সহজিয়া কড়চা-কৌপীন নয়, পোশাকটাই আসল by সৈয়দ আবুল মকসুদ
বহু বছর আগে, স্বাধীনতারও বছর দুই আগে, আমাদের এলাকায় হঠাৎ এক সিদ্ধপুরুষের আবির্ভাব ঘটে। কোথা থেকে তিনি এলেন তা আমরা জানতাম না। জানার প্রয়োজনও বোধ করিনি। শরীর মেদবহুল। নেংটির মতো সামান্য এক টুকরো কাপড় পরা। কপালে তিলক। হাতে লম্বা চিমটা।
দেখলে কার সাধ্য তাকে শ্রদ্ধা না করে! তিনি সবাইকে নয়, কাউকে কাউকে দীক্ষা দিচ্ছিলেন। আমার এক হিন্দু সহপাঠী বলল, চলো যাই, কী দীক্ষা দেয়, নিয়া আসি।
প্রতিদিনই তাঁর দর্শনে যেতাম। কিন্তু দীক্ষার বাসনা নিয়ে যেদিন গেলাম, সেদিন একটু রাত করে গেলাম। জীবনের গুরুতর ব্যাপার, যেমন তদবির করা, দীক্ষা নেওয়া—এসব লোকজনের ভিড়ের মধ্যে হয় না।
সিদ্ধপুরুষ বললেন, তোমাদের যে দীক্ষা দিতেছি তাতে কৌপীন পরার প্রয়োজন হইবে। সুতরাং সাধনার শুরু করো কৌপীন পরা দিয়া।
আমার বন্ধু বলল, কৌপীন পরা আর এমন কি?
সিদ্ধপুরুষ বললেন, এই তো ভুল করলা। কৌপীন পরা সহজ কাজ না।
তারপর মহাযোগী যে ডেমোনস্ট্রাশন দিলেন এবং যা বললেন তা আমার আজও মনে আছে। শুধু ভয়টা ছিল আমাদেরও কাপড় খুলতে বলেন কি না। তিনি বলেছিলেন: দুই হাতে (মোনাজাত করার ভঙ্গিতে) অঞ্জলি বাঁধতে। মন লিঙ্গমূলে স্থির করবে। এবং মনে মনে বলবে—হে প্রভু, তুমি আমার মনের চঞ্চলতা দূর করো।
তারপর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সুন্দরী নারী দেখলে কি সম্ভোগেচ্ছা জাগে?
আমরা বুঝলাম, এই প্রশ্নের হ্যাঁ-বাচক উত্তর তিনি শুনতে চান না। কিন্তু সামান্যতম সততা থাকলেও না-বাচক উত্তর দিই কী করে? মাথা নিচু করে বসে রইলাম।
বিজ্ঞ সিদ্ধপুরুষ ফ্রয়েড ও ইয়ুং-এর চেয়ে পাকা মনস্তত্ত্ববিদ। আমাদের মনের কথা তিনি জানেন। বললেন, বুঝলাম, এখনো তোমাদের মনের চঞ্চলতা দূর হয় নাই। ঈশ্বরের প্রতি মন নিবদ্ধ করো।
তাঁকে বলতে চেয়েছিলাম, কৌপীন পরতে গিয়েও যদি সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন হয় তাহলে বড় সমস্যার সমাধান চাইতে কার সাহায্য চাইব। কিন্তু সিদ্ধপুরুষদের সামনে অবিনয়ী প্রশ্ন করা অপরাধতুল্য। তাই চুপ করে রইলাম।
প্রথম দিন তিনি কৌপীন পরারই তালিম দিলেন। তবে আমাদের মতো তরুণদের ভালোমতো দীক্ষাদানের যথেষ্ট সময় তিনি পাননি। তিনি টের পেয়েছিলেন, এলাকায় তাঁর নৈশকালীন কার্যকলাপ নিয়ে বাতাসে কিছু কথা ভাসছে। এক সকালে গিয়ে দেখি তিনি নেই। এলাকায় যারা তাঁর খুব বেশি ভক্ত ছিল, যারা তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে বাজারের চায়ের দোকান গরম করত, তারাও কিছুদিনের জন্য অদৃশ্য হয়ে গেল।
আধ্যাত্মিক ব্যাপারেই হোক আর গণতান্ত্রিক রাজনীতির মতো নিরেট বাস্তব ব্যাপারেই হোক—স্থায়ী ভক্ত বলে কিছু নেই। ভক্তরা আজ দলে দলে আসছে তো কাল একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
রাষ্ট্র পরিচালনার কাজটি আধ্যাত্মিক সাধনার চেয়ে কিছুমাত্র কম কষ্টসাধ্য নয়। রাষ্ট্র যেহেতু কোটি কোটি লোকের কারবার, তাই তা ঠিকঠাকভাবে চালানো অসাধারণ দক্ষতা ছাড়া সম্ভব নয়। আমাদের সেই সিদ্ধপুরুষের মতো হলে শেষরক্ষা হওয়া তো দূরের কথা—কোনো রকমে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া দ্বিতীয় উপায় থাকে না। টাইট করে কৌপীন পরা নিয়ে কসরত করতেই যাঁদের সময় পার হয়, তাঁরা লক্ষ্যে পৌঁছার সময় পেতেই পারেন না।
মোটর গাড়ির শরীরটির সঙ্গে তার ইঞ্জিন ও চাকার যে সম্পর্ক, রাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের সেই সম্পর্ক। ইলেকট্রিসিটি না থাকলে স্টার্টই নেবে না। তা ছাড়া গাড়ি চলবে না যদি টায়ারে হাওয়া না থাকে, ব্যাটারি বসে যায়, ডায়নামো কাজ না করে, রেডিয়েটর ফুটো হয়ে যায় বা ফ্যান না ঘোরে। রাষ্ট্রের কোনো একটি বিভাগ যদি নষ্ট হয়ে যায় বা ঠিকমতো কাজ না করে তাহলে রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে পড়ে। শাসন বিভাগ, পার্লামেন্ট, বিচার বিভাগ এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্বারা রাষ্ট্র চলে। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশ। একটি অংশ নষ্ট হলে অন্য অংশগুলো কাজ করতে পারে না।
দক্ষ প্রশাসন ও শক্ত অর্থনীতি ছাড়া কোনো উন্নত রাষ্ট্র কল্পনাই করা যায় না। রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে ছোট-বড় সব ধরনের শিল্পোদ্যোক্তার ভূমিকাও খুব বড়। যাঁরা নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে তোলেন, তাঁরা তাতে নিজেরা যে বিত্তবান হন তা-ই নয়, তাঁরা দেশেরই সেবা করেন। সরকারি প্রচারমাধ্যমও থাকা উচিত, কিন্তু স্বাধীন সংবাদমাধ্যম, পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন-রেডিও ছাড়া আধুনিক রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না। অর্থাৎ একটি আদর্শ আধুনিক রাষ্ট্রে মন্ত্রী, এমপি, শীর্ষ আমলা, বিচারক, শিল্পোদ্যোক্তা, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী প্রভৃতির সমন্বিত ভূমিকা অপরিহার্য।
সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রধান শাসক। মন্ত্রীরা তাঁর সহকর্মী, যাঁদের হাতে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন দায়িত্ব বণ্টন করে দিয়েছেন। বিভিন্ন পদবি দিয়ে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় আরও অনেককে তিনি নিয়োগ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নিজের একান্ত কিছু গুরুদায়িত্ব আছে, তা ছাড়া তাঁর আর একটি কাজ হলো মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের কাজ মনিটর করা। জনপ্রতিনিধি হিসেবে সাংসদদের দায়িত্ব অশেষ—জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষা করা তাঁদের এক নম্বর কাজ। গোটা দেশের সার্চলাইট হলো সংবাদমাধ্যম। এই সার্চলাইটটি কালো কাগজ অথবা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলে দেশের চেহারা ও শরীরটাকে দেখা যায় না—কেমন ভুতুড়ে ভুতুড়ে মনে হয়।
সবার কথাই বললাম, একটি পদের কথা বাদ পড়েছে। সেটি হলো পার্লামেন্টে বিরোধী দলের নেতা। আমাদের দেশে এই পদটি তুলে দিলেই ভালো ছিল। আমাদের গণতন্ত্রে এই একটি মাত্র পদ যাঁর কোনো কাজই নেই। রাষ্ট্র তাঁকে অফিস ও লোকজন সবই দিয়েছে কিন্তু রাষ্ট্রকে দেওয়ার মতো কোনো কাজ তাঁর নেই। তিনি দলের কাজ করেন মধ্যরাত পর্যন্ত, দলীয় নেতাদের উপদলীয় কোন্দল মেটান, কিন্তু ঘণ্টা দুই দেশের কাজ করার ফুরসত পান না। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রে গুরুত্বের দিক থেকে বিরোধী দলের নেতার স্থান প্রধানমন্ত্রীর পরেই। আমাদের সরকারের ধরন এখন অনেকটা মোগল প্রশাসনের মতো: মন্ত্রী-আমলা এবং নয় দুগুণে আঠারো রকমের রত্ন আছেন, কিন্তু বিরোধী দলের নেতার কোনো ভূমিকা নেই।
সম্রাট আকবরের নবরত্নরাই তাঁর উপদেষ্টার কাজ করতেন। মিয়া তানসেন, মোল্লা দোপিয়াজা প্রমুখ বাদশাকে সাধ্যমতো পরামর্শ দিতেন। এত বড় ভারতবর্ষ একার বুদ্ধিতে চালানো সম্ভব হতো না। পরামর্শদাতার বুদ্ধি যদি পাকা হয়, তাহলে দেশের উপকার হয়; আর তাদের বুদ্ধি যদি কাঁচা হয়, তাহলে জনগণেরই যে কপাল পোড়ে তা-ই নয়, সরকারেরও সর্বনাশ ডেকে আনা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টাকে আমি শাবাশ দিই। তিনি পরম সততার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি মহাজোট সরকারের পলিসিকে সুস্পষ্ট ভাষায় ও অত্যন্ত সাবলীলভাবে প্রকাশ করেছেন। সাড়ে ১৩ হাজার জনকে কমিউনিটি হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে। উপদেষ্টা বলেছেন: ‘১৩ হাজার ৫০০ পোস্টের একটাও (আল্লাহর ইচ্ছায় দুই-একটা যাইতে পারে) যাতে আমাদের দলের বাইরে না হয়, পরীক্ষিত কর্মীরা পায়, সেই জন্য আমি মোটামুটি একটা সিস্টেম করছি। আমি তো আমার অফিসারকে বলে দেব, আমার লোককে চাকরি দিতে হবে।...আমরা আল্লাহর ওয়াস্তে যেন অজু-গোসল কইরা...অন্ততপক্ষে যে কয়দিন আছি, চেষ্টা করি।...যদি কিছু নিতে হয়, নিজেদের কর্মীদের কাছ থেকে নিতে...অন্যদের কাছ থেকে নিয়ে জামাত-জুমাতকে চাকরি দিস না...।’
এই বক্তব্যের ভাবসম্প্রসারণ করতে গেলে বিরাট থিসিস লিখতে হয়। সাড়ে ১৩ হাজারের মধ্যে দুই-একটা ছাড়া সবই তাঁর নিজের দলের লোকদের দেবেন। ওই ‘দুই-একটা’ তিনি কাকে দেবেন, তা বলেননি। জাতীয় পার্টি, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টিকে পুরো একটা করে দিতে পারবেন না। পরীক্ষিত কর্মী বলতে তো আজকাল চাপাতি ও রামদাঅলাদের বোঝায়। তাদের ইন্টারভিউ নিতে গেলে অজু-গোসল করে যাওয়াই ভালো। নাপাক শরীরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করাই শ্রেয়।
উপদেষ্টার একটি কথাই শুধু করুণ শোনাল। ‘যে কয়দিন আছি’ কথাটার মধ্যে হতাশা ও অনিশ্চয়তার সুর। এই হতাশা কার জন্য? তাঁর নিজের জন্য, না তাঁর সরকারের জন্য? তাঁর নিজের জন্য হলে আমাদের দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া করার আর কিছুই নেই। তাঁর সরকারের জন্য হলে দুঃখজনক। ২০২১ সাল অনেক দূর। বেশি না নিয়ে ‘কিছু’ নেওয়ার কথা যে তিনি বলেছেন, তাতে তাঁর বাস্তববোধ ও সততার প্রকাশ ঘটেছে। অভাবের দেশে বেকারদের থেকে ‘বেশি’ নিতে নিরুৎসাহিত করেছেন। তাতে দুই পক্ষই উপকৃত হবে, নিয়োগদাতা অফিসার এবং যাকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
‘অন্যদের কাছ থেকে’ কিছু না নিতে তিনি আদরের ভাষায় পরামর্শ দিয়েছেন। উপদেষ্টা মহোদয় একটি জিনিস ভুলে গেছেন। এই রাষ্ট্র চলে সব দলের মানুষের ট্যাক্সের টাকায়। তার মধ্যে বিএনপি, সিপিবি, সর্বহারা পার্টি, জামায়াত-জুমায়াত সবই আছে। তাদের টাকায় নিজেদের ‘পরীক্ষিত’দের বেতন দেবেন—সেটা কেমন কথা। তিনি ভুলে গেছেন বাংলাদেশ একটা রাষ্ট্র—কোনো দলীয়, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করে দিলে সাড়ে ১৩ হাজারের মধ্যে সাড়ে চার হাজার প্রোভাইডারের বেতন দিতে পারবেন না।
সরকারি চাকরি হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে, নতুন উদ্ভাবিত কোনো সিস্টেমে নয়। অন্য দলের বলে জিপিএ পাঁচঅলা চাকরি পাবে না, তিনি তাঁর দলের পরীক্ষিতদের যোগ্যতা জিপিএ আড়াই থেকে দুইয়ে কমাতে চাইছেন। একপর্যায়ে জিপিএ এক পর্যন্তও তাঁকে নামতে হতে পারে। সে সিস্টেম করাও কঠিন নয়। কিন্তু তা হবে সংবিধানের লঙ্ঘন এবং গণতন্ত্রের বরখেলাপ। যে নির্বাচিত সরকার শুধু তার নিজের দলের লোকদের চাকরি দেয়, তাদের যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক, তাকে গণতান্ত্রিক সরকার বলে না—তা গণতন্ত্রের কলঙ্ক।
আসলে এই সিস্টেমের কথা ফাঁস করে দিয়ে তিনি বাজিমাত করেছেন। অবশ্য বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ভাষায় বলতে গেলে: দেশ এখন বাজিকরদের হাতে। ভর্তিবাজি, নিয়োগবাজি, টেন্ডারবাজি, দলবাজি, মতলববাজির রকমফের দেখে মানুষ দিশেহারা। যেখানে নাগরিকদের কোনো বা প্রাপ্তি রয়েছে সেখানেই বাজিকরেরা উৎকট ব্যস্ততায় উন্মুক্ত। যেখানে একটা চতুর্থ শ্রেণীর চাকরির জন্য তিন লাখ টাকা গুনতে হয়, সেখানে মেধাভিত্তিক প্রশাসন কেমন করে আমরা গড়ব।
বিচারপতি হাবিবুর রহমান একজন যুক্তিবাদী বাঙালি মুসলমান, কোরআন সম্পর্কে বই লিখলেও অকপট বাঙালি জাতীয়তাবাদী। তিনি মহাজোট সরকারের অহিতার্থী নন। কারও প্রতি তাঁর কোনো বিদ্বেষ আছে বলে কখনো দেখিনি। এত বেশি বয়সেও এত বেশি পড়াশোনা এ দেশে আর কেউ করেন বলে আমি জানি না। তিনি তাঁর সেদিনের প্রশংসিত বক্তৃতায় আরও বলেছেন: আজ চীনের অর্থনৈতিক সাফল্য নিয়ে নানা তত্ত্ব দেওয়া হচ্ছে। আমার মনে হয়, রাজনৈতিক ক্যাডাররা নয়, চীনের মেধাভিত্তিক প্রশাসনই তার উত্থানের প্রধান কারণ।
বৃদ্ধ বিচারপতি একজন প্রাজ্ঞ লেখক ও চিন্তাবিদ। সেদিন তিনি আর একটি বাক্যও বলেছেন: ‘গণতন্ত্রের সোপানে আরোহণ করেই ফ্যাসিজম ও নাৎসিজমের জন্ম।’ তাঁর বক্তব্য নিয়ে বাজিকরদের অভিভাবকেরা কেউ কেউ ভ্রু কুঁচকেছেন, কেউ হাহাকার করেছেন। তাঁদের বক্তব্য: লোকটি বলেন কী? এসব বলতে নেই। যা চলছে চলুক। জয় জিপিএ এক দশমিক এক। সব প্রবীণ নেতা বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের এখন মাউথপিস বা মুখপাত্র তার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেছেন, ‘দেশের দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে হয়তো তিনি কথাগুলো বলেছেন। যেসব বিষয়ের কথা বলেছেন তা আগে থেকেই সমাজে ব্যাধি হিসেবে ছিল, যার পরিচর্যার দায়িত্ব এখন আমাদের।’ [ডেসটিনি]। ঠিক কথাই বলেছেন, বিভিন্ন বাজির এখন সর্বোচ্চ পরিচর্যাই তাঁরা করছেন।
জননেতা ইনুর জন্য ত্যাগ স্বীকার করে এমপি হতে না পেরে সান্ত্বনা হিসেবে তিনি দলের মুখপাত্রের পদ পেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এসব ব্যাধি দূর করার জন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং ভিশন-২০২১ ঘোষণা করেছেন। বাংলার মাটির রাজনীতিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদটি বড়ই অলক্ষুনে। খন্দকার মোশতাক ছিলেন আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। বিএনপির যুগ্ম এখন বিলেতের বাতাস খাচ্ছেন। কখন কার ভাগ্যে কী হয়, সিদ্ধপুরুষ ছাড়া কেউ বলতে পারেন না।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টার বাজিমাতের পরই বাজি ফাটালেন মাননীয় বিচারপতি। একই দিনে আর একটি খবরে জানা গেল, ‘পরিকল্পনামন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর সুপারিশের পরও দুই লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে চাকরি’ দেননি পাবনার সিভিল সার্জন। চাকরিপ্রার্থী মিনতির দাবি, তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।...সিভিল সার্জন তাঁর কাছে ‘তিন লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। মিনতি দুই লাখ টাকা পরিশোধ করেন।’ [সমকাল] বাকি এক লাখ না পাওয়ায় চাকরি হয়নি। তা নিয়ে মামলা হয়েছে। এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনাই বটে।
পাবনার প্রসিদ্ধ কাণ্ডটিতে অন্যান্য অঘটনের মধ্যে কর্তব্য পালন করতে গিয়ে মার খেয়েছেন একজন নারী কর্মকর্তা এবং একজন হিন্দু কর্মকর্তা। কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ সেক্যুলার। এখানে কার কী ধর্ম, সে প্রশ্ন তোলা আইনত দণ্ডনীয়। তবে ধর্ম ও লিঙ্গ-নির্বিশেষে যেকোনো আহত মানুষের কাঁদার অধিকার কেন বেআইনি নয়, সে ব্যাপারে এখনো কোনো রুল জারি হয়নি। সুতরাং যে কেউ মনের কষ্টে কাঁদতে পারেন। হাসি এবং কান্না কোনোটা নিয়ে ক্যামেরা কারসাজি করতে পারে না। ক্যামেরা ক্যাডার ও কলামলেখকদের চেয়ে কিঞ্চিৎ দলনিরপেক্ষ।
উপদেষ্টা মহোদয় ‘পরীক্ষিত’দের কথা বলেছেন। যাদের তিনি ‘পরীক্ষিত কর্মী’ বলছেন তাদের আমরা কোনো পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে দেখিনি। তাদের একটি পরীক্ষার সময় এসেছিল যেদিন শেখ হাসিনাকে আটক করা হয়। সাড়ে ১৩ হাজার পরীক্ষিতের মধ্যে সাড়ে ১৩ জনকেও রাস্তায় প্রতিবাদ মিছিল বের করতে দেখা যায়নি। যেদিন শেখ হাসিনাকে বিদেশে তারেকের মতো আরামে থাকার নীলনকশা করা হয়, সেদিন সাড়ে ১৩ হাজার যদি বিক্ষোভ মিছিল করত, তা হলে উদ্দীনীয় সরকার উড়ে যেত। সে সময় আমাদের মতো হতভাগারাই গোলটেবিল লম্বাটেবিল করে টেবিল চাপড়েছে। সেখানে শ্রোতা হিসেবেও কাউকে পাওয়া যেত না। সেসব দিনের সাক্ষী আবদুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, তোফায়েল আহমেদ, ফারুক খান, ড. আব্দুর রাজ্জাকসহ আরও অনেকে; যাঁদের কারও কারও এখন সরকারের সেবা করার সুযোগ নেই।
গত নির্বাচনের প্রশ্ন? সে নির্বাচনের আমি এক পর্যবেক্ষক ছিলাম। তাতে অধিকাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে দলের নেত্রী শেখ হাসিনাকে। ভোটের আগের এক মাস এবং ভোটের দিন ‘পরীক্ষিত’দের কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য ভূমিকা আমি দেখিনি। পরীক্ষা তাঁরা দিয়েছেন নির্বাচনের পর সরকারটি গঠিত হলে। সে পরীক্ষা কলম ও কাগজে নয়—চাপাতি, রামদা, গাদা বন্দুক ও পিস্তল দিয়ে।
পাবনার প্রসিদ্ধ ব্যাপারের পর সেখানকার দলীয় নেতা বলেছেন: ‘ডিসির প্রত্যাহারের মাধ্যমে পাবনার আওয়ামী লীগ এবং সাধারণ মানুষের জয় হয়েছে।’ আমরা করজোড়ে বলব: লাখ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পরাজিত করবেন না। অতি বেশি জয় ভালো নয়। সেই যে কবি বলেছেন:
একচ্ছত্র জয় নেই, নেই কোনো জয়ী,
বিজয়ী বিজিত কভু, বিজিত বিজয়ী।
রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের জন্য মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, উপদেষ্টা, সাংসদ, সচিব, রাষ্ট্রদূত ও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ পাঁচ-ছয় শ মানুষ দায়ী। সব দায়দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর ঘাড়ে চাপিয়ে যে যা খুশি তা-ই করবেন, জনগণ তা সহ্য করবে না বেশি দিন। জনগণ ক্ষিপ্ত হচ্ছে, বিদেশি বন্ধুরা অসন্তুষ্ট। ৮ মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্তা ফ্রোয়েন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন: উই আর নট হ্যাপি।
একজন মানুষকে যেমন কৌপীনের চেয়ে স্বাভাবিক পোশাকে ভালো দেখায়, রাষ্ট্রকেও ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনে সুন্দর লাগে; অবিচার ও অনাচারে নয়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
প্রতিদিনই তাঁর দর্শনে যেতাম। কিন্তু দীক্ষার বাসনা নিয়ে যেদিন গেলাম, সেদিন একটু রাত করে গেলাম। জীবনের গুরুতর ব্যাপার, যেমন তদবির করা, দীক্ষা নেওয়া—এসব লোকজনের ভিড়ের মধ্যে হয় না।
সিদ্ধপুরুষ বললেন, তোমাদের যে দীক্ষা দিতেছি তাতে কৌপীন পরার প্রয়োজন হইবে। সুতরাং সাধনার শুরু করো কৌপীন পরা দিয়া।
আমার বন্ধু বলল, কৌপীন পরা আর এমন কি?
সিদ্ধপুরুষ বললেন, এই তো ভুল করলা। কৌপীন পরা সহজ কাজ না।
তারপর মহাযোগী যে ডেমোনস্ট্রাশন দিলেন এবং যা বললেন তা আমার আজও মনে আছে। শুধু ভয়টা ছিল আমাদেরও কাপড় খুলতে বলেন কি না। তিনি বলেছিলেন: দুই হাতে (মোনাজাত করার ভঙ্গিতে) অঞ্জলি বাঁধতে। মন লিঙ্গমূলে স্থির করবে। এবং মনে মনে বলবে—হে প্রভু, তুমি আমার মনের চঞ্চলতা দূর করো।
তারপর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সুন্দরী নারী দেখলে কি সম্ভোগেচ্ছা জাগে?
আমরা বুঝলাম, এই প্রশ্নের হ্যাঁ-বাচক উত্তর তিনি শুনতে চান না। কিন্তু সামান্যতম সততা থাকলেও না-বাচক উত্তর দিই কী করে? মাথা নিচু করে বসে রইলাম।
বিজ্ঞ সিদ্ধপুরুষ ফ্রয়েড ও ইয়ুং-এর চেয়ে পাকা মনস্তত্ত্ববিদ। আমাদের মনের কথা তিনি জানেন। বললেন, বুঝলাম, এখনো তোমাদের মনের চঞ্চলতা দূর হয় নাই। ঈশ্বরের প্রতি মন নিবদ্ধ করো।
তাঁকে বলতে চেয়েছিলাম, কৌপীন পরতে গিয়েও যদি সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন হয় তাহলে বড় সমস্যার সমাধান চাইতে কার সাহায্য চাইব। কিন্তু সিদ্ধপুরুষদের সামনে অবিনয়ী প্রশ্ন করা অপরাধতুল্য। তাই চুপ করে রইলাম।
প্রথম দিন তিনি কৌপীন পরারই তালিম দিলেন। তবে আমাদের মতো তরুণদের ভালোমতো দীক্ষাদানের যথেষ্ট সময় তিনি পাননি। তিনি টের পেয়েছিলেন, এলাকায় তাঁর নৈশকালীন কার্যকলাপ নিয়ে বাতাসে কিছু কথা ভাসছে। এক সকালে গিয়ে দেখি তিনি নেই। এলাকায় যারা তাঁর খুব বেশি ভক্ত ছিল, যারা তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে বাজারের চায়ের দোকান গরম করত, তারাও কিছুদিনের জন্য অদৃশ্য হয়ে গেল।
আধ্যাত্মিক ব্যাপারেই হোক আর গণতান্ত্রিক রাজনীতির মতো নিরেট বাস্তব ব্যাপারেই হোক—স্থায়ী ভক্ত বলে কিছু নেই। ভক্তরা আজ দলে দলে আসছে তো কাল একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
রাষ্ট্র পরিচালনার কাজটি আধ্যাত্মিক সাধনার চেয়ে কিছুমাত্র কম কষ্টসাধ্য নয়। রাষ্ট্র যেহেতু কোটি কোটি লোকের কারবার, তাই তা ঠিকঠাকভাবে চালানো অসাধারণ দক্ষতা ছাড়া সম্ভব নয়। আমাদের সেই সিদ্ধপুরুষের মতো হলে শেষরক্ষা হওয়া তো দূরের কথা—কোনো রকমে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া দ্বিতীয় উপায় থাকে না। টাইট করে কৌপীন পরা নিয়ে কসরত করতেই যাঁদের সময় পার হয়, তাঁরা লক্ষ্যে পৌঁছার সময় পেতেই পারেন না।
মোটর গাড়ির শরীরটির সঙ্গে তার ইঞ্জিন ও চাকার যে সম্পর্ক, রাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের সেই সম্পর্ক। ইলেকট্রিসিটি না থাকলে স্টার্টই নেবে না। তা ছাড়া গাড়ি চলবে না যদি টায়ারে হাওয়া না থাকে, ব্যাটারি বসে যায়, ডায়নামো কাজ না করে, রেডিয়েটর ফুটো হয়ে যায় বা ফ্যান না ঘোরে। রাষ্ট্রের কোনো একটি বিভাগ যদি নষ্ট হয়ে যায় বা ঠিকমতো কাজ না করে তাহলে রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে পড়ে। শাসন বিভাগ, পার্লামেন্ট, বিচার বিভাগ এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্বারা রাষ্ট্র চলে। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশ। একটি অংশ নষ্ট হলে অন্য অংশগুলো কাজ করতে পারে না।
দক্ষ প্রশাসন ও শক্ত অর্থনীতি ছাড়া কোনো উন্নত রাষ্ট্র কল্পনাই করা যায় না। রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে ছোট-বড় সব ধরনের শিল্পোদ্যোক্তার ভূমিকাও খুব বড়। যাঁরা নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে তোলেন, তাঁরা তাতে নিজেরা যে বিত্তবান হন তা-ই নয়, তাঁরা দেশেরই সেবা করেন। সরকারি প্রচারমাধ্যমও থাকা উচিত, কিন্তু স্বাধীন সংবাদমাধ্যম, পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন-রেডিও ছাড়া আধুনিক রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না। অর্থাৎ একটি আদর্শ আধুনিক রাষ্ট্রে মন্ত্রী, এমপি, শীর্ষ আমলা, বিচারক, শিল্পোদ্যোক্তা, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী প্রভৃতির সমন্বিত ভূমিকা অপরিহার্য।
সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রধান শাসক। মন্ত্রীরা তাঁর সহকর্মী, যাঁদের হাতে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন দায়িত্ব বণ্টন করে দিয়েছেন। বিভিন্ন পদবি দিয়ে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় আরও অনেককে তিনি নিয়োগ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নিজের একান্ত কিছু গুরুদায়িত্ব আছে, তা ছাড়া তাঁর আর একটি কাজ হলো মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের কাজ মনিটর করা। জনপ্রতিনিধি হিসেবে সাংসদদের দায়িত্ব অশেষ—জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষা করা তাঁদের এক নম্বর কাজ। গোটা দেশের সার্চলাইট হলো সংবাদমাধ্যম। এই সার্চলাইটটি কালো কাগজ অথবা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলে দেশের চেহারা ও শরীরটাকে দেখা যায় না—কেমন ভুতুড়ে ভুতুড়ে মনে হয়।
সবার কথাই বললাম, একটি পদের কথা বাদ পড়েছে। সেটি হলো পার্লামেন্টে বিরোধী দলের নেতা। আমাদের দেশে এই পদটি তুলে দিলেই ভালো ছিল। আমাদের গণতন্ত্রে এই একটি মাত্র পদ যাঁর কোনো কাজই নেই। রাষ্ট্র তাঁকে অফিস ও লোকজন সবই দিয়েছে কিন্তু রাষ্ট্রকে দেওয়ার মতো কোনো কাজ তাঁর নেই। তিনি দলের কাজ করেন মধ্যরাত পর্যন্ত, দলীয় নেতাদের উপদলীয় কোন্দল মেটান, কিন্তু ঘণ্টা দুই দেশের কাজ করার ফুরসত পান না। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রে গুরুত্বের দিক থেকে বিরোধী দলের নেতার স্থান প্রধানমন্ত্রীর পরেই। আমাদের সরকারের ধরন এখন অনেকটা মোগল প্রশাসনের মতো: মন্ত্রী-আমলা এবং নয় দুগুণে আঠারো রকমের রত্ন আছেন, কিন্তু বিরোধী দলের নেতার কোনো ভূমিকা নেই।
সম্রাট আকবরের নবরত্নরাই তাঁর উপদেষ্টার কাজ করতেন। মিয়া তানসেন, মোল্লা দোপিয়াজা প্রমুখ বাদশাকে সাধ্যমতো পরামর্শ দিতেন। এত বড় ভারতবর্ষ একার বুদ্ধিতে চালানো সম্ভব হতো না। পরামর্শদাতার বুদ্ধি যদি পাকা হয়, তাহলে দেশের উপকার হয়; আর তাদের বুদ্ধি যদি কাঁচা হয়, তাহলে জনগণেরই যে কপাল পোড়ে তা-ই নয়, সরকারেরও সর্বনাশ ডেকে আনা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টাকে আমি শাবাশ দিই। তিনি পরম সততার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি মহাজোট সরকারের পলিসিকে সুস্পষ্ট ভাষায় ও অত্যন্ত সাবলীলভাবে প্রকাশ করেছেন। সাড়ে ১৩ হাজার জনকে কমিউনিটি হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে। উপদেষ্টা বলেছেন: ‘১৩ হাজার ৫০০ পোস্টের একটাও (আল্লাহর ইচ্ছায় দুই-একটা যাইতে পারে) যাতে আমাদের দলের বাইরে না হয়, পরীক্ষিত কর্মীরা পায়, সেই জন্য আমি মোটামুটি একটা সিস্টেম করছি। আমি তো আমার অফিসারকে বলে দেব, আমার লোককে চাকরি দিতে হবে।...আমরা আল্লাহর ওয়াস্তে যেন অজু-গোসল কইরা...অন্ততপক্ষে যে কয়দিন আছি, চেষ্টা করি।...যদি কিছু নিতে হয়, নিজেদের কর্মীদের কাছ থেকে নিতে...অন্যদের কাছ থেকে নিয়ে জামাত-জুমাতকে চাকরি দিস না...।’
এই বক্তব্যের ভাবসম্প্রসারণ করতে গেলে বিরাট থিসিস লিখতে হয়। সাড়ে ১৩ হাজারের মধ্যে দুই-একটা ছাড়া সবই তাঁর নিজের দলের লোকদের দেবেন। ওই ‘দুই-একটা’ তিনি কাকে দেবেন, তা বলেননি। জাতীয় পার্টি, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টিকে পুরো একটা করে দিতে পারবেন না। পরীক্ষিত কর্মী বলতে তো আজকাল চাপাতি ও রামদাঅলাদের বোঝায়। তাদের ইন্টারভিউ নিতে গেলে অজু-গোসল করে যাওয়াই ভালো। নাপাক শরীরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করাই শ্রেয়।
উপদেষ্টার একটি কথাই শুধু করুণ শোনাল। ‘যে কয়দিন আছি’ কথাটার মধ্যে হতাশা ও অনিশ্চয়তার সুর। এই হতাশা কার জন্য? তাঁর নিজের জন্য, না তাঁর সরকারের জন্য? তাঁর নিজের জন্য হলে আমাদের দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া করার আর কিছুই নেই। তাঁর সরকারের জন্য হলে দুঃখজনক। ২০২১ সাল অনেক দূর। বেশি না নিয়ে ‘কিছু’ নেওয়ার কথা যে তিনি বলেছেন, তাতে তাঁর বাস্তববোধ ও সততার প্রকাশ ঘটেছে। অভাবের দেশে বেকারদের থেকে ‘বেশি’ নিতে নিরুৎসাহিত করেছেন। তাতে দুই পক্ষই উপকৃত হবে, নিয়োগদাতা অফিসার এবং যাকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
‘অন্যদের কাছ থেকে’ কিছু না নিতে তিনি আদরের ভাষায় পরামর্শ দিয়েছেন। উপদেষ্টা মহোদয় একটি জিনিস ভুলে গেছেন। এই রাষ্ট্র চলে সব দলের মানুষের ট্যাক্সের টাকায়। তার মধ্যে বিএনপি, সিপিবি, সর্বহারা পার্টি, জামায়াত-জুমায়াত সবই আছে। তাদের টাকায় নিজেদের ‘পরীক্ষিত’দের বেতন দেবেন—সেটা কেমন কথা। তিনি ভুলে গেছেন বাংলাদেশ একটা রাষ্ট্র—কোনো দলীয়, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করে দিলে সাড়ে ১৩ হাজারের মধ্যে সাড়ে চার হাজার প্রোভাইডারের বেতন দিতে পারবেন না।
সরকারি চাকরি হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে, নতুন উদ্ভাবিত কোনো সিস্টেমে নয়। অন্য দলের বলে জিপিএ পাঁচঅলা চাকরি পাবে না, তিনি তাঁর দলের পরীক্ষিতদের যোগ্যতা জিপিএ আড়াই থেকে দুইয়ে কমাতে চাইছেন। একপর্যায়ে জিপিএ এক পর্যন্তও তাঁকে নামতে হতে পারে। সে সিস্টেম করাও কঠিন নয়। কিন্তু তা হবে সংবিধানের লঙ্ঘন এবং গণতন্ত্রের বরখেলাপ। যে নির্বাচিত সরকার শুধু তার নিজের দলের লোকদের চাকরি দেয়, তাদের যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক, তাকে গণতান্ত্রিক সরকার বলে না—তা গণতন্ত্রের কলঙ্ক।
আসলে এই সিস্টেমের কথা ফাঁস করে দিয়ে তিনি বাজিমাত করেছেন। অবশ্য বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ভাষায় বলতে গেলে: দেশ এখন বাজিকরদের হাতে। ভর্তিবাজি, নিয়োগবাজি, টেন্ডারবাজি, দলবাজি, মতলববাজির রকমফের দেখে মানুষ দিশেহারা। যেখানে নাগরিকদের কোনো বা প্রাপ্তি রয়েছে সেখানেই বাজিকরেরা উৎকট ব্যস্ততায় উন্মুক্ত। যেখানে একটা চতুর্থ শ্রেণীর চাকরির জন্য তিন লাখ টাকা গুনতে হয়, সেখানে মেধাভিত্তিক প্রশাসন কেমন করে আমরা গড়ব।
বিচারপতি হাবিবুর রহমান একজন যুক্তিবাদী বাঙালি মুসলমান, কোরআন সম্পর্কে বই লিখলেও অকপট বাঙালি জাতীয়তাবাদী। তিনি মহাজোট সরকারের অহিতার্থী নন। কারও প্রতি তাঁর কোনো বিদ্বেষ আছে বলে কখনো দেখিনি। এত বেশি বয়সেও এত বেশি পড়াশোনা এ দেশে আর কেউ করেন বলে আমি জানি না। তিনি তাঁর সেদিনের প্রশংসিত বক্তৃতায় আরও বলেছেন: আজ চীনের অর্থনৈতিক সাফল্য নিয়ে নানা তত্ত্ব দেওয়া হচ্ছে। আমার মনে হয়, রাজনৈতিক ক্যাডাররা নয়, চীনের মেধাভিত্তিক প্রশাসনই তার উত্থানের প্রধান কারণ।
বৃদ্ধ বিচারপতি একজন প্রাজ্ঞ লেখক ও চিন্তাবিদ। সেদিন তিনি আর একটি বাক্যও বলেছেন: ‘গণতন্ত্রের সোপানে আরোহণ করেই ফ্যাসিজম ও নাৎসিজমের জন্ম।’ তাঁর বক্তব্য নিয়ে বাজিকরদের অভিভাবকেরা কেউ কেউ ভ্রু কুঁচকেছেন, কেউ হাহাকার করেছেন। তাঁদের বক্তব্য: লোকটি বলেন কী? এসব বলতে নেই। যা চলছে চলুক। জয় জিপিএ এক দশমিক এক। সব প্রবীণ নেতা বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের এখন মাউথপিস বা মুখপাত্র তার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেছেন, ‘দেশের দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে হয়তো তিনি কথাগুলো বলেছেন। যেসব বিষয়ের কথা বলেছেন তা আগে থেকেই সমাজে ব্যাধি হিসেবে ছিল, যার পরিচর্যার দায়িত্ব এখন আমাদের।’ [ডেসটিনি]। ঠিক কথাই বলেছেন, বিভিন্ন বাজির এখন সর্বোচ্চ পরিচর্যাই তাঁরা করছেন।
জননেতা ইনুর জন্য ত্যাগ স্বীকার করে এমপি হতে না পেরে সান্ত্বনা হিসেবে তিনি দলের মুখপাত্রের পদ পেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এসব ব্যাধি দূর করার জন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং ভিশন-২০২১ ঘোষণা করেছেন। বাংলার মাটির রাজনীতিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদটি বড়ই অলক্ষুনে। খন্দকার মোশতাক ছিলেন আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। বিএনপির যুগ্ম এখন বিলেতের বাতাস খাচ্ছেন। কখন কার ভাগ্যে কী হয়, সিদ্ধপুরুষ ছাড়া কেউ বলতে পারেন না।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টার বাজিমাতের পরই বাজি ফাটালেন মাননীয় বিচারপতি। একই দিনে আর একটি খবরে জানা গেল, ‘পরিকল্পনামন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর সুপারিশের পরও দুই লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে চাকরি’ দেননি পাবনার সিভিল সার্জন। চাকরিপ্রার্থী মিনতির দাবি, তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।...সিভিল সার্জন তাঁর কাছে ‘তিন লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। মিনতি দুই লাখ টাকা পরিশোধ করেন।’ [সমকাল] বাকি এক লাখ না পাওয়ায় চাকরি হয়নি। তা নিয়ে মামলা হয়েছে। এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনাই বটে।
পাবনার প্রসিদ্ধ কাণ্ডটিতে অন্যান্য অঘটনের মধ্যে কর্তব্য পালন করতে গিয়ে মার খেয়েছেন একজন নারী কর্মকর্তা এবং একজন হিন্দু কর্মকর্তা। কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ সেক্যুলার। এখানে কার কী ধর্ম, সে প্রশ্ন তোলা আইনত দণ্ডনীয়। তবে ধর্ম ও লিঙ্গ-নির্বিশেষে যেকোনো আহত মানুষের কাঁদার অধিকার কেন বেআইনি নয়, সে ব্যাপারে এখনো কোনো রুল জারি হয়নি। সুতরাং যে কেউ মনের কষ্টে কাঁদতে পারেন। হাসি এবং কান্না কোনোটা নিয়ে ক্যামেরা কারসাজি করতে পারে না। ক্যামেরা ক্যাডার ও কলামলেখকদের চেয়ে কিঞ্চিৎ দলনিরপেক্ষ।
উপদেষ্টা মহোদয় ‘পরীক্ষিত’দের কথা বলেছেন। যাদের তিনি ‘পরীক্ষিত কর্মী’ বলছেন তাদের আমরা কোনো পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে দেখিনি। তাদের একটি পরীক্ষার সময় এসেছিল যেদিন শেখ হাসিনাকে আটক করা হয়। সাড়ে ১৩ হাজার পরীক্ষিতের মধ্যে সাড়ে ১৩ জনকেও রাস্তায় প্রতিবাদ মিছিল বের করতে দেখা যায়নি। যেদিন শেখ হাসিনাকে বিদেশে তারেকের মতো আরামে থাকার নীলনকশা করা হয়, সেদিন সাড়ে ১৩ হাজার যদি বিক্ষোভ মিছিল করত, তা হলে উদ্দীনীয় সরকার উড়ে যেত। সে সময় আমাদের মতো হতভাগারাই গোলটেবিল লম্বাটেবিল করে টেবিল চাপড়েছে। সেখানে শ্রোতা হিসেবেও কাউকে পাওয়া যেত না। সেসব দিনের সাক্ষী আবদুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, তোফায়েল আহমেদ, ফারুক খান, ড. আব্দুর রাজ্জাকসহ আরও অনেকে; যাঁদের কারও কারও এখন সরকারের সেবা করার সুযোগ নেই।
গত নির্বাচনের প্রশ্ন? সে নির্বাচনের আমি এক পর্যবেক্ষক ছিলাম। তাতে অধিকাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে দলের নেত্রী শেখ হাসিনাকে। ভোটের আগের এক মাস এবং ভোটের দিন ‘পরীক্ষিত’দের কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য ভূমিকা আমি দেখিনি। পরীক্ষা তাঁরা দিয়েছেন নির্বাচনের পর সরকারটি গঠিত হলে। সে পরীক্ষা কলম ও কাগজে নয়—চাপাতি, রামদা, গাদা বন্দুক ও পিস্তল দিয়ে।
পাবনার প্রসিদ্ধ ব্যাপারের পর সেখানকার দলীয় নেতা বলেছেন: ‘ডিসির প্রত্যাহারের মাধ্যমে পাবনার আওয়ামী লীগ এবং সাধারণ মানুষের জয় হয়েছে।’ আমরা করজোড়ে বলব: লাখ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পরাজিত করবেন না। অতি বেশি জয় ভালো নয়। সেই যে কবি বলেছেন:
একচ্ছত্র জয় নেই, নেই কোনো জয়ী,
বিজয়ী বিজিত কভু, বিজিত বিজয়ী।
রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের জন্য মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, উপদেষ্টা, সাংসদ, সচিব, রাষ্ট্রদূত ও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ পাঁচ-ছয় শ মানুষ দায়ী। সব দায়দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর ঘাড়ে চাপিয়ে যে যা খুশি তা-ই করবেন, জনগণ তা সহ্য করবে না বেশি দিন। জনগণ ক্ষিপ্ত হচ্ছে, বিদেশি বন্ধুরা অসন্তুষ্ট। ৮ মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্তা ফ্রোয়েন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন: উই আর নট হ্যাপি।
একজন মানুষকে যেমন কৌপীনের চেয়ে স্বাভাবিক পোশাকে ভালো দেখায়, রাষ্ট্রকেও ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনে সুন্দর লাগে; অবিচার ও অনাচারে নয়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments