নাম বদলের পালা by মাহবুব তালুকদার
গুরুদেব যোগাসনে বসিয়া ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন। তাহার চক্ষুদ্বয় নিমীলিত ছিল। শিষ্য লক্ষ্য করিল ধ্যানকালে গুরুদেবের মুখমণ্ডলের চতুষ্পার্শ্ব হইতে এক অলৌকিক জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়। শিষ্যের ধারণা হইল, গুরুদেব অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল রহস্য অধিগত করিয়াছেন। সে নির্বাক দৃষ্টিতে প্রভুর মুখের প্রতি তাকাইয়া রহিল।
একসময়ে গুরুদেব দৃষ্টি উন্মোচিত করিলেন। কহিলেন, বত্স! অবধান করো।
আজ্ঞা করুন প্রভু। শিষ্য উত্কর্ণ হইয়া গুরুদেবের বাণীর প্রতীক্ষা করিতে থাকিল।
তুমি কি জানো জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তিত হইতে যাইতেছে?
নামকরণ সম্পর্কে মন্ত্রী পরিষদের সভায় নীতিগত সিদ্ধান্ত হইয়াছে বলিয়া শুনিয়াছি। শিষ্য বলিল।
এই বিষয়ে তোমার প্রতিক্রিয়া কি?
প্রভু! আওয়ামী লীগ তাহাদের পূর্ববর্তী সরকারি আমলে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের প্রচেষ্টা চালাইয়া ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করিতে ব্যর্থ হইয়াছিল। এইবার তাহারা যাহাতে ব্যর্থ না হয়, সেইজন্য অন্য একটি কৌশল অবলম্বন করিয়াছে।
কি ধরনের কৌশল?
এইবার তাহারা জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম মুছিয়া শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করিতে চাহিতেছে, যাহাতে ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় আসিলে যেন হজরত শাহজালালের পুণ্য নাম পরিবর্তন করিয়া শহীদ জিয়ার নামে প্রত্যাবর্তন করিতে না পারে। তবে এই কৌশলটি বিএনপির নিকট হইতে শেখা।বিএনপির নিকট হইতে কৌশল শিখিয়াছে আওয়ামী লীগ? তুমি কি বলিতেছ?
জ্বি, মহাত্মন! আমি ঠিকই বলিতেছি। শিষ্য ব্যাখ্যা করিল, এর আগে বিএনপি চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম এমএ হান্নানের নামে নামকৃত চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করা হইয়াছে?
হ্যাঁ। এইভাবে নাম পরিবর্তন অনভিপ্রেত।
হুজুর! গোস্তাকি মাফ করিলে একটি কথা বলিতে পারি।
তুমি নির্ভয়ে বলো।
নাম বদলের পালায় পীর-আউলিয়াদের টানিয়া আনাকে আমি তাহাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন বলিয়া মনে করি না। বরং আমি মনে করি পীর আউলিয়াদের নাম রাজনৈতিক দলগুলি তাহাদের সূক্ষ্ম প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য ঢাল হিসেবে ব্যবহার করিতেছে। পীর-আউলিয়াদের প্রতি শ্রদ্ধা থাকিলে নতুন একটি স্থাপনা নির্মাণ করিয়া তাহাদের পুণ্যনামে নামকরণ করা হইলেই যথাযথ হইত।
হ্যাঁ। হজরত শাহজালালের নামে সিলেটে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হইয়াছে।
উহার নামকরণ লইয়াও কিছু বিতর্ক আছে। বর্তমানে সেই বিতর্ক উচ্চগ্রামে উঠিয়াছে।
কিরুপ বিতর্ক?
সাধারণত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এলাকার নামানুসারে হইয়া থাকে। কোনো ব্যক্তির নামানুসারে করা হয় না। সিলেটে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় উহার ব্যতিক্রম। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হলের নামকরণ করা হইয়াছে হজরত শাহজালালের অনুগামী শিষ্য হযরত শাহপরানের নামে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলের নামকরণ লইয়া ক্যাম্পাস পুনরায় উত্তপ্ত হইয়া উঠিয়াছে।
ওইরূপ একটি ঘটনা পূর্বে ঘটিয়াছিল বলিয়া মনে পড়িতেছে। গুরুদেব জানাইলেন।
শিষ্য বলিল, ১৯৯৯ সালের ৩০ আগস্ট শাবির সিন্ডিকেট সভায় কয়েকজন ব্যক্তির নামে ৬টি ভবন ও ২টি আবাসিক হলের নামকরণ লইয়া তুমুল আন্দোলন ও বিক্ষোভ উত্তাল হইয়া ওঠে। আন্দোলনকারীরা হজরত শাহজালালের অনুগামীদের নামে হলের নামকরণ দাবি করিয়াছিলেন। ওই আন্দোলনের সময় বিডিআরের গুলিতে এক মাদ্রাসা ছাত্র প্রাণ হারায়। ইহার জের ধরিয়া প্রায় ৯ মাস বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার পর ২০০০ সালের ৬ মে তত্কালীন চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বিতর্কিত নামকরণের সিদ্ধান্ত স্থগিত করিলে আন্দোলন প্রত্যাহত হয় ও ক্যাম্পাস খুলিয়া দেওয়া হয়।
উহা তো অনেক আগের কথা। বর্তমানে উহার প্রাসঙ্গিকতা কোথায়?
স্যার! বর্তমানে ওই পুরাতন ঘটনার সূত্র ধরিয়া নতুনভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হইয়াছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী হলের প্রভোস্ট ওই হলের নাম ‘শহীদ জননী জাহানারা ইমাম হল’ বলিয়া দাবি করেন। তাহার মতে, ওই সময়ে রাষ্ট্রপতির মৌখিক নির্দেশে হলের নামকরণ স্থগিত করা হইয়াছিল এবং বলা হইয়াছিল রাষ্ট্রপতির আদেশ চিঠির আকারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের নিকট পাঠানো হইবে। কিন্তু বিগত ১০ বত্সরেও ওই চিঠি আসে নাই। ফলে এখন অবস্থা জটিল হইতে জটিলতর হইতেছে।
জটিল হইতে জটিলতর বলিতেছ কেন? বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে দিয়া একটি আদেশ জারি করাইলেই সব ল্যাঠা চুকিয়া যায়।
প্রভু! বিতর্কিত নাম পুনর্বহালের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আবার উত্তপ্ত হইয়া ওঠার আলামত দেখা যাইতেছে। ইহা লইয়া শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় বন্ধ হইলে ভবিষ্যতে উহা কতদূর গড়াইবে, তাহা বলা দুরূহ।
হ্যাঁ, বত্স! তোমার উদ্বেগ যুুক্তিযুক্ত।
মহাত্মন! একটি বিষয় আমি বুঝিতে পারি না। শিষ্য কহিল, নামকরণ ও নাম বদল লইয়া আমাদের রাজনৈতিক দলগুলি এতো উদগ্রীব কেন? যেন রাজনৈতিক দলগুলির ইহা ব্যতীত আর কিছু করার নাই।
তুমি ঠিকই বলিয়াছ। গুরুদেব বলিলেন, দলগুলি নিজেদের নেতা-নেত্রীর নামে বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণ করিয়া তাহাদিগকে স্মৃতিতে জাগরূক রাখিতে চায়। কিন্তু সরকার পরিবর্তিত হইলে ভিন্ন দলের বা নেতার স্মারকচিহ্ন বহাল রাখার উদারতা তাহাদের মধ্যে দেখা যায় না। সরকার পরিবর্তনের প্রধান কাজই যেন নাম পরিবর্তন।
শিষ্য মাথা ঝুকাইয়া বলিল, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসিয়া বঙ্গবন্ধু সেতুর নাম পরিবর্তন করিয়া যমুনা সেতু নামকরণ করে। বঙ্গবন্ধু নভো থিয়েটারের নামও পরিবর্তন করিয়া ভাসানী নভোথিয়েটার রাখা হয়। পুলিশের মনোগ্রামে নৌকা থাকায় বিএনপি আমলে পুলিশের মনোগ্রাম হইতে মনোগ্রাম তুলিয়া দেয়া হয়। ওই মনোগ্রামে নৌকা বর্তমানে পুনঃস্থাপিত হইয়াছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও বিভিন্ন স্থাপনা হইতে জিয়াউর রহমানের নাম মুছিয়া দিতে বদ্ধপরিকর। ইহার ধারাবাহিকতায় কেবল জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নহে, শহীদ জিয়া শিশু পার্কটিও উঠাইয়া দেওয়া হইতেছে। চট্টগ্রামের জিয়া স্মৃতি কমপ্লেক্স, মিনি বাংলাদেশ স্থাপনাটিও এখন বন্ধ।
হ্যাঁ, পাল্টাপাল্টি নামকরণ বা নাম বদল এখন আমাদের রাজনৈতিক কালচারে পরিণত হইয়াছে।
সর্বাধিক মজার ঘটনা ঘটিয়াছে শেরেবাংলা নগরের ক্রিসেন্ট লেক সংলগ্ন পার্কটি লইয়া। এরশাদ আমলে উহার নাম দেওয়া হইয়াছিল চন্দ্রিমা উদ্যান। ওই স্থানে জিয়াউর রহমানের কবরের সূত্র ধরিয়া উহার নামকরণ হয় জিয়া উদ্যান। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ আমলে জিয়া উদ্যান আবার চন্দ্রিমা উদ্যানে পরিণত হইলেও বিএনপি আমলে জিয়া উদ্যান নাম পুনরায় বহাল হয়। এইবার উহার কি দশা হইবে কে জানে।
আমার যতদূর মনে পড়ে, ওই সময়ে মূল সড়ক হইতে জিয়াউর রহমানের কবরগামী ব্রিজটিকেও সরাইয়া লওয়া হয় যাহাতে সহজে কেহ যেন কবর পর্যন্ত পৌঁছাইতে না পারে। গুরুদেব কহিলেন, এই সকল কর্মকাণ্ডে বড় দুইটি দলেরই হীনমন্যতা প্রকাশ পাইয়াছে। তাহাতে দেশের অগ্রগতি পিছাইয়া যাইতেছে।
ইহার কি কোন প্রতিকার নাই প্রভু? শিষ্য জিজ্ঞাসিল।
প্রতিকার অবশ্যই আছে। সকলেরই মনে রাখা উচিত যে, নাম বদলের এই ধারা অব্যাহত থাকিলে কোনো কোনো স্থাপনার নামই স্থায়ী হইবে না। সকল নামই চক্রাকারে পরিবর্তিত হইতে থকিবে। এহেন কালচার বন্ধ হওয়া উচিত।
কিন্তু কি প্রকারে তাহা সম্ভব?
টেলিভিশনে দেখিলাম সুধীবৃন্দ পরামর্শ দিয়াছেন, কোনো স্থাপনার প্রথমবার যে নামকরণ করা হইয়াছিল ওই নামে ফিরিয়া যাওয়া উচিত।
তাহা হইলে কি এরশাদ নগর, এরশাদ আর্মি স্টেডিয়াম উহাদের পুরাতন নামে ফিরিয়া যাইবে?
তাহা বোধহয় সম্ভব হইবে না। নাম বদলের পালায় একটি সময়সীমা থাকা প্রয়োজন। এরশাদ পরবর্তী সময় হইতেই ইহার সময় গণ্য করা দরকার।
মহাত্মন! এই সকল নাম বদলের ফলে শত কোটি টাকার আর্থিক অপচয় হইবে বলিয়া সুধীজনরা ধারণা করিতেছেন। এইরূপ অপচয়ের বিষয়টি সরকারের ভাবিয়া দেখা উচতি নহে কি?
আমি মনে করি, শত কোটি হইতে অনেক বেশি অর্থ অপচয় হইতে যাইতেছে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কারণে।
কেন প্রভু?
জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি দেশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। বিশেষত বিদেশীরা আগমন-নির্গমনের সময় জিয়াউর রহমানের নামের সহিত পরিচিত হয়, যাহা অপরপক্ষের অভিপ্রেত নয়। তাহাদের মতে, এইরূপ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বঙ্গবন্ধুর নামেই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু জিয়ার বদলে বঙ্গবন্ধু নামটি প্রতিস্থাপন করা যুক্তিযুক্ত নহে ধারণা করিয়া তাহারা বঙ্গবন্ধুর নামে আরেকটি নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্থাপনার কাজ আরম্ভ করিয়াছে। নতুন আরেকটি বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হইবে।
উহা না করিয়া বঙ্গবন্ধুর নামে আরেকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নামকরণ করা যায় না কি?
অবশ্যই যায়। তবে সরকারি তরফে বলা হইয়াছে, বর্তমান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটিকে অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর করা হইবে।
যদি তাহাই হয়, জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম বদলের দরকার কি? বর্তমান সরকারের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হইলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নামে নতুন একটি বিমানবন্দর নির্মাণ করিলেই চলে। শিষ্য অবনত শিরে তাহার অভিমত ব্যক্ত করিল।
বত্স! তোমার স্বাভাবিক বুদ্ধি পূর্বাপেক্ষা পরিপকস্ফ হইলেও রাজনৈতিক বুদ্ধি পকস্ফতা লাভ করে নাই। গুরুদেব কহিলেন, ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় আসিলে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি পুনরায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরিণত হইবে এবং অন্য নতুন বিমানবন্দরটির নাম অপরিবর্তিত রাখিয়া উহা যে অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরে রূপান্তরিত হইবে না, তাহা কে বলিতে পারে?
শিষ্য মুখ তুলিয়া দেখিল গুরুদেব পুনরায় ধ্যানমগ্ন হইয়া পড়িয়াছেন।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
mahbub_talukdar@yahoo.com
No comments