শিবের গীত-বিমানবন্দরের মশা by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
মাগুরার ছেলে আমাদের আবদুল হালিম মাথায় একটা ফুটবল রেখে ১৫ কিলোমিটার হেঁটে বিশ্ব রেকর্ড গড়ল এবং গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম ওঠাল। হালিমের কৃতিত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা গিনেসের তালিকায় আরেকটি নাম তোলার চেষ্টা চালাতে পারি এবং তা ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মশাবান্ধব কৃতিত্বের জন্য।
পৃথিবীর আর কোনো রাজধানী শহরের বিমানবন্দরে মশা আছে কি না, আমরা জানি না; থাকলেও ঢাকার মতো নিশ্চয় নয়। কলকাতা, দিল্লিতে মশা নেই, এমনকি আগরতলায়ও নেই—আমাকে জানালেন সম্প্রতি আগরতলা ঘুরে আসা এক পরিচিতজন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যত যাত্রী, তার কয়েকগুণ মশা। এমনকি যাত্রী-দর্শনার্থী মিলিয়েও মশার সংখ্যার ধারেকাছে পৌঁছানো যাবে না। অনুপাতের এ তথ্যটিও বিশ্ব রেকর্ড অর্জনের জন্য প্রয়োজন হবে। আমরা জানি বাংলাদেশ বিমানের উড়োজাহাজের সংখ্যার অনুপাতে জনবল বিশ্বের অন্য যেকোনো বিমান সংস্থা থেকে বেশি। মশারা হয়তো এই পরিসংখ্যান জানে, তাই যাত্রী-অনুপাতে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে তারা বাংলাদেশ বিমানকেও যে ছাড়িয়ে যাবে, তাতে আশ্চর্য কী।
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় যখন ক্রিকেট বিশ্বকাপের আসর বসে, দু-তিনবার আমাকে বিমানবন্দরে যেতে হয়েছিল। গিয়ে এমন কামড় খেলাম মশার যে বিরক্ত হয়ে বিমান ও পর্যটনসচিব মহোদয়কে একটা চিঠিই লিখে বসলাম। মশা নির্মূলের পাশাপাশি টয়লেটগুলোর মলিনদশা এবং কারপার্কিংয়ের ভেতরে ও আশপাশের নোংরা আবর্জনাপূর্ণ অবস্থার একটা প্রতিকারের আর্জি জানালাম তাঁর কাছে। সচিব মহোদয় আমাকে জানালেন, তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠিটা পাঠিয়েছেন। তাঁর কথা শুনে আমি আশ্বস্ত হলাম। হয়তো মশাযুগের অবসান হবে, বিমানবন্দর পরিষ্কার হবে। তত দিনে অবশ্য ওয়ার্ল্ড কাপ শেষ। বিদেশি যারা এ দেশে এসেছিল খেলতে, খেলা দেখতে অথবা খেলার ওপর প্রতিবেদন পাঠাতে, তারা মশাময় কিছু সময় বিমানবন্দরে কাটিয়ে দেশে ফিরে গেছে। কিন্তু এরপর অনেক দিন পার হলেও মশাদের কর্তৃত্ব যখন মোটেও শেষ হলো না, আমার ধারণা হলো চিঠিটা নিশ্চয় ফাইলবন্দী হয়েই পড়ে আছে। এ রকমই হওয়ার কথা, সরকারি কর্তৃপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানে। শুধু শুধু একটা ব্যতিক্রমী নজির সৃষ্টি করে কী লাভ?
এবার ফেব্রুয়ারিতে দু-তিন দিন বিমানবন্দরে গিয়ে দেখলাম, মশারা আছে বহাল তবিয়তে। আমাকে দেখে মশারা তেড়ে এল। নিশ্চয় তাদের সামষ্টিক অবচেতনে ছাপ মারা আছে, কয়েক প্রজন্ম আগের মশাদের নির্মূলের জন্য এই লোক একটা চিঠি লিখেছিল। একটি দুই বছরের শিশুকে দেখলাম হাত দিয়ে মশা তাড়াচ্ছে। শিশুটিকে দেখতে দেখতে আমার মনে হলো শিশুদের বাস্তব পৃথিবীতে টিকে থাকার প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটা উত্তম জায়গা হতে পারে এই বিমানবন্দর। ঢাকা যখন দুই ভাগ হলো আমার মতো শিশুটিও নিশ্চয় উৎফুল্ল হয়েছিল, এবার দুই ঢাকা সিটি করপোরেশনের সেবা-সিডরের আঘাতে মশারা ঢাকা ছেড়ে মঙ্গলগ্রহে পালাবে। তা যখন হয়নি; বরং মশা-সিডরে আমাদেরই পালানোর দশা—তখন মশা থেকে কীভাবে নিরাপদ থাকা যায়, তার প্রশিক্ষণ তো শিশুটিকে নিতেই হবে। কে আর সেধে সেধে ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়ায় ভুগতে চায়। ঘরের প্রশিক্ষণ শিশুটি ঘরে পাবে, বাইরের প্রশিক্ষণ বিমানবন্দরে। এ জন্য ২০০ টাকা দিয়ে দর্শনার্থী টিকিট কিনতে হলেও সই।
শিশুটিকে দেখতে দেখতে এবং দুহাত দিয়ে মশাদের কশাঘাত ঠেকাতে ঠেকাতে আমার হঠাৎ এ রকম একটি চিন্তা মনে এল: এই মশাদের আমরা পর্যটনের জন্য কেন ব্যবহার করি না! বছর চারেক আগে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, হাশেম খান ও আমি মিলে বাংলাদেশ কান্ট্রি ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’ এবং ‘রূপময় বাংলাদেশ’ এ দুটি স্লোগান তৈরি করেছিলাম। এখন এর সঙ্গে ‘মার্সিফুল বাংলাদেশ’ স্লোগানটা দিলে কেমন হয়? বিমানবন্দরে নেমে বিদেশিরা দেখবে, মশার প্রতি আমরা কত দয়াশীল। তারা আরও দেখবে, আমরা কোনো কেমিক্যাল ব্যবহার করি না। আমরা উদার প্রকৃতির পূজারি। আমরা বিমানবন্দরের মতো আধুনিক একটি স্থাপনাতেও প্রকৃতির প্রতি কতটা দয়াশীল। প্রকৃতি না ঢুকতে পারুক, প্রকৃতির ক্ষুদ্রপ্রাণ মশককুল ঢুকছে দলে দলে এবং আমরা বলছি, স্বাগতম।
বাংলাদেশ বিমানের লোগোতে যে বলাকা আছে, যা কামরুল হাসানের আঁকা, তা বদলে কয়েক বছর আগে নতুন বলাকা আঁকার একটা হইচই হয়েছিল। আমার মনে হয় বলাকা বদলে মশার ছবি বসিয়ে দিলে সবচেয়ে ভালো হয়। কামরুল হাসান প্রকৃতিপ্রেমিক ছিলেন। তিনিও হয়তো এতে আপত্তি করতেন না। মশার প্রতি আমাদের ঔদার্য্যের বাণী বিমান সারা বিশ্বে বয়ে বেড়াবে।
আমার চিন্তাগুলো এক তরুণ কবিকে জানালে সে বলল, মশা থেকে বরং মানুষের প্রতি দয়াশীল হলে কেমন হয়? সে এক ভারতীয় চলচ্চিত্র দেখেছে, যেখানে রজনীকান্ত দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আরও অভিনয় করেছেন ঐশ্বরিয়া রাই। ঐশ্বরিয়াকে একটা মশা কামড় দিলে রোবট-চরিত্রের রজনীকান্ত সেই মশাকে পাকড়াও করে ঐশ্বরিয়ার কাছে এনে হাজির করলেন এবং তাকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়ালেন।
রোবট রজনীকান্ত যে সুবিবেচক এ বিষয়ে ঐশ্বরিয়ার কোনো সন্দেহ থাকলে নিশ্চয় তা ঘুচেছে। আমাদের বিমানবন্দরওয়ালারা এতটা সুবিবেচক হবেন, আশা করা ঠিক হবে না। হাজার হাজার যাত্রীর কাছে হাজার হাজার মশা পাকড়াও করে নিয়ে হাজির করানোটা হবে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। তার চেয়ে আমি বরং খুশি হতাম অন্তত ওই শিশুটির কাছে যদি কেউ গিয়ে বলত, ‘দুঃখিত’; এবং, ‘চেষ্টা করছি’। ব্যস, ওইটুকুই।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় যখন ক্রিকেট বিশ্বকাপের আসর বসে, দু-তিনবার আমাকে বিমানবন্দরে যেতে হয়েছিল। গিয়ে এমন কামড় খেলাম মশার যে বিরক্ত হয়ে বিমান ও পর্যটনসচিব মহোদয়কে একটা চিঠিই লিখে বসলাম। মশা নির্মূলের পাশাপাশি টয়লেটগুলোর মলিনদশা এবং কারপার্কিংয়ের ভেতরে ও আশপাশের নোংরা আবর্জনাপূর্ণ অবস্থার একটা প্রতিকারের আর্জি জানালাম তাঁর কাছে। সচিব মহোদয় আমাকে জানালেন, তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠিটা পাঠিয়েছেন। তাঁর কথা শুনে আমি আশ্বস্ত হলাম। হয়তো মশাযুগের অবসান হবে, বিমানবন্দর পরিষ্কার হবে। তত দিনে অবশ্য ওয়ার্ল্ড কাপ শেষ। বিদেশি যারা এ দেশে এসেছিল খেলতে, খেলা দেখতে অথবা খেলার ওপর প্রতিবেদন পাঠাতে, তারা মশাময় কিছু সময় বিমানবন্দরে কাটিয়ে দেশে ফিরে গেছে। কিন্তু এরপর অনেক দিন পার হলেও মশাদের কর্তৃত্ব যখন মোটেও শেষ হলো না, আমার ধারণা হলো চিঠিটা নিশ্চয় ফাইলবন্দী হয়েই পড়ে আছে। এ রকমই হওয়ার কথা, সরকারি কর্তৃপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানে। শুধু শুধু একটা ব্যতিক্রমী নজির সৃষ্টি করে কী লাভ?
এবার ফেব্রুয়ারিতে দু-তিন দিন বিমানবন্দরে গিয়ে দেখলাম, মশারা আছে বহাল তবিয়তে। আমাকে দেখে মশারা তেড়ে এল। নিশ্চয় তাদের সামষ্টিক অবচেতনে ছাপ মারা আছে, কয়েক প্রজন্ম আগের মশাদের নির্মূলের জন্য এই লোক একটা চিঠি লিখেছিল। একটি দুই বছরের শিশুকে দেখলাম হাত দিয়ে মশা তাড়াচ্ছে। শিশুটিকে দেখতে দেখতে আমার মনে হলো শিশুদের বাস্তব পৃথিবীতে টিকে থাকার প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটা উত্তম জায়গা হতে পারে এই বিমানবন্দর। ঢাকা যখন দুই ভাগ হলো আমার মতো শিশুটিও নিশ্চয় উৎফুল্ল হয়েছিল, এবার দুই ঢাকা সিটি করপোরেশনের সেবা-সিডরের আঘাতে মশারা ঢাকা ছেড়ে মঙ্গলগ্রহে পালাবে। তা যখন হয়নি; বরং মশা-সিডরে আমাদেরই পালানোর দশা—তখন মশা থেকে কীভাবে নিরাপদ থাকা যায়, তার প্রশিক্ষণ তো শিশুটিকে নিতেই হবে। কে আর সেধে সেধে ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়ায় ভুগতে চায়। ঘরের প্রশিক্ষণ শিশুটি ঘরে পাবে, বাইরের প্রশিক্ষণ বিমানবন্দরে। এ জন্য ২০০ টাকা দিয়ে দর্শনার্থী টিকিট কিনতে হলেও সই।
শিশুটিকে দেখতে দেখতে এবং দুহাত দিয়ে মশাদের কশাঘাত ঠেকাতে ঠেকাতে আমার হঠাৎ এ রকম একটি চিন্তা মনে এল: এই মশাদের আমরা পর্যটনের জন্য কেন ব্যবহার করি না! বছর চারেক আগে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, হাশেম খান ও আমি মিলে বাংলাদেশ কান্ট্রি ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’ এবং ‘রূপময় বাংলাদেশ’ এ দুটি স্লোগান তৈরি করেছিলাম। এখন এর সঙ্গে ‘মার্সিফুল বাংলাদেশ’ স্লোগানটা দিলে কেমন হয়? বিমানবন্দরে নেমে বিদেশিরা দেখবে, মশার প্রতি আমরা কত দয়াশীল। তারা আরও দেখবে, আমরা কোনো কেমিক্যাল ব্যবহার করি না। আমরা উদার প্রকৃতির পূজারি। আমরা বিমানবন্দরের মতো আধুনিক একটি স্থাপনাতেও প্রকৃতির প্রতি কতটা দয়াশীল। প্রকৃতি না ঢুকতে পারুক, প্রকৃতির ক্ষুদ্রপ্রাণ মশককুল ঢুকছে দলে দলে এবং আমরা বলছি, স্বাগতম।
বাংলাদেশ বিমানের লোগোতে যে বলাকা আছে, যা কামরুল হাসানের আঁকা, তা বদলে কয়েক বছর আগে নতুন বলাকা আঁকার একটা হইচই হয়েছিল। আমার মনে হয় বলাকা বদলে মশার ছবি বসিয়ে দিলে সবচেয়ে ভালো হয়। কামরুল হাসান প্রকৃতিপ্রেমিক ছিলেন। তিনিও হয়তো এতে আপত্তি করতেন না। মশার প্রতি আমাদের ঔদার্য্যের বাণী বিমান সারা বিশ্বে বয়ে বেড়াবে।
আমার চিন্তাগুলো এক তরুণ কবিকে জানালে সে বলল, মশা থেকে বরং মানুষের প্রতি দয়াশীল হলে কেমন হয়? সে এক ভারতীয় চলচ্চিত্র দেখেছে, যেখানে রজনীকান্ত দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আরও অভিনয় করেছেন ঐশ্বরিয়া রাই। ঐশ্বরিয়াকে একটা মশা কামড় দিলে রোবট-চরিত্রের রজনীকান্ত সেই মশাকে পাকড়াও করে ঐশ্বরিয়ার কাছে এনে হাজির করলেন এবং তাকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়ালেন।
রোবট রজনীকান্ত যে সুবিবেচক এ বিষয়ে ঐশ্বরিয়ার কোনো সন্দেহ থাকলে নিশ্চয় তা ঘুচেছে। আমাদের বিমানবন্দরওয়ালারা এতটা সুবিবেচক হবেন, আশা করা ঠিক হবে না। হাজার হাজার যাত্রীর কাছে হাজার হাজার মশা পাকড়াও করে নিয়ে হাজির করানোটা হবে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। তার চেয়ে আমি বরং খুশি হতাম অন্তত ওই শিশুটির কাছে যদি কেউ গিয়ে বলত, ‘দুঃখিত’; এবং, ‘চেষ্টা করছি’। ব্যস, ওইটুকুই।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments