পরিবেশ-জ্বালানি-সাশ্রয়ী ইটভাটা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে by মুশফিকুর রহমান
সংবাদমাধ্যমে এখন ইটভাটা নিয়ে নিয়মিতই বিভিন্ন খবর প্রকাশিত হচ্ছে। ইটভাটা নিয়ে অধিকাংশ খবরের সঙ্গে মানুষের পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগের সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিবছর এ সময় শুকিয়ে যাওয়া জলাভূমি, নদীর পাড়, ফসলের মাঠসহ বিভিন্ন জায়গায় মৌসুমি ইটভাটায় রাত-দিন ইট তৈরি হয়।
ইট পোড়ানোর ফলে কৃষিজমির উপরিভাগের নরম মাটি পুড়ছে। মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাসের সঙ্গে ফ্লোরিন গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এই ফ্লোরিন গ্যাস বিষাক্ত এবং তা ফসল, ফল ও ফুলের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর। এ ছাড়া ইটভাটার ধোঁয়ার সঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ও নাইট্রোজেনের অক্সাইডসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস ও প্রচুর ভাসমান বস্তুকণা (ধূলিকণা) বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা মহানগরে শুষ্ক মৌসুমে ধূলিময় অসহনীয় বায়ুদূষণের যে পরিবেশ তৈরি হয় তার অন্যতম ইন্ধন এসব ইটভাটার দূষণ।
দেশে বিভিন্ন ধরনের ইটভাটায় বিভিন্ন মাত্রার জ্বালানি পোড়ানো হচ্ছে এবং বিভিন্ন ইটভাটার দূষণের মাত্রাও বিভিন্ন। তা ছাড়া ইট তৈরির প্রয়োজনীয় উপাদান মাটি, কয়লা, শ্রমশক্তি, পুঁজি সবকিছুর মূল্য বাড়ছে। ফলে ইটের দাম ও নির্মাণ ব্যয় উভয়ই বাড়ছে। সংগতভাবেই ইট উৎপাদনের উন্নততর প্রযুক্তির চাহিদা বাড়ছে। কম জ্বালানি ব্যবহার করে মানসম্পন্ন ইট তৈরির লক্ষ্যে ইতিমধ্যে ঢাকা ও বড় শহরগুলোর আশপাশে গড়ে ওঠা ইটভাটায় ব্যবহূত প্রযুক্তির পরিবর্তন ধীরে হলেও ঘটতে শুরু করেছে। এ জন্য দেশের পরিবেশ আইনের কড়াকড়ি, মানুষের সচেতনতা এবং আইন প্রয়োগের চেষ্টার কিছু ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে।
দেশে এখন ইটভাটা প্রায় আট হাজার। এর মধ্যে প্রাচীন পদ্ধতিতে ইট তৈরি ও পোড়ানোর প্রযুক্তি বহাল থাকলেও অধিকাংশ ইটভাটা স্থায়ী ও প্রায় ১২০ ফুট উঁচু চিমনির ভাটা। এ জাতীয় এক ইউনিটের একটি ইটভাটা তৈরিতে প্রায় এক লাখ আট হাজার বর্গফুট জায়গা দরকার। তা ছাড়া ইট তৈরির জন্য মাটি; জ্বালানি রাখতে, কাঁচা ইট তৈরি ও রোদে শুকানো, তৈরি ইট স্তূপ করে রাখা ও পরিবহনের সুবিধা মিলিয়ে একটি ইটভাটার জন্য প্রায় পাঁচ-ছয় একর জায়গা প্রয়োজন হয়। উঁচু জায়গার স্বল্পতায় অধিকাংশ ইটভাটা গড়ে ওঠে নিচু জমিতে।
গ্রীষ্মের শেষ বা বর্ষার শুরু পর্যন্ত চলে মৌসুমি ভাটায় ইট তৈরি ও সেগুলো পোড়ানোর আয়োজন। ঢাকার চারপাশের ইটভাটাগুলোকে দূরবর্তী স্থান থেকে ইট তৈরির উপযোগী মাটি, গাবতলীর তুরাগ নদী তীরের সরবরাহ উৎস থেকে কয়লা সংগ্রহ করতে হয়। সহজলভ্য হলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠ এবং কয়লার মিশ্র জ্বালানি ব্যবহার হয়। তা ছাড়া স্টিলের ড্রাম কেটে তৈরি স্থান পরিবর্তনকারী চিমনির পুরোনো ইটভাটা এবং স্থায়ীভাবে স্থাপিত চিমনির ইটভাটায় কয়লায় আগুন জ্বালানোর জন্য শুরুতে জ্বালানি কাঠ ব্যবহার হয়। এক একটি ইটভাটায় প্রায় ২৫০ জন শ্রমিক দিন-রাত কাজ করে এক মৌসুমে তৈরি করে ৩০-৩২ লাখ ইট। পোড়ানোর মানভেদে ইটভাটায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর ইট তৈরি হয়। তবে প্রস্তুতকারীর চেষ্টা থাকে সিংহভাগ ইট যেন প্রথম শ্রেণীর হয়। বর্তমানে প্রচলিত ভাটায় উৎপাদিত প্রথম শ্রেণীর প্রতিটি ইটের মূল্য প্রায় সাড়ে পাঁচ টাকা। ঢাকার নিকটবর্তী ইটভাটার মালিকদের দাবি, তাঁদের প্রতিটি ইট তৈরিতে প্রায় পাঁচ টাকা ব্যয় হয়।
প্রচলিত স্থায়ী চিমনির ইটভাটায় প্রতি এক লাখ ইট তৈরি করতে প্রায় ১০ হাজার ঘনফুট মাটি এবং ২২-২৪ টন কয়লার প্রয়োজন হয়। ইটভাটা ও ইট তৈরির প্রযুক্তি জ্বালানি সাশ্রয়ী ও কম দূষণকারী কীভাবে করা যায় তা নিয়ে স্থায়ী চিমনির ইটভাটার চেয়ে জিগজাগ পদ্ধতির ইটভাটায় জ্বালানি কয়লা কিছু কম প্রয়োজন হয়। ফলে দূষণ কিছু কমে। তবে স্থায়ী চিমনির ও জিগজাগ প্রযুক্তির ইটভাটায় যেহেতু তাপ নিরোধক ব্যবস্থা অনুপস্থিত, সে কারণে জ্বালানি পুড়িয়ে সৃষ্ট তাপের অনেক অপচয় হয়। তা ছাড়া হাতে তৈরি হয় বলে ইটের আকৃতি ও মানও সব সময় সুষম হয় না। তবে দেশের অধিকাংশ ইটভাটায় যে শ্রমিক ও প্রযুক্তি ব্যবহার হয় তা দ্রুত প্রতিস্থাপন সহজ নয়। একটি স্থায়ী চিমনির ইটভাটা নির্মাণে প্রায় ৩০ লাখ টাকা এবং জিগজাগ ভাটা নির্মাণে এর দ্বিগুণ ব্যয় হয় (জমির মূল্য বা ভাড়া ব্যতিরেকে)। অবশ্য নতুন প্রযুক্তির ইটভাটা নির্মাণের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত লোকবল সংকট রয়েছে। তা ছাড়া বাড়তি পুঁজির জোগানও গুরুত্বপূর্ণ।
ঢাকার আশপাশে ইতিপূর্বে গ্যাস দিয়ে পোড়ানোর উপযোগী এবং সারা বছর উৎপাদনক্ষম স্বয়ংক্রিয় হফমান কিলন প্রযুক্তির প্রায় ২৩টি আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটা তৈরি হয়েছে। সুষম আকৃতি ও শ্রেয়তর মানের ইট তৈরির এসব কারখানায় এখনো উৎপাদন অব্যাহত আছে। কিন্তু পুঁজিঘন ও গ্যাসনির্ভর এসব ইটভাটার ব্যাপক বিস্তৃতি সংগত কারণেই ঘটেনি। একইভাবে, দেশের ইট উৎপাদনের চাহিদা পূরণে এসব কারখানা যথেষ্ট নয়।
গত কয়েক বছরে গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটির (জিইএফ) তহবিল সহায়তায় ইউএনডিপি বাংলাদেশে কয়লা ব্যবহার করে জ্বালানি সাশ্রয়ী ও সীমিত দূষণের হাইব্রিড হফমান কিলন প্রযুক্তিনির্ভর সাতটি পরিবেশবান্ধব ইটভাটা প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে। আরও বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়ায় আছে। চীনের জিয়ান ইনস্টিটিউট অব ওয়াল অ্যান্ড রুফ ম্যাটেরিয়ালসের কারিগরি সহায়তা এই প্রযুক্তির বাণিজ্যিক বাস্তবায়নে সহায়ক হয়েছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাদামাটির সঙ্গে কয়লার গুঁড়ো মিশিয়ে, আধাস্বয়ংক্রিয় মেশিনে সুষম আকৃতির মজবুত ও নির্মাণকাজে ব্যবহারের জন্য উৎকৃষ্ট ইট তৈরি করা হয়। হাইব্রিড হফমান কিলনে কয়লা দহনের তাপকে কাজে লাগিয়ে বিশেষভাবে নির্মিত দক্ষ চুল্লিতে ইট পোড়ানো হয়। আবার ইট পোড়ানোর তপ্ত ধোঁয়াকে কাজে লাগিয়ে নির্দিষ্ট ড্রায়ারে কাঁচা ইট শুকানো হয়। এভাবে জ্বালানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করায় এক লাখ ইট তৈরিতে মাত্র ১৩-১৪ টন কয়লা প্রয়োজন হয় এবং প্রায় ধোঁয়া ও ধুলোবালিমুক্ত পরিবেশে প্রতিদিন ৪৫-৫০ হাজার ইট একটি কারখানা থেকে তৈরি করা সম্ভব হয়। ফলে প্রতিটি ইট তৈরিতে খরচ কমে দাঁড়ায় (ঢাকার কাছাকাছি স্থাপিত একটি হাইব্রিড হফমান কিলনের হিসাব অনুযায়ী) চার থেকে সাড়ে চার টাকায়। তা ছাড়া সারা বছর বিরতিহীনভাবে এ জাতীয় ইটভাটায় ইট তৈরি সম্ভব হয় বলে একটি ইটভাটার উৎপাদন দিয়ে প্রচলিত প্রযুক্তির পাঁচ-সাতটি ইটভাটা প্রতিস্থাপন সম্ভব। অবশ্য হাইব্রিড হফমান কিলন প্রযুক্তির একটি ইটভাটা স্থাপনে জমির মূল্যসহ আট থেকে ১১ কোটি টাকা এককালীন বিনিয়োগ প্রয়োজন।
বিশ্বের দূষণ বাজারে কার্বন ক্রেডিট বেচাকেনা আগেই চালু হয়েছে। একটি হাইব্রিড হফমান কিলন প্রযুক্তির ইটভাটায় প্রতি এক লাখ ইট পোড়াতে নয় টন কয়লা সাশ্রয় করে যে পরিমাণ কার্বন ক্রেডিট পাওয়া যায়, তা বৈশ্বিক কার্বন বাজারে ক্রেডিট হিসেবে বিক্রি করা যায়। এ থেকে বছরে প্রায় দেড় কোটি ইট উৎপাদনের কারখানা ব্যবসার লাভ ছাড়াও প্রায় সাত লাখ টাকা কার্বন সাশ্রয়ের অতিরিক্ত লাভ গুনতে পারে। ইতিমধ্যেই নতুন প্রযুক্তির ইটভাটার মালিকেরা কার্বন বাজারে সংযুক্ত হয়েছেন। অন্যরাও এগিয়ে আসছেন।
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী; জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
No comments