক্ষ থেকে হয়তো হাজার দুয়েক প্রতিনিধি মূল কক্ষে প্রবেশ করেন। আর হয়তো ৩-৪শ' জন সরকারি কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞ ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে একেকটি বিষয়ে দরকষাকষি করে।
ফিরে আসি দোহাতে। শেষ পর্যন্ত কী ছিল। প্রথমত, যে কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে তার জন্য যেসব গ্যাস দায়ী সেসব প্রশাসনের জন্য যে গ্যাসগুলো কমানোর কথা, সেগুলো কমানোর লক্ষ্যে যে আন্তর্জাতিক আইনটি আছে, অর্থাৎ বিষয়টা প্রটোকলের কার্যকারিতার মেয়াদ বৃদ্ধি করা। এই মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২০ সাল পর্যন্ত। তবে ২০০৫ সালে কিয়োটো প্রটোকল প্রণয়নের পরে উন্নত বিশ্বের যে দেশগুলো দায়িত্ব নিয়েছিল, তাদের পক্ষ থেকে কয়েকটি দেশ বাদে বাকি সব দেশ এ দায়িত্ব মাথা পেতে নিয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ দায়িত্ব নেয়নি। আর এবারে জাপান, রাশিয়া এবং নিউজিল্যান্ড দায়িত্ব নেওয়া থেকে বিরত থাকল। কানাডাও কিয়োটো প্রটোকল থেকে বেরিয়ে দায়ভার নিতে অস্বীকার করল। এতে ২০২০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস কমার কোনো সম্ভাবনা থাকল না। তবে কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ ২০২০ সাল পর্যন্ত বর্ধিত হওয়া একটি বিরাট অর্জন। দোহাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, ১৯১৪ সালের মধ্যে নতুন আন্তর্জাতিক আইনির খসড়া তৈরি হবে, যেখানে বিশ্বের সব দেশকে বাধ্য করা হবে গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর জন্য। ২০১৫ সালের ওই খসড়া নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। ২০২০ সালের মধ্যে তা চূড়ান্ত ও কার্যকর হবে! কিয়োটো প্রটোকলের বিভিন্ন বিধান ও অনুশাসনগুলো প্রভাবিত নতুন আইন তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
১৯৯৫ সালে প্রণীত কিয়োটো প্রটোকল কার্যকর হয়েছিল ২০০৫ সালে। তখন কিয়োটো প্রটোকলের অধীনে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর জন্য কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ বিভিন্ন গ্যাস নির্গমনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কেবল আর্থিকভাব উন্নত দেশগুলোর ওপর বর্তমান হয়েছিল। এই দেশগুলোর তালিকা প্রণীত হয়েছিল ১৯৯২ সালে। আজকে ওই দেশগুলো প্রধান উদ্গিরণকারী নয়। উন্নয়নশীল বিশ্বের অগ্রসর দেশগুলো তখন প্রধান উদ্গিরণকারী। সোজা কথায় বলতে গেলে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র হলো প্রধান উদ্গিরণকারী। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশের সমষ্টিগত উদ্গিরণ। কাজেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো চাপ দিচ্ছিল প্রধান উদ্গিরণকারী দেশগুলোকে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। তা অবশ্য সফল হয়নি। তবে ২০২০ সালের মধ্যে যে আইন প্রণীত হওয়ার কথা, তাতে সব দেশের ওপর দায়িত্ব বর্তানোর ব্যবস্থা থাকবে। সব দেশ তা মেনে নিয়েছে। তবে এ জন্য দায়িত্ব বণ্টনের ফর্মুলা বের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যেসব নীতির কথা বলা হচ্ছে তা হলো, কমন বাট ডিফরেনশিয়েটেড রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড রেসপেক্টটিভ রেসপনসিবিলিটি অর্থাৎ দায়িত্ব বণ্টনের ক্ষেত্রে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় কোনো কোনো দেশের দায়িত্ব লাঘব করা যেতে পারে। অনুন্নত বিশ্বের উন্নয়নের আশঙ্কা যাতে কোনোভাবে অবদমিত না হয়, সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা হবে।
তবে দোহাতে আবার বলা হলো, বৈশ্বিক উষ্ণতা কোনোভাবে দুই ডিগ্রির ওপর উঠতে দেওয়া হবে না। আমি কেন যেন এই আশ্বাস বাণীর ওপর ভরসা রাখতে পারছি না। ইতিমধ্যে তাপমাত্রা বাড়ার যে হার লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে ২০২০ সালে দুই ডিগ্রির কাছাকাছি তাপমাত্রা পেঁৗছতে পারে এবং আরও ২৫-৩০ বছরে তা ছাড়িয়ে তিন-সাড়ে তিন হয়ে শতাব্দীর শেষ নাগাদ তা ১২ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যেতে পারে।
২০১৩ সালে এ বিষয়ে অনেক আন্তর্জাতিক পর্যালোচনা সভা ও কর্মশালা হবে। ১ মার্চের মধ্যে দেশগুলোকে তাদের মতামত লিখিতভাবে জানাতে বলেছে। এই কাজটি বাংলাদেশ যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে প্রতিপালন করবে বলে আমার বিশ্বাস।
দোহা সম্মেলনের আরেকটি বিষয় কিছু আলোকপাত করি। উন্নত বিশ্ব বলেছিল ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে। দশ বিলিয়ন ডলার করে মোট ৩০ বিলিয়ন ডলার অনুদান হিসেবে উন্নয়নশীল বিশ্বকে দেবে। আমাদের ধারণা ছিল, দ্বিপক্ষীয় সহায়তা হিসেবে যে টাকা দেওয়া হয়, তার অতিরিক্ত হবে। এ টাকা প্রশাসন ও অভিযোজন দুই কাজেই সমান সমান ব্যবহৃত হবে।
এখন আমরা হিসাব করে দেখছি, তারা ১২ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে যেটাকে নতুন বলা যেতে পারে। উন্নত বিশ্ব বলছে, তারা ইতিমধ্যে ৩৪ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। তারা বরং দোষ দিচ্ছেন উন্নয়নশীল বিশ্বকে যে অর্থের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। অর্থাৎ খরচ হচ্ছে না। সংক্ষেপ বলতে গেলে উন্নত বিশ্ব বলছে, টাকা দেওয়া হয়েছে; কিন্তু গ্রহীতাদের খরচ করার ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ প্রকল্প প্রণয়ন হচ্ছে না। আর আমরা বলছি, টাকা কোথায় এবং পুরনো অনুদান নতুন করে জমার খাতায় তোলা হচ্ছে।
তারা আরও বলেছিল, ২০২৫ সাল নাগাদ এই অনুদান বেড়ে ১০০ বিলিয়নে দাঁড়াবে। উন্নয়নশীল বিশ্বের দাবি হচ্ছে, ২০১৩ থেকে ২০২০ সালে বরাদ্দের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ১০০ বিলিয়নে উন্নীত করতে হবে। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো, বিশেষ করে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও ডেনমার্ক স্পষ্টভাবে তাদের অনুদানের ঘোষণা দিয়েছে। উন্নত বিশ্ব ২০২০ সালে ১০০ বিলিয়ন ডলারের কথা ঠিকই বলছে। কিন্তু তা অনুদান হবে_ এ কথা থেকে পিছিয়ে আসছে। তারা এখন প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপের কথা বলছে। অর্থাৎ বেসরকারি খাতের মাধ্যমে টাকার প্রবাহ চালু করার কথা বলছে। একই সঙ্গে এটা নতুন টাকা হবে এবং স্বাভাবিক অনুদানের অতিরিক্ত হবে, তা মানতে রাজি নয়; তবে তারা রাজি হয়েছে। এ বিষয়ে ২০১৩ সালে আরও আলাপ-আলোচনা করে ওই বছরের নভেম্বর নাগাদ সুস্পষ্ট প্রভাব নিয়ে আসবে। এখানে বলে নেওয়া যেতে পারে, ২০১৩ সালে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারসোতে ১১-২৩ নভেম্বর পরবর্তী সম্মেলন হবে।
উন্নত বিশ্বের দাবি অনুযায়ী যে ৩৪ বিলিয়ন ডলার জমা হয়েছে, তা পর্যাপ্ত কিংবা অপ্রতুল। এ বিষয়ে মতামত দেব না। তবে বলব যে, এই টাকার দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থাপনায় খরচ হবে_ এটাই আমার ধারণা। অর্থাৎ প্রত্যেকটি দাতা দেশের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে এই অর্থ লাভ করতে হবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়েন্ট ফান্ডের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত উপযোগী হবে বলে আমার ধারণা। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত যেসব অর্থায়ন হবে, সে জন্য এই কাজটি স্থাপন করে বাংলাদেশ সরকার দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। পদক্ষেপ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। আজ এখানেই শেষ করছি। পরে দোহায় গৃহীত অন্যান্য সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোকপাত করব।
অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত :পরিবেশ বিশেষজ্ঞ; উপাচার্য, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
সম্মেলনটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ৭ ডিসেম্বর শুক্রবার বিকেল নাগাদ। কয়েকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত না হওয়ায় ইনফরমাল কনসালটেশনের নামে দরকষাকষি চলতে থাকে। মাঝরাত পেরিয়ে যায়। ভোরে ঠিক করা হয়। ৮ ডিসেম্বর অর্থাৎ শনিবারেও আলোচনা চলবে। শনিবারের মাঝরাতে গিয়ে আলোচনা শেষ হলো।
জলবায়ু পরিবর্তনের সম্মেলনগুলো যারা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন, তারা জানেন যে সম্মেলনের শেষ দু'দিনে তীব্র বাদানুবাদ হতে থাকে। সিদ্ধান্তগুলো আটকে যায়। এক থেকে দেড় দিন বাড়তি সময় হাতে নেওয়া হয় এবং সব শেষে সমঝোতা হয়। এটি ২০০৭ সালে বালিতে হয়েছে। ২০০৯ সালে কোপেনহেগেন। ২০১০ সালে কানকুনের সভা তার ব্যতিক্রম ছিল না, ২০১১ সালে ডায়বানেও তার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। ২০১২ সালে দোহাতেও একই ঘটনা ঘটেছে। তবে এর আগের বার্ষিক সভাগুলোতে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা ৪০-৪৫ হাজার ছাড়িয়েছিল। এবারে কাতার সরকারের হিসাব অনুযায়ী ১৬ হাজারের কিছু বেশি হয়েছিল। অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যার বড় অংশ হচ্ছে বেসরকারি সংগঠন বা এনজিও প্রতিনিধি। আগের সম্মেলনের তুলনায় দোহাতে সংখ্যা কমায় বোঝা যায় যে, বেসরকারি সংস্থাগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল আশা করেনি।
একজন পাঠক স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন করলে পারেন যে, এত লোক কি আলোচনায় সরাসরি অংশগ্রহণ করে থাকে? উত্তর হচ্ছে, তারা মূলত ওই বৈশ্বিক সম্মেলনগুলোকে উপলক্ষ করে যে বহু সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়, তারা তাতে উপস্থিত থাকেন বা অংশগ্রহণ করেন। আরও কিছু সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় এ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে। সেগুলোতেও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও এনজিও কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। মূল নেগোসিয়েশনে অংশ নিতে হলে সরকারের প্রতিনিধি হতে হয়। ১৯৫টি দেশের পক্ষ থেকে হয়তো হাজার দুয়েক প্রতিনিধি মূল কক্ষে প্রবেশ করেন। আর হয়তো ৩-৪শ' জন সরকারি কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞ ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে একেকটি বিষয়ে দরকষাকষি করে।
ফিরে আসি দোহাতে। শেষ পর্যন্ত কী ছিল। প্রথমত, যে কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে তার জন্য যেসব গ্যাস দায়ী সেসব প্রশাসনের জন্য যে গ্যাসগুলো কমানোর কথা, সেগুলো কমানোর লক্ষ্যে যে আন্তর্জাতিক আইনটি আছে, অর্থাৎ বিষয়টা প্রটোকলের কার্যকারিতার মেয়াদ বৃদ্ধি করা। এই মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২০ সাল পর্যন্ত। তবে ২০০৫ সালে কিয়োটো প্রটোকল প্রণয়নের পরে উন্নত বিশ্বের যে দেশগুলো দায়িত্ব নিয়েছিল, তাদের পক্ষ থেকে কয়েকটি দেশ বাদে বাকি সব দেশ এ দায়িত্ব মাথা পেতে নিয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ দায়িত্ব নেয়নি। আর এবারে জাপান, রাশিয়া এবং নিউজিল্যান্ড দায়িত্ব নেওয়া থেকে বিরত থাকল। কানাডাও কিয়োটো প্রটোকল থেকে বেরিয়ে দায়ভার নিতে অস্বীকার করল। এতে ২০২০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস কমার কোনো সম্ভাবনা থাকল না। তবে কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ ২০২০ সাল পর্যন্ত বর্ধিত হওয়া একটি বিরাট অর্জন। দোহাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, ১৯১৪ সালের মধ্যে নতুন আন্তর্জাতিক আইনির খসড়া তৈরি হবে, যেখানে বিশ্বের সব দেশকে বাধ্য করা হবে গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর জন্য। ২০১৫ সালের ওই খসড়া নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। ২০২০ সালের মধ্যে তা চূড়ান্ত ও কার্যকর হবে! কিয়োটো প্রটোকলের বিভিন্ন বিধান ও অনুশাসনগুলো প্রভাবিত নতুন আইন তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
১৯৯৫ সালে প্রণীত কিয়োটো প্রটোকল কার্যকর হয়েছিল ২০০৫ সালে। তখন কিয়োটো প্রটোকলের অধীনে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর জন্য কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ বিভিন্ন গ্যাস নির্গমনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কেবল আর্থিকভাব উন্নত দেশগুলোর ওপর বর্তমান হয়েছিল। এই দেশগুলোর তালিকা প্রণীত হয়েছিল ১৯৯২ সালে। আজকে ওই দেশগুলো প্রধান উদ্গিরণকারী নয়। উন্নয়নশীল বিশ্বের অগ্রসর দেশগুলো তখন প্রধান উদ্গিরণকারী। সোজা কথায় বলতে গেলে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র হলো প্রধান উদ্গিরণকারী। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশের সমষ্টিগত উদ্গিরণ। কাজেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো চাপ দিচ্ছিল প্রধান উদ্গিরণকারী দেশগুলোকে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। তা অবশ্য সফল হয়নি। তবে ২০২০ সালের মধ্যে যে আইন প্রণীত হওয়ার কথা, তাতে সব দেশের ওপর দায়িত্ব বর্তানোর ব্যবস্থা থাকবে। সব দেশ তা মেনে নিয়েছে। তবে এ জন্য দায়িত্ব বণ্টনের ফর্মুলা বের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যেসব নীতির কথা বলা হচ্ছে তা হলো, কমন বাট ডিফরেনশিয়েটেড রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড রেসপেক্টটিভ রেসপনসিবিলিটি অর্থাৎ দায়িত্ব বণ্টনের ক্ষেত্রে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় কোনো কোনো দেশের দায়িত্ব লাঘব করা যেতে পারে। অনুন্নত বিশ্বের উন্নয়নের আশঙ্কা যাতে কোনোভাবে অবদমিত না হয়, সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা হবে।
তবে দোহাতে আবার বলা হলো, বৈশ্বিক উষ্ণতা কোনোভাবে দুই ডিগ্রির ওপর উঠতে দেওয়া হবে না। আমি কেন যেন এই আশ্বাস বাণীর ওপর ভরসা রাখতে পারছি না। ইতিমধ্যে তাপমাত্রা বাড়ার যে হার লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে ২০২০ সালে দুই ডিগ্রির কাছাকাছি তাপমাত্রা পেঁৗছতে পারে এবং আরও ২৫-৩০ বছরে তা ছাড়িয়ে তিন-সাড়ে তিন হয়ে শতাব্দীর শেষ নাগাদ তা ১২ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যেতে পারে।
২০১৩ সালে এ বিষয়ে অনেক আন্তর্জাতিক পর্যালোচনা সভা ও কর্মশালা হবে। ১ মার্চের মধ্যে দেশগুলোকে তাদের মতামত লিখিতভাবে জানাতে বলেছে। এই কাজটি বাংলাদেশ যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে প্রতিপালন করবে বলে আমার বিশ্বাস।
দোহা সম্মেলনের আরেকটি বিষয় কিছু আলোকপাত করি। উন্নত বিশ্ব বলেছিল ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে। দশ বিলিয়ন ডলার করে মোট ৩০ বিলিয়ন ডলার অনুদান হিসেবে উন্নয়নশীল বিশ্বকে দেবে। আমাদের ধারণা ছিল, দ্বিপক্ষীয় সহায়তা হিসেবে যে টাকা দেওয়া হয়, তার অতিরিক্ত হবে। এ টাকা প্রশাসন ও অভিযোজন দুই কাজেই সমান সমান ব্যবহৃত হবে।
এখন আমরা হিসাব করে দেখছি, তারা ১২ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে যেটাকে নতুন বলা যেতে পারে। উন্নত বিশ্ব বলছে, তারা ইতিমধ্যে ৩৪ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। তারা বরং দোষ দিচ্ছেন উন্নয়নশীল বিশ্বকে যে অর্থের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। অর্থাৎ খরচ হচ্ছে না। সংক্ষেপ বলতে গেলে উন্নত বিশ্ব বলছে, টাকা দেওয়া হয়েছে; কিন্তু গ্রহীতাদের খরচ করার ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ প্রকল্প প্রণয়ন হচ্ছে না। আর আমরা বলছি, টাকা কোথায় এবং পুরনো অনুদান নতুন করে জমার খাতায় তোলা হচ্ছে।
তারা আরও বলেছিল, ২০২৫ সাল নাগাদ এই অনুদান বেড়ে ১০০ বিলিয়নে দাঁড়াবে। উন্নয়নশীল বিশ্বের দাবি হচ্ছে, ২০১৩ থেকে ২০২০ সালে বরাদ্দের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ১০০ বিলিয়নে উন্নীত করতে হবে। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো, বিশেষ করে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও ডেনমার্ক স্পষ্টভাবে তাদের অনুদানের ঘোষণা দিয়েছে। উন্নত বিশ্ব ২০২০ সালে ১০০ বিলিয়ন ডলারের কথা ঠিকই বলছে। কিন্তু তা অনুদান হবে_ এ কথা থেকে পিছিয়ে আসছে। তারা এখন প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপের কথা বলছে। অর্থাৎ বেসরকারি খাতের মাধ্যমে টাকার প্রবাহ চালু করার কথা বলছে। একই সঙ্গে এটা নতুন টাকা হবে এবং স্বাভাবিক অনুদানের অতিরিক্ত হবে, তা মানতে রাজি নয়; তবে তারা রাজি হয়েছে। এ বিষয়ে ২০১৩ সালে আরও আলাপ-আলোচনা করে ওই বছরের নভেম্বর নাগাদ সুস্পষ্ট প্রভাব নিয়ে আসবে। এখানে বলে নেওয়া যেতে পারে, ২০১৩ সালে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারসোতে ১১-২৩ নভেম্বর পরবর্তী সম্মেলন হবে।
উন্নত বিশ্বের দাবি অনুযায়ী যে ৩৪ বিলিয়ন ডলার জমা হয়েছে, তা পর্যাপ্ত কিংবা অপ্রতুল। এ বিষয়ে মতামত দেব না। তবে বলব যে, এই টাকার দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থাপনায় খরচ হবে_ এটাই আমার ধারণা। অর্থাৎ প্রত্যেকটি দাতা দেশের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে এই অর্থ লাভ করতে হবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়েন্ট ফান্ডের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত উপযোগী হবে বলে আমার ধারণা। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত যেসব অর্থায়ন হবে, সে জন্য এই কাজটি স্থাপন করে বাংলাদেশ সরকার দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। পদক্ষেপ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। আজ এখানেই শেষ করছি। পরে দোহায় গৃহীত অন্যান্য সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোকপাত করব।
অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত :পরিবেশ বিশেষজ্ঞ; উপাচার্য, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
No comments