কে এফ রুস্তামজির চোখে ১৯৭১-ইন্দিরা মে মাসেই অভিযান চালাতে চেয়েছিলেন by সোহরাব হাসান

তৃতীয় পর্ব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার ধরন এবং অভিযানের সময় নিয়ে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে যেমন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল, তেমনি তাঁরা আন্তর্জাতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে বেশ ভাবিত ছিলেন। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূমিকা কী হবে—সেটি ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।


ভারত বরাবর যুদ্ধের ঝুঁকি এড়াতে চাইছিল। অন্যদিকে, বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ তথা মুক্তিযোদ্ধারা চাইছিলেন, ভারত দ্রুত অভিযান চালাক।
রুস্তামজি যুদ্ধের মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা ভাবতেন, স্বাধীনতাযুদ্ধ ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে অভিযান চালাবে এবং তাঁরা প্রথম ১৫ দিনেই সর্বোচ্চ ত্যাগ দেখাতে পারবেন। কিন্তু তাঁরা যখন দেখলেন, ভারত অভিযান চালাচ্ছে না, তখন হতাশ হয়ে পড়লেন। তাঁর মন্তব্য, ‘তাঁরা পাকিস্তানের একমাত্র ও বৃহৎ শত্রু দেশটির মনোভাব বুঝতে পারেননি। তাঁদের বেশির ভাগের উপলব্ধি ছিল, ভারত আক্রমণ না করা পর্যন্ত তাঁদের সাফল্য নেই। তাঁরা দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের জন্য তৈরি ছিলেন না। ১৯৭১ সালের ১ মে আমি বুঝতে পারলাম, আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ৫ ডিভিশন পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে মুক্তিবাহিনী কুলিয়ে উঠতে পারবে না।’
রুস্তামজি আরও লিখেছেন, ‘সিভিলিয়ান ও সেনাবাহিনী থেকে আসা মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা চেয়েছিলেন দ্রুত সাফল্য। কিন্তু যখন দেখলেন পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের দিকে যাচ্ছে এবং বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন ও জাতীয় সম্পদ নষ্ট হচ্ছে; বিশেষ করে যেসব এলাকা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। এ অবস্থায় সিনিয়র কর্মকর্তারা যুদ্ধ-এলাকা এড়িয়ে চলতেন এবং সংবাদপত্রে জুনিয়র কর্মকর্তা ও ননকমিশন্ড কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অতিরঞ্জিত করে অভিযানের খবর প্রচার করতেন।’
রুস্তামজি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সামরিক নীতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘শরণার্থীদের চাপ এবং দেশের ভেতরে জনমতের কারণে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী চেয়েছিলেন, সেনাবাহিনী মে মাসেই অভিযান চালাবে। কিন্তু সেনাবাহিনীর প্রধান মানেকশ তাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, সেনাবাহিনী প্রস্তুত নয়। মানেকশ মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন, তিনি তখনই যুদ্ধে যাবেন, যখন জয় সম্পর্কে নিশ্চিত হবেন। বিশেষ করে, প্রতিপক্ষ থেকে আক্রমণ মোকাবিলায় ভারত-চীন সীমান্তে যথেষ্ট সেনা ও যুদ্ধসরঞ্জাম পৌঁছানোর বিষয়টি নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন তিনি।’
এরপর রুস্তামজি রণাঙ্গনের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘সেনাবাহিনীর এই অস্বীকৃতির পর আমাদের যে কিছু ভারী অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল, তা থেকে বঞ্চিত হলাম। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যুদ্ধসরঞ্জাম সরবরাহও বন্ধ থাকল। ফলে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর যে ১৮টি বিমান ছিল, তা ভূপাতিত করা কঠিন হয়ে পড়ল। ওই বিমানগুলোই দিনের পর দিন মুক্তিবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে এবং তাদের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কোণঠাসা করে ফেলে।’
ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই পশ্চাদপসরণে বিএসএফের প্রধান হতাশ হয়ে পড়েন। কেননা ছাত্র ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যরাই বেশি পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের শিকার হচ্ছিল। সেনাবাহিনীর পুরোপুরি দৃশ্যপটের বাইরে থাকা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। রুস্তামজির স্বগতোক্তি, ‘আমার মনে হলো, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আমি এক ব্যক্তির যুদ্ধে লিপ্ত আছি।’
তাঁর অভিযোগ, ‘সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ আমার এবং বিএসএফের ভূমিকায় খুশি ছিলেন না। তিনি একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “খসরু, তুমি কি বুঝতে পারছ বিএসএফের কর্মকাণ্ড কতটা বিপজ্জনক? তুমি এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করছ, যেখানে পরবর্তী কিছুদিনের মধ্যে আমাদের সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এবং এটি এমন এলাকা নয়, যা আমাদের জন্য সুবিধাজনক।”’
মানেকশর এই অবস্থানের কারণ পূর্বাঞ্চল সামরিক অভিযানের জন্য সম্পূর্ণ অসুবিধাজনক। সেখানে বড় কোনো সেনানিবাস নেই, সামরিক যান চলাচলের ভালো সড়ক নেই এবং নড়বড়ে রেলব্যবস্থা ও চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে বিপর্যস্ত করে দেওয়া সম্ভব। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে যখন সুযোগ এসেছিল, তখন তা কাজে লাগানো হয়নি এ কারণে যে তাতে ভারতের প্রতি বাঙালিদের আস্থা নষ্ট হবে। তা ছাড়া সেনাবাহিনী যদি পূর্বাঞ্চলে ব্যস্ত থাকে, তাহলে পাকিস্তানের পক্ষে কাশ্মীরে হামলা চালানো সহজ হবে, যা তারা জন্মের পর থেকেই চালিয়ে আসছে।
রুস্তামজির বয়ানে আমরা জানতে পারি, এপ্রিলের মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা সেনানিবাসগুলোতে অবস্থান সংহত করে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যে অতিরিক্ত সেনা এসেছে, তাদের সীমান্তে পাঠানো হয় এবং ইপিআরের নিয়ন্ত্রণে থাকা কিছু সীমান্ত-চৌকিও তারা দখল করে নেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ তখনো প্রশিক্ষণ শেষ করতে পারেনি। তা ছাড়া তাদের হাতে ভারী কোনো অস্ত্র ছিল না, যা দিয়ে পাকিস্তানিদের মোকাবিলা করতে পারে।
কিন্তু এই হতবিহ্বল অবস্থা বেশি দিন ছিল না। মাস খানেকের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা ঘুরে দাঁড়ায়। রুস্তামজি লিখেছেন, ‘পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলায় বিএসএফের সামর্থ্য ছিল অত্যন্ত সীমিত। ৩০ এপ্রিল ভারতীয় সেনাবাহিনী পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে অভিযান চালায়; এর ১৬ দিন পর আসাম ও ত্রিপুরা সীমান্তে। তখন বিএসএফ সেনাবাহিনীর অপারেশন জ্যাকপটের অধীনে চলে আসে। ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় ও তথ্য আদান-প্রদানের জন্য বিএসএফের ওপর নির্ভর করত। সেনাপ্রধান তাদের আগ্রাসী অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন। এরপর সেনাবাহিনীর সদস্যরাও বিএসএফের অভিযানে সহায়তা করতে থাকেন। এমনকি তারা জেলা সদর দপ্তরেও অভিযান চালায়। যেখান থেকে নগদ টাকা ও অস্ত্র লুট করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয়।’
এরপর বিএসএফের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান ও আক্রমণের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। এ অবস্থায় সারা দেশে ভয়ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানি সেনারা ছাউনি থেকে বের হতে ভয় পেত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মরিয়া হয়ে ওঠে এবং ‘বিদ্রোহীদের’ নির্মূল করতে অভিযান চালাতে থাকে। রুস্তামজি লিখেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনীর এসব গণহত্যা ও নৃশংস অভিযানে মুসলিম লীগ, বিহারি মুসলমান ও জামায়াতে ইসলামীর অনুসারীদের নিয়ে গঠিত আলবদর ও আলশামসও যোগ দিল। তাদের বিশেষ লক্ষ্য ছিলেন চিকিৎসক, অধ্যাপক, শিক্ষকেরা। তারা রাতের বেলায় বের হতো, তাঁদের ধরে নির্ধারিত স্থানে নিয়ে যেত এবং গুলি করে হত্যা করত। তারা দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ লাশ রেখে দিত। তাদের বর্বরতা থেকে কেউ রেহাই পেত না। যখন তাদের নির্দয় বর্বরতা ও নৃশংসতার খবর ছড়িয়ে পড়ল, তখন সারা বিশ্ব স্তম্ভিত হলো। এভাবে নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুদের নির্বিচারে হত্যার বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।’
রুস্তামজি লিখেছেন, ‘মে মাসের শুরুতে পাঞ্জাবি ও পাঠান সেনাদের কাছ থেকে খবর আসতে থাকল, কোনো কোনো পাকিস্তানি সেনা নিরস্ত্র নারী ও শিশুদের হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানাল। তারা বলল, এটি ইসলাম ধর্মের নীতিবিরোধী। এই ইস্যুতে পাকিস্তানি সেনারা বিভক্ত হয়ে পড়ল এবং বিজয়পুরের কাছে অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ে ছয় পাঞ্জাবি ও চার পাঠান সেনা নিহত হয়।’ (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.