জাতীয় কমিটি-দেশপ্রেমের হরতাল by আসিফ নজরুল

গত ৩০ জুন হেঁটে যাচ্ছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে। দূর থেকে স্লোগানের শব্দ শুনে ফিরে তাকাই। দিগন্তে আলোর নাচন, দৃপ্ত মশাল উঁচিয়ে এগিয়ে আসছে মিছিল। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মিছিলের জন্য অপেক্ষা করি, পাশে এলে তার সঙ্গে এগোই কিছুটা পথ। এই মিছিলের তরুণ-তরুণীদের চিনি আমি।


এরা ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টসহ বিভিন্ন বাম সংগঠনের ছেলেমেয়ে। এরাই তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির কর্মী। এদের মিছিল ক্ষমতায় যাওয়ার মিছিল নয়, উচ্ছিষ্ট ভোগের লোভ নয়, নেতা-নেত্রীর বন্দনার জন্য নয়। এই মিছিল দেশকে ভালোবাসার। এই মিছিল দেশের সম্পদ রক্ষার। একটি দেশপ্রেমিক হরতালকে সফল করার আহ্বানের।
বহুদিন পর এমন একটি হরতাল দেখলাম আমরা। এই হরতাল কি সফল হবে? সরকারের ভয়, প্রলোভন আর দাসত্ব যাদের গ্রাস করেছে, তারা হয়তো বলবে, একদম সফল হয়নি। তাতে আমাদের কিছু আসে-যায় না। এই হরতাল ডাকার মানুষ আজও আছে দেশে, এটাই স্বস্তিকর। এই হরতালে সমর্থন নেই বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টির। এই হরতাল দমনে মারমুখী হয়ে নেমেছে সরকারের পুলিশ আর গোয়েন্দা। দেশের সম্পদ রক্ষায় সোচ্চার তরুণ-তরুণীকে নির্দয় লাঠিপেটা করেছে, বন্দী করে নিয়ে গেছে পুলিশের খাঁচায়। এই হরতালে ভয় পায় সব সরকার। কারণ, কোনো না কোনোভাবে এরা সবাই বিশ্ব পুঁজিবাদের দাস। ক্ষমতার লড়াইয়ে আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদ ও লুটেরা শক্তির অনুগ্রহপ্রত্যাশী। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ বিদেশিদের হাতে অসম চুক্তিতে তুলে দেওয়ার উৎকোচ এরা গ্রহণ করে নানাভাবে।
হরতাল ডাকা হয়েছে যেসব দাবিতে এবং যেসব প্রশ্ন তুলে, তার উত্তর নেই এদের কাছে। যুক্তিপূর্ণ উত্তর যেখানে নেই সেখানে থাকে মিথ্যাচার, নিন্দা আর চরিত্র হননের অপচেষ্টা। হরতাল ডেকেছে জাতীয় কমিটি। বলা হচ্ছে শুধু কমিটির সদস্য-সচিব আনু মুহাম্মদের নাম। এক নেতা প্রশ্ন তুলেছেন, হরতাল ডাকার জন্য আনু মুহাম্মদ কে? আরেক অর্ধেক মন্ত্রী সংসদে তাঁকে মনু মুহাম্মদ ডেকে স্থূল ভাঁড়ামো করেছেন।
দেশ আর ইতিহাসবিস্মৃত মানুষের পক্ষে এমন আচরণ অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আমরা আনু মুহাম্মদকে দেখেছি, তরুণ বয়সেই তেল-গ্যাস-অস্ত্রকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নিয়ে গবেষণাধর্মী লেখা লিখতে। অন্য অনেকের মতো আমল বুঝে নয়, সব সরকারের আমলেই তিনি এই ষড়যন্ত্রবিরোধী লড়াইয়ে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। শুধু তিনি নন, জাতীয় কমিটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এর অধিকাংশ নেতার অঙ্গীকার, দেশপ্রেম আর অবিচল পক্ষপাতশূন্যতা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশের সংকটকালে জাতীয় কমিটির লোকদের কখনো দেখা যায়নি। আমার মনে হয় না, তিনি এই কমিটি সম্পর্কে খুব বেশি জেনে এটি বলেছেন। এই কমিটির আহ্বায়কসহ অনেক নেতা সেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে সব প্রগতিশীল ও জনস্বার্থমূলক আন্দোলনে শরিক থেকেছেন। নিকট অতীত থেকেই উদাহরণ দিই। বিগত বিএনপি সরকারের আমলে বিবিয়ানা কূপ থেকে ভারতে গ্যাস রপ্তানি, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন এবং চট্টগ্রাম বন্দর মার্কিন কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা প্রতিরোধ করেছিল মূলত এই কমিটিই। ২০০৫ সালে এশিয়া এনার্জির কাছে কয়লা সম্পদ তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে কমিটির ডাকা হরতালে সমর্থন জানিয়েছিলেন স্বয়ং শেখ হাসিনা।
আমরা স্বীকার করি, কোনো বিষয়ে সরকারের নিজস্ব অভিমত ও বিচার-বিবেচনা থাকতে পারে। কিন্তু তাতে তো তাঁদের কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। বহু কাটাছেঁড়া এবং তুঘলকি কর্মকাণ্ডের পরও দেশের সংবিধানে এখনো দেশের এবং এর সব সম্পদের মালিক জনগণ। সরকারের কাছে আমাদের বিনীত প্রশ্ন, জনগণের সম্পদ নিয়ে কী শর্তে কেন বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হলো, তা জনগণকে কেন জানতে দেওয়া হবে না? কেন এই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রকাশ করা হবে না?
আমরা শুধু জানি, কনোকোফিলিপসের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে পিএসসি-২০০৮-এর অধীনে। জাতীয় কমিটি এর কয়েকটি অনুচ্ছেদকে জাতীয় স্বার্থবিরোধী বলছে এবং কিছু প্রশ্ন তুলেছে। যেমন—কেন কনোকোফিলিপসের প্রাথমিক বিনিয়োগের চেয়ে তিন গুণ বেশি অর্থ ব্যয়ে ১৭৫ মাইল পাইপলাইন স্থাপন করলেই কেবল বাংলাদেশ প্রাপ্ত গ্যাসের মাত্র ২০ শতাংশের অধিকারী হবে? ‘দুর্ঘটনার রাজা’ হিসেবে পরিচিত কনোকোফিলিপসের কর্মকাণ্ডের ঝুঁকি থেকে বঙ্গোপসাগর, তার সম্পদ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার কী নিশ্চয়তা চুক্তিতে রয়েছে? এই চুক্তির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের সীমানা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের দাবি কি একপক্ষীয়ভাবে মেনে নেওয়া হলো? জাতীয় কমিটির সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, পুঁজি সংগ্রহ করে এবং প্রয়োজনীয় সাব-কনট্রাকটিং করে তেল-গ্যাস উত্তোলনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আমরা নিজেরাই কেন গ্রহণ করি না?
জাতীয় কমিটির নিজস্ব বক্তব্য আছে এসব প্রশ্নের। তাদের সব বক্তব্য-বিশ্লেষণ অকাট্য না-ও হতে পারে। তাদের বক্তব্যে এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাস্তবতার কমতিও থাকতে পারে। কিন্তু তাদের নির্দিষ্ট বক্তব্যের কোনো উত্তর নেই কেন সরকারের? কেন তারা প্রকাশ করছে না কনোকোফিলিপসের সঙ্গে চুক্তি বা ভারত-আমেরিকাসহ অন্য রাষ্ট্র বা বিদেশি কোম্পানিদের সঙ্গে সম্পাদিত সব চুক্তি? কেন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুসারে সংসদে পেশ করা হয় না এসব চুক্তি?
আওয়ামী লীগ-বিএনপি কেউ এসব প্রশ্নের উত্তর দেবে না। তাদের অশুভ অলিখিত আঁতাত এখানেই। এই আঁতাতে আমরা অন্যান্য দলের বর্ণচোরাদেরও মাঝেমধ্যে কৌশলে অংশ নিতে দেখি। এত অন্ধকারে তাই দেশপ্রেমী বামদের মশাল মিছিল অক্ষয় আলো হয়ে থাকে। তাদের হরতালই প্রকৃত দেশপ্রেম।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.