এক-এগারো ষড়যন্ত্রের তৃতীয় বর্ষপূর্তিঃ পুনরাবৃত্তি চাই না


তিন বছর আগে জবরদস্তিমূলক ক্ষমতা দখলের ঘটনা গতকাল স্মরণ করেছে সমগ্র জাতি। বিরোধী দল বিএনপি দিনটিকে ‘কালো দিবস’ হিসেবে পালন করে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা সেদিন যে অসাংবিধানিক সরকার গঠন করেছিল, দুই বছরের মাথায় সেই সরকার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়।
তবে আমাদের রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতিতে তাদের সৃষ্ট ক্ষতের রক্তক্ষরণ এখনও বন্ধ হয়নি। কবে বন্ধ হবে বা আদৌ হবে কিনা, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সেই সেনাসমর্থিত সরকারের উদ্যোক্তা, সুবিধাভোগী ও তাদের সঙ্গে আঁতাতকারীদের যতদিন না বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া না যাবে, ততদিন এর জের চলতে থাকবে, সন্দেহ নেই।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি কী ঘটেছিল সেটা এখন সবার জানা। নির্ধারিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ১১ দিন আগে সেদিন সামরিক অভ্যুত্থান না হলেও সেনাবাহিনীপ্রধানসহ শীর্ষ ব্যক্তিরা রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করেছিলেন। বন্দুকের জোরে রাষ্ট্রপতিকে জিম্মি করে সরকারপ্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ ও জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণায় স্বাক্ষর করিয়ে নেয়া হয়েছিল। একদিন পর বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ও মার্কিন পাসপোর্টধারী ড. ফখরুদ্দীনকে প্রধান করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। এক্ষেত্রেও সংবিধান লঙ্ঘন প্রমাণিত সত্য। এভাবে ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য সংঘাত, সংঘর্ষ ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টির পেছনে দেশীয় শক্তির সঙ্গে বিদেশি শক্তির সম্পৃক্ততার কথাও কারও অজানা নেই। ব্রিটিশ, মার্কিন, কানাডিয়ান ও ভারতীয় কূটনীতিকদের সঙ্গে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর ভূমিকা ষড়যন্ত্রমূলক বলাই যথেষ্ট নয়। জাতিসংঘ মহাসচিবের বক্তব্য পাল্টে সেনাবাহিনীকে উস্কে দেয়া হয়েছিল ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের বিরুদ্ধে। জরুরি অবস্থা ঘোষণার আগেই তত্কালীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপি মহাসচিবকে ডেকে এই ঘোষণার পেছনে কূটনীতিকদের সমর্থনের কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। তখন শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ীর উত্সাহী ভূমিকার কথাও নিশ্চয়ই কেউ ভুলে যাননি।
ক্ষমতা দখল করেই জরুরি অবস্থার সরকার হামলে পড়েছিল সাধারণ মানুষের ওপর। শহর ও গ্রামাঞ্চলের লাখ লাখ গরিব মানুষকে বাস্তুচ্যুতই শুধু নয়, তাদের রুটিরুজির পথও বন্ধ করা হয়েছিল। তবে আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল রাজনীতিকরা। ব্যবসায়ীরাও রেহাই পাননি। দুর্নীতি দমনের নামে সে সরকার ও তাদের যৌথবাহিনীর দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক অধিকারহীন অবস্থায় তাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছে কতজন, কত টাকা তারা লুট করেছে তার হিসাব সম্ভবত পাওয়া যাবে না। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে অর্থনীতির। সরকারের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড না থাকা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে বিপর্যয়ের ফলে দেশের বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যায়। একদিকে কর্মচ্যুত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশছোঁয়া দাম জনজীবনকে দুঃসহ করে তুলেছিল। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের ওপর তখনকার নির্যাতনকে ‘ডাকাতি’ বলে উল্লেখ করেছেন। অথচ সেই ডাকাত সর্দারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। তাহলে কী কোনো না কোনোভাবে সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহতই রয়ে গেছে! বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে।
দেশবাসী নিশ্চয়ই ভুলে যাননি, অসাংবিধানিক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণকে অভিনন্দন জানিয়েছিল আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা সে সরকারের সব পদক্ষেপকে বৈধতা দেয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। এ সবই পুরনো কথা। সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল ও দু’বছরের দুঃশাসনে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার অভিযোগে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে বর্তমান মহাজোট সরকার নীরব ভূমিকা পালন করায় অনেকেই হতাশ হয়েছেন। দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয়, একটি প্রভাবশালী মহল ১/১১-এর নায়কদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ব্যাপারে আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। এটা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। রাষ্ট্রক্ষমতায় যাতে কেউ অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করতে না পারে, সে ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোকেই বরং সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা সাধারণ মানুষের মতোই জোর দিয়ে বলতে চাই, কোনোভাবেই এক-এগারোর পুনরাবৃত্তি চাই না। সময় থাকতেই এমন আশঙ্কা নস্যাত্ করতে গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক শক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.