কৃষকের গলায় ফাঁস, দায়ভার কার? by ড. আনোয়ারুল ইসলাম বক্সী
কিছুদিন আগে একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবর ছিল নিম্নরূপ : 'উৎপাদিত কৃষিপণ্যের লাভজনক সরকারি দাম নির্ধারণ ও কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে দালাল ও ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য বন্ধসহ বিভিন্ন দাবিতে কৃষকরা আলু, শিম, কপি ও টমেটো লাগানোর রশি গলায় ঝুলিয়ে এ কর্মসূচি পালন করেন।'
খবরটি দেশের এক প্রান্তের, যেখানকার মানুষ যুগ যুগ ধরে মঙ্গা আর মহামারিকেই সঙ্গী করে জীবন পাড়ি দিয়ে চলছে। তাদের এ প্রতীকী ফাঁস আপাতভাবে মূল্যবঞ্চিত কিছু কৃষকের প্রতিবাদ বলে মনে হলেও মূলত এটি জাতীয় রাজনীতির তথা সাংবিধানিক গণতন্ত্রের উদাসীনতারই প্রমাণ। প্রতিবাদ কর্মসূচির দাবিনামা আর আমার মন্তব্যে কোনো সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়ার কথা নয়! ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে পণ্য বাজারজাতকরণে দালাল-ফড়িয়ারা কতটুকু লাভবান হচ্ছে সে হিসাব সুদূর সিডনিতে বসে নিয়মিত সংবাদ পাঠের মাধ্যমেই করতে পারি। কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত এক গ্রামেই আমার পারিবারিক খামার। খামারের দুধ, ডিম, শাক-সবজি, ফলমূল ইত্যাদি ফড়িয়াদের কাছেই বিক্রি হয় এবং সেই দর প্রায় প্রতিদিনই জেনে থাকি। আর ঢাকা শহরের বাজার দর তো নিয়মিত সংবাদ পাঠেই জানছি। তা থেকে মাঝেমধ্যে বিস্মিত হই যে দালাল-ফড়িয়াদের নামে যেসব প্রচার শোনা যায়, সে লাভ কোথায়। ঢালাওভাবে দালাল-ফড়িয়াদের জন্য সাফাই গাইতে বসিনি, বরং বলতে চাই যে দাবি আদায়ের বা সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রকৃষ্ট এবং স্থায়ী সমাধান চিন্তা করে সে লক্ষ্যে আন্দোলন করলেই কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যেতে পারে। আবার এটুকুও মনে রাখা দরকার যে দালাল-ফড়িয়ারাও শ্রমজীবী মানুষ বা এক ধরনের ব্যবসায়ী, যাঁরা রাত-দিন অর্থ এবং গতর দুই-ই খাটিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। দেশের সার্বিক প্রেক্ষাপটেই ঘাটে ঘাটে মাসোহারার বিনিময়েই তাঁদের ব্যবসায় টিকে থাকতে হয়। আর সরকারি দাম নির্ধারণ : কিছু কৃষিপণ্যের হতে পারে, সব কিছুর নয়। শাক-সবজির মতো দ্রুত পচনশীল পণ্যের ক্ষেত্রে এটা আরো দুরূহ। তবে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হলে লাভজনক মূল্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা কিছুটা হলেও আশা করা যেতে পারে। উদ্যোগটা হবে স্থানীয়ভাবে কৃষিশিল্প প্রতিষ্ঠার, উন্নত সার-বীজসহ কৃষি উপকরণ ও প্রযুক্তি সরবরাহের নিশ্চয়তা দানের, প্রতিষ্ঠা করতে হবে কৃষি তথ্যকেন্দ্র। এসব প্রতিষ্ঠার দাবি দেশের সব প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষক তথা জনসাধারণের সাংবিধানিক অধিকার।
স্বাধীনতার চার দশক পরও উত্তরের এ অঞ্চল অবহেলিত জনপদের খেতাব থেকে উত্তরণের স্বাদ পায়নি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এসব জনপদ এ যাবৎ অনেক কীর্তিমান মানব জন্ম দিয়েছে বা এ অবহেলিত জনপদের সুবাদেই অনেকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। অনেকেই বিভিন্ন সময় সংবিধানের ধারক-বাহকের মুখ্য ভূমিকায়ও আসীন ছিলেন। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে তাঁরা তাঁদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে যথাযথ নিয়োজিত থাকলে সবার সঙ্গে মেহনতি এ কৃষকদেরও উন্নতি হতো। প্রতীকী ফাঁস পরতে হতো না। সরকারি বা বিরোধীদলীয় পদে সর্বাবস্থায় সাংবিধানিক এসব ব্যক্তিই প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গী হয়ে দাবি আদায় তথা কৃষকের স্বার্থরক্ষা ও গ্রামাঞ্চলের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকায় অগ্রণী হওয়ার কথা। বাস্তবে কতটুকু হচ্ছে, সেটা সংবাদমাধ্যম আর সংসদীয় আলোচনায় দৃষ্ট।
সাংবিধানিক কর্তব্যে যথাযথ ভূমিকার অভাবের পরিণতিতে চির অবহেলিত গ্রামাঞ্চলের মানুষ ছুটছে শহর পানে; শ্রমজীবীরা বেঁচে থাকার তাগিদে কর্মের সন্ধানে আর অবস্থাপন্নরা তথাকথিত উন্নত জীবনযাপনের আশায়। এতে সৃষ্টি হচ্ছে ভারসাম্যহীনতা। গ্রাম ও শহরে একইভাবে, সর্বোপরি পরিবেশের ওপর, প্রকারান্তরে সর্বস্তরের মানুষই ভুগছে নানা জটিলতায়। এসবের সার্বিক সমাধান না হলেও প্রশমনের একমাত্র উপায় অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন। দরকার আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে প্রশাসনিক এবং রাষ্ট্রীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের বিকেন্দ্রীকরণ। এতে আঞ্চলিক কৃষি উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে নানা কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা স্থাপনে উদ্যোগ সহজ হবে বা শিল্পোদ্যোক্তারা এগিয়ে আসতে সাহস পাবেন।
বাংলাদেশের উৎপাদিত ফলমূল ও শাক-সবজি এখন পৃথিবীর নানা দেশে রপ্তানি হচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা স্বদেশি স্বাদের এসব খাদ্যসামগ্রী চরা দামেই কিনছেন; অনেকটা দেশি স্বাদ এবং কিছুটা হলেও দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত করার জন্য। প্রবাসে বাংলাদেশের রপ্তানিযোগ্য এসব খাদ্যসামগ্রীর চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে। অথচ একই সময় উৎপাদিত নানা ফসল বাজারজাত বা প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবে কৃষকের গলার ফাঁস হচ্ছে। অন্যদিকে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে এসব কৃষিপণ্যের চাহিদা আর উচ্চমূল্যও বর্তমান। তাই উপায় বের করতে হবে, যাতে কৃষকদের ঘরে লাভ পৌঁছায়।
যেকোনো পণ্যের বহুমুখী বাজার ব্যবস্থাই কেবল স্থায়ী লাভজনক মূল্য জোগান দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও শিল্প স্থাপন কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের যথাযথ মূল্যপ্রাপ্তিতে অধিকতর নিশ্চয়তা দিতে পারে। খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করা যেতে পারে দেশীয় বাজারের জন্য এবং সঙ্গে সঙ্গে বিদেশে রপ্তানিযোগ্য হিমায়িত শাক-সবজি ও ফলমূলসহ সব ধরনের কৃষিপণ্য। এর পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ওপর ভিত্তি করে বিশেষায়িত হিমাগার তৈরির মাধ্যমে দ্রুত পচনশীল কৃষিপণ্যের অপচয় কমিয়ে অধিকমূল্যে বাজারজাতের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বিশেষ করে পচনশীল কৃষিপণ্যের উৎপাদন অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক দৈনিক হাটবাজার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়ই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রত্যন্ত এ জেলাগুলো থেকে উৎপাদিত পচনশীল কৃষিপণ্য চাহিদানুযায়ী অন্যত্র সরবরাহের জন্য বিশেষায়িত হিমায়িত পরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এসবই হতে হবে সরকারি উদ্যোগে; কিন্তু স্থাপনা হতে পারে সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিমালিকানায় বা অংশীদারির ভিত্তিতে।
দেশে আরো জরুরি ভিত্তিতে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের জন্য কৃষকদের সহায়তায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের উপজেলাগুলোয় সমন্বিত তথ্যকেন্দ্র প্রয়োজন। তথ্যকেন্দ্রে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, কৃষক প্রতিনিধিরা ও কৃষিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানাদি নিয়মিত তথ্যের আদান-প্রদান করবেন।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, আগামী কয়েক দশকে সারা বিশ্বেই খাদ্যের চাহিদা এবং অভাব বহুগুণ বেড়ে যাবে, যখন বাংলাদেশের মতো দেশগুলোই প্রথমে হুমকিতে পড়বে। দেশ বাঁচাতে হলে এ দেশের কৃষককে বাঁচাতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে চিন্তা করতে হবে যে কৃষি-উপকরণ ব্যবসায়ী, কৃষক আর দালাল-ফড়িয়া থেকে শুরু করে সব মধ্যস্বত্ব এবং শেষে ক্ষুদ্র বিক্রেতার হাত হয়ে যে 'সাপ্লাই চেইনে' খাদ্য সব শ্রেণীর মানুষের প্রথম নম্বরের মৌলিক চাহিদা মেটাচ্ছে, তার কোনো একটিও উপেক্ষা করার উপায় নেই। কৃষক এখানে মূল চালক হিসেবে প্যাডেল ঘোরাচ্ছেন, আর তাই তাঁদের সবলতার সঙ্গে বাঁচিয়ে রাখাটাই প্রথম কাজ। সমানভাবে জরুরি চিন্তা করে এই 'চেইন' মজবুত রাখার জন্য প্রতিটি 'সেগমেন্ট'-এর ত্রুটি-বিচ্যুতিও সাড়াতে হবে। তা না হলে ভয়াবহ খাদ্য চাহিদার ভারে ছেঁড়া 'চেইন'- সব জাতির গলার ফাঁস হবে।
লেখক : গবেষক কৃষি, সিডনি ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া।
anowarul.bokshi@sydney.edu.au
বাংলাদেশে পণ্য বাজারজাতকরণে দালাল-ফড়িয়ারা কতটুকু লাভবান হচ্ছে সে হিসাব সুদূর সিডনিতে বসে নিয়মিত সংবাদ পাঠের মাধ্যমেই করতে পারি। কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত এক গ্রামেই আমার পারিবারিক খামার। খামারের দুধ, ডিম, শাক-সবজি, ফলমূল ইত্যাদি ফড়িয়াদের কাছেই বিক্রি হয় এবং সেই দর প্রায় প্রতিদিনই জেনে থাকি। আর ঢাকা শহরের বাজার দর তো নিয়মিত সংবাদ পাঠেই জানছি। তা থেকে মাঝেমধ্যে বিস্মিত হই যে দালাল-ফড়িয়াদের নামে যেসব প্রচার শোনা যায়, সে লাভ কোথায়। ঢালাওভাবে দালাল-ফড়িয়াদের জন্য সাফাই গাইতে বসিনি, বরং বলতে চাই যে দাবি আদায়ের বা সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রকৃষ্ট এবং স্থায়ী সমাধান চিন্তা করে সে লক্ষ্যে আন্দোলন করলেই কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যেতে পারে। আবার এটুকুও মনে রাখা দরকার যে দালাল-ফড়িয়ারাও শ্রমজীবী মানুষ বা এক ধরনের ব্যবসায়ী, যাঁরা রাত-দিন অর্থ এবং গতর দুই-ই খাটিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। দেশের সার্বিক প্রেক্ষাপটেই ঘাটে ঘাটে মাসোহারার বিনিময়েই তাঁদের ব্যবসায় টিকে থাকতে হয়। আর সরকারি দাম নির্ধারণ : কিছু কৃষিপণ্যের হতে পারে, সব কিছুর নয়। শাক-সবজির মতো দ্রুত পচনশীল পণ্যের ক্ষেত্রে এটা আরো দুরূহ। তবে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হলে লাভজনক মূল্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা কিছুটা হলেও আশা করা যেতে পারে। উদ্যোগটা হবে স্থানীয়ভাবে কৃষিশিল্প প্রতিষ্ঠার, উন্নত সার-বীজসহ কৃষি উপকরণ ও প্রযুক্তি সরবরাহের নিশ্চয়তা দানের, প্রতিষ্ঠা করতে হবে কৃষি তথ্যকেন্দ্র। এসব প্রতিষ্ঠার দাবি দেশের সব প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষক তথা জনসাধারণের সাংবিধানিক অধিকার।
স্বাধীনতার চার দশক পরও উত্তরের এ অঞ্চল অবহেলিত জনপদের খেতাব থেকে উত্তরণের স্বাদ পায়নি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এসব জনপদ এ যাবৎ অনেক কীর্তিমান মানব জন্ম দিয়েছে বা এ অবহেলিত জনপদের সুবাদেই অনেকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। অনেকেই বিভিন্ন সময় সংবিধানের ধারক-বাহকের মুখ্য ভূমিকায়ও আসীন ছিলেন। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে তাঁরা তাঁদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে যথাযথ নিয়োজিত থাকলে সবার সঙ্গে মেহনতি এ কৃষকদেরও উন্নতি হতো। প্রতীকী ফাঁস পরতে হতো না। সরকারি বা বিরোধীদলীয় পদে সর্বাবস্থায় সাংবিধানিক এসব ব্যক্তিই প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গী হয়ে দাবি আদায় তথা কৃষকের স্বার্থরক্ষা ও গ্রামাঞ্চলের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকায় অগ্রণী হওয়ার কথা। বাস্তবে কতটুকু হচ্ছে, সেটা সংবাদমাধ্যম আর সংসদীয় আলোচনায় দৃষ্ট।
সাংবিধানিক কর্তব্যে যথাযথ ভূমিকার অভাবের পরিণতিতে চির অবহেলিত গ্রামাঞ্চলের মানুষ ছুটছে শহর পানে; শ্রমজীবীরা বেঁচে থাকার তাগিদে কর্মের সন্ধানে আর অবস্থাপন্নরা তথাকথিত উন্নত জীবনযাপনের আশায়। এতে সৃষ্টি হচ্ছে ভারসাম্যহীনতা। গ্রাম ও শহরে একইভাবে, সর্বোপরি পরিবেশের ওপর, প্রকারান্তরে সর্বস্তরের মানুষই ভুগছে নানা জটিলতায়। এসবের সার্বিক সমাধান না হলেও প্রশমনের একমাত্র উপায় অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন। দরকার আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে প্রশাসনিক এবং রাষ্ট্রীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের বিকেন্দ্রীকরণ। এতে আঞ্চলিক কৃষি উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে নানা কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা স্থাপনে উদ্যোগ সহজ হবে বা শিল্পোদ্যোক্তারা এগিয়ে আসতে সাহস পাবেন।
বাংলাদেশের উৎপাদিত ফলমূল ও শাক-সবজি এখন পৃথিবীর নানা দেশে রপ্তানি হচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা স্বদেশি স্বাদের এসব খাদ্যসামগ্রী চরা দামেই কিনছেন; অনেকটা দেশি স্বাদ এবং কিছুটা হলেও দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত করার জন্য। প্রবাসে বাংলাদেশের রপ্তানিযোগ্য এসব খাদ্যসামগ্রীর চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে। অথচ একই সময় উৎপাদিত নানা ফসল বাজারজাত বা প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবে কৃষকের গলার ফাঁস হচ্ছে। অন্যদিকে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে এসব কৃষিপণ্যের চাহিদা আর উচ্চমূল্যও বর্তমান। তাই উপায় বের করতে হবে, যাতে কৃষকদের ঘরে লাভ পৌঁছায়।
যেকোনো পণ্যের বহুমুখী বাজার ব্যবস্থাই কেবল স্থায়ী লাভজনক মূল্য জোগান দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও শিল্প স্থাপন কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের যথাযথ মূল্যপ্রাপ্তিতে অধিকতর নিশ্চয়তা দিতে পারে। খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করা যেতে পারে দেশীয় বাজারের জন্য এবং সঙ্গে সঙ্গে বিদেশে রপ্তানিযোগ্য হিমায়িত শাক-সবজি ও ফলমূলসহ সব ধরনের কৃষিপণ্য। এর পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ওপর ভিত্তি করে বিশেষায়িত হিমাগার তৈরির মাধ্যমে দ্রুত পচনশীল কৃষিপণ্যের অপচয় কমিয়ে অধিকমূল্যে বাজারজাতের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বিশেষ করে পচনশীল কৃষিপণ্যের উৎপাদন অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক দৈনিক হাটবাজার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়ই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রত্যন্ত এ জেলাগুলো থেকে উৎপাদিত পচনশীল কৃষিপণ্য চাহিদানুযায়ী অন্যত্র সরবরাহের জন্য বিশেষায়িত হিমায়িত পরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এসবই হতে হবে সরকারি উদ্যোগে; কিন্তু স্থাপনা হতে পারে সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিমালিকানায় বা অংশীদারির ভিত্তিতে।
দেশে আরো জরুরি ভিত্তিতে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের জন্য কৃষকদের সহায়তায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের উপজেলাগুলোয় সমন্বিত তথ্যকেন্দ্র প্রয়োজন। তথ্যকেন্দ্রে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, কৃষক প্রতিনিধিরা ও কৃষিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানাদি নিয়মিত তথ্যের আদান-প্রদান করবেন।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, আগামী কয়েক দশকে সারা বিশ্বেই খাদ্যের চাহিদা এবং অভাব বহুগুণ বেড়ে যাবে, যখন বাংলাদেশের মতো দেশগুলোই প্রথমে হুমকিতে পড়বে। দেশ বাঁচাতে হলে এ দেশের কৃষককে বাঁচাতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে চিন্তা করতে হবে যে কৃষি-উপকরণ ব্যবসায়ী, কৃষক আর দালাল-ফড়িয়া থেকে শুরু করে সব মধ্যস্বত্ব এবং শেষে ক্ষুদ্র বিক্রেতার হাত হয়ে যে 'সাপ্লাই চেইনে' খাদ্য সব শ্রেণীর মানুষের প্রথম নম্বরের মৌলিক চাহিদা মেটাচ্ছে, তার কোনো একটিও উপেক্ষা করার উপায় নেই। কৃষক এখানে মূল চালক হিসেবে প্যাডেল ঘোরাচ্ছেন, আর তাই তাঁদের সবলতার সঙ্গে বাঁচিয়ে রাখাটাই প্রথম কাজ। সমানভাবে জরুরি চিন্তা করে এই 'চেইন' মজবুত রাখার জন্য প্রতিটি 'সেগমেন্ট'-এর ত্রুটি-বিচ্যুতিও সাড়াতে হবে। তা না হলে ভয়াবহ খাদ্য চাহিদার ভারে ছেঁড়া 'চেইন'- সব জাতির গলার ফাঁস হবে।
লেখক : গবেষক কৃষি, সিডনি ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া।
anowarul.bokshi@sydney.edu.au
No comments