নারীর ক্ষমতায়ন-সংবিধান সংশোধন ও সংসদে নারী আসন by বদিউল আলম মজুমদার
গত ২১ জুলাই আমাদের সংবিধান সংশোধনের উদ্দেশ্যে ১৫ সদস্যের একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। উচ্চ আদালতের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল-সংক্রান্ত মামলার রায় বাস্তবায়ন এবং অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল রোধে কঠোর বিধানের সুপারিশ করাই মনে হয় যেন কমিটির অন্যতম অগ্রাধিকার।
তবে সুপারিশ চূড়ান্ত করার আগে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় নেওয়া আবশ্যক। সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের পদ্ধতি হতে হবে যার অন্যতম।
আওয়ামী লীগ তার ‘দিনবদলের সনদ’ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহারে সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করেছে, ‘জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩৩ শতাংশে উন্নীত করা হবে।’ নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ভবিষ্যতে সংবিধান সংশোধন করে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন (প্রথম আলো ১৫ ফেব্রুয়ারি-২০১০)। এখন সে প্রতিশ্রুতি রক্ষার লক্ষ্যে সংবিধানে যথাযথ সংশোধনী আনার সময় এসেছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকেই আমাদের জাতীয় সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব অপ্রতুল ও অনেকটা গুরুত্বহীন। আমাদের মূল ‘সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটি’র সদস্যদের মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন নারী। তাই আমাদের ১৯৭২ সালের সংবিধানে সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১০ বছরের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষণের বিধান করা হয়। ১৯৭৮ সালে সংরক্ষিত আসনসংখ্যা ৩০-এ উন্নীত এবং এর মেয়াদ ১৫ বছর করা হয়। ২০০৪ সালে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত আসনসংখ্যা ৪৫ ও এর সময়সীমা ১০ বছর নির্ধারণ করা হয়। আমাদের জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির এ-প্রক্রিয়াকে ‘কোটা’ পদ্ধতি বলা হয়।
কোটা তিন ধরনের হতে পারে: নির্বাচনবিহীন কোটা, নির্বাচনভিত্তিক কোটা ও ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি। তবে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিও একটি নির্বাচনভিত্তিক পদ্ধতি। এসব পদ্ধতির সংমিশ্রণেও কোটা প্রথা প্রচলন করা যেতে পারে।
নির্বাচনবিহীন কোটা পদ্ধতিতে সংরক্ষিত আসনগুলো পূরণ হয় দলীয় ‘মনোনয়ন’-এর মাধ্যমে। এ পদ্ধতিই বর্তমানে আমাদের জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন পূরণে ব্যবহূত হয়। এ ব্যবস্থাকে ‘পরোক্ষ’ নির্বাচন পদ্ধতিও বলা হয়ে থাকে, যদিও এর সঙ্গে ভোটাভুটির বিষয়টি একেবারেই যুক্ত নয়।
নির্বাচনবিহীন কোটা পদ্ধতিও দুই ধরনের হতে পারে, যার একটি হলো ‘উইনার-টেক-অল’ বা বিজয়ীদেরই সব সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন দেওয়ার পদ্ধতি। দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো, সংসদে প্রতিনিধিত্বের হারের ভিত্তিতে দলগুলোর মধ্যে সংরক্ষিত নারী আসনগুলো ভাগ করে দেওয়া। যেমন, ক্ষমতাসীন দলের যদি সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ প্রতিনিধিত্ব থাকে, তাহলে সরকারি দলের প্রাপ্য দুই-তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত নারী আসন। বিরোধী দল-দলগুলোর প্রাপ্য অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ আসন। আমাদের সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে দ্বিতীয় ধরনের পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়—এর আগে সাধারণ আসনে বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই সব সংরক্ষিত আসন পূরণ করত।
নির্বাচনভিত্তিক কোটা পদ্ধতিতে সংরক্ষিত নারী আসন পূরণ করা হয় ‘প্রত্যক্ষ’ বা সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে। আমাদের ইউনিয়ন পরিষদ ও অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসনগুলো পূরণ করা হয় এভাবেই। এ ক্ষেত্রে একাধিক সাধারণ আসন নিয়ে সংরক্ষিত আসন গঠিত হয়। যেমন, আমাদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় তিনটি সাধারণ আসন নিয়ে একটি সংরক্ষিত মহিলা আসন গঠন করা হয়।
নির্বাচনবিহীন কোটা পদ্ধতির অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রথমত, এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হয় না—সংরক্ষিত নারী আসনগুলো পূরণ করা হয় মনোনয়নের মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন হয় না বলে এ ক্ষেত্রে নারীদের জন্য কোনো নির্বাচনী এলাকা নির্ধারিত থাকে না। ফলে যোগ্য নারীদের জন্য তাঁদের যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা কাজে লাগিয়ে পরবর্তী সময়ে সরাসরি নির্বাচনে, মূলত পুরুষদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয় না। তৃতীয়ত, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকে না বলে, এসব আসন পূরণে প্রার্থীদের যোগ্যতা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় নয়। বরং এ ক্ষেত্রে দলীয় উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা সংরক্ষিত নারী আসনগুলোকে ফায়দা প্রদানের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করেন। অর্থাৎ সংরক্ষিত নারী আসনগুলো করুণা হিসেবেই বা লেনদেনের বিনিময়ে বিতরণ করা হয়। যোগ্যতার পরিবর্তে কানেকশনই এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই এসব আসন হয়ে পড়ে অনেকটা অলংকারিক।
চতুর্থত, নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা থাকে না বলে সংরক্ষিত আসন অলংকৃত করা প্রতিনিধিদের জনগণের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। বস্তুত, এসব নারী মূলত ‘দায়বদ্ধ’ থাকেন দলীয় কর্তাব্যক্তিদের কাছে। পঞ্চমত, সাধারণ আসনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তুলনায় সংরক্ষিত আসনে মনোনীত নারীদের ক্ষমতা ও দায়দায়িত্ব বহুলাংশে ভিন্ন। তাই এটি একটি অন্তর্ভুক্তিকরণমূলক (inclusive) পদ্ধতি নয়—সংরক্ষিত আসনে মনোনীত নারীরা ক্ষমতা-কাঠামোর বাইরেই থেকে যান। ষষ্ঠত, এটি নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য স্বয়ংক্রিয় ও কার্যকর পদ্ধতি নয়। কারণ, সংরক্ষণ পদ্ধতি বিলুপ্ত হলে সংরক্ষিত আসনে মনোনীত প্রতিনিধিদের সাধারণ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়ে আসার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ।
নির্বাচনভিত্তিক কোটা পদ্ধতিরও কতগুলো গুরুতর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রথমত, সাধারণ আসনের তুলনায় এ ক্ষেত্রে সংরক্ষিত নারী আসনগুলোর পরিধি বড় এবং ভোটারের সংখ্যাও বেশি হয়। তাই এটি একটি অসম পদ্ধতি। এসব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য অনেক বেশি সময় ও শ্রম দিতে এবং অর্থ ব্যয় করতে হয়। বৃহত্তর আসনের প্রতিনিধিত্ব করাও অনেক বেশি কষ্টসাধ্য। দ্বিতীয়ত, এ পদ্ধতিতে দ্বৈত প্রতিনিধিত্ব বিরাজ করে। অর্থাৎ দুজন প্রতিনিধি—একজন সাধারণ আসন, আরেকজন সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি—প্রত্যেক আসনের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। ফলে তাঁদের মধ্যে দায়দায়িত্ব বিভাজন দুরূহ হয়ে পড়ে এবং তাঁদের মধ্যে সাধারণত সহযোগিতার পরিবর্তে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সম্পর্কই গড়ে ওঠে। তৃতীয়ত, প্রতিটি সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিত (পুরুষ) সদস্যদের তুলনায় সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিদের ক্ষমতা ও দায়দায়িত্ব কার্যত ভিন্ন। তাই এটিও একটি অন্তর্ভুক্তিকরণ পদ্ধতি নয়—এসব সংরক্ষিত আসনকে অনেকে ‘অতিরিক্ত’ ও অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করেন। চতুর্থত, এ ধরনের কোটা সাধারণত শতাংশ (যেমন, ৩৩ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশ) হিসাবে প্রকাশ করা হয় এবং এতে একটি শুভঙ্করের ফাঁকি বিরাজমান। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের প্রতি তিনটি নির্বাচনী এলাকা নিয়ে একটি সংরক্ষিত নারী আসন গঠিত হয় বলে এটিকে এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষণ পদ্ধতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু বাস্তবে মোট ১২ জন (সাধারণ আসনের নয়জন+সংরক্ষিত আসনের তিনজন) সদস্যের মধ্যে তিনজন নারী—অর্থাৎ নারীর প্রতিনিধিত্ব এক-চতুর্থাংশ মাত্র।
কোটা-ব্যবস্থার মধ্যে উৎকৃষ্টতম পদ্ধতি হলো ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সব আসন থেকে পর্যায়ক্রমে একজন নারী সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ পান। যদি আমাদের জাতীয় সংসদের এক-তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকে এবং এগুলো ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে পূরণের সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে প্রথম টার্মে লটারি কিংবা অন্য কোনো পদ্ধতিতে ১০০ আসন চিহ্নিত করে এগুলো নারীদের জন্য সংরক্ষিত করা হবে। এভাবে নির্ধারিত ১০০টি আসনে শুধু নারীরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অন্য ২০০ আসন নারী-পুরুষ উভয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যই উন্মুক্ত থাকবে। পরবর্তী নির্বাচনে আগেরবারের ২০০টি উন্মুক্ত আসনের মধ্য থেকে লটারি কিংবা অন্য কোনো পদ্ধতিতে ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত করা হবে। অন্য ২০০ আসন, যার মধ্যে প্রথমবারের ১০০ সংরক্ষিত আসন অন্তর্ভুক্ত, নারী-পুরুষ উভয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। তৃতীয় টার্মে অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষিত হবে এবং অন্য ২০০ আসন উন্মুক্ত হয়ে যাবে। লক্ষণীয় যে এ পদ্ধতিতে মোট সংসদীয় আসনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় না।
ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে প্রতিটি সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা থাকে এবং এসব নির্বাচনী এলাকা আইনগতভাবে সাধারণ আসনের নির্বাচনী এলাকার সমতুল্য। বস্তুত এ পদ্ধতিতে সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনের আয়তন ও ভোটারের সংখ্যার দিক থেকে সমতা বিরাজ করে। এসব আসন থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা ও দায়দায়িত্বের মধ্যেও কোনো পার্থক্য থাকে না—সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অতিরিক্ত নন। তাঁরা সবাই ভোটারদের কাছে দায়বদ্ধ। তাই এটি একটি অন্তর্ভুক্তিকরণ পদ্ধতি। এতে সংরক্ষিত আসন প্রতীকী হওয়ার কোনো অবকাশ থাকে না। এ পদ্ধতিতে তিন টার্মে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকা থেকে অন্তত একজন নারী নির্বাচিত হয়ে আসেন।
ঘূর্ণায়মান পদ্ধতির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য এটি একটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি। দ্বৈত প্রতিনিধিত্বের অনুপস্থিতিতে এ পদ্ধতিতে যোগ্য ও কর্মদক্ষ নারীরা তাঁদের নির্বাচনী এলাকাকে ‘কালটিভেট’ বা গড়ে তোলার সুযোগ পান, যা পরবর্তী নির্বাচনে পুরুষদের সঙ্গে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়ে আসার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ফলে এ পদ্ধতিতে সংরক্ষিত আসনের বাইরে থেকেও—অর্থাৎ উন্মুক্ত আসন থেকেও নারীদের নির্বাচিত হয়ে আসার সম্ভাবনা নিশ্চিত হয়। তাই কোটার মাধ্যমে নির্ধারিত আসনের থেকে বেশি আসনে নারীরা নির্বাচিত হয়ে আসেন। সুতরাং, ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে একসময় নারীর সমপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য কোটার প্রয়োজনীয়তাই ফুরিয়ে যায়।
উল্লেখ্য, ভারতীয় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় কোটা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যা অত্যন্ত কার্যকর। পঞ্চায়েত পর্যায়ের ইতিবাচক অভিজ্ঞতার আলোকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি করার জন্য এ বছরের প্রথম দিকে ভারতীয় রাজ্যসভায় ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিভিত্তিক একটি বিল পাস হয়। দুর্ভাগ্যবশত ভারতীয় লোকসভায় বিলটি এখনো পাস হয়নি।
ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি যে নির্বাচনভিত্তিক পদ্ধতি থেকে উৎকৃষ্টতর, তা বাংলাদেশ ও ভারতের অভিজ্ঞতা থেকেই সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তুলনায় ২০০৩ সালের নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসনে প্রার্থীর সংখ্যা ৪৩ হাজার ৯৬৯ থেকে কমে ৪৩ হাজার ৭৬৪-তে এসে দাঁড়িয়েছিল, যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে প্রার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়া উচিত ছিল। পক্ষান্তরে, ভারতের পঞ্চায়েতে নির্বাচিত নারী সদস্যদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যেমন, ভারতীয় পঞ্চায়েতের তিন স্তরে—গ্রাম, মধ্য (পঞ্চায়েত সমিতি) এবং জেলা মোট নারী সদস্যের সংখ্যা ২০০২ সালে প্রায় পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার থেকে ২০০৮ সালে প্রায় ১০ লাখ ৪০ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতে নারী প্রতিনিধির সংখ্যা বেড়েছে ১৩ হাজার ৩০০ থেকে ২১ হাজার ৩৫১-তে।
কোটা পদ্ধতির কয়েকটি সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। একটি সীমাবদ্ধতা হলো, এটি সবচেয়ে উপযোগী সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণে। কারণ, তারা তাদের সংখ্যার কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিনিধিত্ব অর্জন করতে পারে না। কিন্তু নারীরা সংখ্যালঘু নয় এবং এটি তাদের জন্য সবচেয়ে উপযোগী নয়। আরেকটি সমস্যা হলো, এ পদ্ধতিতে অর্থ-বিত্ত ও শিক্ষার দিক থেকে অপেক্ষাকৃত অগ্রসর নারীরা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকেন। তবে সব নির্বাচনের ক্ষেত্রেই এ সমস্যা বিরাজমান। এ ছাড়া নিজেদের আসন হারানোর ভয়ে সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিত পুরুষ সদস্যরা এর বিরোধিতা করতে পারেন, যা করছেন ভারতীয় লোকসভার সদস্যরা। কিন্তু কোনো সাংসদেরই কোনো আসনে জন্মগত অধিকার নেই কিংবা একটি দেশের নির্বাচন-পদ্ধতি তথা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একদল ব্যক্তির নির্বাচিত হওয়ার কাছে জিম্মি হয়ে যেতে পারে না। আবার অনেক সময় অভিযোগ করা হয় যে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে পুরুষ আত্মীয়স্বজনেরা সংরক্ষিত আসনগুলো ‘গরম’ (warm) বা নিজেদের আয়ত্তে রাখার জন্য নারীদের ব্যবহার করেন, যাতে সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা শেষ হলে সে আসনগুলো পুনরুদ্ধার করা সহজ হয়। কিন্তু এটি একটি ঢালাও অভিযোগ। উপরন্তু ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি হতে হবে একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা। সর্বোপরি কোনো পদ্ধতিই সম্পূর্ণভাবে ত্রুটিমুক্ত নয়। ত্রুটি সত্ত্বেও সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে এবং বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের সবচেয়ে কম ত্রুটিসম্পন্ন পদ্ধতি বেছে নিতে হবে।
পরিশেষে, এটি সুস্পষ্ট যে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ব্যবহূত তিন ধরনের বিকল্পের মধ্যে ঘূর্ণায়মান কোটা পদ্ধতি সর্বোত্তম। প্রতিবেশী ভারতের পঞ্চায়েতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, সেখানে একটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ক্রমাগতভাবে নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধিতে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি কার্যকারিতা প্রদর্শন করছে। এ অবস্থায় অদূর ভবিষ্যতে ভারতীয় স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থায় যথাযথ সংখ্যক নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কোটা পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তাই ফুরিয়ে যাবে এবং তা বিলুপ্ত করা সম্ভব হবে। এ অভিজ্ঞতার আলোকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির জন্য ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিভিত্তিক কোটা প্রচলনের লক্ষ্যে ভারতীয় রাজ্যসভায় ইতিমধ্যেই একটি আইন পাস করা হয়েছে, যা বর্তমানে লোকসভার বিবেচনাধীন। আশা করি, সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটি আমাদের জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিভিত্তিক কোটা প্রথা প্রচলনের সুপারিশ করবে, যা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন-সম্পর্কিত নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নেও সহায়ক হবে। আরও আশা করি, সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে কমিটি ‘পিসিমল্’ (piecemeal) ও এডহক (adhoc) ভিত্তিতে অগ্রসর হবে না এবং তাড়াহুড়ো করবে না।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশ।
আওয়ামী লীগ তার ‘দিনবদলের সনদ’ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহারে সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করেছে, ‘জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩৩ শতাংশে উন্নীত করা হবে।’ নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ভবিষ্যতে সংবিধান সংশোধন করে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন (প্রথম আলো ১৫ ফেব্রুয়ারি-২০১০)। এখন সে প্রতিশ্রুতি রক্ষার লক্ষ্যে সংবিধানে যথাযথ সংশোধনী আনার সময় এসেছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকেই আমাদের জাতীয় সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব অপ্রতুল ও অনেকটা গুরুত্বহীন। আমাদের মূল ‘সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটি’র সদস্যদের মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন নারী। তাই আমাদের ১৯৭২ সালের সংবিধানে সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১০ বছরের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষণের বিধান করা হয়। ১৯৭৮ সালে সংরক্ষিত আসনসংখ্যা ৩০-এ উন্নীত এবং এর মেয়াদ ১৫ বছর করা হয়। ২০০৪ সালে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত আসনসংখ্যা ৪৫ ও এর সময়সীমা ১০ বছর নির্ধারণ করা হয়। আমাদের জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির এ-প্রক্রিয়াকে ‘কোটা’ পদ্ধতি বলা হয়।
কোটা তিন ধরনের হতে পারে: নির্বাচনবিহীন কোটা, নির্বাচনভিত্তিক কোটা ও ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি। তবে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিও একটি নির্বাচনভিত্তিক পদ্ধতি। এসব পদ্ধতির সংমিশ্রণেও কোটা প্রথা প্রচলন করা যেতে পারে।
নির্বাচনবিহীন কোটা পদ্ধতিতে সংরক্ষিত আসনগুলো পূরণ হয় দলীয় ‘মনোনয়ন’-এর মাধ্যমে। এ পদ্ধতিই বর্তমানে আমাদের জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন পূরণে ব্যবহূত হয়। এ ব্যবস্থাকে ‘পরোক্ষ’ নির্বাচন পদ্ধতিও বলা হয়ে থাকে, যদিও এর সঙ্গে ভোটাভুটির বিষয়টি একেবারেই যুক্ত নয়।
নির্বাচনবিহীন কোটা পদ্ধতিও দুই ধরনের হতে পারে, যার একটি হলো ‘উইনার-টেক-অল’ বা বিজয়ীদেরই সব সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন দেওয়ার পদ্ধতি। দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো, সংসদে প্রতিনিধিত্বের হারের ভিত্তিতে দলগুলোর মধ্যে সংরক্ষিত নারী আসনগুলো ভাগ করে দেওয়া। যেমন, ক্ষমতাসীন দলের যদি সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ প্রতিনিধিত্ব থাকে, তাহলে সরকারি দলের প্রাপ্য দুই-তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত নারী আসন। বিরোধী দল-দলগুলোর প্রাপ্য অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ আসন। আমাদের সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে দ্বিতীয় ধরনের পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়—এর আগে সাধারণ আসনে বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই সব সংরক্ষিত আসন পূরণ করত।
নির্বাচনভিত্তিক কোটা পদ্ধতিতে সংরক্ষিত নারী আসন পূরণ করা হয় ‘প্রত্যক্ষ’ বা সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে। আমাদের ইউনিয়ন পরিষদ ও অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসনগুলো পূরণ করা হয় এভাবেই। এ ক্ষেত্রে একাধিক সাধারণ আসন নিয়ে সংরক্ষিত আসন গঠিত হয়। যেমন, আমাদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় তিনটি সাধারণ আসন নিয়ে একটি সংরক্ষিত মহিলা আসন গঠন করা হয়।
নির্বাচনবিহীন কোটা পদ্ধতির অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রথমত, এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হয় না—সংরক্ষিত নারী আসনগুলো পূরণ করা হয় মনোনয়নের মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন হয় না বলে এ ক্ষেত্রে নারীদের জন্য কোনো নির্বাচনী এলাকা নির্ধারিত থাকে না। ফলে যোগ্য নারীদের জন্য তাঁদের যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা কাজে লাগিয়ে পরবর্তী সময়ে সরাসরি নির্বাচনে, মূলত পুরুষদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয় না। তৃতীয়ত, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকে না বলে, এসব আসন পূরণে প্রার্থীদের যোগ্যতা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় নয়। বরং এ ক্ষেত্রে দলীয় উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা সংরক্ষিত নারী আসনগুলোকে ফায়দা প্রদানের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করেন। অর্থাৎ সংরক্ষিত নারী আসনগুলো করুণা হিসেবেই বা লেনদেনের বিনিময়ে বিতরণ করা হয়। যোগ্যতার পরিবর্তে কানেকশনই এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই এসব আসন হয়ে পড়ে অনেকটা অলংকারিক।
চতুর্থত, নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা থাকে না বলে সংরক্ষিত আসন অলংকৃত করা প্রতিনিধিদের জনগণের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। বস্তুত, এসব নারী মূলত ‘দায়বদ্ধ’ থাকেন দলীয় কর্তাব্যক্তিদের কাছে। পঞ্চমত, সাধারণ আসনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তুলনায় সংরক্ষিত আসনে মনোনীত নারীদের ক্ষমতা ও দায়দায়িত্ব বহুলাংশে ভিন্ন। তাই এটি একটি অন্তর্ভুক্তিকরণমূলক (inclusive) পদ্ধতি নয়—সংরক্ষিত আসনে মনোনীত নারীরা ক্ষমতা-কাঠামোর বাইরেই থেকে যান। ষষ্ঠত, এটি নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য স্বয়ংক্রিয় ও কার্যকর পদ্ধতি নয়। কারণ, সংরক্ষণ পদ্ধতি বিলুপ্ত হলে সংরক্ষিত আসনে মনোনীত প্রতিনিধিদের সাধারণ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়ে আসার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ।
নির্বাচনভিত্তিক কোটা পদ্ধতিরও কতগুলো গুরুতর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রথমত, সাধারণ আসনের তুলনায় এ ক্ষেত্রে সংরক্ষিত নারী আসনগুলোর পরিধি বড় এবং ভোটারের সংখ্যাও বেশি হয়। তাই এটি একটি অসম পদ্ধতি। এসব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য অনেক বেশি সময় ও শ্রম দিতে এবং অর্থ ব্যয় করতে হয়। বৃহত্তর আসনের প্রতিনিধিত্ব করাও অনেক বেশি কষ্টসাধ্য। দ্বিতীয়ত, এ পদ্ধতিতে দ্বৈত প্রতিনিধিত্ব বিরাজ করে। অর্থাৎ দুজন প্রতিনিধি—একজন সাধারণ আসন, আরেকজন সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি—প্রত্যেক আসনের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। ফলে তাঁদের মধ্যে দায়দায়িত্ব বিভাজন দুরূহ হয়ে পড়ে এবং তাঁদের মধ্যে সাধারণত সহযোগিতার পরিবর্তে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সম্পর্কই গড়ে ওঠে। তৃতীয়ত, প্রতিটি সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিত (পুরুষ) সদস্যদের তুলনায় সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিদের ক্ষমতা ও দায়দায়িত্ব কার্যত ভিন্ন। তাই এটিও একটি অন্তর্ভুক্তিকরণ পদ্ধতি নয়—এসব সংরক্ষিত আসনকে অনেকে ‘অতিরিক্ত’ ও অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করেন। চতুর্থত, এ ধরনের কোটা সাধারণত শতাংশ (যেমন, ৩৩ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশ) হিসাবে প্রকাশ করা হয় এবং এতে একটি শুভঙ্করের ফাঁকি বিরাজমান। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের প্রতি তিনটি নির্বাচনী এলাকা নিয়ে একটি সংরক্ষিত নারী আসন গঠিত হয় বলে এটিকে এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষণ পদ্ধতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু বাস্তবে মোট ১২ জন (সাধারণ আসনের নয়জন+সংরক্ষিত আসনের তিনজন) সদস্যের মধ্যে তিনজন নারী—অর্থাৎ নারীর প্রতিনিধিত্ব এক-চতুর্থাংশ মাত্র।
কোটা-ব্যবস্থার মধ্যে উৎকৃষ্টতম পদ্ধতি হলো ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সব আসন থেকে পর্যায়ক্রমে একজন নারী সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ পান। যদি আমাদের জাতীয় সংসদের এক-তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকে এবং এগুলো ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে পূরণের সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে প্রথম টার্মে লটারি কিংবা অন্য কোনো পদ্ধতিতে ১০০ আসন চিহ্নিত করে এগুলো নারীদের জন্য সংরক্ষিত করা হবে। এভাবে নির্ধারিত ১০০টি আসনে শুধু নারীরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অন্য ২০০ আসন নারী-পুরুষ উভয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যই উন্মুক্ত থাকবে। পরবর্তী নির্বাচনে আগেরবারের ২০০টি উন্মুক্ত আসনের মধ্য থেকে লটারি কিংবা অন্য কোনো পদ্ধতিতে ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত করা হবে। অন্য ২০০ আসন, যার মধ্যে প্রথমবারের ১০০ সংরক্ষিত আসন অন্তর্ভুক্ত, নারী-পুরুষ উভয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। তৃতীয় টার্মে অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষিত হবে এবং অন্য ২০০ আসন উন্মুক্ত হয়ে যাবে। লক্ষণীয় যে এ পদ্ধতিতে মোট সংসদীয় আসনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় না।
ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে প্রতিটি সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা থাকে এবং এসব নির্বাচনী এলাকা আইনগতভাবে সাধারণ আসনের নির্বাচনী এলাকার সমতুল্য। বস্তুত এ পদ্ধতিতে সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনের আয়তন ও ভোটারের সংখ্যার দিক থেকে সমতা বিরাজ করে। এসব আসন থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা ও দায়দায়িত্বের মধ্যেও কোনো পার্থক্য থাকে না—সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অতিরিক্ত নন। তাঁরা সবাই ভোটারদের কাছে দায়বদ্ধ। তাই এটি একটি অন্তর্ভুক্তিকরণ পদ্ধতি। এতে সংরক্ষিত আসন প্রতীকী হওয়ার কোনো অবকাশ থাকে না। এ পদ্ধতিতে তিন টার্মে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকা থেকে অন্তত একজন নারী নির্বাচিত হয়ে আসেন।
ঘূর্ণায়মান পদ্ধতির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য এটি একটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি। দ্বৈত প্রতিনিধিত্বের অনুপস্থিতিতে এ পদ্ধতিতে যোগ্য ও কর্মদক্ষ নারীরা তাঁদের নির্বাচনী এলাকাকে ‘কালটিভেট’ বা গড়ে তোলার সুযোগ পান, যা পরবর্তী নির্বাচনে পুরুষদের সঙ্গে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়ে আসার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ফলে এ পদ্ধতিতে সংরক্ষিত আসনের বাইরে থেকেও—অর্থাৎ উন্মুক্ত আসন থেকেও নারীদের নির্বাচিত হয়ে আসার সম্ভাবনা নিশ্চিত হয়। তাই কোটার মাধ্যমে নির্ধারিত আসনের থেকে বেশি আসনে নারীরা নির্বাচিত হয়ে আসেন। সুতরাং, ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে একসময় নারীর সমপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য কোটার প্রয়োজনীয়তাই ফুরিয়ে যায়।
উল্লেখ্য, ভারতীয় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় কোটা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যা অত্যন্ত কার্যকর। পঞ্চায়েত পর্যায়ের ইতিবাচক অভিজ্ঞতার আলোকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি করার জন্য এ বছরের প্রথম দিকে ভারতীয় রাজ্যসভায় ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিভিত্তিক একটি বিল পাস হয়। দুর্ভাগ্যবশত ভারতীয় লোকসভায় বিলটি এখনো পাস হয়নি।
ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি যে নির্বাচনভিত্তিক পদ্ধতি থেকে উৎকৃষ্টতর, তা বাংলাদেশ ও ভারতের অভিজ্ঞতা থেকেই সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তুলনায় ২০০৩ সালের নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসনে প্রার্থীর সংখ্যা ৪৩ হাজার ৯৬৯ থেকে কমে ৪৩ হাজার ৭৬৪-তে এসে দাঁড়িয়েছিল, যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে প্রার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়া উচিত ছিল। পক্ষান্তরে, ভারতের পঞ্চায়েতে নির্বাচিত নারী সদস্যদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যেমন, ভারতীয় পঞ্চায়েতের তিন স্তরে—গ্রাম, মধ্য (পঞ্চায়েত সমিতি) এবং জেলা মোট নারী সদস্যের সংখ্যা ২০০২ সালে প্রায় পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার থেকে ২০০৮ সালে প্রায় ১০ লাখ ৪০ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতে নারী প্রতিনিধির সংখ্যা বেড়েছে ১৩ হাজার ৩০০ থেকে ২১ হাজার ৩৫১-তে।
কোটা পদ্ধতির কয়েকটি সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। একটি সীমাবদ্ধতা হলো, এটি সবচেয়ে উপযোগী সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণে। কারণ, তারা তাদের সংখ্যার কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিনিধিত্ব অর্জন করতে পারে না। কিন্তু নারীরা সংখ্যালঘু নয় এবং এটি তাদের জন্য সবচেয়ে উপযোগী নয়। আরেকটি সমস্যা হলো, এ পদ্ধতিতে অর্থ-বিত্ত ও শিক্ষার দিক থেকে অপেক্ষাকৃত অগ্রসর নারীরা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকেন। তবে সব নির্বাচনের ক্ষেত্রেই এ সমস্যা বিরাজমান। এ ছাড়া নিজেদের আসন হারানোর ভয়ে সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিত পুরুষ সদস্যরা এর বিরোধিতা করতে পারেন, যা করছেন ভারতীয় লোকসভার সদস্যরা। কিন্তু কোনো সাংসদেরই কোনো আসনে জন্মগত অধিকার নেই কিংবা একটি দেশের নির্বাচন-পদ্ধতি তথা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একদল ব্যক্তির নির্বাচিত হওয়ার কাছে জিম্মি হয়ে যেতে পারে না। আবার অনেক সময় অভিযোগ করা হয় যে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে পুরুষ আত্মীয়স্বজনেরা সংরক্ষিত আসনগুলো ‘গরম’ (warm) বা নিজেদের আয়ত্তে রাখার জন্য নারীদের ব্যবহার করেন, যাতে সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা শেষ হলে সে আসনগুলো পুনরুদ্ধার করা সহজ হয়। কিন্তু এটি একটি ঢালাও অভিযোগ। উপরন্তু ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি হতে হবে একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা। সর্বোপরি কোনো পদ্ধতিই সম্পূর্ণভাবে ত্রুটিমুক্ত নয়। ত্রুটি সত্ত্বেও সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে এবং বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের সবচেয়ে কম ত্রুটিসম্পন্ন পদ্ধতি বেছে নিতে হবে।
পরিশেষে, এটি সুস্পষ্ট যে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ব্যবহূত তিন ধরনের বিকল্পের মধ্যে ঘূর্ণায়মান কোটা পদ্ধতি সর্বোত্তম। প্রতিবেশী ভারতের পঞ্চায়েতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, সেখানে একটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ক্রমাগতভাবে নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধিতে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি কার্যকারিতা প্রদর্শন করছে। এ অবস্থায় অদূর ভবিষ্যতে ভারতীয় স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থায় যথাযথ সংখ্যক নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কোটা পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তাই ফুরিয়ে যাবে এবং তা বিলুপ্ত করা সম্ভব হবে। এ অভিজ্ঞতার আলোকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির জন্য ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিভিত্তিক কোটা প্রচলনের লক্ষ্যে ভারতীয় রাজ্যসভায় ইতিমধ্যেই একটি আইন পাস করা হয়েছে, যা বর্তমানে লোকসভার বিবেচনাধীন। আশা করি, সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটি আমাদের জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিভিত্তিক কোটা প্রথা প্রচলনের সুপারিশ করবে, যা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন-সম্পর্কিত নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নেও সহায়ক হবে। আরও আশা করি, সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে কমিটি ‘পিসিমল্’ (piecemeal) ও এডহক (adhoc) ভিত্তিতে অগ্রসর হবে না এবং তাড়াহুড়ো করবে না।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশ।
No comments