শিক্ষাঙ্গন-অ-নীতি চর্চা ও পাঠদানের মানহীনতা

শিক্ষাদান পেশায় জড়িত যাঁরাই মনে-মননে ও নীতি-নৈতিকতায় শিক্ষকসত্তার অধিকারী তাঁদের জন্য বর্তমান সময়টি নানা কারণেই বেদনার, বিব্রতবোধের এবং অস্বীকার করার উপায় নেই যে হতাশারও বটে। সাম্প্রতিককালের দৈনিক পত্রিকাগুলোর অনেকগুলো খবরের কয়েকটি এ রকম: ক) শিক্ষক ছাত্র অপহরণের এবং মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টার সঙ্গে


জড়িত এবং সহযোগীসমেত অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার। খ) প্রশ্নপত্র ফাঁস ও বিক্রয়ের দায়ে শিক্ষক ধৃত। গ) অধ্যক্ষকে পাশ কাটিয়ে সহকারী অধ্যক্ষের আবেদনপত্রে সই। ঘ) সব শিক্ষক অনুপস্থিত, বিদ্যালয় ছুটি দিয়ে দিলেন ঝাড়ুদার। ঙ) এক বিদ্যালয়ে দুই প্রধান শিক্ষক। চ) শিক্ষকদের ভুলে অনিশ্চিত ৬৭ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ। ছ) শিক্ষক কর্তৃক বিনা মূল্যের বই বিক্রি। জ) প্রাইভেট না পড়ায় লাঠিপেটা। ঝ) শিক্ষকদের ভর্তি-বাণিজ্য। ঞ) শিক্ষকদের ভুলে ৯৭ জন ছাত্রের স্বপ্নভঙ্গ। ট) মাদ্রাসা সুপারের সনদ জাল। ঠ) বিদ্যালয় থেকে বেতন নেন পাঠদান করেন কলেজে। ড) ধর্ষক ও ছাত্রী নিপীড়নকারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীর মামলা, বিচার দাবি, মানববন্ধন, অভিযোগ, শাস্তি ইত্যাদি। ঢ) মাদ্রাসা শিক্ষক কর্তৃক ছাত্র যৌন-নির্যাতিত। ণ) শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীর অশ্লীল ভিডিও প্রচার। ত) বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ছাত্রীকে ধর্ষণ, দুই শিক্ষক আটক ইত্যাদি। ভিকারুননিসা কলেজ-সংক্রান্ত সাম্প্রতিক সংবাদ শিরোনামসমূহ বাদ দিলেও এ তালিকা শুধু দীর্ঘ হতে দীর্ঘতরই হবে। একজন প্রকৃত সৎ ও নীতিবান শিক্ষকের অনুভূতিটি এই দুর্যোগাচ্ছন্ন শিক্ষকসময়ে স্বভাবতই অনুশোচনার, আক্ষেপের ও লজ্জার।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে আরও কয়েকটি অসুখ মহামারির আকার নিয়েছে। এর দু-একটি হচ্ছে উন্নয়ন ফির নামে শিক্ষার্থী-অভিভাবকের অর্থ লুণ্ঠন এবং প্রাইভেট পাঠদান ও কোচিং সেন্টারভিত্তিক শিক্ষাগ্রহণে বাধ্যকরণ। বিদ্যালয়কেন্দ্রিক ‘করপোরাল পানিশমেন্ট’ বা ছাত্রছাত্রীদের প্রতি নির্দয় ও নিষ্ঠুর শারীরিক নির্যাতন এবং ফলস্বরূপ শিক্ষার্থীর মৃত্যুবরণ বা পঙ্গুত্ববরণ ও মানসিক স্বাস্থ্য-বিপর্যয়ের খবর দেখছি প্রতিদিনের সংবাদপত্রের পাতায়। ইউনিসেফের ২০০৯ সালের জরিপে উল্লেখ করা হয়েছিল, ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থীই বিদ্যালয়ভিত্তিক শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে শিক্ষকেরাই এসব অনাচারের জন্য দায়ী। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ১৯, ২৮ ও ৩৭ অনুচ্ছেদত্রয় বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের ২ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর ঘোষিত হয়েছে। এ ধারার বিচারে শিশু অধিকার বয়স্ক অধিকারের মতোই। আত্মমর্যাদার এবং শারীরিক নিরাপত্তার অধিকারপ্রাপ্তিতে বয়স্ক-অপ্রাপ্তবয়স্কের ভেদ নেই এবং শারীরিক-মানসিকভাবে অমর্যাদাকর ও অবদমনমূলক প্রক্রিয়ায় শিশুদের শৃঙ্খলায়ন সর্বৈব অগ্রহণযোগ্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ২০০৬ সালে একবার প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয়গুলোতে ‘করপোরাল পানিশমেন্ট’ বন্ধে প্রজ্ঞাপন পাঠানো হয়েছিল। ২০১২ সালের ১৩ জানুয়ারি থেকে কার্যকর ঘোষিত আরেকটি পরিপত্রে পুনরায় বিদ্যালয়ভিত্তিক নির্যাতনমূলক শৃঙ্খলায়ন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সমস্যার কথা হচ্ছে কতজন শিক্ষক এসব নির্দেশনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল? বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক-মানসিক আঘাত ব্যতীত শিক্ষাদান যে সম্ভব— কতজন এ বিষয়ে সচেতন? শিক্ষকেরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকেও এ বিষয়ে কার্যকর কোনো চাপ অনুভব করেন কি না তাও সন্দেহ। তবে কি রাষ্ট্রপক্ষ নিজেই বিধিবিধানগুলো কার্যকর করা অসম্ভব মনে করছে? শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকৌশল-রণকৌশল বা প্রায়োগিক নীতিমালার অপর্যাপ্ততাও মোটা দাগে চোখে পড়ার মতো। অথচ ১৯৯৫ সাল থেকেই সেভ দ্য চিলড্রেন, ইউনিসেফ এবং বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। ১৯৯৫ সালের এপ্রিলে ত্রিপক্ষীয় একটি জরিপের পত্রও প্রকাশিত হয়েছিল। এতকিছুর পরও বেশির ভাগ শিক্ষকই বিষয়টিকে একটি ‘না-বিষয়’ বা ‘অ-বিষয়’ মনে করেন কেন? তবে কি শিক্ষক নির্মাণকৌশলের শরষের ভেতরের ভূতটির বিতাড়িত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই?
এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের কী উপায়? আমরা মনে করি, এক. রাজনীতিদুষ্ট ব্যবস্থাপনা হতে শিক্ষার শৃঙ্খলমুক্তি অত্যাবশ্যক। এ জন্য প্রথম উদ্যোগটিই হতে হবে বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নিয়োগদান আইনপূর্বক বন্ধ করা। গবেষণার বরাতে জানা গেছে, সারা বাংলাদেশের বিদ্যালয় ও কলেজসমূহে গভর্নিং বডির ৬২ শতাংশ সদস্যই সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং রাজনীতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত। দুই. শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার যথেচ্ছ বাণিজ্যিকীকরণ রোধ করা না যাক, আপাতত শক্ত হাতে লাগাম টেনে ধরার জন্য শক্তিশালী কেন্দ্রীয় পর্যায়ের মনিটরিং এবং পর্যায়ক্রমিকভাবে অনৈতিকতা নিয়ন্ত্রণমূলক ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ হাতে নেওয়া প্রয়োজন। তিন. শিক্ষক-প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনায় মারাত্মক গলদ না থাকলে নীতি-নৈতিকতার বিচ্যুতি এমনতর সর্বনাশা রূপ নিত না, কাজেই প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। চার. শিক্ষাদানের নৈতিকতা, মিথস্ক্রিয়াভিমুখী কলাকৌশল এবং সাম্প্রতিকতম শিক্ষা-প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রায়োগিক শিক্ষাদানে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। চলতি সময়ের নীতিহীনতা সম্পর্কিত ঘটনাবলি এই সত্যটিও নির্দেশ করে যে দেশের ১১৪টি শিক্ষক প্রশিক্ষণকেন্দ্র শিক্ষক-নৈতিকতা সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ বিষয়ে অনতিবিলম্বে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের অন্য কোনো বিকল্পও নেই। পাশাপাশি নিবিড় ও মূল্যায়নধর্মী বাধ্যতামূলক ‘শিক্ষক প্রশিক্ষণ’ এবং ‘শিক্ষকতার নৈতিকতা’বিষয়ক একটি নতুন ও অতিরিক্ত কোর্স অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও। পাঁচ. শিক্ষাব্যবস্থার সকল পর্যায়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগকে একটি অত্যাবশ্যকীয় উপায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ছয়. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা শিক্ষকদের সক্ষমতা মূল্যায়ন নিশ্চিতকরণ জরুরি। এ চর্চা পৃথিবীর তাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক পাঠক্রমের একটি অবধারিত অঙ্গ। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ চর্চার অনুপস্থিতি শিক্ষকদের দায়বদ্ধতার অনুপস্থিতিরও একটি বড় কারণ। শিক্ষকদের পাঠদানের মানহীনতা এবং অনীতি-চর্চার পেছনেও সম্ভবত এ কারণটিকে সমভাবে দায়ী করা যেতে পারে।
এই প্রসঙ্গগুলো আরও গভীরতর আলোচনা-পর্যালোচনার দাবি রাখে। তবে তারচেয়ে বেশি প্রয়োজন ‘অ্যাকটিভিজম’-এর। সরাসরি হাতে-কলমে, গা-গতরে সক্রিয় আন্দোলনের। দরকার একটি সমন্বিত ঐক্যবদ্ধ সামাজিক আন্দোলনের। শুধু কথার ফুলঝুরিতে সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব নয়।
 লেখকেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.