ভারত-রাষ্ট্রপতি ভবন প্রণবের পছন্দ by অমিত বসু

অসংখ্য দাবি পূরণ হয়নি বলে মমতা এখন প্রণববিরোধী। পুরনো প্রাপ্তির জন্য ছিটেফোঁটা কৃতজ্ঞতা বোধ নেই। রাষ্ট্রপতি পদে প্রণব মুখার্জিকে তিনি সমর্থন করেননি। তার পছন্দের প্রার্থী লোকসভার স্পিকার মীরা কুমার, পশ্চিমবঙ্গের সাবেক রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী বা সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম।


প্রণবকে খারিজ করার অন্য কারণও আছে। প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি হলে আবেগের প্লাবনে বাঙালি ভাসবে। সেই ঢেউয়ে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস উজ্জীবিত হবে। তৃণমূলে ভাটার টান দেখা দেবে। নিজের ইমেজ রক্ষার স্বার্থে এবং তৃণমূলকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে প্রণব মুখার্জিকে
আটকানো দরকার


শেয়াল কাঁটার অনেক নাম, স্বর্ণক্ষীরা, সুবর্ণা, হেমদুগ্ধী, কাঞ্চনী, রুক্মিণী। আরও আছে, সব বলে শেষ করা যাবে না। ভেষজ বিশেষজ্ঞরা এভাবেই ডাকেন আদর করে। কণ্টক এতটা তারিফ পায় কী করে! হাজার হোক কাঁটা বই তো নয়। কারণ একটাই, কাঁটা হলেও খুব কাজের। মোক্ষম ঔষধি বৃক্ষ। জটিল ব্যাধিতে ধন্বন্তরি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রণব মুখার্জির রাস্তায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাঁটা মনে করা হয়েছিল। হয়েছিলেনও। তবে আটকাতে পারেননি। এক বছর আগে মমতা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই কংগ্রেস বিপাকে। মারাত্মক চাপে জর্জরিত। তার একের পর এক দাবি-দাওয়া কালবৈশাখীর মতো ওলট-পালট করেছে কেন্দ্রীয় সরকারের অস্তিত্ব। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তাকে বোঝাতে নাজেহাল। অকালে বন্ধু খুঁজে পায়নি কংগ্রেস। এবার মমতাই মিত্র লাভের রাস্তা চওড়া করে দিয়েছেন। কংগ্রেসের পুরনো বন্ধুদের কাছে টেনে এনেছেন। যাদের সঙ্গে মুখ চাওয়া-চাওয়ি বন্ধ ছিল তারাও চোখ তুলে চাইছে। বাতাসে শূন্যতা তৈরি হলে এপাশ-ওপাশ থেকে মৌসুমি বায়ু হুহু করে ছুটে আসে, সেভাবেই আছড়ে পড়ছে ছিঁড়ে দূরে সরে যাওয়া দল। কংগ্রেস নিশ্চিন্ত। ইউপিএ সরকারের পতনের শঙ্কা নেই। মমতার ব্ল্যাকমেইলিংয়ে কুঁকড়ে যাওয়ার প্রশ্ন থাকছে না। ২০১৪ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে। পরিস্থিতির পরিবর্তনে মমতার সুর নরম। কথার কোমল প্রলেপে বোঝাতে চাইছেন, তিনি কাঁটা নন, ফুল। বিষকণ্টক বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ভয় কেন? তিনি পুষ্পসম চারপাশ সুরভিত করার জন্যই। ইউপিএ সরকার তিনি ছাড়বেন না। শেষদিন পর্যন্ত সঙ্গে থাকবেন।
এই থাকাটা নিজের গরজে, না সরকারের উপকারে? মমতার কি আর কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে? বিজেপির নৌকায় উঠলে আরও বিপদ। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দরিয়ায় তারা হাবুডুবু খাচ্ছে। মমতাকে নিরাপত্তা দেবে কী করে? সাবেক বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিং কলকাতায় এসে মমতাকে তাদের নৌকায় আশ্রয় নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। মমতা চুপ। পচা শামুকে পা কাটার মতো ভুল তিনি করবেন না। তাকেও বাঁচতে হবে। ২০১৬ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকাটা জরুরি। বিজেপির নড়বড়ে নৌকায় উঠে এতটা সময় পার করা যাবে না। বরং নৌকা উল্টে ডোবার ভয় বেশি।
মমতার নিজের তরণীতে ছিদ্র দেখা দিয়েছে। সহযাত্রীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করছেন। বাংলা আকাদেমীর সভানেত্রীর পদে ইস্তফা মহাশ্বেতা দেবীর। নির্বাচনী পর্বে যিনি মমতার হয়ে তুফান তুলেছিলেন, আজ তিনি মমতার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন। বলছেন, মমতা ফ্যাসিস্ট, মানুষকে অসম্মান করতে তার বাধে না। তৃণমূলের পালে যিনি হাওয়া লাগিয়েছেন সেই শিক্ষাবিদ সুনন্দ সান্যাল, কবি তরুণ সান্যালরা মমতার ছায়া মাড়ান না। চিৎকার করে তারা বলছেন, এবার তৃণমূল উৎপাটিত হবে, রাজ্য জাহান্নামে যাবে। বিশ্বনন্দিত শিল্পী গণেশ পাইন হতাশ গলায় এ সরকারের থেকে মুক্তি কামনা করেছেন।
গল্প এখানেই শেষ নয়। তৃণমূলের সহসভাপতি দীপক ঘোষ হাটে হাঁড়ি ভেঙেছেন। একদা মমতা-ঘনিষ্ঠ দীপক আচমকা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে কলম ধরেছেন। বই লিখেছেন, 'মমতা ব্যানার্জীকে আমি যেমন চিনেছি'। ২০০৬ সালের ৪ ডিসেম্বর থেকে সিঙ্গুরে কৃষকদের জমি ফেরত দেওয়ার দাবিতে মমতা ২৫ দিন অনশন করেছিলেন। তৃণমূল নেতাদের বক্তব্য ছিল, এমন অনশন মহাত্মা গান্ধীও করতে পারেননি। এটা নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। দীপক ঘোষ তার বইয়ে অষ্টম পরিচ্ছদে লিখেছেন, 'যারা বিশ্বাস করেন যে, মমতা ব্যানার্জী ২৫ দিন অনশন করেছিলেন, তাদের জানার কোনো উপায় নেই যে, তার সেই অনশন ছিল রাতে চিকেন স্যান্ডউইচ ও দিনভর চকোলেট খেয়ে।'
এসপ্লানেডের মেট্রো চ্যানেলের অনশন মঞ্চে তদারকির সর্বময় কর্তা ছিলেন দীপক ঘোষ। মমতার অনশন সম্পর্কে তার চেয়ে বেশি কারও জানার কথা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, মমতার শত্রু হয়ে গোপন তথ্য ফাঁস করার কারণ কী? জবাব একটাই, দীপককে ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলেছেন মমতা। দীপক আগে তৃণমূলের বিধায়ক ছিলেন। এবার তাকে প্রার্থী করা হয়নি। কাজ ফুরোলেই ফেলে দেওয়াটা মমতার স্বভাব। কিন্তু তার জানা উচিত, যাকে তিনি নিচে নামাবেন, তিনিই তাকে নিচে টানবেন।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির সহযোগিতার কথা ভুলে যান কী করে মমতা? মমতার নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সহজ হয়েছে প্রণব কাণ্ডারি ছিলেন বলেই। সব দিক থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। তিনি যা চেয়েছেন তা-ই দিয়েছেন। আপসরফার ক্ষেত্রে কংগ্রেসের ক্ষতি স্বীকার করে তৃণমূলকে সিংহভাগ আসন ছাড়তে দ্বিধা করেননি। কংগ্রেস নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হওয়া সত্ত্বেও মমতাকে চূড়ান্ত সাফল্যের রাস্তায় টেনে এনেছেন প্রণব মুখার্জি। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বিশেষ আর্থিক প্যাকেজও দেওয়া হয়েছে। পেতে পেতে মমতার প্রত্যাশাও বেড়েছে। যা পাওয়ার কথা নয়, তা-ই তিনি চেয়ে বসেছেন। তিনি দাবি করেছেন, রাজ্যের দু'লাখ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করা হোক। সাংবিধানিকভাবে সেটা অসম্ভব। পশ্চিমবঙ্গের দেনা ছাড় দিলে অন্য রাজ্যকেও সে সুবিধা দিতে হয়। ২৮টি রাজ্যের ঋণ মঞ্জুর করলে কেন্দ্রীয় সরকারই তো দেউলিয়া হয়ে যাবে। মমতা যখন বায়না ধরেন, যুক্তি মানেন না।
অসংখ্য দাবি পূরণ হয়নি বলে মমতা এখন প্রণববিরোধী। পুরনো প্রাপ্তির জন্য ছিটেফোঁটা কৃতজ্ঞতা বোধ নেই। রাষ্ট্রপতি পদে প্রণব মুখার্জিকে তিনি সমর্থন করেননি। তার পছন্দের প্রার্থী লোকসভার স্পিকার মীরা কুমার, পশ্চিমবঙ্গের সাবেক রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী বা সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম। প্রণবকে খারিজ করার অন্য কারণও আছে। প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি হলে আবেগের প্লাবনে বাঙালি ভাসবে। সেই ঢেউয়ে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস উজ্জীবিত হবে। তৃণমূলে ভাটার টান দেখা দেবে। নিজের ইমেজ রক্ষার স্বার্থে এবং তৃণমূলকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে প্রণব মুখার্জিকে আটকানো দরকার।
প্রণব মুখার্জি অবশ্য মমতার ভরসায় দাঁড়িয়ে নেই। ধীর পায়ে রাষ্ট্রপতি ভবনের দিকে এগোচ্ছেন। সহাস্যে সাংবাদিকদের তিনি জানিয়েছেন, পছন্দের এই ভবনের ভেতর মোগল গার্ডেনটা তার খুব পছন্দের। রোজ সকালে এখানে হাঁটতে পারলে ভালো লাগবে।

অমিত বসু :ভারতীয় সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.