কৃষ্ণচূড়ার মতো রাঙা হয়ে ঝোলে by আল মাহমুদ
ঘটনাপ্রবাহের তরঙ্গে আছাড়ি-পিছাড়ি খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত নির্বাক হয়ে বসে থাকি। সবাই বলে, লেখ লেখ। আমার ধারণা, এই কাজটি করতে গেলে খানিকটা আলসেমিরও দরকার হয়। সেই সুযোগ আমার অবশ্য বড় একটা হয় না। লেখার রুটিন থাকলে আমি আর দ্বিধাদ্বন্দ্বে নড়বড়ে হই না। শুরু করে দিই।
আর শুরু করলে কীভাবে যেন শেষও হয়ে যায়। শেষ হলো তো বাঁচলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খানিকক্ষণ ধূমপান করি। যদিও এ কাজটা অনেকটা কমিয়ে এনেছি। আগে পরিপার্শ্ব-প্রতিবেশী এবং নিজের শহরকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে আমি অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু দৃষ্টি অপরিচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার ফলে আমি এখন চুপচাপ বসে থাকতেই ভালোবাসি। কেউ কাছে এসে হাত ধরে কিছু বললে তবেই জবাব দিই। না হলে ঠায় বসে থাকার একটা অভ্যেস আমি গড়েছি। কাউকে বিরক্ত করি না। বিব্রত করি না। একজন বৃদ্ধ লোক যেভাবে খানিকটা স্থবিরতার মধ্যে সময় কাটায়, আমার দশাও হয়েছে তেমনি। তবে আমার মস্তিষ্ক কেন যে এত তীক্ষষ্ট তা বুঝতে পারি না। অতীতের দেখা অনেক অতীত আমার চোখের সামনে বর্তমান হয়ে ভাসতে থাকে। তবে খানিকটা স্থবিরতার মধ্যে আমি সুখ পাই। দুঃখ যে পাই না তেমন নয়। কারণ আমার চিন্তার ডালপালায় সুখের চেয়ে দুঃখের পুষ্প কৃষ্ণচূড়ার মতো রাঙা হয়ে ঝোলে। সাধারণত আমি শুধু লেখার জন্য লিখি—এটা ভাবতে ঈষত্ লজ্জা পাই। লেখার জন্যই লিখি বটে; কিন্তু আমার সামনে আমি তাদেরই দেখতে পাই যারা হা করে আমার কথা গিলে ফেলে।
মাঝেমাঝে বলতে ইচ্ছে করে—ওগো কথাখেকো রাক্ষসের দল, আমি এত কথার জোগান কোত্থেকে দেব। যদি এদেশে এমন কোনো গাছ থাকত যে গাছে শব্দ ফুল হয়ে ফোটে, তাহলে কতই না ভালো হতো। কোনো কিছুই বিনা যত্নে জন্মে না। না কবিতা, না কোনো গল্প-উপন্যাস। আমি আমার সাধ্যমত কথার তরঙ্গ তুলে নিজের দুখের অংশীদার খুঁজি। আছে, আমার দুঃখেরও অংশীদার আছে। তবে যারা আমার দুঃখ নিয়ে মুচকি হাসত, সেইসব আপনজন আর একজনও নেই।
এমন অবস্থা হয়েছে, স্বপ্নেও তাদের দেখি না। যেন তারা সবাই স্বপ্ন থেকেও সতর্ক হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, আমি কি খুব সতর্ক লোক? জবাবে একটু একটু হাসি। আসলে তো কোনো জবাব নেই। লা-জবাব। আজকাল ঘুমানোর আগে মনে মনে স্বপ্ন প্রার্থনা করি। কিন্তু আসে না। ভাসে না। ছায়াছবির খেলা আমাকে ত্যাগ করেছে। এখনও কবিতা লিখতে পারি বটে; কিন্তু হৃদয় পরিতৃপ্ত হয় না। আর যে কাজে হৃদয়ে একটু বাষ্পও জমা হয় না সে কাজকে আমি তো অকাজই বলি।
আগে ভাবতাম মানুষের সবচেয়ে দরকারি বেঁচে থাকার উপাদান হলো স্বপ্ন। স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকার শক্তি পায় না। স্বপ্নই মানুষকে বেঁচে থাকার লক্ষ্যে কর্মমুখী করে তোলে। কিন্তু আমার এই ভাবনা সঠিক নয়। মানুষ স্বপ্ন ছাড়াও বাঁচে। তারা শুধু ঘুমিয়ে পড়ে। আর জাগে বেশ বেলা করে। যদি তাদের রুটিনবাঁধা কোনো কাজকর্ম অবশিষ্ট না থাকে। আজকাল কল্পনা শক্তি নিয়ে কী করব সেটা ভেবে পাই না। মানুষ তো আর প্রাত্যহিক কাব্য সৃষ্টি করতে পারে না। এছাড়া এত কবিতার প্রয়োজন কি আদৌ আছে? আমার মনে হয়, চোখ খোলা রেখে বসে থাকার মতো আরামের কাজ সম্ভবত আর কিছু নেই। আমি নিজে অবশ্য এ কাজটি ঠিকমত করতে পারিনি। কারণ আমি বেঁচে থাকার কার্যকারণ খুঁজি। যদি না খুঁজি তাহলে বড় অবসাদ লাগে। আমি সৃজনকাজের প্রবক্তা। কিন্তু মানুষ তো আর নিত্য সৃষ্টি করতে পারে না। জোর করে করতে গেলে সেটা অনাসৃষ্টি হয়। আজকাল মনের মধ্যে খুব একটা প্রশ্ন ওঠে। সেটা হলো, আর কতদিন থাকব। জবাব অবশ্য আমার মধ্যেই আছে। সেটা হলো, যতদিন লিখতে পারব ততদিন আমার আয়ুষ্কাল। এই জবাব যখন পেয়ে যাই তখন দিলটা একটু নরম হয়। মনে হয় লিখতে পারলে থাকব। কিন্তু না লিখতে পারলেও যে থাকতে হয়, সেটা দুর্ভাবনার বিষয়। না লিখেও থাকতে হলে কীভাবে থাকা যায় সেটা আমি জানি না। আমি তো কত কিছুই জানি না। অথচ মাটিতে দর্প করে ঘুরে বেড়াই একজন সবজান্তা কবি হিসেবে। যদি আমি আমার না-জানার বিষয়ের একটা তালিকা তৈরি করি তাহলে দেখা যাবে কিছুই জানি না। জানার চেষ্টাও করি না। জানতে হলে পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু আমি অলস। ঠাণ্ডা কলসের মতো ঘরের মাঝখানে বসে আছি। কোন অধিকারে বসে আছি? আর লিখে যাচ্ছি। কার জন্য লিখছি? তারা কি আমাকে নিয়ে হাসে না? বাংলাদেশ থেকে কি হাসি-ঠাট্টা একেবারে উঠে গেছে? আমি চাই আমাকে নিয়ে একটু বিদ্রূপ হোক। ঠাট্টা-তামাশা হোক। কিন্তু হয় না। আমার নামটাই এমন, সব বিদ্রূপ-হাসিকে সংহার করে একটা স্থবিরতা আয়ত্ত করে নিয়েছে।
লেখক : কবি
No comments