পানি চুক্তি নিয়ে জল ঘোলা করছে ভারতঃ ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চনার অবসান হোক
গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করছে ভারত। ত্রিশ বছর মেয়াদি চুক্তিতে উল্লিখিত শর্তের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যেমন খুশি পানি প্রত্যাহার করছে। এর মধ্যেই পানির প্রবাহ কমে গেছে ফারাক্কা পয়েন্টে। ফলে শর্ত মোতাবেক শুকনো মৌসুমে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে বাংলাদেশ।
এ অবস্থায় চলতি শুকনো মৌসুমে গত বছরের তুলনায় বাংলাদেশের পানি প্রাপ্তি অর্ধেকে নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। যে কোনো বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য তা হবে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’-এর শামিল। বাংলাদেশে যখন পঞ্চাশটিরও বেশি নদ-নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ছে, তখন গজলডোবা ব্যারেজের সবগুলো গেট বন্ধ করে দেয়ায় সর্বনিম্নে পৌঁছে গেছে তিস্তা নদীর পানির প্রবাহ। টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারেও দেশবাসী শঙ্কিত। এ অবস্থায় পানি চুক্তি নিয়ে ভারতের টালবাহানা বাংলাদেশের জন্য চরম উত্কণ্ঠার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
যৌথ নদী কমিশন ও ফারাক্কার পানি চুক্তি পর্যবেক্ষণে গঠিত বাংলাদেশ কারিগরি কমিটির সদস্যরা বলেছেন, গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তিতে ফারাক্কা পয়েন্টের পানি ভাগাভাগি করে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ফারাক্কা পয়েন্টের উজানে বাঁধ দিয়ে ভারত একতরফাভাবে এই পানি প্রত্যাহার করতে পারবে না, এ ধরনের কোনো শর্ত চুক্তিতে নেই। শেষ পর্যন্ত সেটিই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। চুক্তির এই দুর্বল দিককে কাজে লাগিয়ে ভারত শুকনো মৌসুমে গঙ্গার বেশিরভাগ পানিই সরিয়ে নিচ্ছে হুগলি ও ভাগীরথী নদীতে। এছাড়া ফারাক্কার উজানে ১৮টি চ্যানেল ও ছোট-বড় প্রায় তিনশ’টি খালের মাধ্যমে পানি নিচ্ছে বিভিন্ন প্রদেশে। এতে স্বভাবতই ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ কমে আসছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের মতে, অন্যান্য বছর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ফারাক্কার পানি কমিয়ে দিলেও এবার শুরু হয়েছে ডিসেম্বর থেকেই। তাছাড়া পানিবণ্টন চুক্তিতে উল্লেখ থাকলেও গত ১৩ বছরে ভারত গঙ্গার নাব্য রক্ষার জন্য কোনো খনন কাজ করেনি। প্রকৌশলীরা আরও বলেছেন, চুক্তি অনুসারে গঙ্গার পানির প্রবাহ কমে গিয়ে সর্বনিম্ন যে পরিমাণ পানিই থাক না কেন, তা থেকে বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে। মোট পানির পরিমাণ এর নিচে হলে দু’দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত পানি বিশেষজ্ঞরা তা বণ্টন করে নেবেন আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে। এ ধরনের পরিস্থিতি প্রায় প্রতি বছরই হচ্ছে। কিন্তু চুক্তির শর্তের কথা উল্লেখ করে আলোচনায় বসার জন্য অনুরোধ করা হলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করছে না। আর তা না করার কারণই হচ্ছে পানি চুক্তিতে উল্লিখিত দুর্বলতা। যদি ফারাক্কা ব্যারেজের উজানে ভারত বাঁধ দিতে পারবে না বলে চুক্তিতে উল্লেখ থাকত তাহলে ফারাক্কা ব্যারেজের পয়েন্টে পর্যাপ্ত পানি থাকত এবং বাংলাদেশ শুকনো মৌসুমে এভাবে পানি স্বল্পতার মুখোমুখি হতো না। কাজেই এখন ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য ভারতকে চাপ দেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক নদীশাসন আইনের বিধান লক্ষ্য করে ভারত ফারাক্কা নামের ‘মরণ ফাঁদ’ নির্মাণ করেছিল। অবশেষে বিস্তর জল ঘোলা করার পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের সঙ্গে ত্রিশ বছর মেয়াদি পানি বণ্টন চুক্তি করে। কিন্তু চুক্তির শর্তাবলির ফাঁকফোকরগুলো যথারীতি খতিয়ে না দেখায় এখন তা আত্মঘাতী আকার ধারণ করেছে। ফারাক্কা পয়েন্টের পানি বাংলাদেশ পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু ওই পয়েন্টেই যদি পানি কম থাকে তাহলে উপায় কি?
এদিকে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ভারতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আন্দোলন চলছে। তিস্তা নদীর উজানে গজলডোবা ব্যাজের গেট বন্ধ করে দেয়ায় আমাদের ডালিয়া সেচ প্রকল্প বন্ধ হওয়ার পথে। ফলে সঙ্কটে পড়েছে চলতি মৌসুমের বোরো আবাদ। এভাবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পানি সংক্রান্ত বহুমুখী সঙ্কটকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী দিল্লিতে পৌঁছেছেন। সেখানে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত অনেক বিষয়ের নিষ্পত্তি হওয়া নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। আমাদের প্রত্যাশা, অন্যান্য ইস্যুর পাশাপাশি, চুক্তি লঙ্ঘন করে গঙ্গার পানি প্রত্যাহারসহ তিস্তা-টিপাইমুখ সংক্রান্ত সমস্যারও ন্যায্য সমাধান হবে এ বৈঠকে। অনুগ্রহ-অনুকম্পা নয়, আমরা ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চনার অবসান চাই।
No comments