দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৫০ লাখঃ প্রতিকার নয়, প্রতিরোধ দরকার
মাদকাসক্তি আমাদের সমাজে যেভাবে দিন দিন বেড়ে চলেছে, তাতে জাতির সক্ষমতার জোর ক্রমেই কমে যাচ্ছে। আমাদের অজান্তে ঘটে চলা এই নেতিবাচক পরিবর্তন রোধ করা না গেলে সামনে ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৫০ লাখের মতো।
আবার ইউনাইটেড ড্রাগ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের (ইউডিসিপি) হিসাবমতে ওই সংখ্যা ৬৫ লাখ। এসব মাদকাসক্তের শতকরা ৯১ ভাগ হচ্ছে কিশোর-যুবক। এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আবার নারী। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে, এই বিপুলসংখ্যক মাদকাসক্তের চিকিত্সাসেবার জন্য দেশে দীর্ঘমেয়াদি কোনো ব্যবস্থা নেই। এখন আমাদের দেশে বেশকিছু মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র আছে কিন্তু এসব কেন্দ্রে দু’তিন মাস চিকিত্সাসেবা দিয়ে, রোগী হিসেবে ভর্তি হওয়া মাদকাসক্তকে ‘সুস্থ’ ঘোষণা করে ছেড়ে দেয়া হয়। এসবই বেসরকারি উদ্যোগ। সরকারি পর্যায়ে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র আছে। ৪০ শয্যার এই কেন্দ্রে মাত্র দু’সপ্তাহের জন্য চিকিত্সাসেবা প্রদান করা হয়। এসব কেন্দ্র থেকে যারা ‘সুস্থ’ হয়ে ফিরে আসে, তারা কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। এভাবে সাত-আটবার নিরাময় কেন্দ্রে চিকিত্সা নেয়ার পরও মাদকাসক্তি ছাড়তে পারেনি—এমন আসক্তের সংখ্যা ভুরি ভুরি।
আসলে দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে মানুষের মধ্যে মাদকাসক্তি জন্ম নেয়। কয়েক বছর ধরে মাদক গ্রহণের ফলে অবস্থা চরম আকার ধারণ করলে তারপরই আত্মীয়স্বজন সামাজিক লজ্জাজনিত সঙ্কোচ ত্যাগ করে মাদকাসক্তকে নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যায়। কিন্তু এতদিনের তীব্র আসক্তি দুু’তিন সপ্তাহ বা দু’তিন মাসের পরিচর্যায় পুরোপুরি চলে যাবে, তেমন ধারণা বাস্তবসম্মত নয়। আসলে নানা কারণে এই আসক্তি আবার ফিরে আসে বলেই মাদকাসক্তরা নিরাময় কেন্দ্র থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে এসে কিছুদিন ভালো থাকার পর আবার মাদকের কাছে আত্মসমর্পণ করে। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে তাই মাদকাসক্তির চিকিত্সার জন্য এক বছরমেয়াদি ব্যবস্থা রয়েছে। এক বছরে রোগীর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠা নিয়ে সন্দেহ থাকলে চিকিত্সাসেবা প্রলম্বিত করা হয়। অবশ্য তাতেও পুরোপুরি সাফল্য আসে না বলে ইদানীং চিকিত্সাবিজ্ঞানীরা মনে করছেন।
তাই এখন নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে মাদকাসক্তদের চিকিত্সা করার চেয়েও মাদকাসক্তি যাতে কোনো মানুষকে পেয়ে না বসে, সে চেষ্টার ওপর বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। কারণ, আসক্ত কাউকে মাদকের নেশা থেকে পুরোপুরি মুক্ত করা অসাধ্য না হলেও দুঃসাধ্য। অবশ্য আমাদের মনে রাখতে হবে যে, দেশে এখন প্রতি ত্রিশজনে একজন মাদকাসক্ত। যত কষ্টসাধ্যই হোক, এদের সুস্থ করে তোলার চেষ্টা আমরা ত্যাগ করতে পারি না। মাদকাসক্তদের সুস্থ করে তোলার জন্য স্বল্পমেয়াদি চিকিত্সার লোক দেখানো নিরাময় কেন্দ্র বাদ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি বিশেষ করে উঠতি প্রজন্মকে মাদকের নেশা থেকে দূরে রাখার জন্য শুরু করতে হবে ব্যাপক মটিভেশন। অবশ্য শুধু তাত্ত্বিক মটিভেশনে কাজ হবে না। যেসব কারণ মাদকাসক্তির শর্ত তৈরি করে, সমাজ থেকে সে কারণগুলো দূর করতে হবে। কাজটি সহজ নয়। এর জন্য সমাজের মৌলিক রূপান্তর দরকার। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের সমাজের বর্তমান অবস্থা তারুণ্যকে মাদকাসক্ত করার অত্যন্ত অনুকূল। এ পরিস্থিতি পাল্টানো না গেলে মাদকাসক্তি নির্মূল করা সম্ভব তো নয়ই; বরং এর ব্যাপকতা ও বহুমুখিতা দিন দিন বাড়বে। তখন সুস্থরাই চিহ্নিত হবে অসুস্থ হিসেবে।
No comments