রণক্ষেত্র কাঁচপুর ও রূপগঞ্জ শিল্পাঞ্চল by দিলীপ কুমার মণ্ডল, রাসেল আহমেদ ও আসাদুজ্জামান নূর

বেতন বাড়ানোর দাবিতে গতকাল শনিবার সকালে কাঁচপুর-রূপগঞ্জ শিল্পাঞ্চল রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সিনহা গ্রুপের বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা সকাল পৌনে ৯টার দিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। সে সময় পুলিশ শ্রমিকদের রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াতে বললে তাঁরা পুলিশের ওপর চড়াও হন।


একপর্যায়ে পুলিশ ও শ্রমিকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কারখানার আসবাবপত্র ও কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করেন।
পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে ৭০২টি রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল ছোড়ে। গুলি, লাঠিপেটা, ইটপাটকেলে পুলিশ, সাংবাদিক, শ্রমিকসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। পুলিশ তিন শ্রমিককে গ্রেপ্তার করেছে। দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা অবরোধের কারণে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। দুপুর আড়াইটার দিকে শ্রমিকরা নদীপথে পালিয়ে গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
পুলিশ, শ্রমিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বাসাভাড়া বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির দাবি জানান। গার্মেন্ট কর্তৃপক্ষ দাবি মেনে না নেওয়ায় গতকাল সকাল পৌনে ৯টার দিকে শ্রমিকরা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। সে সময় শিল্পাঞ্চল পুলিশ তাঁদের রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াতে বললে শ্রমিকরা পুলিশের ওপর চড়াও হন। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ১০-১৫টি গাড়ি ভাঙচুর করে রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করেন। একপর্যায়ে পুলিশ শ্রমিকদের লাঠিপেটা করলে তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। পরে তাঁরা একজোট হয়ে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। সে সময় পুলিশ ও শ্রমিকদের মধ্যে কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে এলে শ্রমিকরা কারখানার ভেতরে ঢুকে গেট বন্ধ করে দেন। এরপর পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করেন।
সকাল ৯টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত পুলিশ ও শ্রমিকদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ, ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে ৭০২টি রাবার বুলেট, টিয়ার শেল, স্মোক গ্রেনেড ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে।
পুলিশের গুলি, লাঠিপেটা ও শ্রমিকদের ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় পুলিশ, সাংবাদিক, শ্রমিকসহ শতাধিক লোক আহত হয়। শ্রমিকদের লাঠিপেটার ছবি তুলতে গেলে উত্তেজিত পুলিশ ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার ফটো সাংবাদিক নবীউল্লা নবী ও বণিক বার্তার সোহেল সৈয়দ আহমেদ ও দৈনিক ইয়াদের আলমাসকে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করে। শ্রমিকদের ইটপাটকেলে নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বি-সার্কেল) এস এম শফিউল্লা, শিল্পাঞ্চল-৪-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ আহমেদ, সোনারগাঁ থানার ওসি হারুনুর রশিদ, উপপরিদর্শক এনামুল, আবুল খায়ের, আমিনুল, আজাহার, বেলায়েত হোসেন, আজমীরুজ্জামান, আলী হোসেনসহ ৩৫ পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশের গুলি ও লাঠিপেটায় শ্রমিক আমিন, রফিক, ইসমাঈল, সাইফুল, দীপু, আবদুল্লা, রবিউল, অনিক, আবদুল মজিদ, হোসনে আরা, আসমা, রিনা, নাঈমা, আমসুন, পপি, আনোয়ারা, মামুন, শুক্কুর আলী, নূপুর, সুজনসহ ৬৫ জন শ্রমিক আহত হন। আহতদের অনেককে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। দুপুর আড়াইটার দিকে শ্রমিকরা শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে পালিয়ে যান। এতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক বন্ধ থাকায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। কয়েক হাজার যাত্রী ভোগান্তির শিকার হয়।
এদিকে সংঘর্ষ চলাকালে কাঁচপুর ও রূপগঞ্জ শিল্পাঞ্চলের অর্ধশতাধিক গার্মেন্ট কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। সে সময় আশপাশের শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। পুলিশ শাহীন মিয়া, উজ্জল ও মনির হোসেন নামের তিন শ্রমিককে গ্রেপ্তার করেছে।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, গতকাল সকালে রূপগঞ্জ উপজেলার চনপাড়া বস্তি থেকে শীতলক্ষ্যা নদী দিয়ে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারের করে প্রায় ৩০০ লোককে সিনহা গার্মেন্টে ভাড়া করে আনা হয়। কাঁচপুর এলাকার একটি মহল তাদের ভাড়ায় আনে বলে সূত্রটি জানায়। সিনহা গার্মেন্টের ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিতে কাঁচপুর এলাকার কয়েকটি গ্রুপ সব সময় তৎপর থাকে। কোনো গ্রুপ ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যর্থ হলে তখনই তাদের মনোনীত শ্রমিকদের দিয়ে আন্দোলনের চেষ্টা চালায়। সূত্রটি আরো জানায়, সিনহা গার্মেন্টসহ আশপাশের গার্মেন্টগুলোর প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক কাঁচপুর এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। এসব শ্রমিককে নিয়ন্ত্রণ করেন কাঁচপুর এলাকার কিছু ঝুট ব্যবসায়ী।
শ্রমিক আসমা, ফাহিমা, ফাতিমা, আফিয়া, সোহেল ও দিপু বলেন, 'যে হারে বাড়িভাড়া ও দ্রব্যমূল্য বাড়ছে, সে হারে আমাদের বেতন বাড়ছে না। তাই আমাদের বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলনে নামতে হচ্ছে। যত দিন আমাদের বেতন বাড়ানো না হবে, তত দিন আমাদের আন্দোলন চলবে।'
সিনহা ওপেক্স গ্রুপের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) দেলোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি তো তাদের মুখে বেতন বাড়ানোর দাবির কথা শুনলাম না। আমাদের কাছে বেতন বাড়ানোর কোনো দাবিও করেনি তারা। এসব কে করাচ্ছে, এটাই ভাবার বিষয়।' ভাঙচুরের ঘটনায় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে তিনি জানান। গার্মেন্ট বন্ধ থাকলে প্রতিদিন প্রায় এক কোটি টাকা লোকসান হয়।
সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হারুনুর রশিদ তিন শ্রমিক গ্রেপ্তারের ঘটনা স্বীকার করে বলেন, ভাঙচুর ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে। শিল্পাঞ্চল-৪-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ আহমেদ জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পুলিশ ৭০২টি টিয়ার শেল, গুলি, স্মোক গ্রেনেড ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে।
নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বি-সার্কেল) এস এম শফিউল্লা বলেন, হঠাৎ করেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এর সঠিক কারণ জানা যায়নি। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.