প্রাচীন মিসরীয় সাহিত্য by মুহম্মদ নূরুল হুদা
মিসরীয় সাহিত্য পৃথিবীর আদি সাহিত্যগুলোর অন্যতম। অজ্ঞাত ও নাম না-জানা মিসরীয় সাহিত্যিকরা যা কিছু লিখত মনের তাগিদে বা প্রয়োজন সিদ্ধির লক্ষ্যে, তার অধিকাংশই তারা জমিয়ে রাখত তাদের স্মৃতিতে, আর কিয়দংশ ধরে রাখত লিখিত প্রক্রিয়ায়।
আর তার মাধ্যম ছিল আধুনিক কাগজের পূর্বসূরি প্যাপিরাস, সমাধিফলক, পিরামিড, মিনার, গুহাগাত্র, চিত্রকর্ম, মিনার, স্মৃতিস্তম্ভ ইত্যাদি। মাধ্যম বিবেচনা করলেই দেখা যাবে—ধর্ম, ইতিহাস ও অমরত্বের সাধনাই ছিল এসব সাহিত্যসৃষ্টির মূল প্রণোদনা। আজকের উন্নত পৃথিবী টেকনোলজির অভাবিতপূর্ব সুরতবদলের কারণে দশকে দশকে বদলে যায়, কিন্তু আদি মানুষের জীবনযাত্রা শতাব্দীর পর শতাব্দী বয়ে চলেছে প্রায় অপরিবর্তিত ধারায়। মিসরেও তেমনটি ঘটেছে। সাহিত্যের এই রীতি, এই মাধ্যম ও এই বিষয়-আশয় যুগ যুগ ধরে প্রায় একইভাবে প্রলম্বিত হয়েছে। তবে পরিবর্তন যে সূচিত হয়নি এমন নয়। এই পরিবর্তনের প্রধান কারণ বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর আবির্ভাব ও তিরোভাব, আর তার পাশাপাশি সভ্যতারও রূপবদল। তবে বদলটা ঘটেছে মূলত ইতিহাসের ধারাবর্ণনায়, লোকমানুষের মৌলিক অনুভূতি ও প্রবৃত্তিতে নয়। ফলে মিসরীয় সাহিত্যের যে মানবিক রূপ তা আধুনিক কাল পর্যন্ত সমভাবে শনাক্তযোগ্য। আর এই মানবিক রূপ বিকশিত হয়েছে রাজাদেশে সৃষ্ট আনুষ্ঠানিক সাহিত্যে নয়, বরং গণমানুষের কল্পনা থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৃষ্ট লোকসাহিত্যে। ধর্মপ্রধান ঐশ্বরিক সাহিত্য, মহাকাব্য, কাহিনীকাব্য বা নানা বিষয়ে মহাগ্রন্থাদি রচিত হওয়ার আগে সামষ্টিক মেধানির্ভর এই লোকসাহিত্যই আদিমিসরীয়দের নৈতিকতা, সৃষ্টিকল্পনা, সাহিত্যরুচি ও মূল্যবোধের প্রকৃষ্ট পরিচায়ক। এই সাহিত্যের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, এতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা তথা হিসাব-নিকাশেরও পরিচয় মেলে।
পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য তাদের মননচর্চার দিকটিও। বিষয়ের বৈচিত্র্যের পাশপাশি বর্ণনা কৌশল বা আঙ্গিকের বিভিন্নতাও চর্চিত হয়েছে সেই শুরু থেকে। দু’পঙক্তির হৃদয়গ্রাহী পদ থেকে হাজার পঙক্তির কাহিনীকাব্য কিংবা ততধিক পৃষ্ঠার মহাকাব্য রচিত হয়েছে তাদের হাতেই। আর এসেছে মনের দিগন্ত প্রসারিত করা, কল্পনাকে লাগামহীন করা, আবার তর্ক ও প্রতিতর্কের সহবিন্যাস করার মতো অনুশীলন। ফলে এই সাহিত্য তাদের আধ্যাত্মিকতা, দার্শনিকতা, নান্দনিকতা ও আঙ্গিকগত বৈচিত্র্যেরও স্মারক হয়ে ওঠে। অবাক হওয়ার বিষয় এই যে, সেই প্রাচীন যুগেই তারা সাহিত্যকে বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত করে উপন্যাস, ছোটগল্প, গীতিকবিতা, কাহিনীকাব্য, মহাকাব্য, লোককাহিনী, প্রবাদ, প্রবচন, নীতিকথা, দর্শন বা সৌন্দর্যতত্ত্বের মতো বিশেষ বিশেষ শ্রেণীতে বিন্যাস করেছিল। কাঠামোগত দিক থেকে প্রায় সব ধরনের মননশীল রচনায় শিরোনাম, ভূমিকা, বক্তব্য বিশ্লেষণ ও উপসংহার ইত্যাদি সন্নিবেশিত হতো। অনুষ্ঠিত হতো আনুষ্ঠানিক বিতর্কেরও। তাতে অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলো যুক্তি ও প্রতিযুক্তির কুশলী অবতারণা করত।
প্রাচীন মিসরীয়রা নিজেদের জন্য লিপি আবিষ্কার করেছিল, আর সে কারণেই তাদের সাহিত্যের লিখিত রূপের নিদর্শন তুলনামূলকভাবে সুলভ। এই লিখিত সাহিত্য প্রধানত ফারাওদের শাসন আমল থেকেই বিকশিত হতে থাকে। রাজা-বাদশার সমাধিতে নানারকম বাণী ও তথ্য রাখার প্রয়োজনেই লিপির বিকাশ ঘটে বলে ধারণা করা হয়। মৃত ও সমাহিত রাজার জীবনকাহিনী লিখিত থাকত এসব সমাধিতে। আত্মজীবনীর আদলে রচিত এই সাহিত্য সমাধি-জীবনী নামেও অভিহিত হতে পারে। এ ধরনের সমাধি-জীবনী (টম্ব অটোবায়াগ্রাফি) যারা লিখেছেন তাদের মধ্যে হারকহুফ ও ওয়েন প্রমুখের নাম বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য।
এর পরে যে আঙ্গিকের দেখা মেলে তার নাম ‘সেবাইত’ বা ‘শিক্ষামূলক নির্দেশনা’। মহত্ ব্যক্তি ও শিক্ষকদের অবশ্যপালনীয় আদেশ-নির্দেশ জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করার জন্য এই আঙ্গিকের সৃষ্টি ও বিস্তৃতি। এই ধরনের সাহিত্যের একটি বড় উদাহরণ ‘ইপুয়্যার প্যাপিরাস’। এটি বিলাপের ভঙ্গিতে রচিত, এর মূল কাহিনী প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও সামাজিক উত্থান-পতন। ঘটনার কারণ ও তার প্রতিকারের জন্য মানুষের করণীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলীও এখানে আছে। এই আঙ্গিক কালে কালে আরও বিকশিত হতে থাকে এবং তারই ধারাবাহিকতায় প্রাচীন মিসরীয় সাহিত্যের মধ্যপাদের ধ্রুপদী নিদর্শন ‘সিনুহে’ রচিত হয়। এই সময়ে আরও রচিত হয় ওয়েস্টকার প্যাপিরাস। এতে রাজা খুফু ও তার সন্তানদের কথোপকথন বিবৃত আছে। পুরোহিতরা কীসব অলৌকিক ও আশ্চর্যজনক ঘটনার অবতারণা করতে পারে, তারই বিবরণ আছে সংলাপের ভঙ্গিতে। এই সাহিত্য কাঠামোগত দিক থেকে নাট্যসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত।
নবপর্যায়ে যখন নতুন রাজাদের আগমন ঘটে, তখন সাহিত্যের প্রকরণও পাল্টে যেতে থাকে। এই সময়ে লিখিত হয় ওয়েনামুন সম্পর্কিত কাহিনী বা গল্প। সিডার জাতীয় চিরহরিত্ বৃক্ষের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে এক অসীম সাহসী যোদ্ধা। বংশে সে অভিজাত। তার গন্তব্য সুদূর লেবানন। কিন্তু যেতে যেতে পথ হারিয়ে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে সে। তারপর শুরু হয় তার মিসরে ফিরে আসার সংগ্রাম। সে কাহিনী যেমন লোমহর্ষক, তেমনি বীরত্বব্যঞ্জক। ফিরে এসে সে দেখে, তার দেখে যাওয়া অবিভক্ত স্বদেশ আর অবশিষ্ট নেই। বিভক্ত মিসরের নানা ভূখণ্ড নানা রাজার শাসনাধীন। অর্থাত্ শুরু হয়েছে প্রাচীন মিসরীয় শাসনামলের তৃতীয় পর্যায়। সাহিত্যের এসব নিদর্শনের অধিকাংশই আবিষ্কৃত হয়েছে বিভিন্ন সমাধি-গ্রন্থাগারে। তেমনি এক প্রাচীন সমাধি-গ্রন্থাগারের ওপর লিখিত রয়েছে—‘স্ক্রাইব’ বা অনুলেখক কথাটি। ধারণা করা হয়, এই সমাধিতে যিনি শুয়ে আছেন তিনি মিসরের চতুর্থ রাজবংশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, যার কাজ ছিল যাবতীয় ঘটনার বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা এবং প্রাপ্ত অন্যসব লিখিত বিবরণী সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা। হয়তো এটিই মিসরীয় সাহিত্যের আদি সংরক্ষণাগার।
লেখক : কবি; প্রফেসর; সভাপতি, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব
No comments