সংগীত-আশার সুরে মন্দ্রিত সন্ধ্যা by আশীষ-উর-রহমান

পরিচয়ের জন্য নামটিই যথেষ্ট। কোনো বিশেষণের প্রয়োজন হয় না। গতকাল শুক্রবার ঢাকায় আর্মি স্টেডিয়ামে ৭৯ বছর বয়সে প্রায় আড়াই ঘণ্টা মঞ্চে দাঁড়িয়ে যে পরিবেশনা শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন আশা ভোঁসলে, এককথায় তা অতুলনীয়।


পুরোনো দিনের স্মৃতি জাগানিয়া ‘কাজরা মুহাব্বত ওয়ালা’ থেকে শুরু করে হাল জামানার ‘সারারা সারারা’, ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না’ থেকে কবিগুরুর ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে’ পর্যন্ত এককে, দ্বৈত কণ্ঠে ৩০টিরও বেশি গান গেয়ে দর্শকদের আশা পূরণ করেছেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী আশা ভোঁসলে।
‘ইটারনাল আশা লাইভ ইন ঢাকা’ নামের এই সংগীতসন্ধ্যার আয়োজন করেছিল ম্যাকম নামের একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা। আশা ভোঁসলের সঙ্গে কয়েকটি একক ও দ্বৈত গান করেন শিল্পী সুদেশ ভোঁসলে। সহযোগী শিল্পী ছিলেন নিশিগন্ধ্যা পাথক, বীণা রিজকুদ ও শিল্পা। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন সঙ্গে আসা কুড়িজন যন্ত্রশিল্পীর একটি দল।
বিকেল পাঁচটায় স্টেডিয়ামের ফটক খুলে দেওয়া হয়েছিল। গান শুরু হয় ঠিক রাত আটটায়। শ্রোতাদের অবশ্য এই লম্বা সময় নিষ্ক্রিয় থাকতে দেয়নি ঢাকার অতি বিখ্যাত মশককুল। মশা তাড়াতেই সদা ব্যস্ত ছিল দর্শকদের দুই হাত। অনেককে পায়ের কাছে কয়েলও জ্বালাতে দেখা গেছে।
মঞ্চ সাজানো হয়েছিল ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ইমারত আহসান মঞ্জিলের আদলে। গেরুয়া রঙের সেই ইমারতের সামনে শুভ্র শাড়ি পরা আশা ভোঁসলে এসে দাঁড়ালে দর্শকেরা আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে করতালিতে তাঁকে সম্মান ও অভিনন্দন জানান। ‘আমি আপনাদের মাঝে আসতে পেরে খুবই আনন্দিত। আপনাদের প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা’—কথা আর না বাড়িয়ে শেষ ফাগুনের নবীন রাতের হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলেন তাঁর মধুর সুর ‘পেয়ার করনে ওয়ালে জানেসে’। টানা গেয়ে গেলেন ‘রাত বাকি বাত বাকি’, ‘এ মেরা দিল’, চুরালিয়া হে তু মেরে দিল কো’, ‘এ লাড়কা হ্যায় আল্লাহ কিতনা হ্যায় দিওয়ানা’, ‘পুছনা ইয়ার ক্যা হুয়া’সহ প্রায় ১০টি গান। বিশেষ করে ‘ও মেরে সোনারে সোনা’ গানটি গাওয়ার সময় তিনি বেশ মজা করেন দর্শকদের সঙ্গে। এ গানটি নূরজাহান গাইলে কেমন করে গাইতেন, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী কেমন করে গাইতেন, ছোট বাচ্চারা কেমন করে গায়—তা অনুকরণ করে গেয়ে তিনি শ্রোতাদের বিমল আনন্দে মাতিয়ে তোলেন।
এর আগে অনুষ্ঠানে গানের পালা শুরু করেন সুদেশ ভোঁসলে। তিনি কিশোর কুমারের গান ‘মেরে মেহেবুব ক্যায়ামত হোগি’ দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন। এরপর তিনি গেয়েছেন মোহাম্মদ রফির ‘ক্যায়া হুয়া তেরা ওয়াদা’সহ বিভিন্ন গান। এর মধ্যে অমিতাভ বচ্চনের কণ্ঠ অনুকরণ করে বিভিন্ন সিনেমার সংলাপ ও অমিতাভের গাওয়া গানগুলো তিনি প্রধানত গেয়ে শ্রোতাদের আনন্দ দিয়েছেন। এর মধ্যে ছিল ‘রঙ বরসে ভিগে চুনারবালি’, ‘চুম্মা চুম্মা দে দে’, ‘দিল মেরা তোড়া’।
আশা ভোঁসলে প্রথম দফা একক গান করার পর মঞ্চে আসেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লা। তিনি এ দেশের শিল্পী ও শ্রোতাদের পক্ষ থেকে আশা ভোঁসলের হাতে পুষ্পস্তবক তুলে দেন। বলেন, লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলে তাঁর অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছেন। রুনা লায়লাকে উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে আশা ভোঁসলে বলেন, ‘রুনা অনেক বড় মাপের শিল্পী। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের জনগণকে সুরের বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছেন।’ এরপর তাঁরা দুজনে ‘দমা দম মাস্ত কালান্দর’ গানটি গেয়ে শোনান।
আশা ভোঁসলে ১০ মিনিট চা পানের বিরতি নিয়েছিলেন রুনা লায়লার সঙ্গে গানটি করার পর। এ সময় সুদেশ আবার আসেন মঞ্চে। এ পর্যায়ে তিনি বিভিন্ন গানের অংশবিশেষ মিলিয়ে মাঝে মাঝে অমিতাভ বচ্চনের নৃত্যভঙ্গির সঙ্গে একটি মিশ্র ধরনের পরিবেশনা উপস্থাপন করেন। তাতে খানিকটা বৈচিত্র্যও এসেছিল অনুষ্ঠানে।
এরপর মঞ্চে এসেই আশা ভোঁসলে গেয়ে শোনান ‘কাজরা মুহাব্বত ওয়ালা’, ‘কই আগ লাগ যায়ে’, ‘ঝুমকা গিরা রে’। শ্রোতারা গানের সঙ্গে করতালি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দিত করেন। অনেকেই বায়না ধরেছিলেন বাংলা গান শোনার। শিল্পী বললেন বাংলাতেই, ‘হবে হবে, একটু দাঁড়ান।’
এরপর আর মঞ্চ ছাড়েননি তিনি। তৃতীয় পর্যায়ে সুদেশের সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে গাইলেন ‘এক ম্যায় অর এক তু’, ‘জানে না কুছ কাঁহাঁ’, ‘ও হাসিনা জুলফওয়ালি’। দ্বৈত গানগুলোর সঙ্গে আশা ভোঁসলে মৃদু ও মধ্যম তাল-ছন্দে নেচেছেনও কখনো কখনো। তা এ পর্বের পরিবেশনায় বাড়তি আনন্দ যোগ করে।
শেষে গাইলেন বাংলা গান। ‘গুরুদেবের গান কি শুনবেন’—পরিষ্কার বাংলাতেই বললেন। আপত্তির তো কোনো কারণ নেই। মাঠ থেকে উঠে আসা বহু কণ্ঠের ‘হ্যাঁ’ ধ্বনির রেশ থাকতেই যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়াই গেয়ে শোনালেন, ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ/ ধন্য হল, ধন্য হল মানবজীবন’। ‘আমি একটু একটু করে কিছু শোনাব’ বলে গাইলেন, ‘কিনে দে রেশমি চুড়ি’, ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না’ এমন কয়েকটি জনপ্রিয় বাংলা গান। রাত তখন সাড়ে ১০টা। নিজেই মঞ্চের যন্ত্রীদের সঙ্গে শ্রোতাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আকাশভরা জ্যোৎস্না। টুকরো টুকরো মেঘ ছুটছে পূর্ণশশীকে মাঝে মাঝে ঢেকে দিয়ে। শ্রোতারাও ফিরলেন গৃহপানে এক স্মরণীয় অনুষ্ঠানের গানের রেশ প্রাণে নিয়ে।

No comments

Powered by Blogger.