সদরে অন্দরে-স্বাস্থ্যনীতির পাশাপাশি সুস্থ মানসিকতাও চাই by মোস্তফা হোসেইন

টেলিভিশনের ক্যামেরা যায় হাসপাতালের বিছানায়। রোগী আর ইয়া বড় কালো বিড়াল মিলেমিশে শুয়ে আছে এক জায়গায়। রোগীর হাতে স্যালাইনের সুই, বিছানায় পাশে পড়ে আছে পাউরুটির থাল। হয়তো রোগীর অ্যাটেনডেন্ট কেউ খেতে খেতে রেখে গেছে আধছোলা কলাসহ। সেখানেই মাছি ভন ভন করছে গণ্ডাকয়েক।


এটা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের একটি চিত্র। বাংলাদেশের একটি সরকারি হাসপাতালের। কয়েক দিন আগে প্রচারিত। এটা বিদেশি টেলিভিশনে প্রচারিত চিত্র মাত্র। কিন্তু নিজের চোখে দেখা বিভিন্ন ক্লিনিক ও হাসপাতালের চিত্রগুলোর কথা লিখতে গেলে স্থান দেওয়া হবে কঠিন। দু-একটি এখানে উল্লেখ্য। প্রথম চিত্র_ঢাকার গ্রিন রোডে বড় দুই ক্লিনিকের মাঝামাঝি জায়গায় একটি ক্লিনিকের অবস্থান। ভেতরে যদি কেউ ঢোকেন তাহলে মাথা ঘুরবে নিশ্চিত। মানুষ বসতির অযোগ্য একটি ঘিঞ্জি বাড়িতে ক্লিনিকের ব্যবসা করার অনুমতি পায় কিভাবে_যে কারো মনেই এ প্রশ্ন আসতে পারে। প্লাস্টিকের কৌটা, পলিথিন ব্যাগ ইত্যাদি মাড়িয়ে ভেতরে গেলে দেখা যাবে, রান্নাঘরের নেটের বেড়াও অক্ষত আছে সেই ওয়ার্ডের। ওখানেই পাতা হয়েছে কয়েকটি বিছানা। প্যাডেস্ট্যাল ফ্যান দিয়ে ঘর ঠাণ্ডা করার চেষ্টা চলছে ঘর-ঘরর শব্দের মাঝে। ভ্যাপসা গরম, নোংরা পরিবেশ। এটা কিছুদিন আগের ঘটনা।
দ্বিতীয় চিত্র_মগবাজারের একটি ক্লিনিকের বারান্দায় ডাবের খোসা, ওষুধের খালি বোতল, স্যালাইনের খালি সুই ও ব্যাগ দেখেও কারো নজর যায় না সেদিকে। কারণ যে রোগীটিই সেখানে ভর্তি হয়েছে, তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আছে কি না সেই চিন্তায় অস্থির থাকে রোগীর স্বজনরা। তৃতীয় চিত্র_গ্রিন রোডের বড় একটি ক্লিনিকে কলনোস্কপি করাতে গিয়ে কয়েকবার স্যাম্পল নেওয়ার পরও বায়োপসি পরীক্ষা করাতে পারেননি এক রোগী। কারণ আর কিছুই নয়, যিনি স্যাম্পল সংগ্রহ করবেন, তাঁর পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা নেই। এটা কয়েক বছর আগের ঘটনা হলেও এই নিবন্ধকারের অভিজ্ঞতা হয়েছিল নিজ মায়ের কলনোস্কপি করাতে গিয়ে। ৮০ বছরের এক বৃদ্ধাকে এই কষ্ট দেওয়ার পরও কি সেই ডাক্তারের বোধশক্তি জেগে উঠেছিল? জানি না, সেই চিকিৎসক আর কতজন মাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে বলেছেন_দুঃখিত, আসলে মেশিনটা বিট্রে করেছিল এখানকার। এখনো তিনি সেভাবেই কলনোস্কপি করিয়ে যাচ্ছেন কি না জানি না। এই নিবন্ধ লেখার আগের রাতে খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার একটি ক্লিনিকে চিকিৎসকের কাছে ফি দিতে গিয়ে চোখ ছানাবড়া। বছরতিনেক আগেও এই চিকিৎসক ফি নিতেন ২০০ টাকা করে। এবার নিলেন ৫০০ টাকা। ওয়েটিং রুমে প্রায় অর্ধশত রোগিণীর একজনের অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসব হবে। রোগিণীর সঙ্গে আসা একজন চিৎকার করে বলছেন_এ কেমন কথা, তাহলে সিজার করিয়ে নিতে কি ৫০ হাজার টাকা খসে যাবে? যাবে না কেন? সঙ্গে যাওয়া নিবন্ধকারের স্ত্রীর জবাব_তাঁর নিজের প্রয়োজনীয় এনজিলক-৫০ ট্যাবলেট এক পাতা সপ্তাহকাল আগে কিনেছেন ৬০ টাকায়, এখন কিনতে হয়েছে ৮০ টাকায়। সপ্তাহকালের মধ্যে যদি এত দাম বাড়তে পারে, তাহলে কয়েক বছরে দ্বিগুণ-তিনগুণ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। ওষুধের আকাশছোঁয়া এবং অযৌক্তিক দাম নিয়ে কালের কণ্ঠে সম্প্রতি প্রকাশিত সংবাদ পড়লে যে কাউকে আঁতকে উঠতে হবে। ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাব_তারা দাম বাড়ায়নি। শুধু ডলারের দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন ব্যয়ের সমন্বয় ঘটিয়েছেন মাত্র। জানি না, তাদের এই বক্তব্য কতটা গ্রহণীয়। ডলারের দাম বাড়ার কারণে মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হলেও ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ দাম বাড়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। পৃথিবীর কোনো দেশে জীবনরক্ষাকারী কোনো ওষুধের দাম একবারে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব কি না এ তথ্য জানা নেই। এখন তো ডলারের দাম কিছুটা কমেছে। কিংবা আরো যখন দাম কমবে, তখন কি ওষুধের দাম তারা কমিয়ে আনবেন? এগুলো উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় কতটা অরাজক অবস্থা চলছে এই দেশে, তার কিছু প্রমাণ দেওয়া। অথচ আমাদের দেশে প্রতিটি রাজনৈতিক দল কিংবা জোট নির্বাচনের সময় জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে_তারা সংবিধানে উলি্লখিত বিধান মেনে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় নিয়োজিত থাকবে এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে। বর্তমান সরকারি দলও তেমনি করেছিল।
সেই লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রণীত হয় জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১, যা সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বিল আকারে উত্থাপিত হয়েছে। চিকিৎসাকে নাগরিকের অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই নীতি প্রণীত হয়েছে বলা হচ্ছে। নাগরিকের অধিকার হিসেবে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার দাবি বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসালয়গুলোকে সেবার মানসিকতা নিয়ে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। কিন্তু এখানে যেভাবে মুনাফালোভী মানসিকতার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়, সেখানে তা কি শুধু স্বাস্থ্যনীতি দিয়ে বদলানো যাবে? স্বাস্থ্যনীতির খসড়া সম্পর্কে বলা হয়েছে, পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর জন্য মানসম্পন্ন ও সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে হলে চিকিৎসকদের গ্রামমুখী করার কোনো বিকল্প নেই। অথচ কোনো সরকারই চিকিৎসকদের গ্রামমুখী করতে পারেনি। বরং তাঁদের গ্রামে জোর করে পাঠানোর পর বিপরীত ফলই পাওয়া গেছে। শহর থেকে গ্রামে ওই সব চিকিৎসককেই পাঠানো হয়ে থাকে, যাঁদের রাজনৈতিক অবস্থান ভিন্নধর্মী। এমন অভিযোগ নিয়মিত। আজকে চিকিৎসকদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি লক্ষণীয়। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, তখন প্রতিপক্ষের চিকিৎসককে শাস্তিস্বরূপ কিংবা প্রতিশোধ গ্রহণের মাধ্যম হিসেবে গ্রামাঞ্চলে প্রেরণ করে। পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসা-সুবিধা প্রদানই যদি নীতি হয়ে থাকে, তাহলে সেখানে রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রাধান্য পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু স্বাচিপ আর ড্যাব পরিচয়ই যদি প্রধান বিবেচ্য হয়ে থাকে, তাহলে স্বাস্থ্যনীতি করে কোনো লাভ হবে বলে মনে করি না।
নতুন স্বাস্থ্যনীতিতে বলা হয়েছে, এমবিবিএস পাস করার পর দুই বছর গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে ইন্টার্নিশিপ সম্পন্ন করতে হবে। এটা কতটা বাস্তব তা ভেবে দেখতে হবে। ইন্টার্নিশিপ একজন চিকিৎসকের হাতেকলমে শিক্ষালাভের সময় হিসেবে বিবেচ্য। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে যেখানে অবকাঠামো নড়বড়ে, চিকিৎসাসেবাই যেখানে সোনার হরিণের মতো, সেখানে ইন্টার্নি করার বাধ্যবাদকতা করা হলে চিকিৎসক তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে কতটা সুফল পাওয়া যাবে, তা ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পেঁৗছে দিতে হলে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসালয়গুলোকে আধুনিক করতে হবে। গ্রামের ইন্টার্নি চিকিৎসক যদি রোগীকে চিকিৎসার জন্য শহরের হাসপাতালে রেফার করার কাজটিই করেন, তাহলে তাঁর ইন্টার্নি করার ফল তিনি পাবেন কী করে। আর আগামীতেও ভালো চিকিৎসকও তৈরি হবে কিভাবে? তাই স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের পাশাপাশি মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। চিকিৎসককে সেবার মানসিকতাও লালন করতে হবে।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.