পদ্মা সেতু প্রকল্প-বিশ্বব্যাংকই ভুয়া প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ছিল by পার্থ সারথি দাস
পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছিল যে বিশ্বব্যাংক, সেই বিশ্বব্যাংকই ওই যোগ্যতা যাচাইয়ে ভুয়া তথ্যদানকারী চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কম্পানির (সিআরসিসি) স্থানীয় এজেন্টের পক্ষে দফায় দফায় দাবি করেছিল।
পদ্মা সেতুর ডিজাইন-পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়নে ওই প্রতিষ্ঠানটি অযোগ্য বিবেচিত হয়েছিল। অথচ বিশ্বব্যাংক মূল্যায়নটি গ্রহণ না করে চীনের ওই কম্পানিটিকে অন্তর্ভুক্ত করানোর ইচ্ছায় আরো কয়েকবার প্রাক-যোগ্যতা যাচাই করতে বাধ্য করে মূল্যায়ন কমিটিকে। কিন্তু প্রতিবারই কম্পানিটি অযোগ্য বিবেচিত হয়ে বাদ পড়ে। একপর্যায়ে ধরা পড়ে সিআরসিসির এজেন্টের জালিয়াতি। এ সত্ত্বেও বিশ্বব্যাংক সেতুর কাজ শুরু করার অনুমোদনপ্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রাখে। বাংলাদেশ সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে এ বিস্ময়কর তথ্য।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের দরপত্রে প্রাক-যোগ্যতার ক্ষেত্রে প্রথমবার ১১টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। সেতু বিভাগ জানায়, এর মধ্যে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের তালিকা ২০১০ সালের ২০ জুলাই বিশ্বব্যাংকের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠায় তারা। ডিজাইন-পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়নের পরই এ তালিকা বিশ্বব্যাংকে পাঠানো হয়। কিন্তু অনুমোদন না দিয়ে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই বিশ্বব্যাংক তিন মাস পর আবার প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ের পরামর্শ দেয়। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে দ্বিতীয় দফায় প্রাক-যোগ্যতার জন্য আহ্বান করা দরপত্রে ১০টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। দ্বিতীয় দফায়ও প্রথমবার মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ করা পাঁচটি প্রতিষ্ঠানই যোগ্য বিবেচিত হয়। সেতু কর্তৃপক্ষ ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি এই তালিকা বিশ্বব্যাংকের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠায়। কিন্তু বিশ্বব্যাংক একই বছরের ২৯ মার্চ বিশেষজ্ঞদের যাচাই-বাছাইয়ে অযোগ্য বিবেচিত চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কম্পানিকে বিবেচনা করার বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সুপারিশ করে। পরে ডিজাইন-পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি সিআরসিসির দাখিল করা কাগজপত্র পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করা যায় না উল্লেখ করে প্রতিবেদন দাখিল করে। সেতু কর্তৃপক্ষ ২০১১ সালের ৩০ মার্চ এ প্রতিবেদন বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠায়। প্রায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৬ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক সিআরসিসিকে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করার বিষয়টি পুনরায় পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দাখিলের অনুরোধ করে।
সেতু কর্তৃপক্ষ ডিজাইন-পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন যোগ করে সিআরসিসিকে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা না করার কারণ ব্যাখ্যা করে বিশ্বব্যাংককে চিঠি দেয়। একই বছরের ১৩ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক পুনরায় সিআরসিসির কাছ থেকে সেতু নির্মাণের পাইলের বিষয়ে অধিকতর তথ্য সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা অনুরোধ করে চিঠি দেয় সেতু বিভাগে। এরপর সিআরসিসির কাছে রেকিং পাইলের অভিজ্ঞতার প্রমাণপত্র চাওয়া হলে প্রতিষ্ঠানটি ছবিসহ কিছু প্রমাণ সেতু বিভাগে দাখিল করে। ডিজাইন-পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি রেকিং পাইলের অভিজ্ঞতার এই প্রমাণপত্র পর্যালোচনায় দেখতে পায়, অন্য প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ করা সেতুর ছবি পরিবর্তন করে সিআরসিসি নিজের নামে জমা দিয়েছে। ২০১১ সালের ৭ মে ডিজাইন-পরামর্শক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, সিআরসিসি মিথ্যা তথ্য দাখিল করেছে। এ অবস্থায় ঢাকার চীন দূতাবাসের ইকোনমিক কাউন্সিলরকে সেতু কর্তৃপক্ষের অফিসে ডেকে এনে সিআরসিসির চিঠি দেখানো হলে তিনি জানান, চীনা ভাষার চিঠিতে করা স্বাক্ষর নকল।
২০১১ সালের ৯ মে সিআরসিসি বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে মূল সেতুর প্রস্তাব প্রত্যাহার করে। তারা তাদের স্থানীয় এজেন্ট ভেঞ্চার ইন্টারন্যাশনালের এজেন্সিশিপ বাতিল করে। সেতু বিভাগ বুঝতে পারে সিআরসিসির পক্ষে স্থানীয় এজেন্ট ভেঞ্চার ইন্টারন্যাশনাল বিভিন্ন ভুল তথ্য ও জাল প্রমাণপত্র দিয়েছে। আর এই ভুল তথ্যদানকারী এজেন্টের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। পরে একই বছরের ১১ মে সেতু কর্তৃপক্ষ ডিজাইন-পরামর্শকের প্রতিবেদন ও সিআরসিসির প্রাক-যোগ্যতা প্রত্যাহারের প্রস্তাব বিশ্বব্যাংকের কাছে দেয়। মূল সেতুর প্রাক-যোগ্যতার জন্য যোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে সম্মতি চায়। পরদিন বিশ্বব্যাংক হালনাগাদ প্রাক-যোগ্যতার মূল্যায়ন প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সেতু কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে। প্রাক-যোগ্য পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের জন্য সর্বশেষ ১৮ মে বিশ্বব্যাংকে হালনাগাদ প্রতিবেদন পাঠানো হয়। পরে বিশ্বব্যাংক ১ জুলাই প্রাক-যোগ্য এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে সম্মতি দেয়।
কিন্তু দুই মাস যেতে না যেতেই ২০১১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক প্রকল্পে মূল সেতুর প্রাক-যোগ্যতা যাচাই ও পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে বলে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে অবহিত করে। প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করে।
জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এই প্রকল্পে প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দুর্নীতি হয়েছে বলে আমার জানা নেই।' পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক (প্রকল্প ও তদারকি) সানোয়ার আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ে কোনো দুর্নীতি হয়নি। একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিশ্বব্যাংক তদবির করেছিল। তবে একপর্যায়ে ওই প্রতিষ্ঠান তাদের প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।
তবে বিশ্বব্যাংক বলছে, প্রকল্পের স্বচ্ছতার ব্যাপারে যাতে প্রশ্ন না ওঠে সে জন্যই ওই প্রতিষ্ঠানের (সিআরসিসি) বিষয়ে তারা বারবার চিঠি দিয়েছিল তথ্য যাচাই করার জন্য। বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের যোগাযোগ কর্মকর্তা মেহেরীন মাহবুব কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ভবিষ্যতে যাতে অস্বচ্ছতার অভিযোগ না ওঠে সেদিকে খেয়াল রেখেই প্রকল্প বাস্তবায়নে আমরা আমাদের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে থাকি।'
চীনের কম্পানিটিকে অন্তর্ভুক্ত করার মানসে বিশ্বব্যাংক অনুমোদনপ্রক্রিয়ার ফাঁদে ফেলে নষ্ট করে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বছরখানেক সময়। পছন্দের প্রতিষ্ঠানটিকে নির্বাচিত তালিকায় না রাখায় অখুশি হয়ে প্রকল্পে শেষমেশ অর্থায়নই স্থগিত করে সংস্থাটি। তবে একটি কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগও তোলে বিশ্বব্যাংক। কোনো ক্ষেত্রেই বিশ্বব্যাংক তাদের অভিযোগের বিষয়গুলো স্পষ্ট করেনি। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্তে নেমে প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কোনো দুর্নীতি পায়নি। আর কানাডার প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারেও দুদকের তদন্ত চলছে। তবে কানাডার পুলিশও বিষয়টি তদন্ত করায় তাদের ফলাফলটির জন্যও অপেক্ষা করছে দুদক।
দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্পটি ঝুলিয়ে রাখা ও দুর্নীতির অভিযোগ তোলায় ক্ষুণ্ন হয়েছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি। প্রকল্পে নির্মাণ ব্যয়ও বাড়ছে দফায় দফায়। প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। এই অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য অভিযুক্ত করে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে 'তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি'র সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিশ্বব্যাংক তাদের ঋণ সহায়তার প্রকল্পে তাদেরই পছন্দের লোকজনকে বসাতে চায়। না হলে খেপে যায়। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ক্ষেত্রেও বিশ্বব্যাংকের ফাঁদে পড়েছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা যায়। তবে সরকারের অবস্থান এ ক্ষেত্রে শক্ত হতে হবে। আমরা ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলাম।'
দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে নিয়ে গঠিত পদ্মা সেতু প্রকল্পের আট সদস্যের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রায় সব সদস্যের সঙ্গে দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তারা কথা বলেছেন। বিশ্বব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী যোগ্য প্রতিষ্ঠানের তালিকা করেই তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে দুদককে জানিয়েছে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি। কিন্তু চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় এজেন্ট জালিয়াতি করেছে।
সেতু নির্মাণ নিয়ে বর্তমান অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে এখন দেশীয় অর্থায়ন বা বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশনির্ভরতা কমাতে হবে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক পিয়াস করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে কি না এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। সরকারের উচিত পুরো বিষয়টিই জাতির সামনে তুলে ধরা। আমরা সরকারের স্পষ্ট অবস্থান জানতে চাই।'
পদ্মা সেতু প্রকল্পের দরপত্রে প্রাক-যোগ্যতার ক্ষেত্রে প্রথমবার ১১টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। সেতু বিভাগ জানায়, এর মধ্যে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের তালিকা ২০১০ সালের ২০ জুলাই বিশ্বব্যাংকের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠায় তারা। ডিজাইন-পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়নের পরই এ তালিকা বিশ্বব্যাংকে পাঠানো হয়। কিন্তু অনুমোদন না দিয়ে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই বিশ্বব্যাংক তিন মাস পর আবার প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ের পরামর্শ দেয়। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে দ্বিতীয় দফায় প্রাক-যোগ্যতার জন্য আহ্বান করা দরপত্রে ১০টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। দ্বিতীয় দফায়ও প্রথমবার মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ করা পাঁচটি প্রতিষ্ঠানই যোগ্য বিবেচিত হয়। সেতু কর্তৃপক্ষ ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি এই তালিকা বিশ্বব্যাংকের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠায়। কিন্তু বিশ্বব্যাংক একই বছরের ২৯ মার্চ বিশেষজ্ঞদের যাচাই-বাছাইয়ে অযোগ্য বিবেচিত চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কম্পানিকে বিবেচনা করার বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সুপারিশ করে। পরে ডিজাইন-পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি সিআরসিসির দাখিল করা কাগজপত্র পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করা যায় না উল্লেখ করে প্রতিবেদন দাখিল করে। সেতু কর্তৃপক্ষ ২০১১ সালের ৩০ মার্চ এ প্রতিবেদন বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠায়। প্রায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৬ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক সিআরসিসিকে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করার বিষয়টি পুনরায় পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দাখিলের অনুরোধ করে।
সেতু কর্তৃপক্ষ ডিজাইন-পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন যোগ করে সিআরসিসিকে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা না করার কারণ ব্যাখ্যা করে বিশ্বব্যাংককে চিঠি দেয়। একই বছরের ১৩ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক পুনরায় সিআরসিসির কাছ থেকে সেতু নির্মাণের পাইলের বিষয়ে অধিকতর তথ্য সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা অনুরোধ করে চিঠি দেয় সেতু বিভাগে। এরপর সিআরসিসির কাছে রেকিং পাইলের অভিজ্ঞতার প্রমাণপত্র চাওয়া হলে প্রতিষ্ঠানটি ছবিসহ কিছু প্রমাণ সেতু বিভাগে দাখিল করে। ডিজাইন-পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি রেকিং পাইলের অভিজ্ঞতার এই প্রমাণপত্র পর্যালোচনায় দেখতে পায়, অন্য প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ করা সেতুর ছবি পরিবর্তন করে সিআরসিসি নিজের নামে জমা দিয়েছে। ২০১১ সালের ৭ মে ডিজাইন-পরামর্শক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, সিআরসিসি মিথ্যা তথ্য দাখিল করেছে। এ অবস্থায় ঢাকার চীন দূতাবাসের ইকোনমিক কাউন্সিলরকে সেতু কর্তৃপক্ষের অফিসে ডেকে এনে সিআরসিসির চিঠি দেখানো হলে তিনি জানান, চীনা ভাষার চিঠিতে করা স্বাক্ষর নকল।
২০১১ সালের ৯ মে সিআরসিসি বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে মূল সেতুর প্রস্তাব প্রত্যাহার করে। তারা তাদের স্থানীয় এজেন্ট ভেঞ্চার ইন্টারন্যাশনালের এজেন্সিশিপ বাতিল করে। সেতু বিভাগ বুঝতে পারে সিআরসিসির পক্ষে স্থানীয় এজেন্ট ভেঞ্চার ইন্টারন্যাশনাল বিভিন্ন ভুল তথ্য ও জাল প্রমাণপত্র দিয়েছে। আর এই ভুল তথ্যদানকারী এজেন্টের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। পরে একই বছরের ১১ মে সেতু কর্তৃপক্ষ ডিজাইন-পরামর্শকের প্রতিবেদন ও সিআরসিসির প্রাক-যোগ্যতা প্রত্যাহারের প্রস্তাব বিশ্বব্যাংকের কাছে দেয়। মূল সেতুর প্রাক-যোগ্যতার জন্য যোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে সম্মতি চায়। পরদিন বিশ্বব্যাংক হালনাগাদ প্রাক-যোগ্যতার মূল্যায়ন প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সেতু কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে। প্রাক-যোগ্য পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের জন্য সর্বশেষ ১৮ মে বিশ্বব্যাংকে হালনাগাদ প্রতিবেদন পাঠানো হয়। পরে বিশ্বব্যাংক ১ জুলাই প্রাক-যোগ্য এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে সম্মতি দেয়।
কিন্তু দুই মাস যেতে না যেতেই ২০১১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক প্রকল্পে মূল সেতুর প্রাক-যোগ্যতা যাচাই ও পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে বলে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে অবহিত করে। প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করে।
জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এই প্রকল্পে প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দুর্নীতি হয়েছে বলে আমার জানা নেই।' পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক (প্রকল্প ও তদারকি) সানোয়ার আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ে কোনো দুর্নীতি হয়নি। একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিশ্বব্যাংক তদবির করেছিল। তবে একপর্যায়ে ওই প্রতিষ্ঠান তাদের প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।
তবে বিশ্বব্যাংক বলছে, প্রকল্পের স্বচ্ছতার ব্যাপারে যাতে প্রশ্ন না ওঠে সে জন্যই ওই প্রতিষ্ঠানের (সিআরসিসি) বিষয়ে তারা বারবার চিঠি দিয়েছিল তথ্য যাচাই করার জন্য। বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের যোগাযোগ কর্মকর্তা মেহেরীন মাহবুব কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ভবিষ্যতে যাতে অস্বচ্ছতার অভিযোগ না ওঠে সেদিকে খেয়াল রেখেই প্রকল্প বাস্তবায়নে আমরা আমাদের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে থাকি।'
চীনের কম্পানিটিকে অন্তর্ভুক্ত করার মানসে বিশ্বব্যাংক অনুমোদনপ্রক্রিয়ার ফাঁদে ফেলে নষ্ট করে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বছরখানেক সময়। পছন্দের প্রতিষ্ঠানটিকে নির্বাচিত তালিকায় না রাখায় অখুশি হয়ে প্রকল্পে শেষমেশ অর্থায়নই স্থগিত করে সংস্থাটি। তবে একটি কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগও তোলে বিশ্বব্যাংক। কোনো ক্ষেত্রেই বিশ্বব্যাংক তাদের অভিযোগের বিষয়গুলো স্পষ্ট করেনি। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্তে নেমে প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কোনো দুর্নীতি পায়নি। আর কানাডার প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারেও দুদকের তদন্ত চলছে। তবে কানাডার পুলিশও বিষয়টি তদন্ত করায় তাদের ফলাফলটির জন্যও অপেক্ষা করছে দুদক।
দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্পটি ঝুলিয়ে রাখা ও দুর্নীতির অভিযোগ তোলায় ক্ষুণ্ন হয়েছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি। প্রকল্পে নির্মাণ ব্যয়ও বাড়ছে দফায় দফায়। প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। এই অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য অভিযুক্ত করে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে 'তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি'র সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিশ্বব্যাংক তাদের ঋণ সহায়তার প্রকল্পে তাদেরই পছন্দের লোকজনকে বসাতে চায়। না হলে খেপে যায়। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ক্ষেত্রেও বিশ্বব্যাংকের ফাঁদে পড়েছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা যায়। তবে সরকারের অবস্থান এ ক্ষেত্রে শক্ত হতে হবে। আমরা ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলাম।'
দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে নিয়ে গঠিত পদ্মা সেতু প্রকল্পের আট সদস্যের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রায় সব সদস্যের সঙ্গে দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তারা কথা বলেছেন। বিশ্বব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী যোগ্য প্রতিষ্ঠানের তালিকা করেই তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে দুদককে জানিয়েছে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি। কিন্তু চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় এজেন্ট জালিয়াতি করেছে।
সেতু নির্মাণ নিয়ে বর্তমান অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে এখন দেশীয় অর্থায়ন বা বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশনির্ভরতা কমাতে হবে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক পিয়াস করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে কি না এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। সরকারের উচিত পুরো বিষয়টিই জাতির সামনে তুলে ধরা। আমরা সরকারের স্পষ্ট অবস্থান জানতে চাই।'
No comments