বাড়ছে জ্বালানি তেল গ্যাস বিদ্যুতের দাম by আরিফুজ্জামান তুহিন
জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকতা সারতে চলতি মাসের শেষ দিকে গণশুনানি হবে। জুলাই মাসের মাঝামাঝি ঘোষণা আসবে। তবে গ্যাস ও বিদ্যুতের বাড়তি দাম কার্যকর হবে ১ জুলাই থেকে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
তবে বরাবরের মতো জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে কমিশনের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না- নির্বাহী আদেশে বাড়ানো হবে জ্বালানি তেলের দাম; যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে জানা গেছে, কমিশনের কাছে তারা বিদ্যুতের পাইকারি দাম ৫০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। পিডিবির যুক্তি হলো, ২০১২-১৩ অর্থবছরে তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ৮০ শতাংশ উৎপাদন ক্ষমতায় চালানোর জন্য ইউনিটপ্রতি ব্যয় দাঁড়াবে ছয় টাকা ৮৭ পয়সা। যদি পাইকারি বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি চার টাকা দুই পয়সা বহাল থাকে, তাহলে ইউনিটপ্রতি ক্ষতি দাঁড়াবে দুই টাকা ৮৫ পয়সা। এ ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য বিদ্যুতের পাইকারি দাম ৫০ শতাংশ অর্থাৎ দুই টাকা এক পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এরপরও সরকার প্রতি ইউনিটে ৮৪ পয়সা ভর্তুকি দেবে। বছর শেষে সরকারের ভর্তুকির এ পরিমাণ দাঁড়াবে তিন হাজার ৭০০ কোটি টাকায়।
পাইকারি দাম বাড়ার ফলে মূল্য সমন্বয় করতে খুচরা বিদ্যুতের দামও বাড়বে। খুচরা বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি দাম ৩০ শতাংশ বাড়তে পারে।
গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও আবাসিক গ্রাহক ছাড়া অন্য সবার ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়বে। ইতিমধ্যে পেট্রোবাংলা গ্যাসের দাম বাড়ানোর একটি প্রস্তাব দিয়েছে এনার্জি কমিশনের কাছে। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, ক্ষেত্রভেদে ৯.৭১ থেকে ১০২.৯৪ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। জানা যায়, প্রতি হাজার ঘনফুট সারে ৭২ দশমিক ৯২ থেকে ৮০ টাকা অর্থাৎ ৯.৭১ শতাংশ, ক্যাপটিভে ১১৮ দশমিক ২৬ থেকে ২৪০ টাকা অর্থাৎ ১০২.৯৪ শতাংশ, শিল্পে ১৬৫ টাকা ৯১ পয়সা থেকে ২২০ টাকা অর্থাৎ ৩২.৬০ শতাংশ, চা বাগানে ১৬৫ দশমিক ৯১ থেকে ২০০ টাকা অর্থাৎ ২০.৫৫ শতাংশ, বাণিজ্যিকে ২৬৮ দশমিক ৯ থেকে ৩৫০ টাকা অর্থাৎ ৩০ দশমিক ৫৫ ভাগ, সিএনজিতে ৬৫১ দশমিক ২৯ থেকে ৯০৫ দশমিক ৯২ টাকা অর্থাৎ ৩৯ দশমিক ১০ ভাগ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় হবে ৮০০ কোটি টাকা।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গ্যাস খাতের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ কমে গেছে। ফলে নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।
দাম বাড়ানোর বিষয় জানতে চাইলে বিইআরসির সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, 'আমরা খুব শিগগির গণশুনানির ব্যবস্থা করব। সেটা এ মাসের শেষে অথবা আগামী মাসের প্রথম দিকে হতে পারে। তারপর যথাসময়ে মূল্য নির্ধারণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানাব।' কবে থেকে নতুন মূল্যে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম পরিশোধ করতে হবে- জানতে চাইলে তিনি জানান, 'আগামী জুলাই মাসের মাঝামাঝি দাম বাড়ার ঘোষণা দিলেও কার্যকর হবে জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে। অর্থাৎ গ্রাহককে ১ জুলাই থেকেই বাড়তি দামে গ্যাস ও বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করতে হবে।'
বিদ্যুতের দাম খুচরা পর্যায় কত বাড়তে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, '৩০ শতাংশ বাড়তে পারে।'
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে কমিশনের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, 'জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো প্রস্তাব আসেনি। এ ব্যাপারে কমিশন অবহিত নয়।'
এদিকে, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এবারও গণশুনানি উপেক্ষা করা হবে বলে সূত্র জানায়। ভর্তুকি কমিয়ে আনতে গত অর্থবছরে সরকার মোট চারবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। সেবার লিটারপ্রতি ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের দাম বাড়ে ১৭ টাকা করে। সরকারের দাবি, ভর্তুকির চাপ কমাতে দাম বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশীয় জ্বালানি গ্যাস ও কয়লার দিকে নজর না দিয়ে আমদানিনির্ভর জ্বালানির ওপর ঝুঁকে পড়ার কারণে বারবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে হচ্ছে; যা শেষ পর্যন্ত নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের আয়কে সংকুচিত করছে। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে আইন মানছে না সরকার। আইন ভেঙে নির্বাহী আদেশে একের পর এক জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির ভূমিকা নিয়ে।
সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ খোদ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম প্রতিদিন কমছে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত বুধবার জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি ওই দিন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, এখন সেচ মৌসুম শেষ, এখনই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির উপযুক্ত সময়।' অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে গত মাস থেকে জ্বালানি তেলের দাম পড়তে শুরু করেছে। এক মাস ধরে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৯৭ ডলারের মধ্যে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মত, এখনই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো ঠিক হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ম তামিম গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, এই মুহূর্তে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কোনো মানে নেই। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে গেছে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে পরিবহন থেকে শুরু করে গোটা অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর রাত ১২টার পর থেকে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম লিটারপ্রতি পাঁচ টাকা করে বাড়ানো হয়। সে অনুযায়ী প্রতি লিটার ডিজেল ৬১, কেরোসিন ৬১, পেট্রল ৯১, অকটেন ৯৪ ও ফার্নেস অয়েল ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে এখন।
কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের জন্য জ্বালানি আমদানির পরিমাণ বেড়ে গেছে। এ ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারকে গত অর্থবছরের চার মাসের মাথায় ব্যাংক খাত থেকে পুরো বছরের জন্য নির্ধারিত ঋণ নিতে হয়েছিল। এর ফলে বেসরকারি খাতের ঋণ গ্রহণের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে মারাত্মকভাবে। গত অর্থবছরে (২০১০-১১) জ্বালানি তেল আমদানিতে বিপিসির লোকসান হয়েছে আট হাজার ১৯৮ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, কুইক রেন্টালের দায় জনগণের ওপর চাপানো কোনোভাবেই ঠিক হবে না। বরং গ্যাসভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে জ্বালানি তেল আমদানির পরিমাণ কমে যাবে।
No comments