সরেজমিন-১-সাংসদ আসাদুজ্জামানের কাছে এত লোক টাকা পাবেন? by সেলিম জাহিদ ও কামনাশীষ শেখর
টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের সরকারদলীয় সাংসদ খন্দকার আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে চাকরি দেওয়ার নামে নিজ এলাকার মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। চাকরি না হওয়ায় টাকা ফেরত চেয়ে পাচ্ছেন না, এমন অন্তত ১০ জন প্রথম আলোর কাছে সরাসরি অভিযোগ করেছেন।
আবার চারজনকে পাওয়া গেছে, যাঁরা চাকরি না হওয়ায় অনেক দেনদরবারের পর আংশিক টাকা ফেরতও পেয়েছেন।
জানতে চাইলে সাংসদ খন্দকার আসাদুজ্জামান লেনদেনের সব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ।’ তাঁর তদবিরে একজন লোকেরও চাকরি হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
তবে সাংসদ আসাদুজ্জামান ঢাকায় তাঁর বাসায় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার শুরুতে এলাকার লোকজনের জন্য ব্যাপক কর্মসংস্থান করেছেন বলে দাবি করেছিলেন। তাঁর দাবি, গত তিন বছরে সরকারের আত্মনির্ভরশীল নানা কর্মসূচি, কৃষি, শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে এলাকার ২০ হাজার লোকের স্থায়ী-অস্থায়ী কর্মসংস্থান করেছেন তিনি।
খন্দকার আসাদুজ্জামান সরকারের সাবেক সচিব ছিলেন। বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। ’৯৬ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপনবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। দুই উপজেলার বিভিন্ন দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে ভূঞাপুর ও গোপালপুর থেকে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৪৩৫ ব্যক্তির নিয়োগ হয়। এর মধ্যে জেলা কোটায় পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) পদে পাঁচজন ও কনস্টেবল পদে ১০৭ জন নিয়োগ পান।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য সহকারী পদে দুই উপজেলায় ৩৪ জন, কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রোভাইডার পদে ৪৫ জন এবং চিকিৎসা সহকারী পদে পাঁচজন নিয়োগ পান।
এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকসহ সহকারী শিক্ষক পদে ১৫২ জন, দুটি কলেজের অধ্যক্ষসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৮৭ জন শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে।
পাওনাদারের তালিকায় দলীয় নেতারা: সাংসদের কাছে টাকা পাওয়ার তালিকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের একাধিক নেতার নাম আছে। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ভূঞাপুর উপজেলা কমিটির সদস্য ও ফলদা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আকবর আলী, কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক হযরত আলী, অর্জুনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা ভূঞাপুর ইব্্রাহিম খাঁ কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (জিএস) আবু ফারুক উল্লেখযোগ্য। আরও কয়েকজন আছেন, যাঁরা এখনই নাম প্রকাশ করতে চান না।
ফলদা ইউনিয়নের আকবর আলী সাংসদের কাছে পাঁচ লাখ টাকা পান বলে দাবি করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমপি সাহেবের মাধ্যমে ছেলের পুলিশে (এসআই পদে) চাকরির জন্য চেষ্টা করেছিলাম, পাঁচ লাখ টাকাও দিয়েছিলাম। চাকরিটা হয়নি, এখন টাকা ফেরত চাইলে খালি তারিখ দেয়।’ তিনি বলেন, ‘অনেক লোকের কাছে শুনি, এমপির কাছে তাঁরাও টাকা পান।’
ভূঞাপুর উপজেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক হযরত আলী সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের এমএলএসএস (পিয়ন) পদে ছেলের চাকরির জন্য সাংসদকে ৫০ হাজার টাকা দেন বলে দাবি করেন। হযরত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘টাকাটা আমি ওনার (সাংসদ) হাতেই দিছিলাম। ছেলে পরীক্ষায় পাসও করেছিল। কিন্তু চাকরি হয়নি।’ টাকা দিয়ে থাকলে কেন চাকরি হয়নি, জানতে চাইলে হযরত আলী বলেন, ‘হুনছি, ময়মনসিংহের আরেকজন নাকি আড়াই লাখ টাকা দিছে।’
উপজেলার ছাব্বিশা গ্রামের বাসিন্দা দরিদ্র হযরত আলী এ টাকা জোগান দিতে এক শতক বসতভিটার অর্ধেক বিক্রি করেন। প্রায় এক বছর ঘুরে হযরত আলী সাংসদের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা উদ্ধার করতে সক্ষম হন। ভিটি বিক্রির দলিল না হওয়ায় পরে স্থানীয়ভাবে দেনদরবার করে ক্রেতাকে টাকা ফেরত দিয়ে বাড়ি রক্ষা করেন হযরত আলী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ একে ‘ডাহা মিথ্যা কথা’ বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘টাকাই নেইনি, ফেরত দেওয়ার প্রশ্ন কেন? বরং আমিই তাঁকে সাহায্য করে বাঁচিয়ে রেখেছি, ঘর করে দিয়েছি।’ একপর্যায়ে সাংসদ বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘তাহলে তো বলব, লোকটা অকৃতজ্ঞ।’
শিক্ষক নিয়োগে বেশি অনিয়ম: স্থানীয় সূত্রগুলোর দাবি, গত তিন বছরে দুই উপজেলায় শিক্ষক নিয়োগে বেশি অনিয়ম হয়েছে। এ সময় গোপালপুরে একজন প্রধান শিক্ষকসহ ৯৩ জন ও ভূঞাপুরে ৫৯ জন সহকারী শিক্ষক নিয়োগ হয়। এর বাইরে গোপালপুর কলেজ ও ভূঞাপুর ইব্রাহিম খাঁ কলেজের অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষসহ শ খানেক শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
গোপালপুরের বরশিলা গ্রামের হারুন তালুকদার দাবি করেন, ছেলের বউকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে চাকরি পাইয়ে দিতে সাংসদকে আড়াই লাখ টাকা দিয়েছেন তিনি। চাকরি হয়নি। অনেক ঘোরাঘুরির পর ৫০ হাজার টাকা সাংসদের কাছ থেকে ফেরত নিতে সক্ষম হন বলে দাবি করেন তিনি।
উপজেলার গোপালপুর কলেজের প্রভাষক পদে চাকরির জন্য শাহিনা পারভিন দিয়েছেন চার লাখ টাকা। শাহিনা পারভিনের পক্ষে তাঁর ভগ্নিপতি রুহুল আমিন ২০১০ সালের ১৩ মার্চ সাংসদ আসাদুজ্জামানকে সরাসরি এই টাকা দেন বলে দাবি করেন। রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর গত ডিসেম্বর মাসে দুই লাখ টাকা ফেরত পেয়েছি।’
ভূঞাপুর লোকমান ফকির মহিলা কলেজে স্ত্রীর চাকরির জন্য সাংসদকে দুই লাখ টাকা দেন স্থানীয় এক ব্যাংক কর্মকর্তা। কিন্তু চাকরি হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ভাই, ক্ষমা চাই। আমার ক্ষতি হবে। ধরে নেন, আমি টাকা ফেরত পেয়েছি।’
ভূঞাপুর উপজেলার ভারই দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে সম্প্রতি সহকারী প্রধান শিক্ষক ও লাইব্রেরিয়ান পদে নিয়োগের উদ্যোগ নেয় পরিচালনা পর্ষদ। কিন্তু নিয়োগের বিষয়ে সাংসদের সঙ্গে যোগাযোগ না করায় পরীক্ষাই হয়নি।
বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আসাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমপি সাহেবের ব্যক্তিগত সহকারী পরীক্ষার দিন ফোন করে বললেন, নিয়োগ দিতে চাইলে আগে স্যারের (সাংসদ) সঙ্গে দেখা করতে হবে। পরীক্ষার দিন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনিও সাংসদের অনুমতি ছাড়া পরীক্ষা নিতে রাজি হননি।’
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহিন আফরোজ বলেন, ‘ওই দিন আমি অসুস্থ ছিলাম। তাই যেতে পারিনি।’ শিক্ষা কর্মকর্তার এই বক্তব্য জানালে পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি বলেন, ‘উনি তো চাকরি করছেন। তাই এখন ভয়ে এমন বলছেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ বলেন, ‘এটা আমি জানি না। ব্যক্তিগত সহকারী আমার দৃষ্টিতে এমন কিছু আনেনি।’
‘অযোগ্য’ অধ্যক্ষ!: গোপালপুর কলেজের অধ্যক্ষের শূন্য পদে আনোয়ারুল ইসলাম আকন্দ নামের ওই কলেজের একজন শিক্ষককে সম্প্রতি নিয়োগ দেওয়া হয়। নাম প্রকাশ না করে একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করেন, অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এই শিক্ষক জ্যেষ্ঠতার তালিকায় ছিলেন ১০ নম্বরে। অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পরীক্ষায় আনোয়ারুল ইসলামসহ পাঁচজন অংশ নিয়েছিলেন। নিয়োগ বোর্ড ‘যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায়নি’ বলে ফলাফল বাতিল করে। এর কদিন পর সাংসদের হস্তক্ষেপে ওই প্রার্থীদের একজন আনোয়ারুল ইসলামকেই নিয়োগ দেওয়া হয়। সাংসদ আসাদুজ্জামান কলেজটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি।
এ কলেজে উপাধ্যক্ষ পদ না থাকলেও গত ৩ ডিসেম্বর একই প্রক্রিয়ায় আরেকজন শিক্ষককে উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে সাংসদ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের ভয়ে নাম প্রকাশ করে কথা বলতে শিক্ষকেরা রাজি হননি।
সূত্র জানায়, গত ডিসেম্বরে ভূঞাপুর ইব্রাহিম খাঁ কলেজের অধ্যক্ষসহ ১২টি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে নিয়োগ দেওয়া হয় কলেজের ২২টি শূন্য পদে।
গত ৪ ডিসেম্বর এ প্রতিবেদক ভূঞাপুর গেলে উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেছিলেন, ভূঞাপুর ইব্রাহিম খাঁ কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দিতে সাড়ে আট লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। এখনো নিয়োগ চূড়ান্ত হয়নি। ওই সময় তিনি হবু অধ্যক্ষের নামও প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন। পরে দেখা গেছে, ওই ব্যক্তিই অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
জানতে চাইলে সাংসদ সব অভিযোগই অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগে সাংসদের কোনো ভূমিকা থাকে না। সরকারের প্রতিনিধিদের মতামতের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়।
আরও অভিযোগ: সাংসদের নিজ এলাকা গোপালপুর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের মান্দিয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আবু ফারুক প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, উপজেলা স্বাস্থ্য সহকারী পদে দুজনের চাকরির জন্য সাংসদকে তিনি তিন লাখ টাকা দিয়েছিলেন। প্রায় দুই বছর পার হয়ে গেছে, কারোরই চাকরি হয়নি। এখন টাকাটাও ফেরত দিচ্ছেন না সাংসদ।
জানতে চাইলে সাংসদ বলেন, ‘আমার কাছে লোকজন আসে, কিন্তু আমার তদবিরে একজন স্বাস্থ্যকর্মীও নেওয়া হয়নি। একটা সেক্টরেও তদবির করে কোনো লোক নিয়োগ দিতে পারিনি।’
গোপালপুরের খামারপাড়া গ্রামের আবু তালেব পুলিশ কনস্টেবল পদে ভাতিজার চাকরির জন্য দুই লাখ টাকা, গাবসারা গ্রামের আবদুল মান্নান ছেলের পুলিশে চাকরির জন্য দুই লাখ টাকা দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন।
সাংসদের বক্তব্য: সাংসদের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগের বিষয় নিয়ে তাঁর গুলশানের বাসায় এ প্রতিবেদকের প্রায় আধা ঘণ্টা কথোপকথন হয়। এ সময় সাংসদের ব্যক্তিগত সহকারী সৈয়দ সলিম উল্লাহ ওরফে হিটলু ও বাবুল আহমেদ পারভেজ নামে সাংসদের এক ঘনিষ্ঠজন উপস্থিত ছিলেন।
একটি পদে চাকরির আশ্বাস দিয়ে একাধিক লোকের কাছ থেকে টাকা নেওয়া, সামনে ‘সার্কুলার আসছে’ বলে লোকজনকে আশা দিয়ে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ সব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে দাবি করেন। তিনি একটি সাম্প্রতিক ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, ‘সেদিন টাঙ্গাইল থেকে পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরির জন্য একজন আসেন। আমার বেগম সাহেবকে টাকাও সাধেন। টাকার কথা শুনে বেগম সাহেব তাঁকে বাসা থেকে বের করে দেন।’
এ পর্যায়ে পাওনাদারদের নাম উল্লেখ করে টাকা লেনদেনের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমার আশপাশের লোক, এলাকার লোক হয়তো মিথ্যা কথা বলে টাকাপয়সা নিতে পারে। বলতে পারে, ঢাকায় স্যারের বাসায় যাব, টাকাপয়সা লাগবে।’
আশপাশের এমন কাউকে শনাক্ত করতে পেরেছেন কি না, জানতে চাইলে সাংসদ বলেন, ‘না। তবে কদিন আগে আমার এক আত্মীয়র নাম শুনে তাঁকে সতর্ক করে দিয়েছি।’ তিনি যোগ করেন, ‘আসলে, সত্য কথা বলি, এমপিদের কথায় চাকরি হয় না। লোকের ধারণা, চাকরি দিয়ে এমপিরা কোটি কোটি টাকা কামাই করছেন।’
এ সময় সাংসদের পাশে বসা বাবুল আহমেদ পারভেজ প্রতিবেদককে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আসলে, স্যারকে কেউ পাত্তা দেয় না।’ বাবুল আহমেদের কথার পিঠে সাংসদ বলেন, ‘উনিও তো দুজনের চাকরির জন্য তদবির করতে এসেছেন। কই, হচ্ছে না তো।’
জানতে চাইলে সাংসদ খন্দকার আসাদুজ্জামান লেনদেনের সব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ।’ তাঁর তদবিরে একজন লোকেরও চাকরি হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
তবে সাংসদ আসাদুজ্জামান ঢাকায় তাঁর বাসায় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার শুরুতে এলাকার লোকজনের জন্য ব্যাপক কর্মসংস্থান করেছেন বলে দাবি করেছিলেন। তাঁর দাবি, গত তিন বছরে সরকারের আত্মনির্ভরশীল নানা কর্মসূচি, কৃষি, শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে এলাকার ২০ হাজার লোকের স্থায়ী-অস্থায়ী কর্মসংস্থান করেছেন তিনি।
খন্দকার আসাদুজ্জামান সরকারের সাবেক সচিব ছিলেন। বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। ’৯৬ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপনবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। দুই উপজেলার বিভিন্ন দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে ভূঞাপুর ও গোপালপুর থেকে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৪৩৫ ব্যক্তির নিয়োগ হয়। এর মধ্যে জেলা কোটায় পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) পদে পাঁচজন ও কনস্টেবল পদে ১০৭ জন নিয়োগ পান।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য সহকারী পদে দুই উপজেলায় ৩৪ জন, কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রোভাইডার পদে ৪৫ জন এবং চিকিৎসা সহকারী পদে পাঁচজন নিয়োগ পান।
এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকসহ সহকারী শিক্ষক পদে ১৫২ জন, দুটি কলেজের অধ্যক্ষসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৮৭ জন শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে।
পাওনাদারের তালিকায় দলীয় নেতারা: সাংসদের কাছে টাকা পাওয়ার তালিকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের একাধিক নেতার নাম আছে। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ভূঞাপুর উপজেলা কমিটির সদস্য ও ফলদা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আকবর আলী, কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক হযরত আলী, অর্জুনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা ভূঞাপুর ইব্্রাহিম খাঁ কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (জিএস) আবু ফারুক উল্লেখযোগ্য। আরও কয়েকজন আছেন, যাঁরা এখনই নাম প্রকাশ করতে চান না।
ফলদা ইউনিয়নের আকবর আলী সাংসদের কাছে পাঁচ লাখ টাকা পান বলে দাবি করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমপি সাহেবের মাধ্যমে ছেলের পুলিশে (এসআই পদে) চাকরির জন্য চেষ্টা করেছিলাম, পাঁচ লাখ টাকাও দিয়েছিলাম। চাকরিটা হয়নি, এখন টাকা ফেরত চাইলে খালি তারিখ দেয়।’ তিনি বলেন, ‘অনেক লোকের কাছে শুনি, এমপির কাছে তাঁরাও টাকা পান।’
ভূঞাপুর উপজেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক হযরত আলী সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের এমএলএসএস (পিয়ন) পদে ছেলের চাকরির জন্য সাংসদকে ৫০ হাজার টাকা দেন বলে দাবি করেন। হযরত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘টাকাটা আমি ওনার (সাংসদ) হাতেই দিছিলাম। ছেলে পরীক্ষায় পাসও করেছিল। কিন্তু চাকরি হয়নি।’ টাকা দিয়ে থাকলে কেন চাকরি হয়নি, জানতে চাইলে হযরত আলী বলেন, ‘হুনছি, ময়মনসিংহের আরেকজন নাকি আড়াই লাখ টাকা দিছে।’
উপজেলার ছাব্বিশা গ্রামের বাসিন্দা দরিদ্র হযরত আলী এ টাকা জোগান দিতে এক শতক বসতভিটার অর্ধেক বিক্রি করেন। প্রায় এক বছর ঘুরে হযরত আলী সাংসদের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা উদ্ধার করতে সক্ষম হন। ভিটি বিক্রির দলিল না হওয়ায় পরে স্থানীয়ভাবে দেনদরবার করে ক্রেতাকে টাকা ফেরত দিয়ে বাড়ি রক্ষা করেন হযরত আলী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ একে ‘ডাহা মিথ্যা কথা’ বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘টাকাই নেইনি, ফেরত দেওয়ার প্রশ্ন কেন? বরং আমিই তাঁকে সাহায্য করে বাঁচিয়ে রেখেছি, ঘর করে দিয়েছি।’ একপর্যায়ে সাংসদ বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘তাহলে তো বলব, লোকটা অকৃতজ্ঞ।’
শিক্ষক নিয়োগে বেশি অনিয়ম: স্থানীয় সূত্রগুলোর দাবি, গত তিন বছরে দুই উপজেলায় শিক্ষক নিয়োগে বেশি অনিয়ম হয়েছে। এ সময় গোপালপুরে একজন প্রধান শিক্ষকসহ ৯৩ জন ও ভূঞাপুরে ৫৯ জন সহকারী শিক্ষক নিয়োগ হয়। এর বাইরে গোপালপুর কলেজ ও ভূঞাপুর ইব্রাহিম খাঁ কলেজের অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষসহ শ খানেক শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
গোপালপুরের বরশিলা গ্রামের হারুন তালুকদার দাবি করেন, ছেলের বউকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে চাকরি পাইয়ে দিতে সাংসদকে আড়াই লাখ টাকা দিয়েছেন তিনি। চাকরি হয়নি। অনেক ঘোরাঘুরির পর ৫০ হাজার টাকা সাংসদের কাছ থেকে ফেরত নিতে সক্ষম হন বলে দাবি করেন তিনি।
উপজেলার গোপালপুর কলেজের প্রভাষক পদে চাকরির জন্য শাহিনা পারভিন দিয়েছেন চার লাখ টাকা। শাহিনা পারভিনের পক্ষে তাঁর ভগ্নিপতি রুহুল আমিন ২০১০ সালের ১৩ মার্চ সাংসদ আসাদুজ্জামানকে সরাসরি এই টাকা দেন বলে দাবি করেন। রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর গত ডিসেম্বর মাসে দুই লাখ টাকা ফেরত পেয়েছি।’
ভূঞাপুর লোকমান ফকির মহিলা কলেজে স্ত্রীর চাকরির জন্য সাংসদকে দুই লাখ টাকা দেন স্থানীয় এক ব্যাংক কর্মকর্তা। কিন্তু চাকরি হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ভাই, ক্ষমা চাই। আমার ক্ষতি হবে। ধরে নেন, আমি টাকা ফেরত পেয়েছি।’
ভূঞাপুর উপজেলার ভারই দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে সম্প্রতি সহকারী প্রধান শিক্ষক ও লাইব্রেরিয়ান পদে নিয়োগের উদ্যোগ নেয় পরিচালনা পর্ষদ। কিন্তু নিয়োগের বিষয়ে সাংসদের সঙ্গে যোগাযোগ না করায় পরীক্ষাই হয়নি।
বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আসাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমপি সাহেবের ব্যক্তিগত সহকারী পরীক্ষার দিন ফোন করে বললেন, নিয়োগ দিতে চাইলে আগে স্যারের (সাংসদ) সঙ্গে দেখা করতে হবে। পরীক্ষার দিন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনিও সাংসদের অনুমতি ছাড়া পরীক্ষা নিতে রাজি হননি।’
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহিন আফরোজ বলেন, ‘ওই দিন আমি অসুস্থ ছিলাম। তাই যেতে পারিনি।’ শিক্ষা কর্মকর্তার এই বক্তব্য জানালে পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি বলেন, ‘উনি তো চাকরি করছেন। তাই এখন ভয়ে এমন বলছেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ বলেন, ‘এটা আমি জানি না। ব্যক্তিগত সহকারী আমার দৃষ্টিতে এমন কিছু আনেনি।’
‘অযোগ্য’ অধ্যক্ষ!: গোপালপুর কলেজের অধ্যক্ষের শূন্য পদে আনোয়ারুল ইসলাম আকন্দ নামের ওই কলেজের একজন শিক্ষককে সম্প্রতি নিয়োগ দেওয়া হয়। নাম প্রকাশ না করে একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করেন, অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এই শিক্ষক জ্যেষ্ঠতার তালিকায় ছিলেন ১০ নম্বরে। অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পরীক্ষায় আনোয়ারুল ইসলামসহ পাঁচজন অংশ নিয়েছিলেন। নিয়োগ বোর্ড ‘যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায়নি’ বলে ফলাফল বাতিল করে। এর কদিন পর সাংসদের হস্তক্ষেপে ওই প্রার্থীদের একজন আনোয়ারুল ইসলামকেই নিয়োগ দেওয়া হয়। সাংসদ আসাদুজ্জামান কলেজটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি।
এ কলেজে উপাধ্যক্ষ পদ না থাকলেও গত ৩ ডিসেম্বর একই প্রক্রিয়ায় আরেকজন শিক্ষককে উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে সাংসদ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের ভয়ে নাম প্রকাশ করে কথা বলতে শিক্ষকেরা রাজি হননি।
সূত্র জানায়, গত ডিসেম্বরে ভূঞাপুর ইব্রাহিম খাঁ কলেজের অধ্যক্ষসহ ১২টি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে নিয়োগ দেওয়া হয় কলেজের ২২টি শূন্য পদে।
গত ৪ ডিসেম্বর এ প্রতিবেদক ভূঞাপুর গেলে উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেছিলেন, ভূঞাপুর ইব্রাহিম খাঁ কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দিতে সাড়ে আট লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। এখনো নিয়োগ চূড়ান্ত হয়নি। ওই সময় তিনি হবু অধ্যক্ষের নামও প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন। পরে দেখা গেছে, ওই ব্যক্তিই অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
জানতে চাইলে সাংসদ সব অভিযোগই অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগে সাংসদের কোনো ভূমিকা থাকে না। সরকারের প্রতিনিধিদের মতামতের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়।
আরও অভিযোগ: সাংসদের নিজ এলাকা গোপালপুর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের মান্দিয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আবু ফারুক প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, উপজেলা স্বাস্থ্য সহকারী পদে দুজনের চাকরির জন্য সাংসদকে তিনি তিন লাখ টাকা দিয়েছিলেন। প্রায় দুই বছর পার হয়ে গেছে, কারোরই চাকরি হয়নি। এখন টাকাটাও ফেরত দিচ্ছেন না সাংসদ।
জানতে চাইলে সাংসদ বলেন, ‘আমার কাছে লোকজন আসে, কিন্তু আমার তদবিরে একজন স্বাস্থ্যকর্মীও নেওয়া হয়নি। একটা সেক্টরেও তদবির করে কোনো লোক নিয়োগ দিতে পারিনি।’
গোপালপুরের খামারপাড়া গ্রামের আবু তালেব পুলিশ কনস্টেবল পদে ভাতিজার চাকরির জন্য দুই লাখ টাকা, গাবসারা গ্রামের আবদুল মান্নান ছেলের পুলিশে চাকরির জন্য দুই লাখ টাকা দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন।
সাংসদের বক্তব্য: সাংসদের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগের বিষয় নিয়ে তাঁর গুলশানের বাসায় এ প্রতিবেদকের প্রায় আধা ঘণ্টা কথোপকথন হয়। এ সময় সাংসদের ব্যক্তিগত সহকারী সৈয়দ সলিম উল্লাহ ওরফে হিটলু ও বাবুল আহমেদ পারভেজ নামে সাংসদের এক ঘনিষ্ঠজন উপস্থিত ছিলেন।
একটি পদে চাকরির আশ্বাস দিয়ে একাধিক লোকের কাছ থেকে টাকা নেওয়া, সামনে ‘সার্কুলার আসছে’ বলে লোকজনকে আশা দিয়ে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ সব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে দাবি করেন। তিনি একটি সাম্প্রতিক ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, ‘সেদিন টাঙ্গাইল থেকে পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরির জন্য একজন আসেন। আমার বেগম সাহেবকে টাকাও সাধেন। টাকার কথা শুনে বেগম সাহেব তাঁকে বাসা থেকে বের করে দেন।’
এ পর্যায়ে পাওনাদারদের নাম উল্লেখ করে টাকা লেনদেনের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমার আশপাশের লোক, এলাকার লোক হয়তো মিথ্যা কথা বলে টাকাপয়সা নিতে পারে। বলতে পারে, ঢাকায় স্যারের বাসায় যাব, টাকাপয়সা লাগবে।’
আশপাশের এমন কাউকে শনাক্ত করতে পেরেছেন কি না, জানতে চাইলে সাংসদ বলেন, ‘না। তবে কদিন আগে আমার এক আত্মীয়র নাম শুনে তাঁকে সতর্ক করে দিয়েছি।’ তিনি যোগ করেন, ‘আসলে, সত্য কথা বলি, এমপিদের কথায় চাকরি হয় না। লোকের ধারণা, চাকরি দিয়ে এমপিরা কোটি কোটি টাকা কামাই করছেন।’
এ সময় সাংসদের পাশে বসা বাবুল আহমেদ পারভেজ প্রতিবেদককে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আসলে, স্যারকে কেউ পাত্তা দেয় না।’ বাবুল আহমেদের কথার পিঠে সাংসদ বলেন, ‘উনিও তো দুজনের চাকরির জন্য তদবির করতে এসেছেন। কই, হচ্ছে না তো।’
No comments