‘ক্ষ’-র স্পর্ধা ও একটি প্রতিক্রিয়া by রাহুল রাহা
আমি নিজেকে রবীন্দ্রনাথের কট্টর ভক্ত বলে
মনে করি। অন্ধ ভক্ত বললেই ভালো। তার সব লেখা পড়ি নি, সব গান শুনিনি, সব
ছবি দেখেছি কিনা মনে নেই, নৃত্যনাট্যের সবগুলোতে মনোযোগ দিতে পারি নি বটে,
তারপরও
জ্ঞান হওয়া অবধি যতটুকু পড়েছি, শুনেছি আর দেখেছি, তাতে রবীন্দ্রনাথই আমার
কাছে শ্রেষ্ঠ বাঙালি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ বিশ্ব নাগরিক। রবীন্দ্র
প্রতিভার কাছে পাশ্চাত্যের বহু খ্যাতিমান, দ্যুতিমান মনিষীকেও ম্লান মনে
হয়।
বিবিসির
সেরা বাঙালি জরিপে রবীন্দ্রনাথ ‘সেকেন্ড’ হওয়াতে আমি কষ্টই পেয়েছিলাম। মনে
হয়েছিলো রবীন্দ্রনাথকে মাপার মত যোগ্যতাসম্পন্ন লোক জরিপে কম অংশ
নিয়েছিলো। প্রতিভা বসু তার আত্মজীবনী ‘জীবনের জলরং’-এ রবীন্দ্রনাথের
সমালোচনা করাতেও আমি কষ্ট পেয়েছিলাম। তিনি গুরুদেবকে কিছুটা অহঙ্কারী ও
পক্ষপাতদুষ্ট বলেছিলেন। যখন স্কুলে পড়ি তখন বামপন্থীদের একাংশকে দেখতাম
কট্টরভাবে রবীন্দ্রবিরোধিতা করতে। তারা রবীন্দ্রনাথকে সাম্রাজ্যবাদের দোসর,
ইংরেজদের পদলেহী হিসাবে প্রমাণের চেষ্টা চালাতেন। আমি বাম ঘরানার
ছাত্রসংগঠন করলেও রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে সবসময় সকলের বিপরীতে থাকতাম।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাজে কথা? নৈব নৈব চ: কারণ, এখনো আমার যাবতীয় মন খারাপ
ভালো করে দিতে পারেন রবীন্দ্রনাথ তার গান দিয়ে। সিদ্ধান্তহীনতায় সিদ্ধান্ত
দিতে পারেন তার প্রবন্ধ দিয়ে। সামনের চলার পথে আলো ধরতে পারেন তার উপন্যাস,
নাটক আর দর্শন দিয়ে। বিমল আনন্দে জাগিয়ে দিতে পারেন তার কবিতা দিয়ে।
রবীন্দ্রনাথ না জন্মালে আমি বাঙালী হিসাবে অহঙ্কারই করতে পারতাম না।
শ্রীচেতন্য-রবীন্দ্রনাথ-মুজিব-সত্যজিৎ-অমর্ত্য-ইউনূস, বাঙালির এই রৈখিক
বিবর্তনে আমার দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ শ্রেষ্ঠতম বাঙালি। কারণ, ১৮৬১র পর
জন্মানো প্রত্যেক বাঙালির মন ও মনন তৈরি করাতে তার মতো প্রভাবশালী আজো কেউ
নন।
কিন্তু এত যে কথা বলছি, তার কারণ একটাই। আমার বন্ধু মাহমুদ মেননের লেখা দেখে। কোনো এক অখ্যাত ব্যান্ড ‘ক্ষ’ ( খিয়ো) র এক অখ্যাত মেয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটা গেয়েছে গিটার বাজিয়ে, ড্রইং রুমে বসে। মুক্তবাতায়ন-দুনিয়ার ই-জানালা দিয়ে সেই গান ছড়িয়ে পড়েছে অনেকের মাঝেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে গানটি। অনেকেই সেই সব দেয়াল থেকে ডাউনলোড (অবমুক্ত) করে গানটি শুনেছে। আমিও শুনেছি। ভালো লেগেছে। আমার ফেসবুকের দেয়ালে সেটা সেঁটে দিয়েছি।
গানটা যথাযথ সুরারোপে গাওয়া হয়নি মানছি, কিন্তু মূল সুর ঠিক ছিলো। তার চেয়েও বেশি ছিলো গানটির প্রতি শিল্পীর দরদ। এর চেয়েও বেশি ছিলো দেশপ্রেম। গতানুগতিকতার বাইরে হঠাৎ করে গানটি শুনে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। আমার ফেসবুক দেয়ালে গেলে যে কেউ দেখবেন, আমি লিখেছি:গানটি শুনে বাংলা মাকে আবারও নতুন করে ভালোবাসতে ইচ্ছে হলো। এর থেকে বড় সার্থকতা কি কোনো শিল্পীর আছে? সঠিকভাবে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার উদ্দেশ্য কি এর বাইরে অন্য কিছু? যারা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত গলা নকল করে বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মত গলা মোটা করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গান, তারা কি গত চল্লিশ বছরে কেউ পেরেছেন অখ্যাত ঐ মেয়েটার মত করে আমার হৃদয় স্পর্শ করতে? দেবব্রত মুখোপাধ্যায় একবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, গলা দিয়ে গান গেয়ো না, বুক দিয়ে গেয়ো। আমার মনে হয়েছে মেয়েটা বুক দিয়ে গেয়েছে, তাই অনেকের অন্তর ছুঁয়ে গেছে।
গানের দুনিয়ায় আইন খাটে না। শ্রোতার ভালো লাগাই শেষ কথা। গানের যত ব্যাকরণ তৈরি হয়েছে তার মূল উদ্দেশ্য সেই ভালো লাগা নিশ্চিত করা। (যারা উপাসনার জন্যে সঙ্গীত ব্যবহারের পক্ষে আমি এখানে তাদের কথা বলছি না।) সেই ব্যাকরণ ভাঙাও একটা যোগ্যতা। সত্যজিৎ তার ছবিতে বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ান নি, সে আমলের লারেলাপ্পা টাইপের ফিল্মি গান গান গাওয়া কিশোর কুমারকে দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়েছিলেন। এমনকি যারা বহু চর্চা করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গান, তারা কি সব সময় পারেন সব স্বর যথাযথ প্রয়োগ করে গান গাইতে? আমার যতদূর মনে পড়ছে, ভুল হলে ক্ষমা করবেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘আমার মাথা নত করে দাও হে, তোমার চরণধূলার তলে’..গানটিতে স্বরলিপি অনুযায়ী ‘তলে-এ’ শব্দটার স্বর প্রক্ষেপণে ‘এ’র গমক হবে..সা..নি সা..তে। কিন্তু হেমন্ত সা-এর উপরেই এ শব্দটা শেষ করেছেন। শুনতে খারাপ লাগে নি। কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছেন নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা? যারা অখ্যাত (ঐ মেয়ের নাম মনে করার আমি এখনো প্রয়োজন বোধ করছি না।) যারা ঐ শিল্পীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনতে চান, তারা আর যা-ই করুন, রবীন্দ্রচেতনা বহন করেন বলে মনে হচ্ছে না। কপিরাইট আইনের কথা বাদ দিলেও একথা নিশ্চিন্তে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের মত মহীরুহের লতাপাতা, ছাল-বাকল, শেকড় নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলবে। পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক চলবে। তাই বলে, দেশদ্রোহিতার অভিযোগ? একটু বেশি সস্তা হয়ে গেলো না? শুধুমাত্র শিল্পীর বিরুদ্ধে শিল্পীর শাস্তির দাবির মত অসুন্দর বিষয়ের প্রতিবাদ করতেই এই লেখার অবতারণা।
‘ক্ষ’র গান নিয়ে এত আলোচনার আসলেই কোনো দরকার ছিলো না। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত কিভাবে আমরা অন্তরে ধারণ করি তা সকলেই জানি। স্কুলগুলোতে যাচ্ছেতাই ভাবে যে বাচ্চাদের দিয়ে গানটা গাওয়ানো হয়, সে ব্যাপারে কেউ খোঁজ রাখেন? চেষ্টা করেন সেধে দু’একটা স্কুলে গিয়ে বাচ্চাদের আর তাদের দায়সারা গোছের শিক্ষকদের একটু শুধরে দিয়ে আসতে?
জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি দায়বদ্ধতা আমাদের সকলেরই আছে। কিন্তু শাস্তির দাবি তুলে সৃষ্টিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যে বঙ্গবন্ধু এদেশ স্বাধীন করার ডাক দিয়েছিলেন বলে আমি মনে করি না।
কিন্তু এত যে কথা বলছি, তার কারণ একটাই। আমার বন্ধু মাহমুদ মেননের লেখা দেখে। কোনো এক অখ্যাত ব্যান্ড ‘ক্ষ’ ( খিয়ো) র এক অখ্যাত মেয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটা গেয়েছে গিটার বাজিয়ে, ড্রইং রুমে বসে। মুক্তবাতায়ন-দুনিয়ার ই-জানালা দিয়ে সেই গান ছড়িয়ে পড়েছে অনেকের মাঝেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে গানটি। অনেকেই সেই সব দেয়াল থেকে ডাউনলোড (অবমুক্ত) করে গানটি শুনেছে। আমিও শুনেছি। ভালো লেগেছে। আমার ফেসবুকের দেয়ালে সেটা সেঁটে দিয়েছি।
গানটা যথাযথ সুরারোপে গাওয়া হয়নি মানছি, কিন্তু মূল সুর ঠিক ছিলো। তার চেয়েও বেশি ছিলো গানটির প্রতি শিল্পীর দরদ। এর চেয়েও বেশি ছিলো দেশপ্রেম। গতানুগতিকতার বাইরে হঠাৎ করে গানটি শুনে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। আমার ফেসবুক দেয়ালে গেলে যে কেউ দেখবেন, আমি লিখেছি:গানটি শুনে বাংলা মাকে আবারও নতুন করে ভালোবাসতে ইচ্ছে হলো। এর থেকে বড় সার্থকতা কি কোনো শিল্পীর আছে? সঠিকভাবে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার উদ্দেশ্য কি এর বাইরে অন্য কিছু? যারা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত গলা নকল করে বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মত গলা মোটা করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গান, তারা কি গত চল্লিশ বছরে কেউ পেরেছেন অখ্যাত ঐ মেয়েটার মত করে আমার হৃদয় স্পর্শ করতে? দেবব্রত মুখোপাধ্যায় একবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, গলা দিয়ে গান গেয়ো না, বুক দিয়ে গেয়ো। আমার মনে হয়েছে মেয়েটা বুক দিয়ে গেয়েছে, তাই অনেকের অন্তর ছুঁয়ে গেছে।
গানের দুনিয়ায় আইন খাটে না। শ্রোতার ভালো লাগাই শেষ কথা। গানের যত ব্যাকরণ তৈরি হয়েছে তার মূল উদ্দেশ্য সেই ভালো লাগা নিশ্চিত করা। (যারা উপাসনার জন্যে সঙ্গীত ব্যবহারের পক্ষে আমি এখানে তাদের কথা বলছি না।) সেই ব্যাকরণ ভাঙাও একটা যোগ্যতা। সত্যজিৎ তার ছবিতে বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ান নি, সে আমলের লারেলাপ্পা টাইপের ফিল্মি গান গান গাওয়া কিশোর কুমারকে দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়েছিলেন। এমনকি যারা বহু চর্চা করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গান, তারা কি সব সময় পারেন সব স্বর যথাযথ প্রয়োগ করে গান গাইতে? আমার যতদূর মনে পড়ছে, ভুল হলে ক্ষমা করবেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘আমার মাথা নত করে দাও হে, তোমার চরণধূলার তলে’..গানটিতে স্বরলিপি অনুযায়ী ‘তলে-এ’ শব্দটার স্বর প্রক্ষেপণে ‘এ’র গমক হবে..সা..নি সা..তে। কিন্তু হেমন্ত সা-এর উপরেই এ শব্দটা শেষ করেছেন। শুনতে খারাপ লাগে নি। কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছেন নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা? যারা অখ্যাত (ঐ মেয়ের নাম মনে করার আমি এখনো প্রয়োজন বোধ করছি না।) যারা ঐ শিল্পীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনতে চান, তারা আর যা-ই করুন, রবীন্দ্রচেতনা বহন করেন বলে মনে হচ্ছে না। কপিরাইট আইনের কথা বাদ দিলেও একথা নিশ্চিন্তে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের মত মহীরুহের লতাপাতা, ছাল-বাকল, শেকড় নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলবে। পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক চলবে। তাই বলে, দেশদ্রোহিতার অভিযোগ? একটু বেশি সস্তা হয়ে গেলো না? শুধুমাত্র শিল্পীর বিরুদ্ধে শিল্পীর শাস্তির দাবির মত অসুন্দর বিষয়ের প্রতিবাদ করতেই এই লেখার অবতারণা।
‘ক্ষ’র গান নিয়ে এত আলোচনার আসলেই কোনো দরকার ছিলো না। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত কিভাবে আমরা অন্তরে ধারণ করি তা সকলেই জানি। স্কুলগুলোতে যাচ্ছেতাই ভাবে যে বাচ্চাদের দিয়ে গানটা গাওয়ানো হয়, সে ব্যাপারে কেউ খোঁজ রাখেন? চেষ্টা করেন সেধে দু’একটা স্কুলে গিয়ে বাচ্চাদের আর তাদের দায়সারা গোছের শিক্ষকদের একটু শুধরে দিয়ে আসতে?
জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি দায়বদ্ধতা আমাদের সকলেরই আছে। কিন্তু শাস্তির দাবি তুলে সৃষ্টিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যে বঙ্গবন্ধু এদেশ স্বাধীন করার ডাক দিয়েছিলেন বলে আমি মনে করি না।
No comments