মোবাইল ফোনে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমঃ গোদের উপর বিষফোঁড়া!


মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে সরকারের আরেকটি ডিজিটাল খাত। যে কাঁটা দিয়ে কাঁটা খোলার কথা, সে কাঁটাই এখন পায়ে বিঁধছে। এ ঘটনা ঘটছে সরকারের নেয়া ‘মোবাইল ফোনে স্বাস্থ্যসেবা’ কার্যক্রমে। চিকিত্সা ব্যবস্থাকে ডিজিটাল করতে ২০০৯ সালে সরকার এ পদক্ষেপ নিলে জনগণ আশান্বিত হয়েছিল এবং সুযোগটি লুফে নিয়েছিল।
কিন্তু বর্তমানে এ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, এ কার্যক্রমের ফলে নতুন করে ফিরে এসেছে পুরনো বিড়ম্বনা। প্রকারান্তরে মোবাইল-চিকিত্সকদের বেসরকারি হাসপাতালে রোগী পাঠানোর ব্যবসা আরও চাঙ্গা হয়েছে। আগে রোগীরা আসার পর ডাক্তাররা অন্যত্র পাঠাতেন। এখন পাঠাচ্ছেন মোবাইল ফোনে পরামর্শের মাধ্যমে।

অভিযোগ আছে, গত বছর মে মাস থেকে মোবাইলে স্বাস্থ্যসেবা দানের আট মাসের বেশি সময়েও সরকারের এ কার্যক্রম ঘোষণা অনুযায়ী প্রচার করা হচ্ছে না। ফোন নম্বরগুলোও বন্ধ থাকছে অধিকাংশ সময়। ফলে স্বভাবতই রোগীদের বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত হলেও কার্যক্রমের মহাপরিচালক জানিয়েছেন, তারা এখনও অভিযোগ পাননি। তবে কর্মসূচি ঠিকমত চলছে কিনা তা তদন্ত করা হবে শিগগির। এ থেকেই আঁচ করা যায় কর্মসূচি যথাযথভাবে চলছে না।
উল্লেখ্য, ‘মোবাইল ফোনে স্বাস্থ্যসেবা’ কার্যক্রমে সারা দেশে জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা কমপ্লেক্সে ৪৮২ জন ডাক্তারের কাছে সরকারের দেয়া মোবাইল ফোন রয়েছে। এছাড়া কয়েকটি ফোন কোম্পানি বেসরকারিভাবে মোবাইল ফোনে চিকিত্সা বিষয়ে নির্ধারিত নম্বরে পরামর্শ দেয়ার ব্যবস্থা করছে। এজন্য আলাদা চার্জ দিতে হয়। কিন্তু সরকারি হাসপাতালের নম্বরে ফোন করলে চার্জ ছাড়াই একজন বিশেষজ্ঞ রোগীকে পরামর্শ দেন। এই সুযোগটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু চিকিত্সার মতো স্পর্শকাতর বিষয়েও যদি শেষ পর্যন্ত ‘সরকারি মাল দরিয়ামে ঢাল’ অবস্থা হয়, তাহলে তার পরিণতি ব্যাখ্যা করার দরকার পড়ে না। প্রাপ্ত তথ্যমতে, এ নাগাদ এ খাতে সরকারের খরচ হয়েছে সাড়ে তিন কোটি টাকারও বেশি। প্রতি মাসে ৩০ লাখ টাকার বেশি খরচ হচ্ছে মোবাইল ফোন বাবদ। প্রয়োজন হলে রোগী কিংবা অন্য কেউ ডাক্তারের কাছে ফোন করছেন নিজেদের পয়সা খরচ করে। অথচ ডাক্তাররা মোবাইল খরচ নিচ্ছেন সরকারের কাছ থেকে প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা। আরেকটি গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, ডাক্তাররা নির্ধারিত ওষুধ কোম্পানির ওষুধ লিখে দিয়ে কোম্পানির পক্ষ থেকে নিচ্ছেন বিভিন্ন উপহার সামগ্রী। পাশাপাশি বেসরকারি চিকিত্সা কেন্দ্র পরিচালনাকারীদের সঙ্গে কমিশনের বিনিময়ে রোগী পাঠানোর চুক্তি করছেন ডাক্তাররা—এমন অভিযোগও রয়েছে বিস্তর। সব মিলিয়ে বলা যায়, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের মাধ্যমে চিকিত্সা সংক্রান্ত তথ্য জানানো এবং তৃণমূল পর্যায়ে সেবা পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগটি মাঠে মরতে বসেছে।
দেশের চিকিত্সাসেবার অবস্থা কোনো বিবেচনায়ই যথেষ্ট নয়, জনসংখ্যা অনুপাতে এ খাতটির উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটেনি। পর্যাপ্ত হাসপাতাল নেই, অ্যাম্বুলেন্স নেই, ডাক্তার-নার্স নেই, নেই প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, যন্ত্রপাতি। বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের চিকিত্সকও হাতেগোনা। ফলে জটিল রোগের চিকিত্সার জন্য অনেকেই বিদেশে যেতে বাধ্য হন। অন্যদিকে প্রতিদিন দুঃসহ বিড়ম্বনার মুখোমুখি হন সাধারণ রোগী। হাসপাতালের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার ত্রুটি তো নতুন কিছু নয়। হাসপাতালে ভর্তি, সুচিকিত্সা—সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে। ডাক্তার নিয়োগ, বদলি, প্রমোশন-ডিমোশন নিয়ে দলীয়করণের অভিযোগও দীর্ঘদিনের। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবার মান কোন তলানিতে ঠেকেছে এবং সাধারণ মানুষের কাছে চিকিত্সাসেবা কতটা দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে, তা বিশ্লেষণ করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তার ওপর যদি মোবাইল ফোনে চিকিত্সাসেবার মতো ভালো উদ্যোগটি ‘গোদের উপর বিষফোঁড়ায়’ পরিণত হয় তাহলে আর কিছুই বলার থাকে না। এতে সরকারের নজরদারি বা তদারকির প্রতি স্বভাবতই অভিযোগের আঙুল ওঠে। একই সঙ্গে ডাক্তারির মতো মহান পেশার প্রতিও বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয়। আমাদের প্রত্যাশা, স্বাস্থ্য অধিদফতর তথা সরকার এবং সংশ্লিষ্ট চিকিত্সকরা উত্থাপিত অভিযোগ খণ্ডন করে জনগণের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিকে এগিয়ে নেবেন। কেননা, আর যাই হোক, ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ দিয়ে চিকিত্সাসেবা তৃণমূলে পৌঁছে দেয়া আক্ষরিক অর্থেই অসম্ভব।

No comments

Powered by Blogger.