দারাদের রবীন্দ্র-দরদ by শরিফুল হাসান
দারাদ আহমেদকে এখন সবাই চেনে। তিনি আমাদের প্রতারণার গুরু। মসজিদের ছবিকে জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বলে চালিয়ে দিয়ে তিনি পকেটে পুরেছেন ছয় কোটি টাকারও বেশি। জাল সনদ দিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন তিনি স্বপ্ন দেখেন—নেতা হবেন, মন্ত্রী হবেন।
কামেল লোক তিনি। চলুন, আগামী দিনের বাংলাদেশের রাজনীতির উজ্জ্বল, সম্ভাবনাময় এই নায়কের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিই। রসিয়ে রসিয়ে তার গল্প শুনি। তিনিই তো আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস!]
নাম ছিল তাঁর মফিজ। কিন্তু ছোটবেলাতেই তিনি বুঝতে পারেন, নামটি একটু কেমন সেকেলে। তাই বুদ্ধি হওয়ার পরই নিজের নাম বদলে একটা আধুনিক নাম নেন তিনি। স্কুলের লেখাপড়ার গণ্ডি শেষ করতে পারেননি, তাতে, নিজেকে উচ্চশিক্ষিত ভাবতে দোষ আছে? এই দুনিয়ার কতজনই তো লেখাপড়া না করে বড় হয়েছেন। আমাদের নায়কও বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। এ স্বপ্ন তো দোষের কিছু নয়।
কিন্তু দেশে থেকে বড় হওয়া যায় না। কালচারাল লাইনে বড় হতে গেলে শান্তিনিকেতনের চেয়ে ভালো প্রতিষ্ঠান আর হয় না। কিন্তু কী মুশকিল! শান্তিনিকেতন দেখি আবার স্কুল-কলেজ পাসের সার্টিফিকেট চায়। কিন্তু চিন্তা কী, নীলক্ষেত আছে না! বানানো হলো জাল সনদ। আর সনদ যখন বানানোই হবে, তখন যেই-সেই প্রতিষ্ঠানের বানিয়ে লাভ কী? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ বানানো হলো। আর যেহেতু তিনি মেধাবী মানুষ, তাই সনদে লিখলেন, ‘প্রথম শ্রেণী’। উচ্চমাধ্যমিকের সনদও বানানো হলো। কিন্তু যে লোকটি সনদ বানাল, সে লোকটি তো আর মেধাবী না। না বুঝেই অনার্স আর উচ্চমাধ্যমিকের সনদ একই বছরের লিখে দিল। ফলে প্রথম বাঙালি মুসলিম হিসেবে দারাদ আহমেদ উচ্চমাধ্যমিক আর অনার্স পাস করলেন একই সালে।
আমাদের মেধাবী দারাদ সাহেব সেই জাল সনদেই ভর্তি হয়ে গেলেন বিশ্বভারতীতে। পতিদের বশে আনতে স্ত্রীদের বিকল্প নেই, সেটা তিনি জানতেন। তাই তিনি দেশ থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন জামদানি শাড়ি। মাঝে মাঝেই উপহার হিসেবে স্যারদের স্ত্রীদের তিনি শাড়ি দিতেন। ম্যাডাম ঠিক তো স্যার ঠিক। উপাচার্য, অধ্যক্ষ—সব তাঁর বাগে। আহা, কী বুদ্ধি!
কেবল স্যারদের বউদের ঠিক রাখলে হবে? বান্ধবী, বিদেশি বন্ধুদেরও তো পটাতে হবে। অবশেষে এল নতুন আইডিয়া। দারাদ মৌলভীবাজারের ছেলে। সেখানে কত চা-বাগান, সব ‘টি এস্টেটের’ মালিক তো তিনি নিজেই। গল্প ছড়িয়ে গেল চারদিক, দেশে তাঁর বিশাল বিশাল চা-বাগান। চায়ের সে কী টেস্ট, আহা! সবাই তাঁর চা-বাগানের গল্পে মুগ্ধ।
অল্প দিনেই শান্তিনিকেতনের এই বুদ্ধির রাজার ভিআইপি রুম জুটল। কিন্তু লেখাপড়া আর পরীক্ষায় ভীষণ ভয় তাঁর। রবীন্দ্রনাথ তো দেখিয়ে গেছেন, স্কুল ফাঁকি দিতে অসুস্থ হতে হয়। জ্বর বানাতে হয়। তাঁকেও এখন অসুস্থ হতে হবে। স্কুলে না হয় জ্বর দিয়ে চলে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় একটু বড় অসুখ না হলে কীভাবে হয়? ‘ব্লাড ক্যানসার’ শুনতে বেশ লাগে! তাই রক্তে তিনি বাসা বাঁধালেন ক্যানসারের। ফলও পেলেন হাতেনাতে। পরীক্ষা এলেই রক্ত বদলাতে চলে যান নানা জায়গায়।
এর মধ্যেই বিশ্বভারতীতে এলেন এক জাপানি। সবাই তাঁকে সমীহ করে। তিনি আবার বাংলাও বলেন। খোঁজ নিয়ে আমাদের গল্পের নায়ক জানলেন, এই জাপানি নাকি অনেক বড় রবীন্দ্রপ্রেমী। অনেক বড় গবেষক। জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি তিনি রবীন্দ্রনাথ পড়ান। বিশ্বভারতীতে জাপান-ভারত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র করেছেন।
বড় হওয়ার বুদ্ধি খোঁজেন আমাদের নায়ক। মনে মনে হাসেন। জাপানি ব্যাটা রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসেন! আমিও তো রবীন্দ্রনাথকে অনেক ভালোবাসি। এঁর সঙ্গে তো খাতির করতেই হয়। কয়েক দিনের মধ্যে হলোও খাতির। জাল ফেললেন দারাদ—বাংলাদেশেও একটা কিছু করুন। বাংলাদেশের প্রতি বর্গইঞ্চি জায়গা রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসে। জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র করার স্বপ্ন ছিল বোকা জাপানি অধ্যাপকের। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের সব দায়িত্ব নিজ স্কন্ধে তুলে নেওয়ার বাসনা জানালেন দারাদ। কিন্তু কোথায় হবে এই কেন্দ্র? আবার আইডিয়া। রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর। গ্রামে যেতে হবে। সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হবে দারাদের ‘টি এস্টেটের’ কোল ঘেঁষে।
এর মধ্যেই ঘটে ছোটখাটো বিপত্তি। ঘরের শত্রু বিভীষণ। বাঙালির নাকি নরকে প্রহরীর প্রয়োজন হয় না। দেশি ভাইয়েরাই গোমর ফাঁস করে দিল আমাদের নায়কের। এক মক্কেলকে দেশ থেকে তিনি নিয়ে এসেছিলেন বিশ্বভারতীতে। ভর্তির কোনো খরচ না লাগলেও নিয়েছিলেন লাখ টাকা। বোকা ছেলেটাকে তিনি ক্যাম্পাস থেকে দূরের একটি বাসায় রেখে বেড়াতে গিয়েছিলেন দার্জিলিং। বলেছিলেন, দু-তিন দিনের মধ্যে আসবেন। কিন্তু দার্জিলিংয়ের প্রকৃতি বলে কথা! সেখানকার রূপসুধা উপভোগ করে আসতে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। এর মধ্যে বোকা ছেলেটা তাঁর খোঁজ না পেয়ে হোস্টেলে গিয়ে দেশি ভাইদের খুঁজে বের করল। বেরিয়ে পড়ল থলের বিড়াল—জাল সনদ, নানা নামে পাসপোর্ট। না! একজনের উন্নতি আরেকজনের আসলেই সহ্য হয় না। দেশিগুলো কখনোই স্বদেশির ভালো চায় না। তাই সবাই মিলে জোর করে মুচলেকার বিনিময়ে নায়ককে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিল।
এখন কী হবে? ভরসা এখন ওই জাপানি। বোকা লোকটা বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কিছু একটা করার স্বপ্নে বিভোর। তাঁকেই গুটি বানাতে হবে। জাপান গিয়ে আবারও সেই প্রস্তাব—চলেন, কিছু একটা করি। কথায় কাজ হয়। বুড়োটা মরার আগে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চান। তাই টাকা এনে তুলে দেন আমাদের নায়কের হাতে। বছর বছর চলে টাকা দেওয়া। টাকার অঙ্ক কোটিতে পৌঁছায়। ভালোই চলে নায়কের জীবন। নানা জায়গায় টাকা ওড়ান। স্বাদ-আহ্লাদ পূরণ করেন। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এর মধ্যেই জাপানিটা জানতে চান, ভবনের কী অবস্থা।
বিপদে পড়েন নায়ক। আবারও আইডিয়া আসে। বাড়ির সামনের মসজিদটা তো হেভি সুন্দর! এটার ছবি পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়? ছবি পাঠানো হয়। দ্রুত ভবনের কজ চলছে। আবার টাকা আসে। এত টাকা! কোটিপতি হয়ে আমাদের নায়কের মনে হয়, এলাকার মানুষের সেবা করার কথা ভাবতে হবে।
আইডিয়া। হুম্ম, সামনে নির্বাচন। এমপি হতে হবে। আমাদের নায়কের যে যোগ্যতা, তাতে তাঁর এমপি হওয়া ঠেকাবে কে? আমাদের নায়ক মসজিদ বেঁচে দেন, তাঁকেই তো জাতির দরকার। নমিনেশন কেনা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাত ফসকে যায়। তবে এলাকার রাজনৈতিক নেতার পদ মেলে। কেন্দ্রে পদ মেলে। রাজনীতি ভালোই চলে। আবার স্বপ্ন দেখতে থাকেন তিনি।
সব ভালোই চলছিল। কিন্তু কিছুদিন ধরে নতুন যন্ত্রণা হয়েছে। জাপানিটা খুব ডিস্টার্ব করছেন। খালি জানতে চান, কবে ভবনের উদ্বোধন হবে। আরে, ভবন উদ্বোধন কি সোজা কথা? এবার নতুন আইডিয়া। আমাদের নায়ক দেশের রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীকেও বেঁচে দেন। চিঠি লেখেন জাপানে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়েছে। মাঝেমধ্যেই দেখা হয়। প্রধানমন্ত্রী ব্যস্ত। সময় দিলেই উদ্বোধন হবে।
কিন্তু উদ্বোধনের সময় হয় না। আবার চিঠি আসে জাপানির। এ তো দেখি মহা যন্ত্রণা! যোগাযোগ বন্ধ না করা ছাড়া উপায় দেখেন না নায়ক। এর মধ্যেই ঘটে যায় বিপত্তি। বোকা জাপানিটা সেখানকার এক প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিককে সব বলেন।
জাপান-প্রবাসী সাংবাদিকের খবর শুনেও নিশ্চিন্তে থাকেন আমাদের নায়ক। কারণ, মসজিদ বিক্রি করে দেওয়ার কাহিনি তো আর কেউ জানে না। কিন্তু নায়কের ভাগ্য প্রসন্ন নয়। কীভাবে কীভাবে যেন এক খুদে সাংবাদিক সব জেনে যায়।
বিপদের গন্ধ পান নায়ক। কারা নাকি তাঁর বাড়ির সামনের মসজিদের ছবিও নিয়ে গেছে। উপায়! এর মধ্যেই নায়ক খোঁজ পান, পত্রিকায় তাঁর নিউজ এসেছে। হায়! এলাকার লোকজন জেনে ফেললে সামনে ভোট চাইবেন কীভাবে? আবার আইডিয়া। অতঃপর পত্রিকা গায়েব। এরপর তিনিও গায়েব। এবার সংস্কৃতির পুণ্যভূমি ফ্রান্স সফরের কথা ভাবছেন। হয়তোবা শুধু দেশের জিনিসই ক্রয়-বিক্রয় নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিস্তার ঘটাবেন তার কর্মকাণ্ড। বিক্রি করবেন আইফেল টাওয়ার, তাজমহল, বিগ বেন। চাই কি আমাদের বঙ্গোপসাগরটাও বিক্রি করে দিতে পারেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বাসার সামনে আইনের লোক। কয়েক দিনের জন্য জেলে যান নায়ক। মনকে সান্ত্বনা দেন—জেলে গেছেন, তার মানে এমপি-মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন বেশি দূরে না। খালি একটি রাজনীতি করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ যেন কী বলেছিলেন? মনে করার চেষ্টা করেন তিনি। আশা করি, তিনি মনে
করতে পারবেন। অচিরেই তিনি ফিরে আসবেন আমাদের মাঝে। নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়ে জনগণের সেবা করার সুযোগ পাবেন।
No comments