কোপেনহেগেন সম্মেলন কি শেষ পর্যন্ত হোপেন হেগেন থেকে ব্রোকেন হেগেন by আফজাল আহমেদ
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে অসম অর্থনৈতিক উন্নয়নে জীবনধারণের মান বিবেচনায় দেশে দেশে, মানুষে মানুষে বৈষম্য ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। গরিব আরও গরিব হয়ে বিত্তহীনে পরিণত হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগের শেষ নেই।
আমাদের দেশের কথাই ধরা যাক—সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি বিশেষ করে নদী ভাঙনে সৃষ্ট পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না লাখ লাখ শোষিত মানুষ। তারা দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাতে কাজের সন্ধানে আপন ভিটেমাটি ফেলে শহরের অজানা-অনিশ্চিত পথে পা বাড়িয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। এসব মানবিক অধিকারবঞ্চিত কোটি কোটি দুর্গত মানুষের চোখের জল মুছে দিতে ব্যর্থ হয়েছে কোপেনহেগেনের জলবায়ু সম্মেলন। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার ধারকবাহক যুক্তরাষ্ট্রসহ শিল্পোন্নত দেশগুলো প্রকৃতির অনুশাসন না মেনে নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টা আর অধিক মুনাফা ও ভোগবাদী আদর্শের অপরিণামদর্শিতায় হুমকির মুখে মানব সভ্যতা, ক্ষয়িষ্ণুমানবতা মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিতে অনাগ্রহী। পরিবেশ বাঁচল কী মরল তা নিয়ে আদৌ উদ্বিগ্ন-উত্কণ্ঠিত নয় অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোর রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তাদের চিন্তা-চেতনা মনোযোগ আবর্তিত হয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত করতে অথবা বিদ্যমান হার ধরে রাখতে। প্রকৃতির সঙ্গে অর্থনীতির এ দ্বন্দ্বে কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলন হোপেন হেগেন থেকে ব্রোকেন হেগেনে পরিণত হয়েছে।
ক্ষতিকর রশ্মি থেকে পৃথিবীকে রক্ষাকারী ওজোন আজ নিজেই বিপদগ্রস্ত। বায়ুমণ্ডলে বর্ধিত কার্বনে ওজোন স্তরের গভীরতা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে কোথাও কোথাও ছিদ্র দেখা গিয়েছে। তাপমাত্রা বাড়ছে, কমছে প্রকৃতির প্রতিরোধ ক্ষমতা। সমুদ্রের পানি আগের ন্যায় কার্বন-ডাই অক্সাইড দ্রবীভূত করে আটকাতে অসমর্থ হয়ে ছেড়ে দিচ্ছে বাতাসে। হিমালয় ও মেরু অঞ্চলের বরফ এলাকা সঙ্কুচিত হওয়ার অর্থ সূর্যরশ্মি কম প্রতিফলিত হওয়া। বৈজ্ঞানিক তথ্যের চুলচেরা বিশ্লেষণে অতি সাধারণের আগ্রহ নেই। কলেরা ও ডায়রিয়ার জীবাণু শ্যাওলা আকারে পানিতে ভাসে-আইসিডিডিআরবি’র ড. সিরাজুল ইসলাম ১৯৯৪-তে সেটা আবিষ্কার করলেও আমাদের ক’জন তা জানে। তাপমাত্রা বাড়া মানে ডায়রিয়ার বংশবিস্তার, যার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় গরমকালে সুপেয় পানির অভাবে বাংলাদেশে কলেরা ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৫০ সালের ভেতর সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা ২ মিটার বেড়ে যাওয়ায় আমাদের ২০ শতাংশ জমি সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে ৩ কোটি মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়া হয়ে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। এসব কঠিন বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত নয় আমাদের হতদরিদ্ররা। আইলা, সিডর, নদীভাঙনে সর্বস্বান্ত হয়ে নদীর সীমাহীন দুর্ভোগে তাদের অস্তিত্ব নদীর মতো প্রাণহীন। পদ্মা-মেঘনা-ব্রক্ষপুত্র অববাহিকায় প্রায় ১২০০ কিলোমিটারজুড়ে ভাঙন অব্যাহত, আরও ৫০০ কিলোমিটার ভাঙার আশঙ্কায় ভীত বাংলাদেশের মানুষ। চারপাশে শুধুই অন্ধকার। সামান্য আলোর আশায় প্রকৃতি বাঁচাতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কোপেনহেগেন সম্মেলনে টু ভ্যালু, মালদ্বীপের মতো দেশ কার্বনের নিঃসরণ কমাতে বিশ্বকে আইনি বাধ্যবাধকতায় আনতে সোচ্চার থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে। আমরা অবশ্য জলবায়ু উদ্বাস্তু, অভিযোজন তহবিল এবং ক্ষতিপূরণ চাওয়ার ব্যাপারে অধিক তত্পর ছিলাম।
নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়ের দেশ হিসেবে অধিক পরিচিত নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রাণভোমরা নদী যে আজ জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তা আমরা এ মাটির সন্তানরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। নাব্যতা সঙ্গটে হাঁটুজলে অচেনা লাগে, মনে হয় ভুল করে অন্য কোথাও চলে এসেছি। মনের টানে আপন গতিতে ক্লান্তহীন বয়ে চলা সেই সব চিরচেনা নদী আস্তে-ধীরে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব মতে, ইতোমধ্যেই পঁচিশটি নদী, শাখা নদী ও উপনদী মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে, চল্লিশটির মতো শুকনো মৌসুমে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। একাত্তরে আমাদের নৌপথ চব্বিশ হাজার কিলোমিটার থাকলেও বর্তমানে তা আট হাজার কিলোমিটার, শীতকালে যা মাত্র তিন হাজার কিলোমিটার। তার জন্য আমাদের মুষ্টিমেয় মানুষের হিংস্র লোভী আচরণে নদী দখল ও দূষণ কম দায়ী নয়। তবে উজানে ভারত কর্তৃক পানি প্রত্যাহারই যে অন্যতম কারণ,
সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফারাক্কা ব্যারেজের কথাই ধরা যাক। গঙ্গা নদী আন্তর্জাতিক নদী হওয়ায় আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী এ নদীর পানির ওপর বাংলাদেশের সমান অধিকার থাকার কথা। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা সে কথা কি বলে? শস্য-শ্যামলা সবুজে ঘেরা আমার সোনার বাংলার প্রমত্ত পদ্মা এখন শুধু ধু ধু বালুচর। পত্রিকার খবর অনুযায়ী পদ্মা রাজশাহী শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে সরে গেছে। শুকনো মৌসুমে সেচের জন্য প্রচুর পরিমাণে পানি সরিয়ে নেয়ার ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ায় পদ্মা ও তার অববাহিকায় দেখা দিয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। শুষ্ক মৌসুমে উদ্বেগজনক হারে পদ্মার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে উপকূলীয় নদীগুলোয় বাড়ছে লবণাক্ততা। আর এ লবণাক্ততা বাড়ায় নদীর পানির পলি পরিবহন ক্ষমতা কমে যাওয়ায় নদী ভরাট হয়ে নদীর পানির ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে, যার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় বন্যার স্থায়িত্ব বাড়ছে। ভূগর্ভের পানির অত্যধিক ব্যবহারে পানির স্তর দ্রুতগতিতে কমছে, বাড়ছে আর্সেনিক সমস্যা। বৃষ্টির তুলনায় বেশি পানি বাষ্প হওয়ায় মাটির আর্দ্রতা কমে যাচ্ছে। উত্তরবঙ্গে খরায় পানির অভাবে জমি হারাচ্ছে তার উর্বরতা। মেঘনা অববাহিকায় প্রায় চার হাজার বর্গকিলোমিটার জমি ভারত থেকে আসা ঢলে প্লাবিত হয়ে পড়ে। বিপন্ন কৃষি ও মত্স্য সম্পদ। এরই মধ্যে অনেক প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে, মারাত্মক হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য। বিনষ্ট নৌ-পরিবহন। শুকনো মৌসুমে তীব্র পানি সঙ্কট থাকলেও বর্ষাকালে থৈ থৈ পানিতে ভয়াবহ বন্যায় ভাসিয়ে নেয় জনপদ। প্রতিকূল পরিবেশে জীবন-জীবিকার লড়াই কঠিন হয়ে সংস্কৃতি হারাচ্ছে নিজস্ব স্বকীয়তা।
টিপাইমুখে ভারতের অতি বড় বাঁধ নির্মাণের প্রচেষ্টা জনগণের ভেতর এক ধরনের আতংক সৃষ্টি করেছে। বড় বাঁধ মানে বড় বিপদ—মিডিয়ার কল্যাণে অনেকেই জানে। টিপাইমুখ বাঁধ পরিবেশবান্ধব না পরিবেশবিরোধী সে নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। আমাদের লাভ-ক্ষতি বিবেচনায় না রেখে নির্দ্বিধায় বলা যায়, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মিত হলে ভারতেই ২৭ হাজার হেক্টরের বেশি ভূমি বিনষ্ট হতে পারে, তলিয়ে যেতে পারে ২৮৮.৬ বর্গকিলোমিটার এলাকাসহ অনেক ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থান। এ বাঁধ নিয়ে ভারত আমাদের মৌখিক আশ্বাস দিয়েছে যে, তারা এমন কিছু করবে না যা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হয়। এ আশ্বাসে অবিশ্বাস করার কিছু নেই, তবে পাশাপাশি মনে রাখা দরকার ফারাক্কা ব্যারেজের ক্ষেত্রেও তারা এমনই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ছিয়াত্তরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে তারা দাবি করেছিল ফারাক্কা ব্যারেজে বাংলাদেশের কিছু সুবিধা হবে। কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে। পরিবেশ বাঁচাতে ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশের রাজনীতিবিদরা রাজনীতি নয় সম্মিলিতভাবে কাজ করবেন—এ প্রত্যাশায় দেশের মানুষ।
লেখক : প্রকৌশলী ও কলাম লেখক
No comments