মনের কোণে হীরে-মুক্তো-বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রশাসনব্যবস্থার বিকল্প প্রস্তাবগুলো by ড. সা'দত হুসাইন

সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা সম্প্রতি একটি কৌতূহলোদ্দীপক প্রস্তাব গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। প্রস্তাবটি হচ্ছে- আইনের মাধ্যমে যেন এমন ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়, যাতে বৃহৎ দুটি দল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ পালাক্রমে দেশ শাসন পরিচালনা করতে পারে। ইতিপূর্বে মিলিটারি শাসন আমলে জেলে থাকা অবস্থায় তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে


সংবিধান যেন এমনভাবে সংস্কার করা হয়, যাতে সেনাবাহিনী প্রধান পদাধিকার বলে দেশের প্রধান নির্বাহীর আসনে অধিষ্ঠিত হয়। মাঝেমধ্যে এরূপ আপাত উদ্ভট প্রস্তাবের মাধ্যমে জনাব হুদা হাস্যরসের সৃষ্টি করে জাতিকে প্রফুল্ল রাখার প্রচেষ্টা চালান। সেদিক থেকে তিনি ধন্যবাদ পাওয়ার উপযুক্ত, যদিও এর ফলে তাঁর ভাবমূর্তিতে একটি ব্যঙ্গাত্মক ছাপ পড়েছে বলে মনে হয়।
তবে তাঁর এসব আপাত উদ্ভট প্রস্তাবকে ঘষে-মেজে নিলে অথবা নিজ বুদ্ধি ও মননশীলতা সহযোগে সম্প্রসারিত করে নিলে দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সম্বন্ধে বেশ কয়েকটি প্রণিধানযোগ্য বিকল্প সম্ভাবনার আভাস মেলে। যেমন জনাব হুদার প্রস্তাব অনুযায়ী বড় দুটি দল পালাক্রমে একেকটি নির্বাচনী মেয়াদে শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনী ফলাফলের কোনো বালাই নেই, যা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। নির্বাচনী ফলাফলকে বাদ দিয়ে কোনো ব্যক্তি বা দলকে শাসনক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। প্রস্তাবটিকে একটু সংশোধন করে যদি বলা হয় যে একই নির্বাচনী মেয়াদে প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হার অনুযায়ী প্রথম দুটি দল নির্বাচনী মেয়াদ ভাগাভাগি বা শেয়ার করে দেশ শাসন করবে, তাহলে কিন্তু একটি বিকল্প শাসনব্যবস্থার সম্ভাবনা পর্যালোচনার উপযোগী হয়ে পড়ে। বাংলাদেশেই এরূপ দৃষ্টান্ত রয়েছে। বিজেএমই-এর একটি মেয়াদে এরূপ ভাগাভাগি করে দুটি দল নির্বাহী কাজ পরিচালনা করেছে। এমনকি কম্বোডিয়ায় একই মেয়াদে একই সঙ্গে দুজন প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন, তবে তাঁদের প্রশাসন-পদ্ধতি সম্বন্ধে আমাদের সম্যক ধারণা নেই।
বিভক্ত হওয়ার পর এ উপমহাদেশের তিনটি দেশেই ঔপনিবেশিক শক্তি যুক্তরাজ্যের অনুকরণে শাসনব্যবস্থা প্রচলন করা হয়। সামরিক বা মিলিটারি শাসনের কারণে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু যখনই গণতান্ত্রিক শাসন প্রচলিত হয়েছে, তখনই যুক্তরাজ্যের অন্ধ অনুকরণেই সে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। নিরবচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আওতায় একটি বিশাল ফেডারেল পদ্ধতির সরকার গড়ে উঠলেও ভারত ঔপনিবেশিক শক্তি যুক্তরাজ্যের আদলেই তার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিনির্মাণ করেছে। এ ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিটি নির্বাচনী এলাকা থেকে একজন সংসদ সদস্য নির্বাচন। সংসদ সদস্য কোনো রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন। আবার তিনি স্বতন্ত্রভাবেও নির্বাচিত হতে পারেন। সংসদে যে দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য রয়েছে, সে দলের নেতাই প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান নির্বাহী হিসেবে সরকার গঠন করেন। বাংলাদেশে পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য সরকার গঠন করা হয়। এ ব্যবস্থায় এমন হতে পারে যে কোনো দলের মোট প্রাপ্ত ভোট অন্য প্রত্যেক দলের চেয়ে বেশি হওয়া সত্ত্বেও সংসদে সে দলের নির্বাচিত সদস্যসংখ্যা কম হওয়ার কারণে তারা সরকার গঠনে ব্যর্থ হয়। তাদের বিরোধী দলে থাকতে হয়। এটি একটি বড় রকমের গাণিতিক অসংগতি, যা অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে যৌক্তিক বিবেচনায় এটি যে একটি বিরাট দুর্বলতা, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
এরূপ অসংগতি এবং নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক নির্বাচনের দুর্নীতি ও অনাচারগুলো নিরসনকল্পে খোদ ইউরোপেই এলাকাভিত্তিক নির্বাচনের পরিবর্তে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচনব্যবস্থা প্রচলন করা হয়েছে। পৃথিবীর আরো অনেক দেশে অন্তত আংশিকভাবে হলেও এ ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। বাংলাদেশে সংরক্ষিত মহিলা আসনের ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক মনোনয়ন প্রথা বাতিল করা হয়েছে। অথচ সাধারণ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থা প্রবর্তনের ব্যাপারে জোরালো অর্থবহ আলোচনা এখনো শুরু হয়নি বললেই চলে। গুরুত্বের বিবেচনায় বিষয়টির ওপর জাতীয় পর্যায়ে জোর আলোচনা শুরু হওয়া আবশ্যক বলে মনে করি।
আলোচনার অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নির্বাচিত সরকারের শাসনকালের মেয়াদ নির্ধারণ। বর্তমানে এই মেয়াদকাল হচ্ছে পাঁচ বছর। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ তথা প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় কর্মসূচি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত সময়ের প্রয়োজন। সেদিক থেকে পাঁচ বছর অযৌক্তিক মেয়াদ নয়। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এত দীর্ঘ সময় ব্যাপ্ত মেয়াদ শাসক দলের মধ্যে আত্মম্ভরিতা, স্বেচ্ছাচারিতা এবং ক্ষমতা স্থায়ীকরণের মানসিকতা সৃষ্টি করে। শাসক দল এবং রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্রের চাপে থাকা বিরোধী দল এত দীর্ঘ সময়ে অনেকটা বেপরোয়া হয়ে ওঠে, তারা ধ্বংসাত্মক কর্মসূচির প্রতি আকৃষ্ট হয়। ইংরেজি পরিভাষায় শাসক দল 'ডেসপট' এবং বিরোধী দল 'ডেসপারেট' হয়ে পড়ে। দুই দলের এরূপ মানসিক অবস্থায় সাধারণ মানুষ পিষ্ট হতে থাকে। এ সমস্যা নিরসনকল্পে অনেকেই নির্বাচিত সরকারের শাসনকাল পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে চার বা তিন বছর করা যৌক্তিক হবে বলে মনে করেন। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার দাবি রাখে।
একই সঙ্গে জাতীয় সংহতি এবং স্থিতিশীলতার স্বার্থে শাসনক্ষমতার কিছু অংশ বিরোধী দলের মধ্যে বণ্টন করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। '৯১ সাল থেকে দেশে যে কয়টি গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হয়েছে, সংসদে তাদের অবস্থান এমন সুদৃঢ় ছিল যে কোনো আইন বা প্রস্তাব পাসের জন্য বিরোধী দলের সহযোগিতার প্রয়োজন দেখা যায়নি। পঞ্চম ('৯১-৯৬) এবং সপ্তম ('৯৬-২০০১) সংসদে শাসক দলের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় অন্তত সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে বিরোধী দলের সহযোগিতার আবশ্যকতা ছিল। অষ্টম (২০০১-২০০৬) এবং নবম (২০০৯ থেকে চলমান) সংসদে সরকারি দলের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় বিল পাস কিংবা সংবিধান সংশোধন কোনো ক্ষেত্রেই বিরোধী দলের সহযোগিতার প্রয়োজন হয় না। ফলে বিরোধী দল সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতাহীন এবং উপেক্ষিত হয়ে পড়ে। এর সঙ্গে 'উইনার টেকস ইট অল'- এই মানসিকতার কারণে বিরোধী দলের সদস্যদের মধ্যে চরম হতাশা এবং নেতিবাচক মানসিকতার সৃষ্টি হয়, যা স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশের বিপরীতে মারাত্মক পরিপন্থী উপাদান হিসেবে কাজ করে। সাংবিধানিক এবং আইনি কাঠামোর মধ্যে বিরোধী দলের কিছুটা ক্ষমতা নিশ্চিত করে একটি 'ইনক্লুসিভ' শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা গেলে নৈরাজ্য এবং অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা বহুলাংশে তিরোহিত হবে। এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে সর্বমহলে আলোচনা হওয়া বাঞ্ছনীয়। এখানে বলা প্রয়োজন যে আনুষ্ঠানিক প্রটোকল নির্দেশে যা-ই থাকুক না কেন, দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর পর তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বিরোধীদলীয় নেতাই স্বীকৃত। এ স্বীকৃতির আনুষ্ঠানিক রূপায়ণ দেশের জন্য বিশেষ কল্যাণকর হবে।
বর্তমান ব্যবস্থায় নির্বাচন শেষ হওয়ার পর শাসক দলের বিপরীতে ভোটাররা তথা সাধারণ জনগণ সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। তাদের কথায় কথায় পাঁচ বছরের জন্য অপেক্ষা করতে বলা হয়। সংসদের মাধ্যমে শাসক দলকে কোনো দিনই জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায় না, কারণ সংসদে শাসক দলের নিশ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে এবং সংসদ সব সময়ই সংসদ নেতা বা প্রধানমন্ত্রীর সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণে থাকে। সুতরাং দেশের অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক অবস্থা যা-ই হোক না কেন, শাসক দল অনেকটা নিশ্চিন্ত মনেই সময় কাটাতে পারে, যতক্ষণ পর্যন্ত রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে তা বিরোধী দলের নিয়ন্ত্রণে চলে না যায়। দেশের সংবিধান বা আইনি কাঠামোয় 'রিকল সিস্টেম' প্রবর্তন করা গেলে এ অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পাওয়া যেত। এ বিষয়ের ওপরও জাতীয় পর্যায়ে জোর আলোচনা শুরু হতে পারে।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আরো অনেক বিষয়ের ওপরও জাতীয় পর্যায়ে নিবিড় আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন, যা সীমিত পরিসরের এই সংলেখে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রদেশ সৃষ্টির সম্ভাবনাসহ শাসনব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ, সুপ্রিম গভর্নেন্স কাউন্সিল গঠন, দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপরেখা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ, রাষ্ট্রীয় পদগুলোর নিয়োগ পদ্ধতি নির্ধারণ, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বয়সসীমার সুসামঞ্জস্যকরণ, কিছু নির্বাচিত পদের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ, নির্বাচিত এবং অনির্বাচিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকার, ক্ষমতা, সীমাবদ্ধতা এবং পারস্পরিক সম্পর্কের নীতিনির্ধারণ ইত্যাদি।
উদ্ভট প্রস্তাব সমাজে হাস্যরসের সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে এ ধরনের প্রস্তাব অনেক সময় আমাদের নতুন চিন্তার খোরাক জোগায়। আপাত উদ্ভট প্রস্তাবগুলোকে শুধু হেসে উড়িয়ে না দিয়ে এর সংশোধিত বা সম্প্রসারিত রূপ কোনো নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয় কি না তা পরীক্ষা করে দেখলে ক্ষেত্রবিশেষে সমাজ এবং দেশ উপকৃত হতে পারে। কোনো প্রস্তাবের মূল বা পরিশীলিত প্রকাশ যদি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করার অনুকূলে সামান্যতম সহায়ক হয়, তবে সে প্রস্তাবের ওপর জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা কিংবা বিতর্ক অনুষ্ঠান থেকে আমাদের পিছপা হওয়া সমীচীন হবে না।
লেখক : পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

No comments

Powered by Blogger.