শাসন কাঠামো-প্রশাসনের কল্পিত বাস্তবতা by আহমদ হোসেন
যদি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়, তবে অবশ্যম্ভাবীভাবেই সরকারকে প্রশাসনিক পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন করতে হবে। ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ১৩ সচিব, ৬ বিভাগীয় কমিশনার, ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার, ৪৬৫ উপজেলার নির্বাহী অফিসার ও ওসি_ এর প্রায় সব ক'টিতে ১৫ দিনের মধ্যে পরিবর্তন সম্পাদন করতে হয়েছিল।
এ সংখ্যার নূ্যনপক্ষে অর্ধেক পরিবর্তন করতে গিয়ে বর্তমানে দলনিরপেক্ষ ও দক্ষ কর্মকর্তা খুঁজে পাওয়া বিরাট সমস্যা আকারে উপস্থিত হবে
দেশের প্রশাসনে দলীয়করণ বর্তমান পরিণতিতে কীভাবে পেঁৗছাল? বিশ্লেষকদের অনেকের মতে কারণগুলো হলো : (১) স্বাধীনতা-উত্তর অস্বচ্ছ নিয়োগ, (২) পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান সার্ভিস বিরোধ, (৩) মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের বিরোধ, (৪) রাজনৈতিক আনুগত্য লাভের দ্বিপক্ষীয় চেষ্টা এবং (৫) আত্মীয়নির্ভরতা। স্বাধীনতার ঊষালগ্নের এসব দ্বন্দ্ব নিরসন হতে না হতে '৭৫-এর পট পরিবর্তন ঘটে। '৭৫-পরবর্তী সরকার সিনিয়র সার্ভিস পুল গঠন, ২৯টি ক্যাডার সৃজন, সিভিল সার্ভিস রিক্রুটমেন্ট রুল, সরকারি কর্মচারীদের শৃঙ্খলা ও আচরণ সংক্রান্ত আইন এবং বিধিবিধান প্রণয়ন করে। নতুন সাংগঠনিক কাঠামোতে স্টেকহোল্ডারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে আরও জটিলতা সৃষ্টি হয়। কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও নতুন জটিলতা সৃষ্টি হয়। সে সময়ও পার্শ্বর্নিয়োগ, চুক্তি, সামরিক সার্ভিস থেকে অন্তর্ভুর্ক্তি_ এগুলো ক্ষমতাসীনদের আনুগত্য লাভে সিভিল সার্ভিস সদস্যদের উৎসাহিত করে। ১৯৮২-পরবর্তী সরকারের আমলে উপজেলা পদ্ধতির জন্য বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ প্রক্রিয়া বর্তমান প্রশাসনে সবচেয়ে বড় জটিলতা তৈরি করে। একসঙ্গে ৬৫০ কর্মকর্তাকে বয়সভিত্তিক বেতন স্কেল প্রদান, ৫০ বছর পর্যন্ত বয়সী ব্যক্তিকে সিভিল সার্ভিসে কেবল ২০০ মার্কের মাল্টিপল চয়েস পরীক্ষার মাধ্যমে নজিরবিহীন পদ্ধতিতে নিয়োগ সমগ্র সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈরিতার সূচনা করে। উপজেলা পদ্ধতি ১৯৯০ সালে বাতিল হয়ে যাওয়ার পর এসব কর্মকর্তার বিসিএস প্রশাসনে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নিতান্ত স্বাভাবিক হলেও তা আন্তঃব্যাচ দ্বন্দ্বকে তুঙ্গে নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ায়। এ পর্যায়ে পদায়ন, পদোন্নতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুকূল্য গ্রহণের চেষ্টা অধিকতর সক্রিয়তা লাভ করে। এর পরবর্তী দুটি সিভিল সার্ভিস নিয়মিত ব্যাচে বড় আকারের নিয়োগ সম্পন্ন হওয়ায় তাদের সার্ভিসের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঊর্ধ্বতন পদ-সোপান সংকীর্ণ হয়ে আসে। ফলে স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক সুযোগ সন্ধানী কর্মকর্তাদের ব্যাপকতা লাভ করে আজকের ভয়াবহতায় রূপান্তরিত হয়েছে। এরই ফাঁক দিয়ে দুর্নীতিও হয়তো ঢুকে পড়ার সুযোগ গ্রহণ করেছে।
দেশে বিদ্যমান দলীয়করণ ও অদক্ষতাপূর্ণ প্রশাসনের কারণে বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষে প্রশাসন অবশ্যম্ভাবীভাবে জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে। বর্তমান সরকারের মেয়াদ সর্বোচ্চ আগামী প্রায় দেড় বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। যদি বর্তমান সরকারই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে কাজ করে, তথাপি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিচালনার স্বার্থেই জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে ব্যাপক পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে। সে ক্ষেত্রে আগামী এক-দেড় বছরের মাথায় সম্ভাব্য যে পরিবর্তন বর্তমান সরকার করবে, তার ফলে বিপুলসংখ্যক অনুগত কর্মকর্তার আস্থা হারাতে হতে পারে সরকারকে। আবার এসব পদ পূরণের জন্য বর্তমান প্রশাসনের মধ্য থেকে কিছুটা নিরপেক্ষ ও দক্ষ কর্মকর্তা খুঁজে পাওয়ার প্রশ্ন থেকেই যাবে।
যদি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়, তবে অবশ্যম্ভাবীভাবেই সরকারকে প্রশাসনিক পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন করতে হবে। ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ১৩ সচিব, ৬ বিভাগীয় কমিশনার, ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার, ৪৬৫ উপজেলার নির্বাহী অফিসার ও ওসি_ এর প্রায় সব ক'টিতে ১৫ দিনের মধ্যে পরিবর্তন সম্পাদন করতে হয়েছিল। এ সংখ্যার নূ্যনপক্ষে অর্ধেক পরিবর্তন করতে গিয়ে বর্তমানে দলনিরপেক্ষ ও দক্ষ কর্মকর্তা খুঁজে পাওয়া বিরাট সমস্যা আকারে উপস্থিত হবে। উপরন্তু নির্বাচন কাঠামোতে এবার নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদেরও গুরুত্ব ব্যাপক। নির্বাচন কমিশনের মাঠ পর্যায়ের অফিসারদের কীভাবে পরিবর্তন হবে_ তা নিয়েও প্রশ্ন দাঁড়াবে। ২০০৬ সালে নির্বাচন কমিশনের নবনিযুক্ত প্রায় ৩০০ কর্মকর্তার পদায়ন ও প্রত্যাহার নিয়ে অনেক জটিল পরিস্থিতি পোহাতে হয়েছে। একসময় মাঠ পর্যায়ের বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার করার কথা কেউ কেউ বলেছিলেন। এবার স্বাধীন বিচার বিভাগের অধীনে সে সুযোগও সীমিত। আরও উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার কর্তৃক বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে বিপুলসংখ্যক দক্ষ পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তা রয়েছেন। পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের দুই-তিন স্তর নিচের কর্মকর্তারা পদোন্নতি নিয়ে ওপরে চলে যাওয়ায় পদায়ন করতে গেলে বহুবিধ জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে। তা ছাড়া কর্ম সম্পাদনে মানসিক দ্বন্দ্ব তো থাকবেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর পদোন্নতি ও পদায়নবঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি প্রদান ও পদায়নজনিত দায়িত্বটি হবে বৃহত্তর চ্যালেঞ্জ ও নৈতিক দায়িত্ব।
পুলিশ প্রশাসনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে বর্তমান সরকারের সুবিধাভোগীদের উপযুক্ত স্থানে বদলি করা হবে সমস্যাসংকুল। মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে সমন্ব্বয় রেখে ঊর্ধ্বতনদের পুলিশ দফতরের বাইরে উপযুক্ত পদে পদায়ন জটিল ও প্রায় অসম্ভব। সর্বোপরি বিরাট এ বাহিনীকে সুনিয়ন্ত্রিত রেখে স্বচ্ছতার সঙ্গে তাদের দ্বারা কর্ম সম্পাদন করার ঝুঁকি বিদ্যমান থাকবে।
আগামী অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার-উত্তর প্রশাসন-পরিস্থিতি আরও জটিল। প্রশাসনের শীর্ষ পদ তথা সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পর্যায়ে বর্তমানে কর্মরতদের সংখ্যার তুলনায় দলীয়করণের ফলে বঞ্চিত কর্মকর্তার সংখ্যাই বেশি। তাদের মধ্যে (১) রাজনৈতিক দোষারোপের কারণে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি), (২) বর্তমান সরকারের পদোন্নতি আশীর্বাদপ্রাপ্ত পদায়নবঞ্চিত ওএসডি, (৩) পদোন্নতিবঞ্চিত ওএসডি, (৪) ডাম্পিং কর্মস্থলে নিষ্পেষিত কর্মকর্তা এবং (৫) পদোন্নতিবঞ্চিত ও ডাম্পিং কর্মস্থলে নিষ্পেষিত কর্মকর্তা। এই পাঁচ ধরনের কর্মকর্তার মধ্যে শ্রেণী, ব্যাচ, স্তর ও ব্যক্তিভেদে সমস্যার বিভিন্নতাও রয়েছে। তাদের সমস্যার সমধর্মিতা না থাকায় সাধারণ সূত্রে এসবের সমাধান করা সম্ভব নয়।
পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে জাতির প্রত্যাশা থাকবে দক্ষ, সৎ ও জনকল্যাণমুখী প্রশাসন সৃজন। এ ক্ষেত্রে পাঁচ স্তরের বঞ্চিতদের বিষয় বিবেচনা করতে গেলে নতুনভাবে বর্তমান সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের অবশ্যম্ভাবীভাবে বঞ্চিতের স্বাদ গ্রহণ করাতে হতে পারে। এ কঠিন কাজটি অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও অত্যন্ত বাস্তব। পাকিস্তান আমলে ্তু৩০৩্থ ও ্তু৫৫৫্থ শিরোনামে অনেক কর্মকর্তাকে প্রশাসন থেকে সরানো হয়েছিল। বাংলাদেশেও প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার-৯ বা মার্শাল ল' অর্ডার-৯ ইত্যাদির মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত করার নজির রয়েছে। এগুলো সবই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বিধায় বর্তমানে এ ধরনের পৃথক আইন নেই। তবে সরকার ইচ্ছে করলে তার সুযোগ সৃষ্টি অসম্ভব নয়। বিদগ্ধ মহলের অনেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক প্রশাসনের অসন্তোষ নিরসন ও বঞ্চিতদের সমস্যা তাৎক্ষণিক সমাধানে স্বল্পকালীন কমিশন গঠনের কথা ভাবছেন। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ওপর এখন আর এ কাজ সম্পাদনে আস্থা পরিলক্ষিত হয় না।
এ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের সূত্র খুঁজে বের করা জরুরি। এ জন্য বিভিন্ন প্রশাসনিক কমিটি, কমিশন ও প্রকল্প পরামর্শকদের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে কার্যক্রম গ্রহণই যথেষ্ট হতে পারে। তবে দলীয়করণজনিত যে সমস্যা আগামী নির্বাচিত সরকারের কাছে আসবে, তার তাৎক্ষণিক অনেক সমাধান না করলে সরকারের কার্য সম্পাদন সম্ভব নাও হতে পারে। আগামী সরকারের আশু করণীয় হবে অগ্রাধিকার।
আহমদ হোসেন :সাবেক সরকারি কর্মকর্তা
দেশের প্রশাসনে দলীয়করণ বর্তমান পরিণতিতে কীভাবে পেঁৗছাল? বিশ্লেষকদের অনেকের মতে কারণগুলো হলো : (১) স্বাধীনতা-উত্তর অস্বচ্ছ নিয়োগ, (২) পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান সার্ভিস বিরোধ, (৩) মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের বিরোধ, (৪) রাজনৈতিক আনুগত্য লাভের দ্বিপক্ষীয় চেষ্টা এবং (৫) আত্মীয়নির্ভরতা। স্বাধীনতার ঊষালগ্নের এসব দ্বন্দ্ব নিরসন হতে না হতে '৭৫-এর পট পরিবর্তন ঘটে। '৭৫-পরবর্তী সরকার সিনিয়র সার্ভিস পুল গঠন, ২৯টি ক্যাডার সৃজন, সিভিল সার্ভিস রিক্রুটমেন্ট রুল, সরকারি কর্মচারীদের শৃঙ্খলা ও আচরণ সংক্রান্ত আইন এবং বিধিবিধান প্রণয়ন করে। নতুন সাংগঠনিক কাঠামোতে স্টেকহোল্ডারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে আরও জটিলতা সৃষ্টি হয়। কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও নতুন জটিলতা সৃষ্টি হয়। সে সময়ও পার্শ্বর্নিয়োগ, চুক্তি, সামরিক সার্ভিস থেকে অন্তর্ভুর্ক্তি_ এগুলো ক্ষমতাসীনদের আনুগত্য লাভে সিভিল সার্ভিস সদস্যদের উৎসাহিত করে। ১৯৮২-পরবর্তী সরকারের আমলে উপজেলা পদ্ধতির জন্য বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ প্রক্রিয়া বর্তমান প্রশাসনে সবচেয়ে বড় জটিলতা তৈরি করে। একসঙ্গে ৬৫০ কর্মকর্তাকে বয়সভিত্তিক বেতন স্কেল প্রদান, ৫০ বছর পর্যন্ত বয়সী ব্যক্তিকে সিভিল সার্ভিসে কেবল ২০০ মার্কের মাল্টিপল চয়েস পরীক্ষার মাধ্যমে নজিরবিহীন পদ্ধতিতে নিয়োগ সমগ্র সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈরিতার সূচনা করে। উপজেলা পদ্ধতি ১৯৯০ সালে বাতিল হয়ে যাওয়ার পর এসব কর্মকর্তার বিসিএস প্রশাসনে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নিতান্ত স্বাভাবিক হলেও তা আন্তঃব্যাচ দ্বন্দ্বকে তুঙ্গে নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ায়। এ পর্যায়ে পদায়ন, পদোন্নতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুকূল্য গ্রহণের চেষ্টা অধিকতর সক্রিয়তা লাভ করে। এর পরবর্তী দুটি সিভিল সার্ভিস নিয়মিত ব্যাচে বড় আকারের নিয়োগ সম্পন্ন হওয়ায় তাদের সার্ভিসের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঊর্ধ্বতন পদ-সোপান সংকীর্ণ হয়ে আসে। ফলে স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক সুযোগ সন্ধানী কর্মকর্তাদের ব্যাপকতা লাভ করে আজকের ভয়াবহতায় রূপান্তরিত হয়েছে। এরই ফাঁক দিয়ে দুর্নীতিও হয়তো ঢুকে পড়ার সুযোগ গ্রহণ করেছে।
দেশে বিদ্যমান দলীয়করণ ও অদক্ষতাপূর্ণ প্রশাসনের কারণে বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষে প্রশাসন অবশ্যম্ভাবীভাবে জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে। বর্তমান সরকারের মেয়াদ সর্বোচ্চ আগামী প্রায় দেড় বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। যদি বর্তমান সরকারই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে কাজ করে, তথাপি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিচালনার স্বার্থেই জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে ব্যাপক পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে। সে ক্ষেত্রে আগামী এক-দেড় বছরের মাথায় সম্ভাব্য যে পরিবর্তন বর্তমান সরকার করবে, তার ফলে বিপুলসংখ্যক অনুগত কর্মকর্তার আস্থা হারাতে হতে পারে সরকারকে। আবার এসব পদ পূরণের জন্য বর্তমান প্রশাসনের মধ্য থেকে কিছুটা নিরপেক্ষ ও দক্ষ কর্মকর্তা খুঁজে পাওয়ার প্রশ্ন থেকেই যাবে।
যদি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়, তবে অবশ্যম্ভাবীভাবেই সরকারকে প্রশাসনিক পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন করতে হবে। ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ১৩ সচিব, ৬ বিভাগীয় কমিশনার, ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার, ৪৬৫ উপজেলার নির্বাহী অফিসার ও ওসি_ এর প্রায় সব ক'টিতে ১৫ দিনের মধ্যে পরিবর্তন সম্পাদন করতে হয়েছিল। এ সংখ্যার নূ্যনপক্ষে অর্ধেক পরিবর্তন করতে গিয়ে বর্তমানে দলনিরপেক্ষ ও দক্ষ কর্মকর্তা খুঁজে পাওয়া বিরাট সমস্যা আকারে উপস্থিত হবে। উপরন্তু নির্বাচন কাঠামোতে এবার নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদেরও গুরুত্ব ব্যাপক। নির্বাচন কমিশনের মাঠ পর্যায়ের অফিসারদের কীভাবে পরিবর্তন হবে_ তা নিয়েও প্রশ্ন দাঁড়াবে। ২০০৬ সালে নির্বাচন কমিশনের নবনিযুক্ত প্রায় ৩০০ কর্মকর্তার পদায়ন ও প্রত্যাহার নিয়ে অনেক জটিল পরিস্থিতি পোহাতে হয়েছে। একসময় মাঠ পর্যায়ের বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার করার কথা কেউ কেউ বলেছিলেন। এবার স্বাধীন বিচার বিভাগের অধীনে সে সুযোগও সীমিত। আরও উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার কর্তৃক বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে বিপুলসংখ্যক দক্ষ পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তা রয়েছেন। পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের দুই-তিন স্তর নিচের কর্মকর্তারা পদোন্নতি নিয়ে ওপরে চলে যাওয়ায় পদায়ন করতে গেলে বহুবিধ জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে। তা ছাড়া কর্ম সম্পাদনে মানসিক দ্বন্দ্ব তো থাকবেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর পদোন্নতি ও পদায়নবঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি প্রদান ও পদায়নজনিত দায়িত্বটি হবে বৃহত্তর চ্যালেঞ্জ ও নৈতিক দায়িত্ব।
পুলিশ প্রশাসনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে বর্তমান সরকারের সুবিধাভোগীদের উপযুক্ত স্থানে বদলি করা হবে সমস্যাসংকুল। মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে সমন্ব্বয় রেখে ঊর্ধ্বতনদের পুলিশ দফতরের বাইরে উপযুক্ত পদে পদায়ন জটিল ও প্রায় অসম্ভব। সর্বোপরি বিরাট এ বাহিনীকে সুনিয়ন্ত্রিত রেখে স্বচ্ছতার সঙ্গে তাদের দ্বারা কর্ম সম্পাদন করার ঝুঁকি বিদ্যমান থাকবে।
আগামী অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার-উত্তর প্রশাসন-পরিস্থিতি আরও জটিল। প্রশাসনের শীর্ষ পদ তথা সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পর্যায়ে বর্তমানে কর্মরতদের সংখ্যার তুলনায় দলীয়করণের ফলে বঞ্চিত কর্মকর্তার সংখ্যাই বেশি। তাদের মধ্যে (১) রাজনৈতিক দোষারোপের কারণে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি), (২) বর্তমান সরকারের পদোন্নতি আশীর্বাদপ্রাপ্ত পদায়নবঞ্চিত ওএসডি, (৩) পদোন্নতিবঞ্চিত ওএসডি, (৪) ডাম্পিং কর্মস্থলে নিষ্পেষিত কর্মকর্তা এবং (৫) পদোন্নতিবঞ্চিত ও ডাম্পিং কর্মস্থলে নিষ্পেষিত কর্মকর্তা। এই পাঁচ ধরনের কর্মকর্তার মধ্যে শ্রেণী, ব্যাচ, স্তর ও ব্যক্তিভেদে সমস্যার বিভিন্নতাও রয়েছে। তাদের সমস্যার সমধর্মিতা না থাকায় সাধারণ সূত্রে এসবের সমাধান করা সম্ভব নয়।
পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে জাতির প্রত্যাশা থাকবে দক্ষ, সৎ ও জনকল্যাণমুখী প্রশাসন সৃজন। এ ক্ষেত্রে পাঁচ স্তরের বঞ্চিতদের বিষয় বিবেচনা করতে গেলে নতুনভাবে বর্তমান সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের অবশ্যম্ভাবীভাবে বঞ্চিতের স্বাদ গ্রহণ করাতে হতে পারে। এ কঠিন কাজটি অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও অত্যন্ত বাস্তব। পাকিস্তান আমলে ্তু৩০৩্থ ও ্তু৫৫৫্থ শিরোনামে অনেক কর্মকর্তাকে প্রশাসন থেকে সরানো হয়েছিল। বাংলাদেশেও প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার-৯ বা মার্শাল ল' অর্ডার-৯ ইত্যাদির মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত করার নজির রয়েছে। এগুলো সবই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বিধায় বর্তমানে এ ধরনের পৃথক আইন নেই। তবে সরকার ইচ্ছে করলে তার সুযোগ সৃষ্টি অসম্ভব নয়। বিদগ্ধ মহলের অনেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক প্রশাসনের অসন্তোষ নিরসন ও বঞ্চিতদের সমস্যা তাৎক্ষণিক সমাধানে স্বল্পকালীন কমিশন গঠনের কথা ভাবছেন। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ওপর এখন আর এ কাজ সম্পাদনে আস্থা পরিলক্ষিত হয় না।
এ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের সূত্র খুঁজে বের করা জরুরি। এ জন্য বিভিন্ন প্রশাসনিক কমিটি, কমিশন ও প্রকল্প পরামর্শকদের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে কার্যক্রম গ্রহণই যথেষ্ট হতে পারে। তবে দলীয়করণজনিত যে সমস্যা আগামী নির্বাচিত সরকারের কাছে আসবে, তার তাৎক্ষণিক অনেক সমাধান না করলে সরকারের কার্য সম্পাদন সম্ভব নাও হতে পারে। আগামী সরকারের আশু করণীয় হবে অগ্রাধিকার।
আহমদ হোসেন :সাবেক সরকারি কর্মকর্তা
No comments