গণকর্মচারী আইনের পরিকল্পনা by এ এম এম শওকত আলী
সম্প্রতি কিছু দৈনিকে নতুন গণকর্মচারী আইন প্রণয়নের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা 'বিশেষজ্ঞ'দের মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে নিয়োগের কথা ভাবছেন। যুক্তি হলো, এর ফলে প্রশাসন সমৃদ্ধ হবে। গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। সম্ভাব্য বিশেষজ্ঞদের যোগ্যতা ও নিয়োগ প্রক্রিয়া কী হবে তা এখনো স্বচ্ছ নয়।
এ পর্যন্ত যা জানা গেছে, তা হলো একটি টাস্কফোর্স গঠন করে এ বিষয়ে রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে। এরপর খসড়া রূপরেখা সরকারি ওয়েবসাইটে প্রদর্শনের মাধ্যমে জনমত আহ্বান করা হবে। পরবর্তী পর্যায়ে খসড়াটি সচিব কমিটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতি চূড়ান্ত অনুমোদন প্রদান করবেন। বলা নিষপ্রয়োজন, প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশের পর রাষ্ট্রপতির অনুমোদন স্বতঃসিদ্ধ। সংবিধানে এমনই বিধান করা হয়েছে। সংসদীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোতে সব দেশেই এ প্রথা প্রচলিত।
যে বিষয়টি স্পষ্ট নয়, তা হলো আইন প্রণয়নের অনুসরণীয় নিয়ম অনুযায়ী আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদ অনুমোদন দেওয়ার কথা। এরপর বিল আকারে খসড়াটি সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি সম্মতি প্রদান করবেন। পক্ষান্তরে জরুরি হলো মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করতে ক্ষমতাবান। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি এত জরুরি কেন হবে, তা অজানা। অবশ্য দৈনিকে যে প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে, তা নাও হতে পারে।
অতীতে প্রথমে সত্তরের দশকে এবং পরে আশির দশকে এ ধরনের নিয়োগ সীমিত ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছিল। মূলত আশির দশকেই বিষয়টি আংশিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভ করে। ওই সময় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার কাঠামোয় রাষ্ট্রপতিকে সচিবালয়ের উচ্চ পর্যায়ে যেকোনো ব্যক্তিকে মোট পদের ১০ শতাংশ পর্যন্ত নিয়োগ প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়। ১৯৯১-পরবর্তী কোনো গণতান্ত্রিক সরকার কাঠামো এ প্রথা পরিবর্তন করেনি। বরং এ ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে সচিবালয়ে কিছু ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ধরনের নিয়োগের পদ্ধতি স্বচ্ছ ছিল না। এ কারণে সিদ্ধান্তও ছিল বিতর্কিত। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, পরিবর্তনের পরই নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা স্বীয় পদ থেকে সরে গেছেন। অর্থাৎ এ নীতিতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের চাকরিসীমা সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাসীন দলের সময়সীমার মধ্যেই সীমিত ছিল।
সংশ্লিষ্ট সংবাদে একজন প্রভাবশালী নীতিনির্ধারকের কিছু বক্তব্যও এ পরিকল্পনার সপক্ষে প্রকাশ করা হয়। যুক্তিগুলো ছিল- এক. বহিরাগত ও দেশীয় পরামর্শকদের মত গ্রহণের বিষয়টি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। দুই. দেশের মধ্যে যথেষ্ট যোগ্য বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যাঁদের ব্যবহার করা যায়। তিন. এসব বিশেষজ্ঞকে সচিব হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে, অন্যথায় তাঁদের কোনো ক্ষমতাই থাকবে না এবং চার. পৃথিবীর অনেক দেশে এ ধরনের প্রথা রয়েছে। কোনো দেশের কথা এ বিষয়ে উল্লেখ ছিল না। উল্লেখ করা হলে ভালো হতো। এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য, সংবিধান অনুযায়ী জনপ্রশাসনের নিয়োগ ও শৃঙ্খলার বিষয়ে কোনো পরিবর্তনের জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মতামত গ্রহণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সংবাদে এ বিষয়ের কোনো উল্লেখ নেই। হয়তো বা খসড়া চূড়ান্ত করার সময়ে এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। প্রস্তাবিত আইন সম্পর্কে বলা যায়, বর্তমান সরকারের আমলেই একটি খসড়া প্রণয়ন করা হয়। উচ্চ পর্যায়ের এক নীতিনির্ধারক ২০১০ বা ২০১১ সালের মার্চ মাসেই এ খসড়া সংসদে প্রস্তাবনা আকারে উপস্থাপন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু তা ২০১২ সালের মার্চ মাসেও হয়নি। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন। কিন্তু কারণ কী তা বলেননি।
বাংলাদেশে সব সরকারের আমলেই জন-প্রশাসন সংক্রান্ত বহু সমীক্ষা হয়েছে। এ সমীক্ষাগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক. উন্নয়ন সহযোগী সাহায্যপুষ্ট সমীক্ষা। দুই. সরকার কর্তৃক গঠিত কমিশন বা কমিটির সমীক্ষা। এর সংখ্যা দুই ডজনের বেশি। কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি একটিও। যে খসড়া আইনটি এর আগে সংসদে পেশ করার কথা বলা হয়েছে, সে খসড়াটি ছিল জাতিসংঘ সাহায্য কর্মসূচি (ইউএনডিপি) কর্তৃক সাহায্যপুষ্ট। অনুমান করা যায়, এ খসড়াটিও জন-প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করা হয় এবং জনমতও আহ্বান করা হয়। কিন্তু চূড়ান্ত খসড়া কেন এখন প্রত্যাখ্যান করা হয় তা সম্পূর্ণ অজানা।
২০০৯-১০ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক সাহায্যপুষ্ট কয়েকটি সমীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। বিষয়গুলো ছিল পদোন্নতিবিষয়ক নীতি, মাঠ প্রশাসনে গতিশীলতা ও বিশেষায়িত মন্ত্রণালয়ে নিযুক্তির জন্য সব মন্ত্রণালয়কে কাজের বিষয় অনুযায়ী কয়েকটি গুচ্ছে বিন্যাস করা। দুজন দেশীয় বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে প্রতিবেদন যথাসময়ে দাখিল করেন। জন-প্রশাসন মন্ত্রণালয় যথারীতি তাদের মন্তব্য-বক্তব্যও প্রদান করে। এসবের আলোকে সমীক্ষা চূড়ান্তরূপ লাভ করে। এরপর সবাই নিশ্চুপ।
উল্লেখ্য, ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংক মন্ত্রণালয়ভিত্তিক গুচ্ছ ও পদোন্নতিবিষয়ক নীতি সম্পর্কেও একজন দেশীয় বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে সমীক্ষা-সংক্রান্ত প্রতিবেদন সম্পন্ন করা হয়। এটা আদৌ সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে কি না এবং হলে সরকার গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করেছে কি না তাও সম্পূর্ণ অজানা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে সরকারি নীতিনির্ধারকের ব্যয়বহুল-সংক্রান্ত যুক্তিটি একেবারেই অগ্রাহ্য করা যায় না। তবে প্রশ্ন হলো, বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর দেশে পরামর্শকের ব্যবহার হ্রাস পাবে কি না। এ নিশ্চয়তা কোনো সরকারই দিতে পারবে না। কারণ ঋণ বা অনুদানের শর্তেই এ বিষয় উল্লেখ থাকবে।
কোনো বিশেষজ্ঞকে সরকারের সচিব করার প্রথা অন্য দেশে কতটুকু এবং কিভাবে রয়েছে তার ব্যাখ্যা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের স্পয়েল সিস্টেম (Spoil System) বিষয়টি এ দেশে অনেকেই জোরেশোরে বলে থাকেন। বিষয়টির প্রকৃত অবস্থা না জেনেই এ কথা বলা হয়। আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র সুদূর অতীতে প্রবর্তিত এ প্রথা থেকে ধীরে ও দৃঢ়ভাবে সরে এসেছে। দুই দশক আগের এ-সংক্রান্ত একটি প্রকাশনা অনুযায়ী এ প্রথার মাধ্যমে নিয়োগ কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বমোট কর্মচারীর সংখ্যার ১০ শতাংশও হবে না। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এরাও বিদায় হয়। কানাডাও এ পথেই এগিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া পরীক্ষামূলকভাবে দুই দশক আগে এ প্রথা চালু করলেও তা সম্পূর্ণ সফল হয়নি। নেদারল্যান্ডসে উচ্চতর সিভিল সার্ভিস গঠন করা হয়। কর্মরত দক্ষ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তারাই এর সুযোগ পান।
যুক্তরাজ্যে লৌহমানবী মার্গারেট থ্যাচারের আমলেও বহিরাগত বা বিশেষজ্ঞদের সচিব পদে নিয়োগের পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু সব মহলের প্রবল আপত্তির কারণে থ্যাচার এটা বাস্তবায়ন করেননি। ওই সময় যুক্তি দেওয়া হয়, একই কর্মচারী ভিন্ন মতাদর্শের সব সরকারের কাজ করতে সক্ষম নয়। পাল্টা যুক্তি ছিল : একজন স্থায়ী গণকর্মচারীই ভিন্ন মতাবলম্বী সব সরকারের জন্য দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম। কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি বহুদলীয় গণতন্ত্র। অন্যান্য জোরালো যুক্তি ছিল- এক. স্থায়ী গণকর্মচারী যেকোনো ক্ষমতাসীন দলকে বলতে পারবে অতীতে কী ধরনের নীতি সফল বা ব্যর্থ হয়েছে এবং এর ফলে ক্ষমতাসীন দল নীতি প্রণয়নে অধিকতর সচেতন হবে। দুই. স্থায়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কর্মরত ব্যক্তিদের প্রাতিষ্ঠানিক স্মৃতি (Institutional Memory) নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সহায়ক এবং তিন. গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সরকারি কর্মচারীদের অন্যতম প্রধান কর্তব্য হলো জনস্বার্থ রক্ষা- সংকীর্ণ দলীয় মতাদর্শ নয়।
২০০৯ সাল থেকে প্রশাসনে দক্ষতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধির কথা বারবার বলা হচ্ছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টি একাধিকবার উচ্চারণ করেছেন। তিনি জন-প্রশাসন মন্ত্রণালয়েরও মন্ত্রী। অনুমান করা যায়, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সন্তোষজনক ফল পাওয়া সম্ভব হয়নি। বিষয়টি নিঃসন্দেহে অনুসন্ধানযোগ্য। প্রশাসনে গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য সরকার আরো একটি পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করবে বলে শোনা গেছে। বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের বদলে ভবিষ্যতে বার্ষিক কর্মসম্পাদন মূল্যায়নের ভিত্তিতে পরবর্তী পদোন্নতি হবে। উল্লেখ্য, বিদ্যমান বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনেও কর্মসম্পাদন মূল্যায়নের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। অতীতে এ নিয়ে খুব একটা সমস্যা হয়নি। ১৯৯১-পরবর্তী সময় থেকেই এ প্রথার অবক্ষয় শুরু হয়।
পক্ষান্তরে উত্থাপিত যেকোনো বিষয় নিষ্পত্তির সময়সীমা সচিবালয় নির্দেশিকায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। কিন্তু এ বিধান অমান্য করাটাই রীতি। কারণ সব পর্যায়ে জবাবদিহিতার অভাব। এ বিষয়টি সব সময় জোরেশোরে বলা হয় কিন্তু কঠোরভাবে নিশ্চিত করার বিষয়ে কেউ আগ্রহী নয়।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
যে বিষয়টি স্পষ্ট নয়, তা হলো আইন প্রণয়নের অনুসরণীয় নিয়ম অনুযায়ী আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদ অনুমোদন দেওয়ার কথা। এরপর বিল আকারে খসড়াটি সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি সম্মতি প্রদান করবেন। পক্ষান্তরে জরুরি হলো মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করতে ক্ষমতাবান। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি এত জরুরি কেন হবে, তা অজানা। অবশ্য দৈনিকে যে প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে, তা নাও হতে পারে।
অতীতে প্রথমে সত্তরের দশকে এবং পরে আশির দশকে এ ধরনের নিয়োগ সীমিত ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছিল। মূলত আশির দশকেই বিষয়টি আংশিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভ করে। ওই সময় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার কাঠামোয় রাষ্ট্রপতিকে সচিবালয়ের উচ্চ পর্যায়ে যেকোনো ব্যক্তিকে মোট পদের ১০ শতাংশ পর্যন্ত নিয়োগ প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়। ১৯৯১-পরবর্তী কোনো গণতান্ত্রিক সরকার কাঠামো এ প্রথা পরিবর্তন করেনি। বরং এ ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে সচিবালয়ে কিছু ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ধরনের নিয়োগের পদ্ধতি স্বচ্ছ ছিল না। এ কারণে সিদ্ধান্তও ছিল বিতর্কিত। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, পরিবর্তনের পরই নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা স্বীয় পদ থেকে সরে গেছেন। অর্থাৎ এ নীতিতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের চাকরিসীমা সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাসীন দলের সময়সীমার মধ্যেই সীমিত ছিল।
সংশ্লিষ্ট সংবাদে একজন প্রভাবশালী নীতিনির্ধারকের কিছু বক্তব্যও এ পরিকল্পনার সপক্ষে প্রকাশ করা হয়। যুক্তিগুলো ছিল- এক. বহিরাগত ও দেশীয় পরামর্শকদের মত গ্রহণের বিষয়টি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। দুই. দেশের মধ্যে যথেষ্ট যোগ্য বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যাঁদের ব্যবহার করা যায়। তিন. এসব বিশেষজ্ঞকে সচিব হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে, অন্যথায় তাঁদের কোনো ক্ষমতাই থাকবে না এবং চার. পৃথিবীর অনেক দেশে এ ধরনের প্রথা রয়েছে। কোনো দেশের কথা এ বিষয়ে উল্লেখ ছিল না। উল্লেখ করা হলে ভালো হতো। এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য, সংবিধান অনুযায়ী জনপ্রশাসনের নিয়োগ ও শৃঙ্খলার বিষয়ে কোনো পরিবর্তনের জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মতামত গ্রহণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সংবাদে এ বিষয়ের কোনো উল্লেখ নেই। হয়তো বা খসড়া চূড়ান্ত করার সময়ে এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। প্রস্তাবিত আইন সম্পর্কে বলা যায়, বর্তমান সরকারের আমলেই একটি খসড়া প্রণয়ন করা হয়। উচ্চ পর্যায়ের এক নীতিনির্ধারক ২০১০ বা ২০১১ সালের মার্চ মাসেই এ খসড়া সংসদে প্রস্তাবনা আকারে উপস্থাপন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু তা ২০১২ সালের মার্চ মাসেও হয়নি। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন। কিন্তু কারণ কী তা বলেননি।
বাংলাদেশে সব সরকারের আমলেই জন-প্রশাসন সংক্রান্ত বহু সমীক্ষা হয়েছে। এ সমীক্ষাগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক. উন্নয়ন সহযোগী সাহায্যপুষ্ট সমীক্ষা। দুই. সরকার কর্তৃক গঠিত কমিশন বা কমিটির সমীক্ষা। এর সংখ্যা দুই ডজনের বেশি। কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি একটিও। যে খসড়া আইনটি এর আগে সংসদে পেশ করার কথা বলা হয়েছে, সে খসড়াটি ছিল জাতিসংঘ সাহায্য কর্মসূচি (ইউএনডিপি) কর্তৃক সাহায্যপুষ্ট। অনুমান করা যায়, এ খসড়াটিও জন-প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করা হয় এবং জনমতও আহ্বান করা হয়। কিন্তু চূড়ান্ত খসড়া কেন এখন প্রত্যাখ্যান করা হয় তা সম্পূর্ণ অজানা।
২০০৯-১০ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক সাহায্যপুষ্ট কয়েকটি সমীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। বিষয়গুলো ছিল পদোন্নতিবিষয়ক নীতি, মাঠ প্রশাসনে গতিশীলতা ও বিশেষায়িত মন্ত্রণালয়ে নিযুক্তির জন্য সব মন্ত্রণালয়কে কাজের বিষয় অনুযায়ী কয়েকটি গুচ্ছে বিন্যাস করা। দুজন দেশীয় বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে প্রতিবেদন যথাসময়ে দাখিল করেন। জন-প্রশাসন মন্ত্রণালয় যথারীতি তাদের মন্তব্য-বক্তব্যও প্রদান করে। এসবের আলোকে সমীক্ষা চূড়ান্তরূপ লাভ করে। এরপর সবাই নিশ্চুপ।
উল্লেখ্য, ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংক মন্ত্রণালয়ভিত্তিক গুচ্ছ ও পদোন্নতিবিষয়ক নীতি সম্পর্কেও একজন দেশীয় বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে সমীক্ষা-সংক্রান্ত প্রতিবেদন সম্পন্ন করা হয়। এটা আদৌ সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে কি না এবং হলে সরকার গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করেছে কি না তাও সম্পূর্ণ অজানা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে সরকারি নীতিনির্ধারকের ব্যয়বহুল-সংক্রান্ত যুক্তিটি একেবারেই অগ্রাহ্য করা যায় না। তবে প্রশ্ন হলো, বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর দেশে পরামর্শকের ব্যবহার হ্রাস পাবে কি না। এ নিশ্চয়তা কোনো সরকারই দিতে পারবে না। কারণ ঋণ বা অনুদানের শর্তেই এ বিষয় উল্লেখ থাকবে।
কোনো বিশেষজ্ঞকে সরকারের সচিব করার প্রথা অন্য দেশে কতটুকু এবং কিভাবে রয়েছে তার ব্যাখ্যা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের স্পয়েল সিস্টেম (Spoil System) বিষয়টি এ দেশে অনেকেই জোরেশোরে বলে থাকেন। বিষয়টির প্রকৃত অবস্থা না জেনেই এ কথা বলা হয়। আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র সুদূর অতীতে প্রবর্তিত এ প্রথা থেকে ধীরে ও দৃঢ়ভাবে সরে এসেছে। দুই দশক আগের এ-সংক্রান্ত একটি প্রকাশনা অনুযায়ী এ প্রথার মাধ্যমে নিয়োগ কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বমোট কর্মচারীর সংখ্যার ১০ শতাংশও হবে না। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এরাও বিদায় হয়। কানাডাও এ পথেই এগিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া পরীক্ষামূলকভাবে দুই দশক আগে এ প্রথা চালু করলেও তা সম্পূর্ণ সফল হয়নি। নেদারল্যান্ডসে উচ্চতর সিভিল সার্ভিস গঠন করা হয়। কর্মরত দক্ষ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তারাই এর সুযোগ পান।
যুক্তরাজ্যে লৌহমানবী মার্গারেট থ্যাচারের আমলেও বহিরাগত বা বিশেষজ্ঞদের সচিব পদে নিয়োগের পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু সব মহলের প্রবল আপত্তির কারণে থ্যাচার এটা বাস্তবায়ন করেননি। ওই সময় যুক্তি দেওয়া হয়, একই কর্মচারী ভিন্ন মতাদর্শের সব সরকারের কাজ করতে সক্ষম নয়। পাল্টা যুক্তি ছিল : একজন স্থায়ী গণকর্মচারীই ভিন্ন মতাবলম্বী সব সরকারের জন্য দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম। কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি বহুদলীয় গণতন্ত্র। অন্যান্য জোরালো যুক্তি ছিল- এক. স্থায়ী গণকর্মচারী যেকোনো ক্ষমতাসীন দলকে বলতে পারবে অতীতে কী ধরনের নীতি সফল বা ব্যর্থ হয়েছে এবং এর ফলে ক্ষমতাসীন দল নীতি প্রণয়নে অধিকতর সচেতন হবে। দুই. স্থায়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কর্মরত ব্যক্তিদের প্রাতিষ্ঠানিক স্মৃতি (Institutional Memory) নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সহায়ক এবং তিন. গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সরকারি কর্মচারীদের অন্যতম প্রধান কর্তব্য হলো জনস্বার্থ রক্ষা- সংকীর্ণ দলীয় মতাদর্শ নয়।
২০০৯ সাল থেকে প্রশাসনে দক্ষতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধির কথা বারবার বলা হচ্ছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টি একাধিকবার উচ্চারণ করেছেন। তিনি জন-প্রশাসন মন্ত্রণালয়েরও মন্ত্রী। অনুমান করা যায়, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সন্তোষজনক ফল পাওয়া সম্ভব হয়নি। বিষয়টি নিঃসন্দেহে অনুসন্ধানযোগ্য। প্রশাসনে গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য সরকার আরো একটি পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করবে বলে শোনা গেছে। বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের বদলে ভবিষ্যতে বার্ষিক কর্মসম্পাদন মূল্যায়নের ভিত্তিতে পরবর্তী পদোন্নতি হবে। উল্লেখ্য, বিদ্যমান বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনেও কর্মসম্পাদন মূল্যায়নের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। অতীতে এ নিয়ে খুব একটা সমস্যা হয়নি। ১৯৯১-পরবর্তী সময় থেকেই এ প্রথার অবক্ষয় শুরু হয়।
পক্ষান্তরে উত্থাপিত যেকোনো বিষয় নিষ্পত্তির সময়সীমা সচিবালয় নির্দেশিকায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। কিন্তু এ বিধান অমান্য করাটাই রীতি। কারণ সব পর্যায়ে জবাবদিহিতার অভাব। এ বিষয়টি সব সময় জোরেশোরে বলা হয় কিন্তু কঠোরভাবে নিশ্চিত করার বিষয়ে কেউ আগ্রহী নয়।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments