মিডিয়া ভাবনা-টিভি চ্যানেলে শিশুদের প্রতিযোগিতা by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

১৯ সেপ্টেম্বর রাতে খুব জাঁকজমকের সঙ্গে শেষ হলো কলকাতার ‘জি বাংলা’ টিভি চ্যানেলের রিয়েলিটি শো ‘সা-রে-গা-মা-পা লিটল চ্যাম্প’। শ্রেষ্ঠাংশু দত্ত নামে একটা বাচ্চা ছেলে এবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আগ্রহী পাঠকেরা এই প্রতিযোগিতার টুকিটাকি সব খবরই জানেন।


এখানে তা বলার দরকার নেই। এই প্রতিযোগিতার সূত্র ধরে অন্য একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করব।
ঢাকায়ও কয়েকটি টিভি চ্যানেল শিশুদের গান, নাচ, আবৃত্তির নানা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। ভারতের টিভি চ্যানেলে যা যা হয়, আমাদেরও তা করতে হবে। এটা অনেকটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব নকলবাজ প্রযোজক আবার টেলপে ‘পরিকল্পনাকারী’ হিসেবে নিজের নাম দিতেও সংকোচ বোধ করেন না। সংবাদপত্রে নকলবাজদের ছবি ও খবর ছাপা হয় ‘পরিকল্পক’ হিসেবে। অনেকেরই মনে হয় কাণ্ডজ্ঞান উবে যাচ্ছে।
‘জি বাংলা’র ‘সা-রে-গা-মা-পা’ প্রতিযোগিতা যাঁরা নিয়মিত দেখেছেন, তাঁরা জানেন কী অসাধারণ গানের গলা পশ্চিমবঙ্গের এই ছেলেমেয়েদের! এত অল্প বয়সে তারা কীভাবে গানের এই কাজ ও সুর রপ্ত করেছে তা শুনে বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়। শুধু কি বাংলা গান? হিন্দি গানের কারুকাজময় সুর ও কথা কী চমৎকারভাবে যে তারা কণ্ঠে ধারণ করেছে, তা সত্যিই অবাক করার মতো। এসব ছেলেমেয়ের বয়স পাঁচ থেকে ১২ বছরের মধ্যে হবে। এত কাঁচা বয়সে এত সুন্দর গান তারা কীভাবে গায়, তা বিস্ময়ের ব্যাপার। তাদের বয়স এতই কম যে সাধনা করার মতো পর্যাপ্ত সময়ও তারা কীভাবে পেয়েছে তাও একটা প্রশ্ন বটে। অথচ গান শুনে মনে হয়, কী তৈরি গলা!
অনুষ্ঠানে অনেকের মা-বাবাও আসতেন। তাঁদের অনেকে ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে মন্তব্যও করেছেন। তাঁদের অনেককে দেখে মনে হয়েছে, তাঁরা মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তের মানুষ। এই কঠিন জীবনসংগ্রামের মধ্যে তাঁরা ছেলেমেয়েদের গান শিখিয়েছেন, যা সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে অনেকে বিশ্বাস করেন না জানি, তবু আমি বলব, এই প্রতিভা অনেকটাই সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। শুধু সাধনায় এই গলা তৈরি হওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে এত অল্প বয়সে। জন্মগত প্রতিভার সঙ্গে নিজের নিষ্ঠা ও সাধনার সম্মিলনে তৈরি হয়েছে এই শিশুপ্রতিভাগুলো।
‘সা-রে-গা-মা-পা’ প্রতিযোগিতার তিনজন বিচারকের মতামত ও মন্তব্যও ছিল বেশ শিক্ষণীয় ও উপভোগ্য। তাঁরা খুব কমই অপ্রয়োজনীয় কথা বলেছেন। যা বলেছেন তা মূল্যবান। তিনজন বিচারকই প্রায় সব সময়ই উচ্ছ্বসিত ছিলেন। কয়েকজন শিশুশিল্পীর গানের পর তাঁরা যেসব প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেছিলেন তা অনেক সময় বড় শিল্পীদের বেলায়ও করা হয় না। আমরা যারা দর্শক-শ্রোতা, তাদের কাছে মন্তব্যগুলো তেমন অতিশয়োক্তি মনে হয়নি। কারণ, এই ছেলেমেয়েগুলো সত্যিই বিস্ময়কর প্রতিভা।
শিশুশিল্পীদের নিয়ে ঢাকার কয়েকটি টিভি চ্যানেলেও প্রতিযোগিতা হয়েছে। সরকারি ‘বিটিভি’ ছিল এ ধরনের প্রতিযোগিতার পথিকৃৎ। অনেক বছর ধরে সেই প্রতিযোগিতা আর হয় না। আজকের বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী সেই প্রতিযোগিতার (নতুন কুঁড়ি) সৃষ্টি। ‘বিটিভি’ সেই বার্ষিক প্রতিযোগিতা আরও বর্ণাঢ্যভাবে আবার শুরু করতে পারে।
কলকাতা ও ঢাকার বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের শিশুশিল্পীদের সংগীত প্রতিযোগিতা দেখে আমার দুটি বিষয় মনে হয়েছে, যা আলোচনা করার জন্য এই নিবন্ধের অবতারণা। শিশুদের নিয়ে যাঁরা কাজ করেন ও যাঁরা টিভি মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত, তাঁরা এ ব্যাপারে আলোচনা করতে পারেন। আলোচনার মাধ্যমে আমরা হয়তো একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারব।
আমার প্রথম বক্তব্য হলো, ছোটদের দিয়ে আমরা বড়দের প্রেম-ভালোবাসার গান গাওয়াব কি না? গাওয়ানো উচিত কি না? বড়দের গানের কথা ও ভাব উপলব্ধি করার মতো বয়স বা মনের অবস্থা তার হয়েছে কি না? যদি তা না হয়ে থাকে তাহলে পুরো গানটিই তার এক ধরনের মুখস্থবিদ্যা। গানের কথা আত্মস্থ করে সে গান করছে না। সেটা সংগীতশিল্পীর জন্য কতটা সমর্থনযোগ্য? এই প্রশ্নগুলোর মীমাংসা হওয়া দরকার।
একই অভিযোগ করা যায় নানা প্রতিযোগিতায় (টিভিসহ) শিশুনৃত্যশিল্পীদের বেলায়ও। তারা যেসব গানের সঙ্গে নৃত্য করে, তার বাণী কতটা শিশুতোষ?
আয়োজক বা উদ্যোক্তারা প্রশ্ন করতে পারেন: ‘শিশুরা যদি শিশুতোষ গান না করে তাহলে আমরা কী করতে পারি?’ এটা প্রশ্ন বটে, তবে খুব ভালো প্রশ্ন নয়। কারণ, এর উত্তর খুব সোজা। আয়োজকেরা প্রতিযোগিতার শর্তের মধ্যেই বলতে পারেন: ‘শিশুশিল্পীদের অবশ্যই শিশুতোষ গান গাইতে হবে বা শিশুতোষ গানের সঙ্গে নাচ করতে হবে। প্রয়োজন হলে ছেলেমেয়েদের প্রতিযোগিতার বহু আগেই তাদের গান অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে।’
অনেক আয়োজক হয়তো বলবেন: ‘এত শিশুতোষ গান ছেলেমেয়েরা কোথায় পাবে?’ হ্যাঁ, এটা একটা ভালো প্রশ্ন। চাহিদার তুলনায় শিশুতোষ গান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ কোথাও বেশি রচিত হয়নি। কিন্তু যা আছে তাও কি ছেলেমেয়েরা গাইছে? ছেলেমেয়েরা কি সেসব গানের খোঁজ করেছে? এখানে আমাদের অর্থাৎ বড়দের একটা বড় ব্যর্থতা স্বীকার করতেই হবে। আমাদের গীতিকার বা লেখকেরা ছোটদের জন্য বেশি গান লেখেননি। এ ব্যাপারে কোনো পরিকল্পিত উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। আমাদের ‘শিশু একাডেমী’রও এই ব্যর্থতা স্বীকার করতে হবে। শিশু একাডেমীর কাজ এগুলোই হওয়া উচিত ছিল। এ প্রসঙ্গে আমি প্রস্তাব করব, ‘বাংলাদেশ শিশু একাডেমী’ অবিলম্বে দুটো কাজে হাত দিতে পারে। ১. বাংলা ভাষায় যত শিশুতোষ গান রয়েছে তার নির্বাচিত গানের একটা সংকলন প্রকাশ করা। ২. শিশুসাহিত্যিক, গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক, শিল্পী ও গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে শিশুদের জন্য নতুন গান রচনার এক প্রকল্প গ্রহণ করা।
এ দুটো কাজ করা খুব জরুরি এ জন্য যে টিভি চ্যানেলের কল্যাণে দেশব্যাপী স্কুলে স্কুলে, বাড়িতে বাড়িতে ছেলেমেয়েদের গান বা নাচ শেখানোর একটা আগ্রহ ছড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারা উপযুক্ত গান পাচ্ছে না। তাই ছেলেমেয়েরা ‘রূপবানে নাচে কোমর দুলাইয়া’-জাতীয় গান করছে বা গানের সঙ্গে নাচ করছে। টিভি চ্যানেলে নানা শিশু প্রতিযোগিতায় এসব গানও গাওয়া হয়। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। কাজেই শিশুদের নিরুৎসাহিত বা বাধা দেওয়ার আগে তাদের সামনে শিশুতোষ গানের সংকলন তুলে ধরতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুলের শিশুতোষ গান বা ছড়ার অভাব নেই। এগুলোও পৃথক দুটি সংকলন হতে পারে।
শিশু একাডেমীর আর্থিক সংকট থাকলে এ ধরনের সংকলন প্রাইভেট প্রকাশকও প্রকাশ করতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতি ও সম্পাদনার কাজটি শিশু একাডেমীর তত্ত্বাবধানে হলে ভালো হয়। এসব কাজে ‘কচি-কাঁচার মেলা’ ও ‘খেলাঘর’-এর সহায়তাও নেওয়া যায়।
আমার দ্বিতীয় বক্তব্য হলো, ঢাকার একটি টিভি চ্যানেলে শিশুদের ‘অলরাউন্ডার’ হওয়ার জন্য যে প্রতিযোগিতা করেছে, তা সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ, এটা খুব কঠিন কাজ। প্রায় অসম্ভব বলা যায়। ঢাকার টিভি চ্যানেলটি শিশুদের মধ্যে ‘অলরাউন্ডার’ হওয়ার একটা অসুস্থ স্বপ্ন ঢুকিয়ে দিয়েছে। কোমলমতি ছেলেমেয়ে ও তাদের অনেক অসচেতন মা-বাবাও ভাবছেন: ছেলেমেয়েকে এখন ‘অলরাউন্ডার’ বানাতে হবে। গান, নাচ, আবৃত্তি, ছবি আঁকা সবকিছুতে তাকে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হতে হবে। নিদেনপক্ষে সবকিছু তাকে জানতে হবে। পারতে হবে। ওদিকে স্কুলের পড়াশোনা ও পরীক্ষার চাপ তো আছেই, যা টিভির পর্দায় দেখা যাচ্ছে না। স্কুলের পড়াশোনা, পরীক্ষা, গান, নাচ, আবৃত্তি, ছবি আঁকা সবকিছু আয়ত্ত করা, বিশেষ বিশেষ মাস্টারের কাছে তালিম নেওয়া—কী যে ধুন্ধুমার কাণ্ড হচ্ছে অনেক ছেলেমেয়ের ওপর!!! শিশু মনস্তত্ত্ববিরোধী এ ধরণের অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেশের বহু শিশু ও তাদের মা-বাবাকে বিভ্রান্ত করেছে। এ ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা যেন কোনো টিভি চ্যানেলে আর প্রচারিত হতে না পারে এ জন্য তথ্য মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
‘অলরাউন্ডার’ শব্দটি ব্যবহার না করে প্রতিটি ক্ষেত্রে পৃথক প্রতিযোগিতা হতে পারত। একজন শিশুকে কোনো একটি ক্ষেত্রে পারদর্শী হওয়ার অনুপ্রেরণা দেওয়াই ভালো হবে। ছাত্রজীবনে সংস্কৃতির সাধনার সময় বেশি পাওয়া যায় না। একটি ক্ষেত্রে সাধনা করলে সে যেমন ভালো শিখতে পারবে, তেমনি একটি দিকেই তার ধ্যান-জ্ঞান নিবদ্ধ রাখতে পারবে। বড় হওয়ার পর অনেক মানুষই নানা কিছুর প্রতি আগ্রহী হয়। নানা কিছু শেখে। কিন্তু শিল্প-সাহিত্যে একসঙ্গে নানা ক্ষেত্রে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেন বা সিদ্ধি অর্জন করেন এমন লোকের সংখ্যা খুব কম। তাঁরা বিরল প্রতিভাবান। আমাদের সাহিত্যে সৈয়দ শামসুল হক ও সদ্য প্রয়াত আবদুল মান্নান সৈয়দ ছাড়া তৃতীয় নাম বলা খুব কঠিন। শিল্পের বিভিন্ন শাখায় সফল সব্যসাচী শিল্পী প্রায় নেই বললেই চলে। এতে কী প্রমাণ হয়? শিল্প-সাহিত্যে ‘অলরাউন্ডার’ হওয়া স্বাভাবিক প্রবণতা নয়।
শিশু-কিশোরদের শিল্প, সংস্কৃতির চর্চায় ও সাধনায় কলকাতা ও ঢাকার টিভি চ্যানেলগুলো নানা প্রতিযোগিতা ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। এত এত বিস্ময়কর প্রতিভার সঙ্গে লাখ লাখ দর্শকের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, এটা কম কথা নয়। কিন্তু এসব প্রতিযোগিতা আরও চিন্তাভাবনা করে আয়োজন করা উচিত। এমন কিছু করা উচিত নয়, যাতে প্রণোদনার পরিবর্তে হিতে বিপরীত হয়। টিভি একটি জনপ্রিয় ও শক্তিশালী মাধ্যম। এর একটি ভুল পদক্ষেপ সমাজে অনেক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।

No comments

Powered by Blogger.