বিলম্বিত বিচার

দরিদ্র ও দুর্বল মানুষকে রক্ষা করতে হবে ইংরেজিতে একটা কথা আছে : জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড। অর্থাৎ সময়মতো বিচারকাজ সম্পন্ন করা না হলে সেটি হয় মানুষের ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির প্রত্যাশাকে অস্বীকার করারই নামান্তর। তা-ই ঘটছে আমাদের আদালতে, বিশেষ করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে।


এসব আদালতে হাজার হাজার মামলা বছরের পর বছর বিচারাধীন। অন্যান্য সরকারি কাজ করার পর ম্যাজিস্ট্রেটরা যেটুকু সময় পান, সেটুকু সময়ে তাঁরা যে কয়টি মামলার নিষ্পত্তি করেন, মামলা আসে এর চেয়ে অনেক বেশি। ফলে প্রতিদিনই বাড়ছে মামলার জট। আর বিচারপ্রার্থীরা আর্থিক ও শারীরিক, উভয় দিক থেকেই অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। দিনের পর দিন তাঁদের আদালতের আঙিনায় ধরনা দিতে হচ্ছে। কেউ কেউ আট বা ১০ বছর ধরে মামলা চালিয়ে আসছেন, কিন্তু মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এসব কারণে অনেকেই এখন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে যেসব ছোটখাটো মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেসব মামলা পরিচালনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এ পরিস্থিতি নাগরিকের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারের সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ নয়।
গতকাল কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কেবল ঢাকার সাতজন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলা বিচারাধীন তিন হাজার ৯৮১টি। এর মধ্যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মনোজ কুমার রায়ের আদালতে গত মার্চে মামলা বিচারাধীন ছিল ৮৬৮টি। ওই আদালতে মার্চ মাসে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৮৮টি এবং নতুন মামলা এসেছে ৩৬২টি। এভাবে প্রতি মাসেই মামলার পরিমাণ কেবল বেড়েই চলেছে। জানা যায়, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা হওয়ার পর ছোটখাটো কিছু বিষয়ে বিচারের দায়িত্ব দেওয়া হয় নির্বাহী হাকিমদের। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে জমিজমার বিরোধের ক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদর্শনের নালিশ নিষ্পত্তি করা, দলিলপত্র উদ্ধারে কার্যকর আদেশ প্রদান, ভিকটিম উদ্ধারের আদেশ প্রদান, নিরাপত্তার প্রশ্নে নালিশ ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, জমিজমার বিরোধ নিয়ে দেশে প্রতিনিয়ত হতাহতের ঘটনা ঘটছে। প্রতিদিনই পত্রিকাগুলোতে এ ধরনের অনেক খবর ছাপা হচ্ছে। ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনাও অনেক বেড়ে গেছে। এসবের জন্য এই বিলম্বিত বিচার কি অনেকাংশেই দায়ী নয়? এমনিতেই দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। অহরহ ঘটছে খুন-রাহাজানির মতো অসংখ্য অপরাধের ঘটনা। অনেক ক্ষেত্রে তা সামাজিক স্থিতিকেও বিনষ্ট করছে। এমতাবস্থায় বিচারের এই দীর্ঘসূত্রতা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
সাধারণত সবলরা গায়ের জোরে বিরোধপূর্ণ অনেক কিছু নিজেরাই মীমাংসা করে নেয়। আর সমাজের দুর্বল ও দরিদ্র শ্রেণীর মানুষই অন্যায়ের শিকার হয়ে আদালতে আসেন প্রতিকার পাওয়ার আশায়। তাঁদের অনেকেরই বছরের পর বছর মামলা পরিচালনার মতো অর্থ থাকে না। সবলের অত্যাচার থেকে বাঁচারও উপায় থাকে না। এই পরিস্থিতিতে তাঁদের সামনে সবলের কাছে আত্মসমর্পণ করা কিংবা মুখ বুজে সহ্য করা বা নীরবে অশ্রু বিসর্জন দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। সমাজের এই দুর্বল অংশের নিরাপত্তা দেওয়া, সবলের অত্যাচার থেকে তাঁদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সংবিধান রাষ্ট্রকে দিয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব পালন করছে কি? রাষ্ট্রের কর্ণধার এবং দেশের বিচার বিভাগের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, বিচার বিলম্বিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি যথাসম্ভব কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হোক।

No comments

Powered by Blogger.