বিচারপতি ইফতেখার ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ by তারেক শামসুর রেহমান
আমাদের দেশের অনেকেই বিচারপতি ইফতেখার মোহম্মদ চৌধুরীর নামের সঙ্গে পরিচিত। তিনি পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। নানা কারণে তিনি মিডিয়ায় আছেন দীর্ঘদিন ধরে। সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ তাঁকে তাঁর পদ থেকে অপসারণ করেছিলেন।
ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তিনি পাকিস্তানে এককভাবে প্রতি জেলার বারগুলোতে সভা করে জনমত গড়ে তুলেছিলেন। একপর্যায়ে উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে তিনি স্বপদে বহাল হন। কিন্তু তিনি আলোচনায় আছেন এখনো। জুনের প্রথম সপ্তাহে দুটি ঘটনায় তিনি আবারও আলোচনায় আসেন। প্রথমটিতে নিজের ছেলের বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত হয়ে তিনি একটি রুল ইস্যু করেছেন। তাঁর ছেলে আরসালান ইফতেখার ও ধনাঢ্য রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী মালিক রিয়াজ হোসেনের মধ্যে অবৈধ অর্থ লেনদেনের সংবাদ প্রকাশিত হলে, প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে সুয়োমোটো রুল জারি করেন। দ্বিতীয়টিতে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে প্রতীকী সাজা দিয়েছিলেন আদালত অবমাননার দায়ে। এতে করে তাঁর সংসদ সদস্যপদ চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু জাতীয় পরিষদের স্পিকার ফাহমিদা মির্জা গত ২৪ মে এক রুলিংয়ে গিলানিকে দায়িত্ব পালনে অযোগ্য ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনে রেফারেন্স পাঠাতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে ইফতেখার মোহম্মদ চৌধুরী গিলানি ও ফাহমিদা মির্জাকে আদালতে তলব করেন। দুটো ঘটনাই পাকিস্তানের পরিপ্রেক্ষিতে যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। প্রথমটিতে বলা যায়, আইন যে অন্ধ, তা প্রমাণিত হলো। আর দ্বিতীয়টিতে বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাকিস্তানের ইতিহাসে সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন দেশটি শাসন করেছে। এ ক্ষেত্রে বিচারপতিদের ভূমিকা খুব উজ্জ্বল নয়। সেনাশাসনের বৈধতাও তাঁরা দিয়েছেন। তবে ব্যতিক্রম বোধ করি ইফতেখার মোহম্মদ চৌধুরীর ক্ষেত্রে। বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় তিনি বারগুলোর সমর্থন পেয়েছেন। এখন রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সঙ্গে বিচার বিভাগের দ্বন্দ্ব দেশটিকে কোথায় নিয়ে যাবে বলা মুশকিল। তবে যে জিনিসটি বিচারপতি ইফতেখার প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা হচ্ছে বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব। প্রেসিডেন্ট জারদারির বিরুদ্ধে সুইজারল্যান্ডে মামলার পুনঃ তদন্তের নির্দেশ, প্রধানমন্ত্রী গিলানিকে দোষী সাব্যস্ত করা কিংবা পার্লামেন্টের স্পিকারকে আদালতে তলব করা- এসব সিদ্ধান্ত অত সহজ ছিল না। পাকিস্তান যখন ধীরে ধীরে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গ্রহণ করছে, সেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে বিচার বিভাগের দ্বন্দ্ব কোনো ভালো খবর নয় দেশটির জন্য। যেখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে বিচার বিভাগ পালন করে মুখ্য ভূমিকা, সেখানে বিচার বিভাগ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে বিচার বিভাগের সঙ্গে সংসদের দ্বন্দ্বের একটি খবর যখন বড় ধরনের একটি 'ঘটনার' জন্ম দিয়েছে, তখন পাকিস্তানের ঘটনাবলির সঙ্গে কেউ কেউ একটি 'মিল' খোঁজার অপচেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু পাকিস্তানের ঘটনাবলির সঙ্গে বাংলাদেশের ঘটনাবলির মিল খোঁজা অর্থহীন। পাকিস্তানে পুরো বিচার বিভাগ সংসদের সঙ্গে এক ধরনের কর্তৃত্বের প্রশ্নে বিতর্কে জড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে এমনটি হয়নি। বাংলাদেশে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চের রায় নিয়ে অনাহূত এক বিতর্কে জড়িয়ে গেছে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এ ক্ষেত্রে কার ক্ষমতা বেশি, কে কর্তৃত্ব করবে, সংবিধান কাকে কতটুকু ক্ষমতা দিয়েছে- এ ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই 'বিরোধ'কে কেউ কেউ 'অশনিসংকেত' হিসেবে মনে করছেন। গণতন্ত্রের জন্য 'হুমকি' হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন কেউ কেউ।
বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ঢাকায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীনে থাকা হাইকোর্টের সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে যে রায় দিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে জাতীয় সংসদের স্পিকারের দেওয়া বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল ও আদালত অবমাননাকর বলে মন্তব্য করেছিলেন। স্পিকার বলেছিলেন, 'আদালতের রায়ে জনগণ ক্ষুব্ধ হলে বিচার বিভাগকেও তারা রুখে দাঁড়াতে পারে' (সমকাল, ৬ জুন)। স্পিকারের এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করেই আদালত স্পিকার সম্পর্কে ওই মন্তব্যটি করেছিলেন। তবে কোনো রুল দেননি। রায়ে আদালত স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, 'আদালত কখনো সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের বিরুদ্ধে নয়।' কিন্তু আদালতের মন্তব্য নিয়ে সংসদে বিচার বিভাগ সম্পর্কে যে মন্তব্য করা হয়েছে, তা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। সংসদে গত ৫ জুনের আলোচনায় বিচারপতি চৌধুরীর অপসারণ চেয়েছেন সংসদ সদস্যরা। বলা হয়েছে, বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা পুনরায় সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনা হবে। তোফায়েল আহমেদের মতো একজন সিনিয়র সংসদ সদস্য বিচারপতি চৌধুরীকে আখ্যায়িত করেছেন 'স্যাডিস্ট' হিসেবে। একজন বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান তোফায়েল সাহেব। তিনি কী করে একজন বিচারপতিকে 'স্যাডিস্ট' বলেন? এতে করে তো আদালত অবমাননা হয়ে গেল! তিনি যখন বলেন 'বিচারপতিদেরকেও বুঝতে হবে বিচারপতিদের বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা' (সমকাল), তখন কি এই বক্তব্য বিচারপতিদের বিরুদ্ধে এক ধরনের হুমকি হয়ে গেল না? কোনো ব্যক্তি কি এ ধরনের কথা বলতে পারেন? একজন সংসদ সদস্য নিশ্চয়ই আইনের ঊধর্ে্ব নন। আরেকজন সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বিচারপতি চৌধুরীকে 'মানসিক বিকারগ্রস্ত' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বললেন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করার কথা। স্পিকার এ ব্যাপারে একটি রুলিং দিয়েছেন রবিবার। কিন্তু সামান্য একটি বিষয় নিয়ে যা ঘটে গেল, তাতে আমরা দুঃখিত; লজ্জিতও বটে। বিচারপতি চৌধুরী স্পিকারের বক্তব্যকে সরাসরি 'রাষ্ট্রদ্রোহিতা' বলেননি, বলেছেন 'রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল'। এ ব্যাপারে আদালত কোনো রায়ও দেননি। কিন্তু সংসদ সদস্যদের বক্তব্যে আমি হতাশ। একজন বিচারপতিকে আমরা কিভাবে 'স্যাডিস্ট' বা 'মানসিক বিকারগ্রস্ত' বলি? একজন সাধারণ মানুষের ব্যাপারেও তো আমরা এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করতে পারি না। আর যেভাবে 'পাঁচ মিনিটের মধ্যে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনার' কথা বলা হয়েছে, তা কি এক ধরনের হুমকি নয়? তাঁরা সবাই সিনিয়র সংসদ সদস্য। তাঁদের কাছ থেকে আমি আরো 'ম্যাচিরওরড' বক্তব্য আশা করেছিলাম। তাঁরাই তো জাতিকে নেতৃত্ব দেবেন।
বিচার ও আইন বিভাগ কেউ কারো প্রতিপক্ষ নয়। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গকে একটির বিরুদ্ধে অন্যটিকে দাঁড়া করানো যায় না। প্রতিটি অঙ্গ তার নিজ নিজ অবস্থানে থেকে রাষ্ট্রের উন্নয়নে কাজ করে যায়। আইন বিভাগ আইন প্রণয়ন করে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা জনগণের স্বার্থে কাজ করে যান। আর বিচার বিভাগ জনগণের আস্থার একটি প্রতীক। জনগণের নিরাপত্তার গ্যারান্টিও দেন উচ্চ আদালত। রাষ্ট্র যখন জনগণের ওপর নিপীড়ন চালায়, তখন সাধারণ মানুষের ভরসার স্থল হয় আদালত। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনকে চিনি না। জানিও না। ভবিষ্যতে জানা ও চেনার সম্ভাবনাও কম। তবে এই বেঞ্চের বেশ কয়েকটি রায়ে আমি আস্থার একটি জায়গা খুঁজে পেয়েছি। নীলফামারী জেলার সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা কাউসার নাসরীন একজন ছাত্রীকে যৌনকর্মী হিসেবে সাব্যস্ত করায় এই বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ওই ইউএনওকে আদালতে তলব করেছিলেন। ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু কামনা করে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। এই বেঞ্চ ওই ঘটনায় একটি রুল ইস্যু করেন। পুলিশের একাধিক 'অপকর্মের' বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিলেন ওই বেঞ্চ। এভাবেই উচ্চ আদালত সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল ইস্যু করেন। এটা তো একটা আস্থার জায়গা। রাষ্ট্রযন্ত্র যখন স্বৈরাচারী আচরণ করে, তখন মানুষ কোথায় যাবে? তাদের ভরসার স্থল তো আদালত। এই বেঞ্চটি শত শত মানুষের দুঃখ, কষ্ট, অভিযোগের নিষ্পত্তি করতে পারেননি সত্য, কিন্তু আদালতের নজরে যখনই কোনো 'ঘটনা' আনা হয়েছে, আদালত এ ব্যাপারে ভিকটিমের পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমার আস্থাটা বেড়ে গেছে। আমি এই আস্থার জায়গাটা নষ্ট হতে দিতে পারি না। আদালতের সিদ্ধান্তে কোনো পক্ষ (এ ক্ষেত্রে সড়ক ও জনপথ বিভাগ) যদি 'ক্ষতিগ্রস্ত' হয়ে থাকে, সে পক্ষের আপিল বিভাগে যাওয়ার সুযোগ ছিল। আমি অবাক হয়েছি, যখন দেখেছি পয়েন্ট অব অর্ডারে সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম আলোচনার সূত্রপাত করলেও, স্পিকার নিজেই মন্তব্য করে বসলেন। সংসদ সদস্যরা আলোচনায় অংশও নিলেন না। আরো মজার কথা আদালতের রায়ের পর সড়ক ও জনপথ বিভাগের দখলে থাকা কয়েকটি ভবন ও কক্ষ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে বুঝিয়েও দেওয়া হয়েছে। অথচ ওই রায়টি নিয়ে এত 'লঙ্কাকাণ্ড' ঘটে গেল!
যে 'ঘটনা' বিচার ও আইন বিভাগকে মুখোমুখি দাঁড় করাল, তা সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য শুভ নয়। হাইকোর্টের একটি রায় নিয়ে কয়েকজন সিনিয়র সংসদ সদস্য যে প্রতিক্রিয়া দেখালেন, তা দৃষ্টিকটু। তাঁদের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রেখেই বলছি, তাঁরা যদি উত্তেজিত না হয়ে, সংযত হয়ে পুরো বিষয়টি আলোচনা করতেন, তাহলে তা শোভন হতো। ভালো হতো। কিন্তু কেন জানি মনে হয়েছে, তাঁরা হুমকির সুরে কথা বলছেন। আদালত একটি কথা বলেছেন। কোনো রুল দেননি। পুরো বিষয়টি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। ১০ জুলাই পরবর্তী তারিখও নির্ধারিত রয়েছে। অথচ সংসদে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে বিচারপতির 'বিচারের'ও দাবি উঠল। আমরা চাই, ৫ জুন সংসদে যে আলোচনার সূত্রপাত, তার সমাপ্তিও হোক সেখানে। বিষয়টি নিয়ে আর আলোচনা হোক, আমরা তা চাই না। আইন তার নিজ গতিতেই চলুক। স্পিকারের রুলিংয়ের পর এটা নিয়ে আর আলোচনা হোক, আমরা তা চাই না। স্পিকার পুরনো পার্লামেন্টারিয়ান। রাষ্ট্রের তিন নম্বর ব্যক্তি তিনি। জাতির আশা-ভরসার একটা জায়গা। তিনিই তো আমাদের পথ দেখাবেন।
লেখক : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
www.tsrahmanbd.blogspot.com
সম্প্রতি বাংলাদেশে বিচার বিভাগের সঙ্গে সংসদের দ্বন্দ্বের একটি খবর যখন বড় ধরনের একটি 'ঘটনার' জন্ম দিয়েছে, তখন পাকিস্তানের ঘটনাবলির সঙ্গে কেউ কেউ একটি 'মিল' খোঁজার অপচেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু পাকিস্তানের ঘটনাবলির সঙ্গে বাংলাদেশের ঘটনাবলির মিল খোঁজা অর্থহীন। পাকিস্তানে পুরো বিচার বিভাগ সংসদের সঙ্গে এক ধরনের কর্তৃত্বের প্রশ্নে বিতর্কে জড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে এমনটি হয়নি। বাংলাদেশে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চের রায় নিয়ে অনাহূত এক বিতর্কে জড়িয়ে গেছে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এ ক্ষেত্রে কার ক্ষমতা বেশি, কে কর্তৃত্ব করবে, সংবিধান কাকে কতটুকু ক্ষমতা দিয়েছে- এ ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই 'বিরোধ'কে কেউ কেউ 'অশনিসংকেত' হিসেবে মনে করছেন। গণতন্ত্রের জন্য 'হুমকি' হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন কেউ কেউ।
বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ঢাকায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীনে থাকা হাইকোর্টের সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে যে রায় দিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে জাতীয় সংসদের স্পিকারের দেওয়া বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল ও আদালত অবমাননাকর বলে মন্তব্য করেছিলেন। স্পিকার বলেছিলেন, 'আদালতের রায়ে জনগণ ক্ষুব্ধ হলে বিচার বিভাগকেও তারা রুখে দাঁড়াতে পারে' (সমকাল, ৬ জুন)। স্পিকারের এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করেই আদালত স্পিকার সম্পর্কে ওই মন্তব্যটি করেছিলেন। তবে কোনো রুল দেননি। রায়ে আদালত স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, 'আদালত কখনো সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের বিরুদ্ধে নয়।' কিন্তু আদালতের মন্তব্য নিয়ে সংসদে বিচার বিভাগ সম্পর্কে যে মন্তব্য করা হয়েছে, তা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। সংসদে গত ৫ জুনের আলোচনায় বিচারপতি চৌধুরীর অপসারণ চেয়েছেন সংসদ সদস্যরা। বলা হয়েছে, বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা পুনরায় সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনা হবে। তোফায়েল আহমেদের মতো একজন সিনিয়র সংসদ সদস্য বিচারপতি চৌধুরীকে আখ্যায়িত করেছেন 'স্যাডিস্ট' হিসেবে। একজন বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান তোফায়েল সাহেব। তিনি কী করে একজন বিচারপতিকে 'স্যাডিস্ট' বলেন? এতে করে তো আদালত অবমাননা হয়ে গেল! তিনি যখন বলেন 'বিচারপতিদেরকেও বুঝতে হবে বিচারপতিদের বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা' (সমকাল), তখন কি এই বক্তব্য বিচারপতিদের বিরুদ্ধে এক ধরনের হুমকি হয়ে গেল না? কোনো ব্যক্তি কি এ ধরনের কথা বলতে পারেন? একজন সংসদ সদস্য নিশ্চয়ই আইনের ঊধর্ে্ব নন। আরেকজন সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বিচারপতি চৌধুরীকে 'মানসিক বিকারগ্রস্ত' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বললেন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করার কথা। স্পিকার এ ব্যাপারে একটি রুলিং দিয়েছেন রবিবার। কিন্তু সামান্য একটি বিষয় নিয়ে যা ঘটে গেল, তাতে আমরা দুঃখিত; লজ্জিতও বটে। বিচারপতি চৌধুরী স্পিকারের বক্তব্যকে সরাসরি 'রাষ্ট্রদ্রোহিতা' বলেননি, বলেছেন 'রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল'। এ ব্যাপারে আদালত কোনো রায়ও দেননি। কিন্তু সংসদ সদস্যদের বক্তব্যে আমি হতাশ। একজন বিচারপতিকে আমরা কিভাবে 'স্যাডিস্ট' বা 'মানসিক বিকারগ্রস্ত' বলি? একজন সাধারণ মানুষের ব্যাপারেও তো আমরা এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করতে পারি না। আর যেভাবে 'পাঁচ মিনিটের মধ্যে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনার' কথা বলা হয়েছে, তা কি এক ধরনের হুমকি নয়? তাঁরা সবাই সিনিয়র সংসদ সদস্য। তাঁদের কাছ থেকে আমি আরো 'ম্যাচিরওরড' বক্তব্য আশা করেছিলাম। তাঁরাই তো জাতিকে নেতৃত্ব দেবেন।
বিচার ও আইন বিভাগ কেউ কারো প্রতিপক্ষ নয়। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গকে একটির বিরুদ্ধে অন্যটিকে দাঁড়া করানো যায় না। প্রতিটি অঙ্গ তার নিজ নিজ অবস্থানে থেকে রাষ্ট্রের উন্নয়নে কাজ করে যায়। আইন বিভাগ আইন প্রণয়ন করে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা জনগণের স্বার্থে কাজ করে যান। আর বিচার বিভাগ জনগণের আস্থার একটি প্রতীক। জনগণের নিরাপত্তার গ্যারান্টিও দেন উচ্চ আদালত। রাষ্ট্র যখন জনগণের ওপর নিপীড়ন চালায়, তখন সাধারণ মানুষের ভরসার স্থল হয় আদালত। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনকে চিনি না। জানিও না। ভবিষ্যতে জানা ও চেনার সম্ভাবনাও কম। তবে এই বেঞ্চের বেশ কয়েকটি রায়ে আমি আস্থার একটি জায়গা খুঁজে পেয়েছি। নীলফামারী জেলার সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা কাউসার নাসরীন একজন ছাত্রীকে যৌনকর্মী হিসেবে সাব্যস্ত করায় এই বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ওই ইউএনওকে আদালতে তলব করেছিলেন। ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু কামনা করে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। এই বেঞ্চ ওই ঘটনায় একটি রুল ইস্যু করেন। পুলিশের একাধিক 'অপকর্মের' বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিলেন ওই বেঞ্চ। এভাবেই উচ্চ আদালত সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল ইস্যু করেন। এটা তো একটা আস্থার জায়গা। রাষ্ট্রযন্ত্র যখন স্বৈরাচারী আচরণ করে, তখন মানুষ কোথায় যাবে? তাদের ভরসার স্থল তো আদালত। এই বেঞ্চটি শত শত মানুষের দুঃখ, কষ্ট, অভিযোগের নিষ্পত্তি করতে পারেননি সত্য, কিন্তু আদালতের নজরে যখনই কোনো 'ঘটনা' আনা হয়েছে, আদালত এ ব্যাপারে ভিকটিমের পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমার আস্থাটা বেড়ে গেছে। আমি এই আস্থার জায়গাটা নষ্ট হতে দিতে পারি না। আদালতের সিদ্ধান্তে কোনো পক্ষ (এ ক্ষেত্রে সড়ক ও জনপথ বিভাগ) যদি 'ক্ষতিগ্রস্ত' হয়ে থাকে, সে পক্ষের আপিল বিভাগে যাওয়ার সুযোগ ছিল। আমি অবাক হয়েছি, যখন দেখেছি পয়েন্ট অব অর্ডারে সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম আলোচনার সূত্রপাত করলেও, স্পিকার নিজেই মন্তব্য করে বসলেন। সংসদ সদস্যরা আলোচনায় অংশও নিলেন না। আরো মজার কথা আদালতের রায়ের পর সড়ক ও জনপথ বিভাগের দখলে থাকা কয়েকটি ভবন ও কক্ষ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে বুঝিয়েও দেওয়া হয়েছে। অথচ ওই রায়টি নিয়ে এত 'লঙ্কাকাণ্ড' ঘটে গেল!
যে 'ঘটনা' বিচার ও আইন বিভাগকে মুখোমুখি দাঁড় করাল, তা সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য শুভ নয়। হাইকোর্টের একটি রায় নিয়ে কয়েকজন সিনিয়র সংসদ সদস্য যে প্রতিক্রিয়া দেখালেন, তা দৃষ্টিকটু। তাঁদের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রেখেই বলছি, তাঁরা যদি উত্তেজিত না হয়ে, সংযত হয়ে পুরো বিষয়টি আলোচনা করতেন, তাহলে তা শোভন হতো। ভালো হতো। কিন্তু কেন জানি মনে হয়েছে, তাঁরা হুমকির সুরে কথা বলছেন। আদালত একটি কথা বলেছেন। কোনো রুল দেননি। পুরো বিষয়টি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। ১০ জুলাই পরবর্তী তারিখও নির্ধারিত রয়েছে। অথচ সংসদে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে বিচারপতির 'বিচারের'ও দাবি উঠল। আমরা চাই, ৫ জুন সংসদে যে আলোচনার সূত্রপাত, তার সমাপ্তিও হোক সেখানে। বিষয়টি নিয়ে আর আলোচনা হোক, আমরা তা চাই না। আইন তার নিজ গতিতেই চলুক। স্পিকারের রুলিংয়ের পর এটা নিয়ে আর আলোচনা হোক, আমরা তা চাই না। স্পিকার পুরনো পার্লামেন্টারিয়ান। রাষ্ট্রের তিন নম্বর ব্যক্তি তিনি। জাতির আশা-ভরসার একটা জায়গা। তিনিই তো আমাদের পথ দেখাবেন।
লেখক : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
www.tsrahmanbd.blogspot.com
No comments