শিশু অধিকার-এতিমখানায় চাই পারিবারিক পরিবেশ by গওহার নঈম ওয়ারা

শিশুদের বিকাশ আর বেড়ে ওঠার জন্য পরিবারই হচ্ছে একমাত্র আদর্শ প্রতিষ্ঠান। তারপরও এতিমখানাগুলো চালু আছে। হয়তো থাকবে আরও অনেক দিন। এ জন্যই এতিমখানাগুলোতে যতটা সম্ভব পরিবারের পরিবেশ ফিরিয়ে আনা দরকার


সম্ভবত ২০১০ সালের এপ্রিলে পঞ্চগড়ের সরকারি এতিমখানা বা শিশু পরিবারের শিশুরা এতিমখানা প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহ শব্দটি হয়তো-বা এক্ষেত্রে খুব ভারী হয়ে যাবে। তবুও সংবাদমাধ্যম তাকে বিদ্রোহ হিসেবে অভিহিত করে। পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসন পুলিশ প্রশাসন ছুটে এসে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনে। শিশুদের বুঝিয়ে আবার এতিমখানায় তালা লাগানো হয়। গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। ঢাকা থেকে পাঠানো হয় সমাজসেবা অধিদফতরের বড় কর্তাদের।
নাটোরের শিশুদের মতো তাদেরও ছিল একই দাবি_ খাবারের মান বাড়াতে হবে ইত্যাদি। যথারীতি তদন্ত রিপোর্ট আসে। যাদের বিরুদ্ধে শিশুদের ক্ষোভ ছিল তাদের বদলি করে দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিবাদী শিশুদের দেওয়া হয় কঠিন শিক্ষা। ১৪ শিশুকে শিক্ষা বছরের মাঝখানে রাস্তায় বের করে দেওয়া হয়। চতুর্থ শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণীর এ ছাত্রদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। নিজ বা পরিবারের চেষ্টায় স্কুল পাল্টিয়ে পঞ্চম আর অষ্টম শ্রেণী সমাপনী দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা থাকলে এসব শিশু এতিমখানার দরজায় এসে দাঁড়াত না।
যেসব শিশু সেদিন সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছিল বা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা যেসব শিশুর ছবি কাগজে ছাপা হয়েছিল বেছে বেছে তাদেরই শিশু পরিবার থেকে বের করে দেওয়া হয়। এ অবিচারে শিশুরা আবার প্রতিবাদমুখর হয়ে রাস্তায় নেমেছিল; কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা প্রতিবাদীদের এতিমখানায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়। 'চিহ্নিত' ১৪ শিশু হারিয়ে যায় সরকারের তালিকা থেকে চিরতরে। এসব নিয়ে সে সময় মানবাধিকার কমিশনের দরজায় কড়া নাড়িয়েছিল শিশু অধিকার নিয়ে ভাবেন এমন সব সংগঠন। কিন্তু সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি তেমন কিছু করার চেষ্টা করেছে বলে জানা যায়নি।
এতদিনে সবাই ভুলে গেছে সে ঘটনা। কোন কষ্টের আবর্জনায় পড়ে প্রতিবাদী সেই ১৪ শিশু হাবুডুবু খাচ্ছে তার খবর কে রাখে? প্রায় দুু'বছর পর নাটোর এতিমখানা বা শিশু পরিবারের শিশুরা একইভাবে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে গত ৪ মার্চ ২০১২ তারিখে। পথে নেমে আসা তারা। শুয়ে পড়ে রাস্তায়, বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। তারপর নজরে আসে তাদের ক্ষোভ আর কষ্ট। জানা যায় তাদের ক্ষোভের কথা। তারা চিঠি দিয়ে সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালককে জানিয়ে দিল বছরের শুরুতেই শিশুরা যেমন ভেবেছিল তেমনভাবে কাজ হয়নি। কেউ ছুটে যায়নি তাদের দুঃখ আর ক্ষোভের কথা শুনতে। শিশুরা ধৈর্য ধরে রাখতে পারেনি 'সবুরের মেওয়া' দেখে দেখে ক্লান্ত শিশুরা বুঝতে পারে জোরে জোরে না কাঁদলে মায়ে দুধ দেয় না। দেড় ঘণ্টা মহাসড়কে শুয়ে থেকে শিশুরা সে কাজটা করেছে।
শিশু পরিবারের ব্যবস্থাপনায় যুক্ত ব্যক্তিদের আবার পঞ্চগড়ের মতো হাওয়া বদলের বদলি করার খবর এসেছে কাগজে। গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। চ্যানেল টিভিতে দেখানো হয়েছে প্রতিবাদী শিশুদের ছবি, পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তাদের নাম। ভয় হয় আবার পঞ্চগড় স্টাইলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার নামে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না তো? বাছাই করে নেতা গোছের কয়েক শিশুকে বের করে দেওয়া হবে না তো? সরকারি শিশু সদন-শিশু পরিবার বাস্তবায়ন নীতিমালার ১৩.৩ ধারা গোপনে শান দেওয়া হচ্ছে না তো? এ ধারায় শিশুদের যখন-তখন বহিষ্কার করা যায়। কিন্তু যাদের কারণে শিশুরা বিক্ষুব্ধ হয়, ন্যায্য আচরণ না পেয়ে রাস্তায় নামে তাদের জবাবদিহিতার কোনো সোজা পথ নেই।
শিশুরা রাস্তায় নামলে জেলা প্রশাসন নড়েচড়ে বসে, পরিদর্শনে যায়, আশ্বাস দেয়। তবে স্বাভাবিক সময়ে তাদের একটু খোঁজখবর নেওয়া উচিত। শুধু অনুষ্ঠানে ফুল নেওয়া আর গান-নাচ দেখে হাততালি দেওয়ার বাইরেও এ এতিম শিশুদের অভিভাবক হিসেবে তাদের কিছু করার আছে।
ব্রিটিশদের মতো অত্যাচারী আর দড়ি বাঁধার কৌশল অন্য কোনো ঔপনিবেশিকদের জানা ছিল না। তারপর এ চতুর আর শোষক জাতি ব্রিটিশ ভারতে জেলখানা গড়ে তোলার পাশাপাশি জেলে থাকা মানুষদের খোঁজখবর করার জন্য একটা বেসরকারি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। সরকারি চাকরি করে না বা সরকারের সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত নয় এমন নারী-পুরুষদের নিয়ে বেসরকারি জেল পরিদর্শক দল গঠনের ব্যবস্থা এখনও চালু আছে। এসব পরিদর্শক যখন খুশি যেদিন খুশি জেলখানায় গিয়ে কয়েদিদের সঙ্গে তাদের কয়েদখানায় বসে কথা বলতে পারেন। আমাদের স্বাধীন দেশে এতিমখানায় গিয়ে শিশুদের সঙ্গে কথা বলার কোনো বাস্তব সুযোগ নেই। যেদিন খুশি যখন খুশি যাওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না। তাহলে শিশুরা কার কাছে কীভাবে তাদের কষ্টের কথা, চাওয়ার কথা বা না পাওয়ার কথা বলবে? বেদনা থেকে ক্ষোভ_ ক্ষোভ থেকে বিক্ষোভ। তারপর তালা ভাঙা, রাস্তায় নামা এসব কারোর জন্যই ভালো নয়। আমাদের এমন একটা সহজ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যাতে শিশুরা তাদের চাওয়া-পাওয়া আর অভাব-অভিযোগের কথা প্রকাশ করতে পারে।
শিশুদের বিকাশ আর বেড়ে ওঠার জন্য পরিবারই হচ্ছে একমাত্র আদর্শ প্রতিষ্ঠান। তারপরও এতিমখানাগুলো চালু আছে। হয়তো থাকবে আরও অনেক দিন। এ জন্যই এতিমখানাগুলোতে যতটা সম্ভব পরিবারের পরিবেশ ফিরিয়ে আনা দরকার। সরকারিভাবে এতিমখানাগুলোর নাম পরিবর্তন করে শিশু পরিবার রাখা হয়েছে। এটা একটা ভালো পদক্ষেপ। তবে গাছের বিচার যেমন নামে হয় না, হয় তার ফলে তেমনি নাম পরিবর্তনের সুফল তখনই শিশুরা পাবে যখন শিশুদের কথা শোনার একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা যাবে।
পুনশ্চ : গত কয়েকদিন বিক্ষুব্ধ শিশুদের ঠাণ্ডা করার জন্য নতুন কাপড়, চাদর, বালিশের কভার দেওয়ার খবর পত্রিকায় এসেছে, এটা ভালো লক্ষণ তবে চাদর আর বালিশের কভারের নিচে যেন পঞ্চগড়ের মতো শাস্তির তলোয়ার ঝুলে না থাকে। প্রতিবাদী শিশুদের যেন রাস্তায় বের করে না দেওয়া হয়। যতদিন শিশু অধিকার কমিশন না হচ্ছে ততদিন মানবাধিকার কমিশন যদি নজরদারি করে তা হলে একটু চাপ কমে। শিশুরা ভালো নেই।

গওহার নঈম ওয়ারা : গবেষক

No comments

Powered by Blogger.