বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩৩৬ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মঙ্গল মিয়া, বীর প্রতীক
সাহসী ও সফল যোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত অবস্থান নিলেন গাছপালা ও ঝোপঝাড়ের আড়ালে। মঙ্গল মিয়াসহ ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা। অদূরে রেলস্টেশন। সেই রেলস্টেশনের দিকে আসছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরাট এক দল।
সাহসী ও সফল যোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত অবস্থান নিলেন গাছপালা ও ঝোপঝাড়ের আড়ালে। মঙ্গল মিয়াসহ ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা। অদূরে রেলস্টেশন। সেই রেলস্টেশনের দিকে আসছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরাট এক দল।
মুক্তিযোদ্ধারা রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা করছেন। সময় যেন কাটে না। অবশেষে শত্রু পাকিস্তানি সেনাদলের বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁদ (অ্যামবুশ) এলাকায় ঢুকে পড়ল। একসঙ্গে গর্জে উঠল মঙ্গল মিয়া ও তাঁর সহযোদ্ধাদের অস্ত্র। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। পেছনে হকচকিত পাকিস্তানি সেনারা যে যেভাবে পারল এদিক-সেদিক ঝাঁপিয়ে পড়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে দিশেহারা জীবিত পাকিস্তানি সেনারা শেষ পর্যন্ত পালিয়ে গেল। এ ঘটনা মন্দভাগ রেলস্টেশনে। ১৯৭১ সালের ১৮ জুন।
মন্দভাগ রেলস্টেশন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন ভারতীয় এলাকায় একটি ক্যাম্পে। সেদিন সকালে মুক্তিযোদ্ধারা খবর পান এক দল পাকিস্তানি সেনা কসবা রেলস্টেশন থেকে রেলের একটি ট্রলিতে করে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও রেশন নিয়ে রওনা হয়েছে সালদা নদী রেলস্টেশনে। ট্রলির নিরাপত্তায় রয়েছে আরেক দল পাকিস্তানি সেনা। তারা সব মিলে প্রায় ২০০ জন।
খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেন পাকিস্তানি সেনাদের অ্যামবুশ করার। তাঁরা দ্রুত সীমান্ত অতিক্রম করে অবস্থান নেন মধ্যবর্তী মন্দভাগ স্টেশনের কাছে। তাঁরা ছিলেন ৪০ জন। দলের নেতৃত্বে সুবেদার আবদুল ওয়াহাব (বীর বিক্রম, পরে অনারারি ক্যাপ্টেন)। মঙ্গল মিয়া সহদলনেতা। তাঁদের অস্ত্র বলতে ছিল দুটি মেশিনগান, সাতটি এলএমজি, একটি দুই ইঞ্চি মর্টার ও একটি রকেট লাঞ্চার। বাকি সব হালকা অস্ত্র।
পাকিস্তানি সেনারা রেলট্রলিকে মাঝে রেখে রেললাইনের দুই পাশ ধরে সারিবদ্ধভাবে হেঁটে আসছিল। রেললাইনের সমান্তরাল রাস্তায় ছিল আরেক দল পাকিস্তানি সেনা। রেলট্রলি ও সেনারা অ্যামবুশের মধ্যে ঢোকামাত্র মঙ্গল মিয়ারা একযোগে আক্রমণ শুরু করেন। মুহূর্তের মধ্যে রকেট লাঞ্চারের একটি গোলা ট্রলি ভেদ করে চলে যায়। গুলিবিদ্ধ কয়েকজন সেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
পাকিস্তানি সেনারা রেললাইনের আড়ালে অবস্থান নিয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। দুই পক্ষে প্রায় ঘণ্টাখানেক তুমুল যুদ্ধ চলে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা শেষ পর্যন্ত রণেভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে মঙ্গল মিয়া অসীম বীরত্ব ও সাহস প্রদর্শন করেন।
মঙ্গল মিয়া চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েব সুবেদার। ১৯৭১ সালে এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল কুমিল্লা সেনানিবাসে। মার্চ মাসে সম্ভাব্য ভারতীয় হামলার কথা বলে তাঁদের সেনানিবাসের বাইরে মোতায়েন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে সালদা নদী, মন্দভাগ, কসবা এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ করেন। তিনি কিংবদন্তির যোদ্ধা আবদুল ওয়াবের কোম্পানিতে ছিলেন। একটি প্লাটুনের নেতৃত্ব দেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মঙ্গল মিয়াকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৭০।
মঙ্গল মিয়া ১৯৮২ সালে মারা গেছেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে সুবেদার পদ থেকে অবসর নেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পৈতৃক ভিটাতেই বসবাস করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার ভাটামাখা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আনোয়ার আলী। মায়ের নাম কেউ বলতে পারেননি। স্ত্রী জাহেরা বেগম। তাঁর দুই ছেলে, ছয় মেয়ে।
সূত্র: প্রথম আলোর আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি দুলাল ঘোষ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
মন্দভাগ রেলস্টেশন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন ভারতীয় এলাকায় একটি ক্যাম্পে। সেদিন সকালে মুক্তিযোদ্ধারা খবর পান এক দল পাকিস্তানি সেনা কসবা রেলস্টেশন থেকে রেলের একটি ট্রলিতে করে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও রেশন নিয়ে রওনা হয়েছে সালদা নদী রেলস্টেশনে। ট্রলির নিরাপত্তায় রয়েছে আরেক দল পাকিস্তানি সেনা। তারা সব মিলে প্রায় ২০০ জন।
খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেন পাকিস্তানি সেনাদের অ্যামবুশ করার। তাঁরা দ্রুত সীমান্ত অতিক্রম করে অবস্থান নেন মধ্যবর্তী মন্দভাগ স্টেশনের কাছে। তাঁরা ছিলেন ৪০ জন। দলের নেতৃত্বে সুবেদার আবদুল ওয়াহাব (বীর বিক্রম, পরে অনারারি ক্যাপ্টেন)। মঙ্গল মিয়া সহদলনেতা। তাঁদের অস্ত্র বলতে ছিল দুটি মেশিনগান, সাতটি এলএমজি, একটি দুই ইঞ্চি মর্টার ও একটি রকেট লাঞ্চার। বাকি সব হালকা অস্ত্র।
পাকিস্তানি সেনারা রেলট্রলিকে মাঝে রেখে রেললাইনের দুই পাশ ধরে সারিবদ্ধভাবে হেঁটে আসছিল। রেললাইনের সমান্তরাল রাস্তায় ছিল আরেক দল পাকিস্তানি সেনা। রেলট্রলি ও সেনারা অ্যামবুশের মধ্যে ঢোকামাত্র মঙ্গল মিয়ারা একযোগে আক্রমণ শুরু করেন। মুহূর্তের মধ্যে রকেট লাঞ্চারের একটি গোলা ট্রলি ভেদ করে চলে যায়। গুলিবিদ্ধ কয়েকজন সেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
পাকিস্তানি সেনারা রেললাইনের আড়ালে অবস্থান নিয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। দুই পক্ষে প্রায় ঘণ্টাখানেক তুমুল যুদ্ধ চলে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা শেষ পর্যন্ত রণেভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে মঙ্গল মিয়া অসীম বীরত্ব ও সাহস প্রদর্শন করেন।
মঙ্গল মিয়া চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েব সুবেদার। ১৯৭১ সালে এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল কুমিল্লা সেনানিবাসে। মার্চ মাসে সম্ভাব্য ভারতীয় হামলার কথা বলে তাঁদের সেনানিবাসের বাইরে মোতায়েন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে সালদা নদী, মন্দভাগ, কসবা এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ করেন। তিনি কিংবদন্তির যোদ্ধা আবদুল ওয়াবের কোম্পানিতে ছিলেন। একটি প্লাটুনের নেতৃত্ব দেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মঙ্গল মিয়াকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৭০।
মঙ্গল মিয়া ১৯৮২ সালে মারা গেছেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে সুবেদার পদ থেকে অবসর নেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পৈতৃক ভিটাতেই বসবাস করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার ভাটামাখা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আনোয়ার আলী। মায়ের নাম কেউ বলতে পারেননি। স্ত্রী জাহেরা বেগম। তাঁর দুই ছেলে, ছয় মেয়ে।
সূত্র: প্রথম আলোর আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি দুলাল ঘোষ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments