স্মরণ-মুক্তবুদ্ধির দিশারি: গোলাম সামদানী কোরায়শী by স্বপন ধর
মৈমনসিংহ গীতিকার ভূমি। মহুয়ার দেশ। পাণ্ডববর্জিত ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব পার। গারো পাহাড়। সবুজ প্রান্তর। ছোট ছোট আঁকা-বাঁকা নদী। মান্দার গাছ। কদলী বাগান। কেয়া-বকুলের আসর জমানো মনোলোভা এক প্রকৃতি নেত্রকোনার কেন্দুয়া।
কবিকঙ্ক, গার্গ্য, মনসুর বয়াতি, চন্দ্র কুমার দে এবং হালের বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, যতীন সরকার, হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবালদের মতো বহু মনীষীর পীঠস্থান কেন্দুয়া। কেন্দুয়া থেকে আট কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব প্রান্তে তিন দিক নদীঘেরা দুর্গম কাউরাট গ্রাম। এ গ্রামে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৫ এপ্রিল জন্মেছিলেন বহুভাষাবিদ, মুক্তবুদ্ধির আলোকবর্তিকা গোলাম সামদানী কোরায়শী। গতকাল ছিল তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। নেত্রকোনার চন্দ্রনাথ হাইস্কুলে হাতেখড়ি (১৯৩৫-৩৬)। তারপর গৌরীপুরের বিভিন্ন স্কুলে চতুর্থ শ্রেণী (১৯৩৭-৪১)। ১৯৪১ থেকে ৪৫ পর্যন্ত আত্মীয়দের বাসায় রাখালি করতে করতে পাঠগ্রহণের পর্বটি প্রায় চুকিয়েই ফেলেছিলেন। তারপর অদম্য মনোবল নিয়ে ভর্তি হন মাদ্রাসায়। নেত্রকোনার মদন উপজেলা থেকে শুরু করে ময়মনসিংহের কাতলা সেন মাদ্রাসা। ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ১৯৫২ সালে ফাজিল প্রথম শ্রেণীতে তৃতীয় এবং ১৯৫৪ সালে কামিল প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করে স্বর্ণপদক পান। তারপর সাধারণ শিক্ষা। এ শিক্ষাতেও তিনি সার্থক হলেন। ৩০ বছর বয়সে ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সসহ এমএ পাস করেন কৃতিত্বের সঙ্গে।
শিক্ষার মতো তাঁর কর্মজীবনও বর্ণাঢ্য এবং বহুব্যাপ্ত। রাখালি থেকে শুরু করে মসজিদের ইমামতি, মাদ্রাসার শিক্ষকতা, বাংলা একাডেমীতে গবেষণার অভিধান প্রণয়ন এবং কলেজে অধ্যাপনা।
১৯৬১ সালে কিংবদন্তিতুল্য ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লার আহ্বানে সাড়া দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান প্রকল্পে বাংলা একাডেমীর ড. শহীদুল্লার সহযোগী হন।
অভিধান প্রকল্পের পাশাপাশি তিনি অনুবাদকর্মেও মনোনিবেশ করেন। ১৯৬৫ সাল থেকে আরবি, ফারসি, উর্দু, ইংরেজি বিভিন্ন ভাষার বহু মৌলিক গ্রন্থ তিনি অনুবাদ করেন। অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে কালিলা ও দিমনা (১৯৬৫); আইন-আদালতের ভাষা আরবি-ফার্সি শব্দ (মূল ইংরেজি), অশাস্ত্রীয় পুরাণ (মূল সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়); শব্দাদর্শ অধ্যয়ন (মূল মুহম্মদ ওবায়দুল্লাহ); তারিখ-ই-ফিরোজশাহী, তোহফা (মূল ফার্সি) প্রভৃতি এবং বাংলা একাডেমী থেকে এসব গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তাঁর অনূদিত হেজাজের সওগাত (মহাকবি ইকবালের আরমুগানে হেজাজ—এর অনুবাদ) ১৯৬৫ সালে করাচির ইকবাল একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া বহু অনুবাদ এবং মৌলিক সৃজনশীল সাহিত্যকর্মের নিদর্শন রেখে যান তিনি।
১৯৮১-৮২ সালে বিখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ইবনে খলদুনের আল মোকাদ্দিমা বাংলা একাডেমী থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজে সাড়া পড়ে। তিনি ইবনে খলদুনের জীবনীগ্রন্থসহ ২৪টি গ্রন্থের অনুবাদক।
তাঁর প্রকাশিত-অপ্রকাশিত প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, উপন্যাস, গল্প, নাটক, কবিতা, ছড়া, গান, রসরচনা অগণন।
সিন্ধুর এক বিন্দু তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনী গ্রন্থ। ছোটদের জন্য তিনি রচনা করেছেন ছোটদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং ছোটদের দুদু মিয়া। শিশু একাডেমী থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থ দুটি সাবলীল গদ্যে অনবদ্য।
তাঁর দায়িত্বশীল কর্মযজ্ঞ শুরু হয় ১৯৬৮ সালে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে অধ্যাপনা করতে এসে। সেখানে এসে তিনি দেখা পান আরেক কর্মবীর, চিন্তাবিদ প্রাবন্ধিক যতীন সরকার; এবং সাংবাদিক-কথাসাহিত্যিক রাহাত খানের সঙ্গে। অধ্যাপক সরকার এবং সামদানী কোরায়শী নাসিরাবাদ কলেজের মণিকাঞ্চন হিসেবে দেখা দেন। সেই সুবাদে কলেজটিও শ্রীবৃদ্ধি পেয়ে খ্যাতি পায়। ময়মনসিংহের প্রতিটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনে কোরায়শী ছিলেন মধ্যমণি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে (১৯৯০) ময়মনসিংহে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক হিসেবে যে কঠিন দায়িত্ব তিনি পালন করেছিলেন, তা কেবল তাঁর মতো অজাতশত্রুর পক্ষেই সম্ভব ছিল। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে তিনি ছিলেন নির্ভীক। ময়মনসিংহের বহু সংগঠনের জন্মদাতা ছিলেন তিনি। প্রেসক্লাব, সাহিত্য সংসদ, উদীচীসহ প্রায় যেকোনো সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনে তিনি কোনো না কোনো দায়িত্ব প্রাপ্ত হতেন। আদর্শ-চেতনার অভিন্নতায় তিনি যতীন সরকার, আলোকময় নাহা, খগেশ কিরণ তালুকদারদের সঙ্গে ‘মুক্তবাতায়ন পাঠচক্র’ গড়ে তোলেন। বিজ্ঞান-দর্শনবিষয়ক পাঠচক্রে তিনি ছিলেন অন্যতম।
তাঁর কৃতকর্মের অবদানস্বরূপ অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার (১৯৯০) উল্লেখযোগ্য হলেও তাঁর কর্মের প্রতি সুবিচার হয়নি মনে হয়। আজও মরণোত্তর পদকে ভূষিত করার দাবি রাখেন এ বুদ্ধিজীবী।
১৯৯১ সালে মাত্র ৬২ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। এতে ময়মনসিংহবাসী অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে আর দেশ হারায় অনন্য প্রতিভাবান, বহুভাষী পণ্ডিত, বহুদর্শী সমাজকর্মীকে। বৈচিত্র্যময় জীবনে তিনি অনন্য। নিজের চলে যাওয়া নিয়েও ছিলেন দার্শনিকরকম সচেতন। সর্বশেষ লেখা ‘আমার রোগ’ নিবন্ধে স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘বিজ্ঞানের প্রক্রিয়া...মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আবহমান কাল ধরে চলতে থাকবে, কিন্তু তার লব্ধ ফলাফল দেখার জন্য আমি তো এখানে থাকব না।’
সংক্ষিপ্ত জীবনকে তিনি সার্থক করে গেছেন অনেকটা নিজের অজান্তেই।
তাঁর মৃত্যুর ১৯ বছর পর তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে আমাদের কণ্ঠে, সত্তায় বেজে ওঠে কবির সেই পঙক্তি:
‘সাথে করে এনেছিলে মৃত্যুহীন প্রাণ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান \’
শিক্ষার মতো তাঁর কর্মজীবনও বর্ণাঢ্য এবং বহুব্যাপ্ত। রাখালি থেকে শুরু করে মসজিদের ইমামতি, মাদ্রাসার শিক্ষকতা, বাংলা একাডেমীতে গবেষণার অভিধান প্রণয়ন এবং কলেজে অধ্যাপনা।
১৯৬১ সালে কিংবদন্তিতুল্য ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লার আহ্বানে সাড়া দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান প্রকল্পে বাংলা একাডেমীর ড. শহীদুল্লার সহযোগী হন।
অভিধান প্রকল্পের পাশাপাশি তিনি অনুবাদকর্মেও মনোনিবেশ করেন। ১৯৬৫ সাল থেকে আরবি, ফারসি, উর্দু, ইংরেজি বিভিন্ন ভাষার বহু মৌলিক গ্রন্থ তিনি অনুবাদ করেন। অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে কালিলা ও দিমনা (১৯৬৫); আইন-আদালতের ভাষা আরবি-ফার্সি শব্দ (মূল ইংরেজি), অশাস্ত্রীয় পুরাণ (মূল সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়); শব্দাদর্শ অধ্যয়ন (মূল মুহম্মদ ওবায়দুল্লাহ); তারিখ-ই-ফিরোজশাহী, তোহফা (মূল ফার্সি) প্রভৃতি এবং বাংলা একাডেমী থেকে এসব গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তাঁর অনূদিত হেজাজের সওগাত (মহাকবি ইকবালের আরমুগানে হেজাজ—এর অনুবাদ) ১৯৬৫ সালে করাচির ইকবাল একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া বহু অনুবাদ এবং মৌলিক সৃজনশীল সাহিত্যকর্মের নিদর্শন রেখে যান তিনি।
১৯৮১-৮২ সালে বিখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ইবনে খলদুনের আল মোকাদ্দিমা বাংলা একাডেমী থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজে সাড়া পড়ে। তিনি ইবনে খলদুনের জীবনীগ্রন্থসহ ২৪টি গ্রন্থের অনুবাদক।
তাঁর প্রকাশিত-অপ্রকাশিত প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, উপন্যাস, গল্প, নাটক, কবিতা, ছড়া, গান, রসরচনা অগণন।
সিন্ধুর এক বিন্দু তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনী গ্রন্থ। ছোটদের জন্য তিনি রচনা করেছেন ছোটদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং ছোটদের দুদু মিয়া। শিশু একাডেমী থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থ দুটি সাবলীল গদ্যে অনবদ্য।
তাঁর দায়িত্বশীল কর্মযজ্ঞ শুরু হয় ১৯৬৮ সালে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে অধ্যাপনা করতে এসে। সেখানে এসে তিনি দেখা পান আরেক কর্মবীর, চিন্তাবিদ প্রাবন্ধিক যতীন সরকার; এবং সাংবাদিক-কথাসাহিত্যিক রাহাত খানের সঙ্গে। অধ্যাপক সরকার এবং সামদানী কোরায়শী নাসিরাবাদ কলেজের মণিকাঞ্চন হিসেবে দেখা দেন। সেই সুবাদে কলেজটিও শ্রীবৃদ্ধি পেয়ে খ্যাতি পায়। ময়মনসিংহের প্রতিটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনে কোরায়শী ছিলেন মধ্যমণি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে (১৯৯০) ময়মনসিংহে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক হিসেবে যে কঠিন দায়িত্ব তিনি পালন করেছিলেন, তা কেবল তাঁর মতো অজাতশত্রুর পক্ষেই সম্ভব ছিল। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে তিনি ছিলেন নির্ভীক। ময়মনসিংহের বহু সংগঠনের জন্মদাতা ছিলেন তিনি। প্রেসক্লাব, সাহিত্য সংসদ, উদীচীসহ প্রায় যেকোনো সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনে তিনি কোনো না কোনো দায়িত্ব প্রাপ্ত হতেন। আদর্শ-চেতনার অভিন্নতায় তিনি যতীন সরকার, আলোকময় নাহা, খগেশ কিরণ তালুকদারদের সঙ্গে ‘মুক্তবাতায়ন পাঠচক্র’ গড়ে তোলেন। বিজ্ঞান-দর্শনবিষয়ক পাঠচক্রে তিনি ছিলেন অন্যতম।
তাঁর কৃতকর্মের অবদানস্বরূপ অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার (১৯৯০) উল্লেখযোগ্য হলেও তাঁর কর্মের প্রতি সুবিচার হয়নি মনে হয়। আজও মরণোত্তর পদকে ভূষিত করার দাবি রাখেন এ বুদ্ধিজীবী।
১৯৯১ সালে মাত্র ৬২ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। এতে ময়মনসিংহবাসী অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে আর দেশ হারায় অনন্য প্রতিভাবান, বহুভাষী পণ্ডিত, বহুদর্শী সমাজকর্মীকে। বৈচিত্র্যময় জীবনে তিনি অনন্য। নিজের চলে যাওয়া নিয়েও ছিলেন দার্শনিকরকম সচেতন। সর্বশেষ লেখা ‘আমার রোগ’ নিবন্ধে স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘বিজ্ঞানের প্রক্রিয়া...মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আবহমান কাল ধরে চলতে থাকবে, কিন্তু তার লব্ধ ফলাফল দেখার জন্য আমি তো এখানে থাকব না।’
সংক্ষিপ্ত জীবনকে তিনি সার্থক করে গেছেন অনেকটা নিজের অজান্তেই।
তাঁর মৃত্যুর ১৯ বছর পর তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে আমাদের কণ্ঠে, সত্তায় বেজে ওঠে কবির সেই পঙক্তি:
‘সাথে করে এনেছিলে মৃত্যুহীন প্রাণ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান \’
No comments