শনিবারের সুসংবাদ-লাক্ষায় সৌভাগ্যের হাতছানি by শহীদুল হুদা অলক

লাক্ষার গৌরবময় ভূমি ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর, দাদনচক ও কানসাট এলাকা। নানা প্রতিবন্ধকতায় একসময় এই শিল্প ঝিমিয়ে পড়েছিল। আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সেই লাক্ষাচাষে ভাগ্য গড়ার দিন ফিরে এসেছে। বাড়ছে এর আবাদ।


সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনুকূল আবহাওয়ার সুবাদে ভালো ফলনের পাশাপাশি উচ্চ দাম পাওয়ায় চাষিরাও স্বপ্ন দেখছেন লাক্ষাচাষে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের।
চাষিসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, দেশ ভাগের আগে থেকেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিনোদপুরসহ সংলগ্ন এলাকায় ব্যাপকভিত্তিক লাক্ষার চাষ হতো। সে সময়ে দেশে লাক্ষার চাহিদার পুরোটাই জোগান হতো এখান থেকে। লাক্ষাচাষের ব্যাপকতার কারণে বিনোদপুরকে বলা হতো 'সোনার বিনোদপুর'। আজ তা ছড়িয়ে পড়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্র অঞ্চলসহ রাজশাহী, নীলফামারী, পীরগঞ্জ ও গাজীপুর পর্যন্ত। দ্রুতই রমরমা রূপ পাচ্ছে লাক্ষাপল্লীগুলো।
আবহাওয়া ও প্রকৃতিগত কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ লাক্ষাচাষের উপযোগী হওয়ায় সরকারও লাক্ষাচাষের উৎকৃষ্ট স্থান হিসেবে এ জেলাকেই বেছে নেয়। ১৯৬১ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের তৎকালীন খামার ইউনিয়নের অক্ট্রয় মোড়সংলগ্ন স্থানে ১২ দশমিক ৪৮ হেক্টর জমিতে স্থাপন করা হয় 'লাক্ষা বীজ উৎপাদন কেন্দ্র'। এ কেন্দ্রে ছিল বিভিন্ন জাতের শত শত কুলগাছ। এখানে উৎপাদিত উৎকৃষ্ট লাক্ষাবীজ সরবরাহ হতো দেশের অন্যান্য স্থানে। কিন্তু বাজারজাতকরণের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকা, উৎপাদিত লাক্ষার ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, ভারত থেকে লাক্ষার চোরাচালানসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমগাছে অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারে লাক্ষাচাষে ব্যাপক ধস নামে। নব্বইয়ের দশকে লাক্ষা আমদানি বেড়ে যাওয়ায় দেশের লাক্ষার বাজারটি চলে যায় ভারতের দখলে। ভারতের লাক্ষা গুণগত মানের দিক থেকে ভালো না হলেও কম দামের কারণে সহজেই তা বাংলাদেশের বাজার দখল করে নেয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্র জানিয়েছে, ১০ বছর আগে দেশে এক হাজার ২০০ টন লাক্ষার চাহিদা ছিল। আর উৎপাদন করা হতো মাত্র ৩০০ টন। সেখানে গত বছর চাহিদা বেড়ে সাত হাজার টনে দাঁড়ায়। আর উৎপাদন করা হয় এক হাজার টন, যার ৯৫ ভাগের জোগানই আসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে। এই ১০ বছরে উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণের বেশি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর, শিবগঞ্জ ও গোমস্তাপুর উপজেলার সাধারণ চাষিদের বাইরে বিশেষ উদ্যোগে বরেন্দ্র অঞ্চলের নাচোল উপজেলার মাক্তাপুর ও কাজলা গ্রাম, রাজশাহীর নবগঙ্গা, নীলফামারীর পীরগঞ্জ ও গাজীপুরে লাক্ষাপল্লী গড়ে উঠেছে। যথাযথভাবে চাষ ও বাজার ধরে রাখতে পারলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশেই লাক্ষা উৎপাদন চাহিদার কাছাকাছি পৌঁছে যাবে।
লাক্ষা কী
মূলত লাক্ষা হচ্ছে এক ধরনের ক্ষুদ্র পোকা। এর বৈজ্ঞানিক নাম ক্যারিয়া লাক্ষা। এটি পোষক গাছের রস চুষে খেয়ে বড় হয়। আর শোষণ করা গাছের এই রস পোকাটির দেহ-ত্বকের নিচে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা এক ধরনের গ্রন্থি বেয়ে দেহের বাইরে বের হয়ে আসে। এই আঠালো রস ক্রমান্বয়ে শক্ত ও পুরু হয়ে পোষক গাছের ডালকে ঘিরে ফেলে। পোষক গাছের ডালের ওপর তৈরি হয় এক ধরনের আবরণ। এই আবরণই লাক্ষা নামে পরিচিত। চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্থানীয় মানুষ যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে 'লাহা'।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান জানান, অনেক জাতের গাছে লাক্ষা উৎপাদিত হলেও প্রধানত কুল, কড়ই, পাকুড়, পলাশ, খয়ের, বাবলা, ডুমুর, অড়হর প্রভৃতি গাছ লাক্ষার পোষক গাছ। বছরে লাক্ষার দুটি চাষ হয়। কার্তিকের চাষ ঘরে উঠতে সময় লাগে চার মাস আর বৈশাখের চাষ ঘরে উঠতে সময় লাগে ছয় মাস। তিনি জানান, একটি পূর্ণাঙ্গ গাছে মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বিনিয়োগে আয় করা সম্ভব কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা। অর্থনৈতিক গুরুত্বের কারণে লাক্ষাচাষ দিন দিন বাড়ছে।
কী কাজে লাগে
লাক্ষা থেকে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে যে দ্রব্যটি তৈরি হয়, তাকে বলে চাঁচ। এটা কোথাও কোথাও 'গালা' নামেও পরিচিত। এগুলো ব্যবহৃত হয় কাঠের আসবাবপত্র, পিতল বার্নিশসহ বিভিন্ন বার্নিশ পেইন্টের কাজ, অস্ত্র ও রেলওয়ে কারখানা, বৈদ্যুতিক শিল্প-কারখানায় বিদ্যুৎ অপরিবাহী কাজে, চামড়া রং করা, পুতুল, নেইল পলিশ, খেলনা, প্রসাধন সামগ্রী তৈরি, সিলমোহর, ওষুধ তৈরি এবং পোকার যৌন আকৃষ্টকরণ পদার্থ তৈরির কাজে। ব্যবহারের ক্ষেত্র বিস্তারের কারণে লাক্ষার চাহিদাও দেশে ব্যাপক হারে বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে দামও। ফলে শুধু দরিদ্র কৃষক নয়, শিক্ষিত বেকার যুবকরাও এগিয়ে আসতে শুরু করেছেন লাক্ষাচাষে। গেল বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে কাঁচা লাক্ষা বিক্রি হয়েছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে।
চাষিরা যা বলেন
সরকারের নতুন উদ্যোগ আর ভালো দামের কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের চারটি জেলায় মাতৃবাগান ও লাক্ষাপল্লী গড়ে উঠেছে। রাজশাহীর মতিহার কাজলায় রাজশাহী কলেজের ছাত্র প্রত্যয় জামানসহ তাঁর সহপাঠীরা ১০০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে লাক্ষার মাতৃবাগান তৈরি করেছেন। তাঁদের বাগানে চার হাজার কুল, চার হাজার খয়ের ও অন্যান্য লাক্ষাচাষের উপযোগী গাছ মিলিয়ে ১০ হাজার গাছ রয়েছে। মাত্র দেড় বছর আগে শুরু করা মাতৃবাগানে সাথি ফসল আবাদ করে ইতিমধ্যে তাঁরা আর্থিকভাবে লাভবান হতে শুরু করেছেন। আর এ কাজে তাঁদের কারিগরি সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্র। আগামী কয়েক বছরের মাথায় তাঁরা ৪০ থেকে ৪৫ টন লাক্ষা উৎপাদন করতে পারবেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিনোদপুরের লাক্ষাচাষি আবুল কাশেম জানান, 'মনাকষা বিনোদপুরে ছিল লাহার (লাক্ষার) জমজমাট ব্যবসা। এখন দিন পাল্টাচ্ছে। আবারও শুরু হয়েছে লাক্ষার চাষ।' লাভের কথা বলতে গিয়ে কাশেম জানান, লাক্ষার চাষ করে চারটি উপকার পাওয়া যায়। গাছের নিচে আদা, হলুদ, গম আবাদ করা যায়। কুল পাওয়া যায়। এমনকি লাক্ষা ছাড়ানোর পর ডালের অংশটা জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। তিনি জানান, চাষিরা রাজশাহীর ভদ্রা, বেলেপুকুর প্রভৃতি এলাকায় লাক্ষা বিক্রি করেন। অনেক সময় ক্রেতারাই চাষিদের কাছে এসে লাক্ষা কিনে নিয়ে যান।
কাশেমের অভিব্যক্তি, 'হামরা এখন ভালোই লাভ পাছি। ইমপোর্ট (আমদানি) বন্ধ কোর‌্যা দিলে আরো লাভ পাব।' কথা হয় নাচোলের হতদরিদ্র গৃহবধূ কুলসুমের সঙ্গে। লাক্ষা থেকে অপ্রত্যাশিত দুই হাজার ৮০০ টাকাপ্রাপ্তি তাঁকে লাক্ষাচাষি বানিয়েছে। তিনি বলেন, 'হাঁর বাড়ির একটা খড়ের ঘরের পাশের বোরের (কুল) গাছ থাইক্যা লাহা (লাক্ষা) বীজ বেচ্যা ২৮০০ টাকা পাইয়্যাছি। অথচ গাছটি বাড়ির কোনাতে এমনিই দাঁড়িয়্যা ছিল। বোইর ছাড়া কোন কিছুই পাইতুন না।'
লাক্ষা ব্যবসায়ী মাক্তাপুরের বেলাল উদ্দীন গত বছর দুই লাখ টাকা লাভ করেছেন। উল্লেখযোগ্য লাভ দেখে তাঁর মতো অনেকেই এখন লাক্ষাচাষ ও ব্যবসায় জড়াচ্ছেন।
চাষিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, লাক্ষা আমদানি নিরুৎসাহ করে বিশাল বরেন্দ্র অঞ্চলের উঁচু-নিচু জমির বিভিন্ন স্থানে থাকা পোষক গাছগুলোকে লাক্ষাচাষের আওতায় আনলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব। এতে একদিকে দেশের চাহিদা মিটবে; অন্যদিকে অর্থনৈতিক সচ্ছলতার মুখ দেখবেন সংশ্লিষ্ট কৃষকরা।

No comments

Powered by Blogger.