তিস্তা চুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা by রাহীদ এজাজ
তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সইয়ে এখনো সায় নেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ কমে গেছে, এমনটা জানতে পেরে তিনি আগের অবস্থানে অনড়। আর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারকে আস্থায় নিয়েই বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিটি সই করতে চায়। এমন পরিস্থিতিতে তিস্তা চুক্তি সই অনিশ্চিতই থেকে যাচ্ছে।
সম্প্রতি দিল্লি ও কলকাতা সফরের সময় সরকারি পর্যায়ে এবং কূটনৈতিক সূত্রে কথা বলে এই অভিমত পাওয়া গেছে।
এদিকে তিস্তা চুক্তি সইয়ের জন্য কল্যাণ রুদ্র কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলছে না পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার। গত ডিসেম্বরে ওই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও সেই সময়সীমা কয়েক দফা পিছিয়েছে।
গত সপ্তাহে কলকাতায় নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে প্রতিবেদন সম্পর্কে জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি জানান, এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের কাছে মুখ না খুলতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার অনুরোধ জানিয়েছে।
তবে রাজ্য সরকারের ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র এবং পশ্চিমা এক কূটনীতিক এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে গেছে এমনটাই মত কল্যাণ রুদ্রের, যা ওই প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয়েছে।
কলকাতার অন্য একটি সূত্রের দাবি, কল্যাণ রুদ্র কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর নতুন করে আরেকটি বিশেষজ্ঞ কমিটি ঘোষণা করতে পারে রাজ্য সরকার। কারণ, কমিশনের প্রতিবেদনে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার বিষয়টি প্রকাশের পর তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ফের উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে।
মমতার সম্মতি অপরিহার্য: বাংলাদেশের সঙ্গে অভিন্ন নদীটির অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি সইয়ের আগে রাজ্য সরকারকে পুরোপুরি আস্থায় নিতে চায় ইউপিএ সরকার। গত সেপ্টেম্বরে চুক্তি সই আটকে যাওয়ায় এ পথেই হাঁটছেন মনমোহন সিং। সম্প্রতি দিল্লি সফরের সময় এ অবস্থানই পুনর্ব্যক্ত করেছেন ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী পবন কুমার বানসাল।
বানসাল ৪ জুন তাঁর দপ্তরে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের যেসব বিষয়ে রাজ্য জড়িত, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের একতরফাভাবে কিছু করার সুযোগ নেই। তা ছাড়া জোট সরকারের শরিক দল হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি যত্নবান হওয়ার বিষয়টি রয়েছে।
বানসাল বলেন, পশ্চিমবঙ্গের ধারণা, বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সই হলে রাজ্যটি শুকিয়ে যাবে। কাজেই তিস্তা নিয়ে সেখানকার মানুষের উদ্বেগ দূর করাটা রাজনীতিবিদ হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দায়িত্ব। তিনি বলেন, ‘তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে উভয় দেশের সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা রয়েছে এবং যত দ্রুত সম্ভব এ চুক্তি সইয়ের জন্য আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি।’
এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা আছে কি না, জানতে চাইলে বানসাল বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নয়, জরুরি হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। আর এ সদিচ্ছা নিয়েই আমরা কাজ করছি। তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থানটা হচ্ছে, তাঁর রাজ্যের মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া, যাতে সব পক্ষই লাভবান হতে পারে।’
অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জের: পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কংগ্রেস পার্টির সঙ্গে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক জোটের (ইউপিএ) অন্যতম শরিক তৃণমূল কংগ্রেসের সম্পর্কের অনিবার্য প্রভাব পড়ছে দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কে। সর্বশেষ ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থিতা নিয়ে দুই শরিকের মতপার্থক্য ফের বেড়েছে। এমন অবস্থায় তিস্তার মতো অনিষ্পন্ন বিষয়ের দ্রুত সমাধানে উচ্চাশাই বটে।
রাজ্যের নাগরিক সমাজ ও সংস্কৃতিসেবীরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সই কিংবা ছিটমহল বিনিময়ের ক্ষেত্রে রাজ্যের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একজন আঞ্চলিক নেতা হিসেবে এটিই তাঁর জন্য স্বাভাবিক। তবে প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের স্বার্থে এসব বিষয়ে কিছুটা ছাড় দেওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু এটি করতে রাজি নন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। ফলে দুই প্রতিবেশীর উন্নত সম্পর্কে এর প্রভাব পড়াটা অস্বাভাবিক নয়।
No comments