অল্পবিদ্যা-এক শতাংশ তত্ত্ব by আসিফ নজরুল
যুগে যুগে বেফাঁস কথা বলে মানুষ বিপদে পড়েছে। আমাদের দেশে তা হয় না এখন। কিছু বেফাঁস কথা বেমালুম অস্বীকার করা হয়। কিছু কথার দায় সাংবাদিকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এটি পুরোনো অভ্যাস। এমনি অভ্যাস যে টিভিতে প্রচারিত হওয়া কথা পর্যন্ত সাংবাদিকেরা বিকৃত করেছেন বলে দাবি করা হয়।
তবে বেফাঁস কথা বলা কিছু মানুষ অল্পদিন সংকোচে ভোগেন, ক্যামেরা এড়িয়ে চলেন। যেমন পুলিশ থেকে সাংবাদিকদের নিরাপদ দূরত্বে থাকতে বলার পর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিজেই কিছুদিন ক্যামেরা থেকে নিরাপদ দূরত্বে রয়েছেন।
অর্থমন্ত্রী একবার বললেন, তিনি শেয়ার মার্কেট বোঝেন না। আমরা কি কল্পনা করতে পারি যে সাহারা খাতুন বলছেন, তিনি গুম বোঝেন না? কিংবা আবুল হোসেন বলছেন টেন্ডার বোঝেন না, বা সুরঞ্জিত বলছেন, তিনি কালো বিড়াল বোঝেন না? পারি না। কাজেই আমাদের উচিত ছিল তাঁর সারল্যে মুগ্ধ হওয়া। তিনি তারপর বললেন, তিনি শেয়ার মার্কেট নিয়ে কথা বলবেন না, কারণ তিনি কথা বললে শেয়ার মার্কেটে দাম পড়ে যায়। ‘কথা বলবেন না’—এটিও একটি কথা, তা তিনি হয়তো বুঝতে পারেননি। অথচ তাঁর এই সামান্য কথার পরও শেয়ার মার্কেটে দাম পড়ে গিয়েছিল।
অর্থমন্ত্রী শুধু কথা না বলার কথা বললেন। তাতেই শেয়ার মার্কেট নড়বড়ে হবে কেন? এত দিনে সম্ভবত তাঁর ব্যাখ্যা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তাঁর মতে, শেয়ার মার্কেট দুষ্টু, পুরোটাই দুষ্টু! আমরা সাদা-কালো যুগে কবরী, শাবানাকে দেখতাম রাজ্জাককে আদর করে দুষ্টু বলতে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের দুষ্টু সেই দুষ্টু নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যুগে সিইসি এম এ সাঈদকে দেখেছিলাম দুষ্টু লোকেরা পালিয়ে গেছে বলতে। মুহিতের দুষ্টু সেই দুষ্টুও নয়। তাঁর কথা, শেয়ার মার্কেটের সবটুকুই দুষ্টু।
দীলিপ বড়ুয়ারা যখন সাম্যবাদ ত্যাগ করছেন, তখন জনাব মুহিত সাম্যবাদের এক অনন্য নজির স্থাপন করলেন এ কথা বলে। শেয়ার মার্কেটের সবটুকু দুষ্টু! তার মানে, এই মার্কেট থেকে হাজার কোটি টাকা যারা লোপাট করছে, আর যারা প্রায় সর্বস্বান্ত হয়েছে (দুজন আত্মহত্যাকারীসহ) তারা সবাই দুষ্টু। সরকারের রোড শো মাছের ঝাঁকায় টেনে আনার মতো করে সাধারণ মানুষকে এই মার্কেটে ডেকে এনেছে যারা তারাও দুষ্টু। ভুল নীতি করে, ভুল লোককে দায়িত্ব দিয়ে, ভুলভাল কথা বলে সহজ-সরল মানুষকে পথে বসিয়েছে যারা তারাও দুষ্টু। অর্থমন্ত্রী নিজেও কি এসব দুষ্টামির দায় এড়াতে পারেন তাহলে!
অর্থমন্ত্রীর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার এক শতাংশ তত্ত্ব। তিনি বলেছেন, শেয়ার মার্কেট মোট অর্থবাজারের এক শতাংশও নয়, তাই এ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই! তাঁর এই তত্ত্ব বুঝলে সরকারের বহু নির্লিপ্ত আচরণ আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হবে। গুম, ক্রসফায়ার আর সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের যারা শিকার হয়েছে তাদের সংখ্যা এক লক্ষাংশ নয়। নদী সংযোগ প্রকল্প বা টিপাইমুখ হলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেছে, তাদের সংখ্যা এক হাজারংশও নয়। যারা সরকারি চাকরি হারিয়েছে, ওএসডি হয়েছে বা কোনো অঞ্চল বা দলের লোক পিছিয়ে পড়ছে তাদের সংখ্যাও এ রকম। যারা দুর্নীতি করে টাকা পাচার করছে তাদের সংখ্যা বড়জোর কয়েক শত মাত্র। যারা রাস্তায় মার খেয়েছে, প্রাণ হারিয়েছে বা জেলে ঢুকছে, তাদের মোট সংখ্যাও সে রকম। টিভি টকশোতে সরকারের বিরোধিতা করছে, যারা তাদের সংখ্যা তো হাতেগোনা মাত্র!
অর্থমন্ত্রীর সরকার এক শতাংশ মাপের এসব বিষয় নিয়ে চিন্তিত নয়। গণতান্ত্রিক সরকার বলে তারা চিন্তিত শুধু একান্ন শতাংশ মানুষ নিয়ে। পত্রপত্রিকার জরিপে এ রকম বা এর চেয়ে অনেক বেশি মানুষ অধিকাংশ সময়ে সরকারের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে। কিন্তু সেগুলো নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্র, কারসাজি বা রাষ্ট্রদ্রোহিতা! সরকার তাই চিন্তিত নয় এসব নিয়ে। আর এগুলো যে সত্যিই ষড়যন্ত্র তা প্রমাণের জন্য যড়যন্ত্রকারীদের তো বাদই দেওয়া হয়েছে নির্বাচনকালীন সরকার থেকে!
এক শতাংশ তত্ত্ব আমাদের বুঝতে হবে। কিছু প্রয়াত ও জীবিত নেতার স্বপ্ন তাহলেই বাস্তবায়িত হবে!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অর্থমন্ত্রী একবার বললেন, তিনি শেয়ার মার্কেট বোঝেন না। আমরা কি কল্পনা করতে পারি যে সাহারা খাতুন বলছেন, তিনি গুম বোঝেন না? কিংবা আবুল হোসেন বলছেন টেন্ডার বোঝেন না, বা সুরঞ্জিত বলছেন, তিনি কালো বিড়াল বোঝেন না? পারি না। কাজেই আমাদের উচিত ছিল তাঁর সারল্যে মুগ্ধ হওয়া। তিনি তারপর বললেন, তিনি শেয়ার মার্কেট নিয়ে কথা বলবেন না, কারণ তিনি কথা বললে শেয়ার মার্কেটে দাম পড়ে যায়। ‘কথা বলবেন না’—এটিও একটি কথা, তা তিনি হয়তো বুঝতে পারেননি। অথচ তাঁর এই সামান্য কথার পরও শেয়ার মার্কেটে দাম পড়ে গিয়েছিল।
অর্থমন্ত্রী শুধু কথা না বলার কথা বললেন। তাতেই শেয়ার মার্কেট নড়বড়ে হবে কেন? এত দিনে সম্ভবত তাঁর ব্যাখ্যা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তাঁর মতে, শেয়ার মার্কেট দুষ্টু, পুরোটাই দুষ্টু! আমরা সাদা-কালো যুগে কবরী, শাবানাকে দেখতাম রাজ্জাককে আদর করে দুষ্টু বলতে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের দুষ্টু সেই দুষ্টু নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যুগে সিইসি এম এ সাঈদকে দেখেছিলাম দুষ্টু লোকেরা পালিয়ে গেছে বলতে। মুহিতের দুষ্টু সেই দুষ্টুও নয়। তাঁর কথা, শেয়ার মার্কেটের সবটুকুই দুষ্টু।
দীলিপ বড়ুয়ারা যখন সাম্যবাদ ত্যাগ করছেন, তখন জনাব মুহিত সাম্যবাদের এক অনন্য নজির স্থাপন করলেন এ কথা বলে। শেয়ার মার্কেটের সবটুকু দুষ্টু! তার মানে, এই মার্কেট থেকে হাজার কোটি টাকা যারা লোপাট করছে, আর যারা প্রায় সর্বস্বান্ত হয়েছে (দুজন আত্মহত্যাকারীসহ) তারা সবাই দুষ্টু। সরকারের রোড শো মাছের ঝাঁকায় টেনে আনার মতো করে সাধারণ মানুষকে এই মার্কেটে ডেকে এনেছে যারা তারাও দুষ্টু। ভুল নীতি করে, ভুল লোককে দায়িত্ব দিয়ে, ভুলভাল কথা বলে সহজ-সরল মানুষকে পথে বসিয়েছে যারা তারাও দুষ্টু। অর্থমন্ত্রী নিজেও কি এসব দুষ্টামির দায় এড়াতে পারেন তাহলে!
অর্থমন্ত্রীর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার এক শতাংশ তত্ত্ব। তিনি বলেছেন, শেয়ার মার্কেট মোট অর্থবাজারের এক শতাংশও নয়, তাই এ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই! তাঁর এই তত্ত্ব বুঝলে সরকারের বহু নির্লিপ্ত আচরণ আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হবে। গুম, ক্রসফায়ার আর সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের যারা শিকার হয়েছে তাদের সংখ্যা এক লক্ষাংশ নয়। নদী সংযোগ প্রকল্প বা টিপাইমুখ হলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেছে, তাদের সংখ্যা এক হাজারংশও নয়। যারা সরকারি চাকরি হারিয়েছে, ওএসডি হয়েছে বা কোনো অঞ্চল বা দলের লোক পিছিয়ে পড়ছে তাদের সংখ্যাও এ রকম। যারা দুর্নীতি করে টাকা পাচার করছে তাদের সংখ্যা বড়জোর কয়েক শত মাত্র। যারা রাস্তায় মার খেয়েছে, প্রাণ হারিয়েছে বা জেলে ঢুকছে, তাদের মোট সংখ্যাও সে রকম। টিভি টকশোতে সরকারের বিরোধিতা করছে, যারা তাদের সংখ্যা তো হাতেগোনা মাত্র!
অর্থমন্ত্রীর সরকার এক শতাংশ মাপের এসব বিষয় নিয়ে চিন্তিত নয়। গণতান্ত্রিক সরকার বলে তারা চিন্তিত শুধু একান্ন শতাংশ মানুষ নিয়ে। পত্রপত্রিকার জরিপে এ রকম বা এর চেয়ে অনেক বেশি মানুষ অধিকাংশ সময়ে সরকারের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে। কিন্তু সেগুলো নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্র, কারসাজি বা রাষ্ট্রদ্রোহিতা! সরকার তাই চিন্তিত নয় এসব নিয়ে। আর এগুলো যে সত্যিই ষড়যন্ত্র তা প্রমাণের জন্য যড়যন্ত্রকারীদের তো বাদই দেওয়া হয়েছে নির্বাচনকালীন সরকার থেকে!
এক শতাংশ তত্ত্ব আমাদের বুঝতে হবে। কিছু প্রয়াত ও জীবিত নেতার স্বপ্ন তাহলেই বাস্তবায়িত হবে!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments