থানায় ডেকে দুজনকে পেটালেন ঢাবি শিক্ষক-যৌতুকের জন্য স্ত্রীকেও নির্যাতন by ওমর ফারুক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মো. নূর উদ্দিন নিজের ছাত্রদের নিয়ে থানার ভেতরে দুই ব্যক্তিকে বেধড়ক মারধর করেছেন। তাঁদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে দু-তিনজন পুলিশ সদস্যও সামান্য আহত হন। মার খাওয়া দুই ব্যক্তি সাইদুল বাকিন ও ডেভিড উত্তরা এলাকার ব্যবসায়ী।
বাকিন অভিযুক্ত শিক্ষকের মামাশ্ব্বশুর ও ডেভিড শ্যালক বলে জানা গেছে। তবে এ তথ্য স্বীকার করেননি নূর উদ্দিন।
শাহবাগ থানার পুলিশ মারধরের বিষয়টি নিশ্চিত করে কালের কণ্ঠকে বলে, বৃহস্পতিবার দুপুরে ওই ঘটনাটি ঘটে। তারা ঠেকাতে গেলে ওসির রুমেও ভাঙচুর চালানো হয়। শাহবাগ থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের একজন শিক্ষকের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ প্রত্যাশিত নয়।' তবে শিক্ষক নূর উদ্দিন এ অভিযোগ অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'থানায় কাউকে মারধরের সুযোগ নেই।'
বাকিনের এক বন্ধু কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, নূর উদ্দিনের স্ত্রী ডা. নুরুন্নাহার ভুঁইয়া এবং যৌতুকের দাবি নিয়ে তাঁদের সম্পর্কে টানাপড়েন রয়েছে। নুরুন্নাহারের মামা সাইদুল বাকিন ও ভাই ডেভিড। তবে শিক্ষক নূর উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেছেন, তিনি নুরুন্নাহার নামের কোনো নারীকে চেনেনই না। তাই বাকিন মামাশ্বশুর ও ডেভিড তাঁর শ্যালক হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষক নুরুন্নাহারকে না চেনার দাবি করলেও গত জানুয়ারি মাসে প্রতারণার অভিযোগ এনে শাহবাগ থানায় নুরুন্নাহার, বাকিন, ডেভিডসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। সেই মামলার আসামি হিসেবে বৃহস্পতিবার থানায় আসার পর বাকিন ও ডেভিডকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পুলিশ আদালতে পাঠায়। আদালত তাঁদের জামিন মঞ্জুর করলে তাঁরা মুক্ত হয়ে বেরিয়ে যান।
বিভিন্ন সূত্র মতে, ২০০৮ সালে নূর উদ্দিনের সঙ্গে বিয়ে হয় ডা. নুরুন্নাহার ভুঁইয়ার। অভিযোগ রয়েছে, বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই যৌতুকের জন্য প্রায়ই নির্যাতন করতেন নূর উদ্দিন। এ ঘটনায় চট্টগ্রাম আদালতে কয়েক মাস আগে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন নুরুন্নাহার। এর পর থেকেই তাঁদের সম্পর্ক আরো খারাপের দিকে যায়।
শাহবাগ থানার সেকেন্ড অফিসার আবদুল জলিল কালের কণ্ঠকে জানান, গত ১৭ জানুয়ারি নূর উদ্দিন বাদী হয়ে সাইদুল বাকিন (৪৫), ইকবাল হোসেন বাবুল (৪৮), ফেরদৌসী ভুঁইয়া (৪২), নুরুন্নাহার ভুঁইয়া (২৬) ও ডেভিড জাহানকে (২৩) আসামি করে শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর ১৯। মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা উত্তরা এলাকায় একটি স্কুল করার জন্য তাঁর কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা নিয়ে সেই অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। ৪০৬/৪২০ ও ৫০৬ ধারায় মামলা দায়ের হয়। মামলার আসামি হিসেবে বাকিন ও ডেভিডকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সাইদুল বাকিনের এক বন্ধু কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা শুনেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাঁর স্ত্রী নুরুন্নাহারকে মারধর করতেন। এরপর নুরুন্নাহারকে আইনি সহযোগিতা দিতে এগিয়ে যান বাকিন। আর এই কারণেই মিথ্যা মামলা দিয়ে তাঁকেও আসামি করা হয়েছে।'
বাকিনের বন্ধু জানান, বৃহস্পতিবার সকালে ঢাবি শিক্ষক ফোন করে বাকিনকে এসব ঘটনা মীমাংসা করার জন্য থানায় আসতে বলেন। বাকিনও এসব ঝামেলা মিটমাট হোক তা চান। এ কারণে তিনি ডেভিডকে নিয়ে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে থানায় যান। থানায় গিয়ে ওসির রুমে যাওয়ার পর সেখানে ৩০-৪০ জন ছাত্র চলে আসে। তারা এসেই বাকিন ও ডেভিডকে মারধর ও ওসির রুমে ভাঙচুর শুরু করে। এ সময় পুলিশ সদস্যরা বাকিন ও ডেভিডকে রক্ষা করতে গেলে তাঁদেরও কিল-ঘুষির শিকার হতে হয়।
শাহবাগ থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, মারধরের সময় নূর উদ্দিন নিজেও ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেন। পরে বিষয়টি জেনে প্রক্টরসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক থানায় আসেন। কিন্তু দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে না পেরে চলে যান।
ওসি সিরাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, থানায় বসে শিক্ষক নূর উদ্দিন বলেছেন, নুরুন্নাহার তাঁর স্ত্রী নন। কিন্তু নুরুন্নাহারের সঙ্গে তাঁর (ওসি) কথা হয়েছে। নুরুন্নাহার ওসিকে জানিয়েছেন, নূর উদ্দিন তাঁকে বিয়ে করার জন্য কয়েক বছর পিছু লেগেছিলেন। বিয়ের পর নূর উদ্দিন বদলে যান। ওসি বলেন, পুরো ঘটনাটি বেশ জটিল। তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার রাতে ফোনে শিক্ষক মো. নূর উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, টঙ্গীতে ওয়েস্টার্ন ব্রিজ, মুনসুন ব্রিজ ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামের তিনটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। সেখানকার একটি প্রতিষ্ঠানে বাকিনের এক আত্মীয় হিসাব শাখায় কাজ করতেন। সেই সূত্রে সেখানে যাওয়া-আসা ছিল বাকিনের। একপর্যায়ে বাকিনের সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। এরই মধ্যে ২০০৭ সালের শেষ দিকে নূর উদ্দিনের চাকরি হয়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। এরপর তিনি স্কুলগুলোর দায়িত্ব থেকে সরে আসেন। পরে বাকিন তাঁকে প্রস্তাব দেন উত্তরা এলাকায় একটি বড় স্কুল করার জন্য। এতে রাজি হয়ে গত বছরের ১৬ অক্টোবর নূর উদ্দিন তাঁর দুলাভাই ও ভাইয়ের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা নিয়ে বাকিনকে দেন। কিন্তু বাকিন ও সংশ্লিষ্টরা সেই টাকা আত্মসাৎ করে। টাকা ফেরত চাইতে গেলে আড়াই মাস আগে উত্তরা এলাকায় ডেকে নিয়ে গিয়ে নূর উদ্দিনকে মারধর করে ও ছবি তুলে রাখেন বলেও তিনি অভিযোগ করেন। নূর উদ্দিন বলেন, 'এর পর থেকেই তারা বিভিন্নভাবে আমাকে হুমকি দিয়ে আসছে।'
এক প্রশ্নের জবাবে নূর উদ্দিন বলেন, 'নুরুন্নাহারকে তো আমি চিনিই না। সে আমার স্ত্রী হতে যাবে কেন। আমার টাকা আত্মসাৎ করার জন্যই তারা নুরুন্নাহার নামের একজনকে আমার স্ত্রী সাজিয়ে চট্টগ্রাম আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা দায়ের করে।' আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'তারাই আমাকে প্রস্তাব দেয় যে শাহবাগ থানায় বিষয়গুলো মিটমাট করবে। আমি থানায় গেলে আমাকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে কয়েকজন ছাত্র থানায় যায়। সেখানে মারধরের সুযোগ কোথায়?'
গতকাল শুক্রবার টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে নুরুন্নাহার কালের কণ্ঠকে জানান, টঙ্গীর মুনসুন ব্রিজ স্কুল এন্ড কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন নূর উদ্দিন। সেই স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন নুরুন্নাহারের খালা খোদেজা। খোদেজার ছেলেমেয়েকে বাসায় গিয়ে প্রাইভেট পড়াতেন নূর উদ্দিন। ২০০৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে নুরুন্নাহার ঢাকায় খালা খোদেজার বাসায় আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে। ওই বাসায় নূর উদ্দিনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। এরপর চট্টগ্রামের একটি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন নুরুন্নাহার। কিন্তু নূর উদ্দিন তাঁর পিছু লেগে বলতে থাকেন নূরুন্নাহারকে তিনি ভালোবেসে ফেলেছেন। ২০০৮ সালে ঢাকায় আসার পর পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় তাঁদের। এর পরই নুরুন্নাহারের মায়ের নামের একখণ্ড জমি নিজের নামে লিখে দেওয়ার জন্য নূর উদ্দিন চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। এসব নিয়েই তাঁদের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল ধরে।
No comments