জনপ্রশাসন-অধরাই রয়ে যাচ্ছে সুশাসন by আলী ইমাম মজুমদার
যাঁরা দেশের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাঁরাও কোনো কোনো সময় অবিচারের শিকার হন। কখনো পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে, কখনো বা কর্মহীন বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা সংক্ষেপে ওএসডি হয়ে। পদোন্নতিবঞ্চিত হলে আইনের আশ্রয় নেওয়া চলে বটে। তবে তা এত ধীরগতির যে এর মধ্যে আরও কয়েক দফা পদোন্নতি ঘটে যায়।
কারও কারও চাকরির মেয়াদও যায় শেষ হয়ে। তাই তিনি রাস্তায় সহজে কেউ যেতে উৎসাহ বোধ করেন না। আর ওএসডি হলে আইনের আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ আছে বলেও মনে হয় না।
ওএসডি করার প্রচলন নতুন বা সর্বক্ষেত্রে নেতিবাচক নয়। তিন মাসের অধিক সময়ের জন্য কোনো প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত কর্মকর্তাকে স্বীয় পদ থেকে প্রত্যাহার করে ওএসডি করা হয় চাকরির ধারাবাহিকতা রক্ষা ও বেতনভাতাদি পরিশোধের সুবিধার্থে। আর হালে পদসংখ্যার অধিক পদোন্নতি দিয়ে পদায়নের সুযোগ সৃষ্টি করতেও কিছুদিন ওএসডি রাখার আবশ্যকতা থাকতে পারে। তেমনি আবশ্যকতা থাকতে পারে গুরুতর অভিযোগ তদন্তাধীন সময়কালে কাউকে ওএসডি রাখা। পাশাপাশি ওএসডি করা হচ্ছে সরকারের নেক নজরে নেই এমন অনেক কর্মকর্তার। রেওয়াজটি দীর্ঘকালের। তবে গত দুই দশকের অধিক সময়কালে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে এর হার ও সময়কাল। এখন তো তিন বছরের অধিক সময় ওএসডি আছেন বেশ কিছু কর্মকর্তা। বিস্ময়ের বিষয় তাঁদের কেউ কেউ আবার দু-একটি পদোন্নতিও পান। তবে পান না পদ। থেকে যান ওএসডি। জানা যায়, সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব, সহকারী সচিব—সব মিলে প্রায় ৪৫০ জন কর্মকর্তা বর্তমানে ওএসডি আছেন। সংখ্যার কিছু হেরফের হতে পারে। তবে বিষয়টি যে জটিল আকার ধারণ করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
একজন ওএসডিকে বেতনভাতা, আবাসন এবং প্রাধিকারপ্রাপ্ত হলে চালক ও জ্বালানিসহ গাড়ি, টেলিফোন ইত্যাদিসহ সুযোগ সরকারকে দিতে হচ্ছে। সময়ান্তরে পেনশনও দিতে হয়। এতে ব্যয় হচ্ছে জনগণের করের রাশি রাশি টাকা। কিন্তু নেওয়া হচ্ছে না তাঁদের সেবা। হতে পারে এ ধরনের কর্মকর্তাদের গুটি কয়েকজন সাবেক সরকারের সময়ে অনেকটা রাজনৈতিক ভূমিকায় ছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ আজ যেসব কর্মকর্তা প্রশাসনের কলকাঠি নাড়ছেন, তাঁদের পদোন্নতিবঞ্চিত বা ওএসডি করার ক্ষেত্রে ভূমিকাও রাখতে পারেন। এ ধরনের সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকলে তো বিভাগীয় মামলা করে শাস্তি দেওয়ার সুযোগও রয়েছে। তবে জোর দিয়ে বলা চলে, এমন কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না এ ধরনের বেশ কিছু কর্মকর্তা এ দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছেন; অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তি রোষে। এসব ওএসডি কর্মকর্তাকে একটি অংশ যথেষ্ট মেধাবী এবং যথাযথ পদোন্নতি ও পদায়ন করা হলে সরকার লাভবান হতো। আগেই উল্লেখ করেছি, ১৯৯১-এর পর থেকে সরকারপরম্পরা এটা ঘটে চলেছে।
আগের এরা করেছে বলে আমরাও করব এবং আরও বেশি করে করব, এমন মনোভাব যদি চলতেই থাকে, তবে তো দলীয়করণমুক্ত পেশাদারি প্রশাসন গড়ে তোলার প্রধান দুটি দলের যে নির্বাচনী অঙ্গীকার তা যথার্থ নয়। শুধু তা-ই নয়, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে যাঁরা এ ধরনের বঞ্চনার শিকার হয়েছিলেন, তাঁদের অনেককে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে যতটুকু সম্ভব ক্ষতিপূরণ করা হয়েছে, অন্যদের ক্ষতি না করে।
প্রায় এক দশক ধরে আরেক নীরব যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। কাউকে কোনো পদ থেকে প্রত্যাহার করে ওএসডিও না করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরবর্তী পদায়নের জন্য ন্যস্ত করে রাখা হয়। জানা যায়, বর্তমানে তাঁদের সংখ্যাও শয়ের কাছাকাছি। এভাবে কোনো কোনো কর্মকর্তাকে সাত-আট মাস রাখার কথাও জানা গেছে। তাঁরা বেতনভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পান না, এ ধরনের কোনো পদ নেই বলে। তাই তাঁরা পদায়ন দূরের কথা, ওএসডি হওয়ার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান। কী নির্মম পরিহাস! এ ধরনের ন্যস্ত করা কোনো বিধির আওতায়ই আসে না। অতি অল্প সময়ের জন্য যদি করাও হয়, দ্রুত পদায়নই তো স্বাভাবিক বিষয় হতে পারে।
ইদানীং প্রাধিকারপ্রাপ্ত ওএসডি কর্মকর্তাদের গাড়ির সুবিধা (যাঁরা আগে পেয়েছেন, তাঁরা ব্যতীত) কর্মরত কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে পরে বিবেচিত হচ্ছে বলে জানা যায়। তাঁরা শখ করে ওএসডি হননি এবং অনেকেই কোনো দোষই করেছেন এমনটাও জানা যায় না। পরিবহন পুলে গাড়ির সংখ্যা সীমিত, এটা বাস্তব সত্য। এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ণয়ে জ্যেষ্ঠতাকে প্রাধান্য দেওয়াই নৈতিক হবে।
একটি বিষয় ভেবে দেখার দাবি রাখে। যাঁদের কর্মহীন করে রাখা হয়েছে, তাঁদের মনোবলে পড়ছে ভাটা। ব্যবহার না হলে ইস্পাতও ধার হারিয়ে ফেলে। কর্মজীবনে ধারাবাহিকতা না থাকায় তাঁরা সরকারের বিভিন্ন সময় জারি করা বিধিবিধান বা আদেশ সম্পর্কে অবগত থাকছে না। কোনো একসময়ে পদায়ন করা হলে তাঁরা সরকারি কাজ চালাতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই হোঁচট খাবেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সরকার বা প্রকৃত অর্থে করদাতা জনগণ। কর্মকর্তারা বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করে অভিজ্ঞতার ভান্ডার ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধ করে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যে অবদান রাখার কথা, তা রাখতে না পারলে ক্ষতিগ্রস্ত তো জনগণই হবে। অথচ এ অবস্থার জন্য তারা আদৌ দায়ী নয়। দায়ী আমাদের প্রশাসনিক অপসংস্কৃতি।
পদোন্নতি-বঞ্চনার কথা বহুবার বিভিন্ন নিবন্ধে আলোচিত হয়েছে। সবাই পদোন্নতি পাবেন না, এটা সত্যি কথা। আর পদোন্নতি বিধিমালার নির্ধারিত নম্বর ছাড়াও যুগ্ম সচিব থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ে ‘সার্বিক বিবেচনায় উপযুক্ত’ বিবেচিত হতে হবে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের কাছে। এ বিধানটি যৌক্তিকও বটে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর অপব্যবহার হচ্ছে। অধিকতর যোগ্যকে বাদ দেওয়া হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই দলীয় বিবেচনা সামনে রেখে। কেউ কেউ অতিক্রান্ত হয়েছেন চার-পাঁচ বারও। প্রথম আলোর ২৩ এপ্রিলের একটি খবর অনুসারে, পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তার সংখ্যা এখন প্রায় ৫০০। গত এক দশকেরও অধিক সময় বিষয়টি ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর রূপ নিচ্ছে। আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়, কাদের বাদ দিতে হবে সে তালিকা তৈরিতে মূল ভূমিকা রাখছেন বলে জানা যায় তাঁদেরই কিছুসংখ্যক সহকর্মী। হয়তো বা তাঁরাও অতীতে এভাবেই বঞ্চিত হয়েছিলেন।
পদোন্নতিবঞ্চিত, ওএসডি বা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ন্যস্ত কর্মকর্তারা সামাজিক ও পারিবারিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন। কেউ কেউ তাঁদের অপরাধী বা অক্ষমও মনে করেন। এতে তাঁরা একটা হীনম্মন্যতায়ও ভোগেন। এ অবস্থা তাঁদের ভবিষ্যতে কাজের ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
একুশ শতকের বিশ্বে কোনো দেশই শুধু আপন বলয়ে আবদ্ধ থাকতে পারে না। তাদের প্রতিনিয়ত প্রতিটি ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় যোগসূত্র রাখতে হয়। আর এর প্রয়োজনীয়তা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছে। সেসব দেনদরবারে কর্মকর্তাদের একটি বড় ভূমিকা থাকে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের মৌলিক দিকনির্দেশনার তাঁদেরই খুঁটিনাটি চূড়ান্ত করতে হয়। সে ক্ষেত্রে মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই। সব দেশই তার সুবিধাটি বড় করে দেখে। আমরাও তা চাই এবং চাইব। তবে পেতে হলে তৈরি করতে হবে একটি দক্ষ ও অরাজনৈতিক জনপ্রশাসন।
কিন্তু বাস্তবে দেখছি এর বিপরীত চিত্র। দলীয়করণমুক্ত প্রশাসনের অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় বসে সবাই জোরদারভাবে দলীয়করণেই মনোযোগ দেয়। ক্ষতির শিকার হন অনেক দক্ষ ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তা। আর আগেই বলেছি, বড় ক্ষতি হয় করদাতা জনগণের। তাঁদের ক্ষতির বিচারটা কে করবে? এ সংস্কৃতির অবসান না ঘটলে সুশাসন তো অধরাই থেকে যাবে। যে সুশাসনের অঙ্গীকার রাজনৈতিক দলগুলো বারবার করছে, তা বাস্তবায়নে অনীহা তাদের আপাত লাভ হলেও দীর্ঘমেয়াদি দেশের ক্ষতির সঙ্গে তাদেরও ক্ষতি হয়ে যাবে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
ওএসডি করার প্রচলন নতুন বা সর্বক্ষেত্রে নেতিবাচক নয়। তিন মাসের অধিক সময়ের জন্য কোনো প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত কর্মকর্তাকে স্বীয় পদ থেকে প্রত্যাহার করে ওএসডি করা হয় চাকরির ধারাবাহিকতা রক্ষা ও বেতনভাতাদি পরিশোধের সুবিধার্থে। আর হালে পদসংখ্যার অধিক পদোন্নতি দিয়ে পদায়নের সুযোগ সৃষ্টি করতেও কিছুদিন ওএসডি রাখার আবশ্যকতা থাকতে পারে। তেমনি আবশ্যকতা থাকতে পারে গুরুতর অভিযোগ তদন্তাধীন সময়কালে কাউকে ওএসডি রাখা। পাশাপাশি ওএসডি করা হচ্ছে সরকারের নেক নজরে নেই এমন অনেক কর্মকর্তার। রেওয়াজটি দীর্ঘকালের। তবে গত দুই দশকের অধিক সময়কালে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে এর হার ও সময়কাল। এখন তো তিন বছরের অধিক সময় ওএসডি আছেন বেশ কিছু কর্মকর্তা। বিস্ময়ের বিষয় তাঁদের কেউ কেউ আবার দু-একটি পদোন্নতিও পান। তবে পান না পদ। থেকে যান ওএসডি। জানা যায়, সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব, সহকারী সচিব—সব মিলে প্রায় ৪৫০ জন কর্মকর্তা বর্তমানে ওএসডি আছেন। সংখ্যার কিছু হেরফের হতে পারে। তবে বিষয়টি যে জটিল আকার ধারণ করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
একজন ওএসডিকে বেতনভাতা, আবাসন এবং প্রাধিকারপ্রাপ্ত হলে চালক ও জ্বালানিসহ গাড়ি, টেলিফোন ইত্যাদিসহ সুযোগ সরকারকে দিতে হচ্ছে। সময়ান্তরে পেনশনও দিতে হয়। এতে ব্যয় হচ্ছে জনগণের করের রাশি রাশি টাকা। কিন্তু নেওয়া হচ্ছে না তাঁদের সেবা। হতে পারে এ ধরনের কর্মকর্তাদের গুটি কয়েকজন সাবেক সরকারের সময়ে অনেকটা রাজনৈতিক ভূমিকায় ছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ আজ যেসব কর্মকর্তা প্রশাসনের কলকাঠি নাড়ছেন, তাঁদের পদোন্নতিবঞ্চিত বা ওএসডি করার ক্ষেত্রে ভূমিকাও রাখতে পারেন। এ ধরনের সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকলে তো বিভাগীয় মামলা করে শাস্তি দেওয়ার সুযোগও রয়েছে। তবে জোর দিয়ে বলা চলে, এমন কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না এ ধরনের বেশ কিছু কর্মকর্তা এ দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছেন; অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তি রোষে। এসব ওএসডি কর্মকর্তাকে একটি অংশ যথেষ্ট মেধাবী এবং যথাযথ পদোন্নতি ও পদায়ন করা হলে সরকার লাভবান হতো। আগেই উল্লেখ করেছি, ১৯৯১-এর পর থেকে সরকারপরম্পরা এটা ঘটে চলেছে।
আগের এরা করেছে বলে আমরাও করব এবং আরও বেশি করে করব, এমন মনোভাব যদি চলতেই থাকে, তবে তো দলীয়করণমুক্ত পেশাদারি প্রশাসন গড়ে তোলার প্রধান দুটি দলের যে নির্বাচনী অঙ্গীকার তা যথার্থ নয়। শুধু তা-ই নয়, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে যাঁরা এ ধরনের বঞ্চনার শিকার হয়েছিলেন, তাঁদের অনেককে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে যতটুকু সম্ভব ক্ষতিপূরণ করা হয়েছে, অন্যদের ক্ষতি না করে।
প্রায় এক দশক ধরে আরেক নীরব যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। কাউকে কোনো পদ থেকে প্রত্যাহার করে ওএসডিও না করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরবর্তী পদায়নের জন্য ন্যস্ত করে রাখা হয়। জানা যায়, বর্তমানে তাঁদের সংখ্যাও শয়ের কাছাকাছি। এভাবে কোনো কোনো কর্মকর্তাকে সাত-আট মাস রাখার কথাও জানা গেছে। তাঁরা বেতনভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পান না, এ ধরনের কোনো পদ নেই বলে। তাই তাঁরা পদায়ন দূরের কথা, ওএসডি হওয়ার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান। কী নির্মম পরিহাস! এ ধরনের ন্যস্ত করা কোনো বিধির আওতায়ই আসে না। অতি অল্প সময়ের জন্য যদি করাও হয়, দ্রুত পদায়নই তো স্বাভাবিক বিষয় হতে পারে।
ইদানীং প্রাধিকারপ্রাপ্ত ওএসডি কর্মকর্তাদের গাড়ির সুবিধা (যাঁরা আগে পেয়েছেন, তাঁরা ব্যতীত) কর্মরত কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে পরে বিবেচিত হচ্ছে বলে জানা যায়। তাঁরা শখ করে ওএসডি হননি এবং অনেকেই কোনো দোষই করেছেন এমনটাও জানা যায় না। পরিবহন পুলে গাড়ির সংখ্যা সীমিত, এটা বাস্তব সত্য। এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ণয়ে জ্যেষ্ঠতাকে প্রাধান্য দেওয়াই নৈতিক হবে।
একটি বিষয় ভেবে দেখার দাবি রাখে। যাঁদের কর্মহীন করে রাখা হয়েছে, তাঁদের মনোবলে পড়ছে ভাটা। ব্যবহার না হলে ইস্পাতও ধার হারিয়ে ফেলে। কর্মজীবনে ধারাবাহিকতা না থাকায় তাঁরা সরকারের বিভিন্ন সময় জারি করা বিধিবিধান বা আদেশ সম্পর্কে অবগত থাকছে না। কোনো একসময়ে পদায়ন করা হলে তাঁরা সরকারি কাজ চালাতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই হোঁচট খাবেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সরকার বা প্রকৃত অর্থে করদাতা জনগণ। কর্মকর্তারা বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করে অভিজ্ঞতার ভান্ডার ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধ করে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যে অবদান রাখার কথা, তা রাখতে না পারলে ক্ষতিগ্রস্ত তো জনগণই হবে। অথচ এ অবস্থার জন্য তারা আদৌ দায়ী নয়। দায়ী আমাদের প্রশাসনিক অপসংস্কৃতি।
পদোন্নতি-বঞ্চনার কথা বহুবার বিভিন্ন নিবন্ধে আলোচিত হয়েছে। সবাই পদোন্নতি পাবেন না, এটা সত্যি কথা। আর পদোন্নতি বিধিমালার নির্ধারিত নম্বর ছাড়াও যুগ্ম সচিব থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ে ‘সার্বিক বিবেচনায় উপযুক্ত’ বিবেচিত হতে হবে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের কাছে। এ বিধানটি যৌক্তিকও বটে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর অপব্যবহার হচ্ছে। অধিকতর যোগ্যকে বাদ দেওয়া হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই দলীয় বিবেচনা সামনে রেখে। কেউ কেউ অতিক্রান্ত হয়েছেন চার-পাঁচ বারও। প্রথম আলোর ২৩ এপ্রিলের একটি খবর অনুসারে, পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তার সংখ্যা এখন প্রায় ৫০০। গত এক দশকেরও অধিক সময় বিষয়টি ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর রূপ নিচ্ছে। আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়, কাদের বাদ দিতে হবে সে তালিকা তৈরিতে মূল ভূমিকা রাখছেন বলে জানা যায় তাঁদেরই কিছুসংখ্যক সহকর্মী। হয়তো বা তাঁরাও অতীতে এভাবেই বঞ্চিত হয়েছিলেন।
পদোন্নতিবঞ্চিত, ওএসডি বা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ন্যস্ত কর্মকর্তারা সামাজিক ও পারিবারিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন। কেউ কেউ তাঁদের অপরাধী বা অক্ষমও মনে করেন। এতে তাঁরা একটা হীনম্মন্যতায়ও ভোগেন। এ অবস্থা তাঁদের ভবিষ্যতে কাজের ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
একুশ শতকের বিশ্বে কোনো দেশই শুধু আপন বলয়ে আবদ্ধ থাকতে পারে না। তাদের প্রতিনিয়ত প্রতিটি ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় যোগসূত্র রাখতে হয়। আর এর প্রয়োজনীয়তা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছে। সেসব দেনদরবারে কর্মকর্তাদের একটি বড় ভূমিকা থাকে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের মৌলিক দিকনির্দেশনার তাঁদেরই খুঁটিনাটি চূড়ান্ত করতে হয়। সে ক্ষেত্রে মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই। সব দেশই তার সুবিধাটি বড় করে দেখে। আমরাও তা চাই এবং চাইব। তবে পেতে হলে তৈরি করতে হবে একটি দক্ষ ও অরাজনৈতিক জনপ্রশাসন।
কিন্তু বাস্তবে দেখছি এর বিপরীত চিত্র। দলীয়করণমুক্ত প্রশাসনের অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় বসে সবাই জোরদারভাবে দলীয়করণেই মনোযোগ দেয়। ক্ষতির শিকার হন অনেক দক্ষ ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তা। আর আগেই বলেছি, বড় ক্ষতি হয় করদাতা জনগণের। তাঁদের ক্ষতির বিচারটা কে করবে? এ সংস্কৃতির অবসান না ঘটলে সুশাসন তো অধরাই থেকে যাবে। যে সুশাসনের অঙ্গীকার রাজনৈতিক দলগুলো বারবার করছে, তা বাস্তবায়নে অনীহা তাদের আপাত লাভ হলেও দীর্ঘমেয়াদি দেশের ক্ষতির সঙ্গে তাদেরও ক্ষতি হয়ে যাবে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
No comments