গোলটেবিল বৈঠক দুর্যোগে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার

১ জুন ২০১৩, প্রথম আলোর আয়োজনে ‘দুর্যোগে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সহযোগিতায় ছিল প্ল্যান বাংলাদেশ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।
যাঁরা অংশ নিলেন
আশরাফ হোসেন, মহাপরিচালক, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর।
মোহাম্মদ আবদুল ওয়াজেদ, মহাপরিচালক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়।
মেহতাব খানম: অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সেলিনা আমিন: কান্ট্রি প্রজেক্টস ম্যানেজার, প্ল্যান বাংলাদেশ।
মো. রমজান আলী, উপসচিব, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়।
মোহাম্মদ শরীফ, পরিচালক, এমসিএইচ সার্ভিস, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর।
মোমেনা খাতুন: প্রজননস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
মোজাহারুল ইসলাম খান: সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার (এসপিও), ইউএনএফপিএ।
জিনাত আরা বেগম: হেড অব, ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, প্ল্যান বাংলাদেশ।
কামরুন নাহার: অ্যাসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট, আইসিডিডিআরবি।
মো. জসিমউদ্দিন কবির: জাতীয় সমন্বয়কারী, ইন্টারভিডা, বাংলাদেশ।
ইখতিয়ার উদ্দিন খন্দকার: অ্যাডভাইজার হেলথ, প্ল্যান বাংলাদেশ।
শাহানাজ মুন্নি: বার্তাপ্রধান, এটিএন বাংলা।
মো. মনির হোসেন: প্রজেক্ট ম্যানেজার, প্ল্যান বাংলাদেশ।
সৈয়দা নবীন আরা: প্রজেক্ট ম্যানেজার, প্ল্যান বাংলাদেশ।
মো. নুরুল ইসলাম: মনিটরিং কো-অর্ডিনেটর, প্ল্যান বাংলাদেশ।
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম, সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম: দুর্যোগকবলিত এলাকায় সব মানুষই সমস্যার মধ্যে থাকে। বিশেষ করে, কিশোর-কিশোরীদের বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া, সেখানে থাকা, পয়োনিষ্কাশন—কোনোটিই নিরাপদ নয়। তারা যৌন হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়। আলোচনায় এসব বিষয় আসবে। এখন আলোচনা করবেন সেলিনা আমিন।

সেলিনা আমিন: বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা চার ভাগের এক ভাগ অ্যাডোলেসেন্ট (কিশোর-কিশোরী)। ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের কিশোর-কিশোরী ধরা হয়। বাংলাদেশে দুর্যোগের ক্ষেত্রে রিলিফসহ বিভিন্ন সহযোগিতা দেওয়ার সময় কিশোর-কিশোরীদের কথা কতটুকু ভাবি? বরগুনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার—এসব এলাকায় রিলিফ দেওয়ার সময় ও আশ্রয়কেন্দ্রে কিশোর-কিশোরীদের প্রচণ্ড রকমের প্রতারণা, প্রবঞ্চনা করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে অন্যায় সুবিধা দিতে বাধ্য করা হয়। মেয়েদের ঋতুকালীন ব্যবস্থাপনার কোনো উদ্যোগ নেই। এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। এই মুহূর্তে প্ল্যান প্রত্যক্ষভাবে ২৫ হাজার এবং পরোক্ষভাবে ১২ হাজার কিশোর-কিশোরীকে নিয়ে কাজ করছে। আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের অধিকার রক্ষা। এ ক্ষেত্রে কিশোর-কিশোরীদের বাবা-মা ও নীতিনির্ধারকদের সচেতন করে তোলা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিশোর-কিশোরীদের মারাত্মক এ সমস্যা তাঁরা অনেকে জানেনই না। বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও ঢাকার কিছু এলাকার তিন লাখ কিশোর-কিশোরীকে নিয়ে ইউএনএফপিএর সঙ্গে একটি কর্মসূচি করতে যাচ্ছি, যাতে নীতিনির্ধারণী মহল দুর্যোগে কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য অধিকারের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখে এবং সবার মধ্যে একটা ব্যাপক সচেতনতা তৈরি হয়।

মো. মনির হোসেন: আমাদের দেশে কিশোর-কিশোরীরা স্বাভাবিক অবস্থায়ও প্রজননস্বাস্থ্যসেবা সঠিকভাবে পায় না। বাল্যবিবাহ, অল্প বয়সে গর্ভধারণ, মাদক, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন সমস্যা কিশোর-কিশোরীদের আছে। কিন্তু দুর্যোগে যৌন ও প্রজননের সমস্যা তাদের আরও অসহায় করে তোলে। সিডর, আইলার পর ওই সব এলাকার সবকিছু বিপর্যস্ত হয়ে যায়। ফলে কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের ঝুঁকির মাত্রা আরও বেড়ে যায়। আশ্রয়কেন্দ্রে দুর্যোগের আগে ও পরে তাদের জন্য পৃথক কোনো কক্ষ, টয়লেট থাকে না। ফলে তারা বিশেষ প্রয়োজন মেটাতে পারে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের একটা গবেষণায় কিছু বিষয় উঠে এসেছে। যেমন দুর্যোগের সময় কিশোর-কিশোরীদের কথা একেবারেই ভাবা হয় না। দুর্যোগের সময় সাধারণত পুরুষ চিকিৎসকেরা প্রাথমিক সেবা দেন। ফলে কিশোরীরা তাঁদের কাছ থেকে সেবা নিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। এসব কিশোরী এক কাপড়ে বাসা থেকে আসে। কোনো কারণে তাদের ঋতুস্রাব শুরু হলে চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। এ ছাড়া যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়।

মোহাম্মদ আবদুল ওয়াজেদ: প্ল্যানের গবেষণায় দেখলাম, কিশোরদের চেয়ে কিশোরীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে সরকার কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে? মাত্র সেপ্টেম্বর ২০১২ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন তৈরি হয়েছে। আইনে শিশুসহ বিপদগ্রস্ত সবার সুরক্ষার কথা বলা আছে। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০১১-এ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ নীতিসহ নারী, শিশু, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী সবার কথা বলা আছে। প্রসূতিদের জন্য পৃথক কক্ষ ও নারীদের জন্য পৃথক টয়লেটের কথা বলা আছে। ১৯৯১ সালের ঝড়ের পর সরকারি-বেসরকারি দুভাবেই অনেক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এ কেন্দ্রগুলো মেয়েদের জন্য উপযোগী নয়। ১৯৯১ সালের পরে আশ্রয়কেন্দ্রের নকশা এমনভাবে করা হয়েছে, যেখানে মেয়েদের জন্য আলাদা সুযোগ-সুবিধা থাকে। সরকারি থেকে বেসরকারি পর্যায়ে বেশি আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। যারা আশ্রয়কেন্দ্র করবে, তাদের নীতিমালা অনুসরণ করার কথা বলা হচ্ছে। একটি বিদেশি সংস্থা আমাদের নকশা না মেনে আশ্রয়কেন্দ্র করতে চেয়েছিল। আমরা নিষেধ করেছি। পরে আমাদের পরামর্শ অনুসারে করেছে। এভাবে কিশোর-কিশোরীদের অধিকার রক্ষার চেষ্টা করছি। স্ট্যান্ডিং অর্ডার অন ডিজাস্টার নামে ১৯৯৭ সালে একটি বই বের করা হয়। ২০১০ সালে সংশোধন করে এটিকে নীতিমালায় পরিণত করা হয়। দুর্যোগের আগে, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগের পরে কিশোর-কিশোরী, নারী, শিশু, বৃদ্ধ—কার জন্য কী প্রয়োজন, সেসব বিস্তারিত বলা আছে। দুর্যোগকালে বাধ্যতামূলকভাবে শতকরা তিন ভাগের এক ভাগ নারী স্বেচ্ছাসেবকের কথা বলা হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলের ১২টি জেলায় ১৬ হাজার নারী স্বেচ্ছাসেবক আছেন। এককভাবে দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

কামরুন নাহার: জনাব কাইয়ুম আইসিডিডিআরবি নারীদের জন্য একটি ম্যাট (মাদুর) তৈরি করেছে। এটা ‘কাইয়ুমস ম্যাট’ নামে পরিচিতি পাচ্ছে। এটা নারীদের প্রসবোত্তর রক্তপাত বিপজ্জনক মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে কি না তা বুঝতে সাহায্য করছে। দুর্যোগের সময় কিশোর-কিশোরীদের কিছু সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। প্রথমত, দেশে বাল্যবিবাহের প্রবণতা রয়েছে। দুর্যোগের সময় এটি আরও বেড়ে যায়। এ সময় পরিবারগুলো আর্থিক সংকটে পড়ে। কারও পরিবারে পাঁচজন সদস্য আছে। এর মধ্যে হয়তো ১২-১৩ বছরের একটি মেয়ে আছে। পরিবার মনে করে, তাকে যদি কোনোভাবে পার করা যায়, তাহলে অভাব-অনটন কিছুুটা কাটবে। এ ধারণা থেকে মেয়েটিকে বিয়ে দেওয়া হয়, ভবিষ্যতে যার পরিণতি ভালো হয় না। দ্বিতীয়ত, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যাওয়া। আপনারা আলোচনায় শুনেছেন, মাসের পর মাস গড়িয়ে বছর আসে। কিন্তু পানিবন্দী জীবন শেষ হয় না। আমি বরিশালের একটি পানিপ্রবণ এলাকার মেয়ে হিসেবে জানি, এরা কী করে। এরা লঞ্চে উঠে সোজা ঢাকায় চলে আসে। তারা বস্তিতে ওঠে এবং স্থায়ীভাবে একটি দারিদ্র্যচক্রের মধ্যে পড়ে যায়। এসব কারণে মানব পাচারের ঘটনা ঘটে।

মোমেনা খাতুন: পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে ৩২ বছর কাজ করেছি। সরকার স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে সমান গুরুত্ব দিচ্ছে। কিশোর-কিশোরীদের পুষ্টির বিষয়টি আগে তেমন গুরুত্ব পায়নি। এখন এ ক্ষেত্রে সরকার যথেষ্ট কাজ করছে। পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। ২০০৬ সালে কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে একটি কৌশলপত্র তৈরি হয়েছিল। এখনো সেটা কার্যকর হয়েছে বলে জানা নেই। তা ছাড়া আমার জানামতে, এ কৌশলপত্রে দুর্যোগে কিশোর-কিশোরীদের জন্য পৃথকভাবে কিছু বলা হয়নি। এ ক্ষেত্রে আজকের আলোচনার সুপারিশগুলো বর্তমান নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হবে। দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ হয়ে থাকে। অর্থনৈতিক দৈন্যের কারণে বাল্যবিবাহ হয়। বাল্যবিবাহ ও অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ রোধ করতে হলে কেবল প্রকল্প এলাকায় কাজ করলে হবে না, সারা দেশে এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে। এ ব্যাপারে কিছু কাজ হয়তো হচ্ছে, কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। দেশে কিশোরীদের পুষ্টির অভাব প্রায় জন্ম থেকেই শুরু হয়। দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় এটি মারাত্মক আকার ধারণ করে। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে পুষ্টির বিষয়টিও ভাবতে হবে ।

মোহাম্মদ শরীফ: আমাদের দুর্ভাগ্য যে একটা কর্মপরিকল্পনা করতে বছরের পর বছর লেগে যায়। দুই বছর তিন মাসে দুটি কর্মপরিকল্পনা পেয়েছি। একটি শেষ করেছি এবং অন্যটি প্রক্রিয়াধীন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নতুন। আগামী জুনের মধ্যে কর্মসূচিতে কিশোরীদের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করব। আমাদের চার হাজার স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র আছে। এগুলোকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কাজে লাগাতে পারি। পরিবারকল্যাণ পরিদর্শকদের একটা কক্ষ দুর্যোগের সময় কিশোরীদের জন্য রাখার ব্যবস্থা করব। প্ল্যান বাংলাদেশ ও ইউএনএফপিএর সহযোগিতায় আমরা কিছু কাজ করছি। দুর্যোগের সময় বিবাহিত ও অবিবাহিত উভয়ের জন্য পৃথক ব্যবস্থার কথা ভাবছি। বিবাহিতদের জন্য পিল, ইনজেকশনসহ কিছু উপকরণ সরবরাহ এবং অবিবাহিতদের জন্য পৃথক কক্ষসহ স্যানিটারি প্যাডের বিষয়টি আমরা বিবেচনা করব। দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় ২৪ ঘণ্টা প্রসবের ব্যবস্থার বিষয়টিও আমরা ভাবছি। দুর্যোগের সময় নারী চিকিৎসকের বিষয়টি আমি নিজে তত্ত্বাবধান করব। এ ছাড়া এখানে আমাদের প্যারামেডিক্স আছে, প্রতিটি ইউনিয়নে পরিবারকল্যাণ প্রতিনিধি, নার্স ও কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারসহ আরও অনেকে কাজ করছেন। ৩১ শতাংশ মা মারা যান প্রসবের পর রক্তক্ষরণে। এ ক্ষেত্রে আমরা খুব ভালো ব্যবস্থা নিয়েছি। পরিবার পরিকল্পনা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারলে দ্রুত সফলতা আসবে।

মোজাহারুল ইসলাম খান: ১৮ বছর বয়সী সন্তানদের কিশোর-কিশোরী বলছি। কিন্তু গবেষণা বলছে, ৬৮ শতাংশ কিশোরীর ১৮ বছরের আগে বিয়ে হচ্ছে। দুর্যোগের সময় বিবাহিত কিশোরীদের কথাও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। ইউএনএফপিএর এক গবেষণায় দুর্যোগের সময় প্রসবের ভীষণ করুণ অবস্থা উঠে এসেছে। হয়তো কোনো এক বাঁধের ওপর বাস করছে। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। দু-তিনজন অদক্ষ নারী সহযোগিতা করছেন। যেকোনো সময় যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে। আশপাশে হয়তো সরকারি সুযোগ আছে। কিন্তু ওই অবস্থায় সেখানে যাওয়া যে কতটা কষ্টকর, কেবল ভুক্তভোগীরা বুঝতে পারে। এখনো অভিভাবকেরা কিশোর-কিশোরীদের অধিকার সম্পর্কে জানেন না। সত্যিকার প্রয়োজনটা কী, সেটা নিরূপণের ক্ষেত্রে আমাদের সমস্যা রয়েছে। সমস্যার সঙ্গে সবাইকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

মো. রমজান আলী: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমরা অন্যদের থেকে এগিয়ে আছি। কিন্তু আজ একটি বিশেষ বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। দেশের সব হাসপাতালে এখনো শিশুদের দুধপান করানোর আলাদা জায়গা নেই। কিন্তু সরকার চেষ্টা করছে হাসপাতালগুলোকে নারীবান্ধব করার জন্য। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিতে এসব বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। দুর্যোগে নারী চিকিৎসককে হয়তো সব সময় পাওয়া যাবে না। কিন্তু স্বাস্থ্য সহকারী যাতে আরও বেশি থাকেন, তার জন্য আলোচনা করব। আগের আশ্রয়কেন্দ্রে সুযোগ-সুবিধা ছিল না। দীর্ঘদিন আশ্রয়কেন্দ্রে থাকলে সেখানে কিছু বাড়তি সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার। এ জন্য যদি কোনো আইন পরিবর্তন করতে হয়, ডিজি মহোদয় নিশ্চয়ই সেটা করবেন। কিছুদিন আগে থাইল্যান্ডে একটি কর্মশালায় গিয়েছিলাম। সেখানে সাতটি দেশের প্রতিনিধিরা ছিলেন। এই কর্মশালায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভালো। আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করি বলেই এ অবস্থানে আসতে পেরেছি।

শাহানাজ মুন্নি: দুর্যোগকালীন আশ্রয়কেন্দ্রে কোনো শিশুর জন্ম হলে তা অনেক ক্ষেত্রে বড় সংবাদ হয়ে ওঠে। শিশুসহ হাসিমুখে মাকে দেখা যায়। হাসিখুশি-সুখী সুখী ভাবের মধ্য দিয়ে খবরটি শেষ হয়ে যায়। কিন্তু মায়ের কষ্টের কথা আমরা কেউ জানি না। দুর্যোগের সময় পরিচিত জায়গা ছেড়ে ভিন্ন পরিবেশে কিশোরীদের যৌন হয়রানির আশঙ্কা থাকে। পরিবারগুলো বিপর্যস্ত থাকে। কেউ কাউকে রক্ষা করতে পারে না। এসব বিষয়ের সঠিক চিত্র তুলে ধরা গণমাধ্যমের কাজ। গণমাধ্যমের কর্মী হিসেবে আমরা কোনো ঘটনার সংবাদমূল্যটা দেখি। অনেক সময় আমাদের বিবেচনা বোধের অভাবে ভালো খবরকে তুলে আনতে পারছি না। এখানে গণমাধ্যমের কিছু করার আছে বলে মনে করি। প্রজননস্বাস্থ্য কেবল শারীরিক নয়, এর সঙ্গে একটা আবেগপ্রবণ মানসিক বিষয় জড়িত থাকে। সঠিক তথ্যপ্রবাহের প্রয়োজন। কিশোর-কিশোরীরা একেবারেই কম জানে। এর মধ্যেও রয়েছে ভুল তথ্য। এসব বিষয় কেবল খবরই নয়; নাটক, সিনেমা, তথ্যচিত্র বিভিন্নভাবে প্রচার করতে হবে।

মো. জসিমউদ্দিন কবির: দুর্যোগে কিশোর-কিশোরীদের চোখের সামনে মানুষ, জীবজন্তু মারা যাচ্ছে; ঘরবাড়ি, গাছপালা ভেঙে যাচ্ছে। জলোচ্ছ্বাসে সবকিছু ভেসে যাচ্ছে। তারা মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত থাকে। এ ক্ষেত্রে তাদের বিভিন্নভাবে সচেতন ও মনোরোগ চিকিৎসকের সাহায্যের বিষয়টিও ভাবতে হবে। আমরা শহরের বস্তিগুলোতে কিছু স্কুল পরিচালনা করি। এখানে দেখেছি, শিক্ষকেরা চিন্তাভাবনায় মধ্যযুগে আছেন। কোনো মেয়ের ঋতুকালীন, শিক্ষক বলেন, যাও এক সপ্তাহ স্কুলে আসার দরকার নেই। স্কুলে থাকলে কোনো মেয়ে বা ছেলেবন্ধু তার পাশে বসতে চায় না। আমরা ঢাকাসহ অন্যান্য এলাকার এক হাজার ৪০০ শিক্ষার্থীকে এসব বিষয়ে সচেতন করেছি। তখন কোনো কোনো অভিভাবক ভুল বুঝেছেন। আমাদের উদ্দেশ্য কর্মশালা শেষে তারা নিজেদের মহল্লার মানুষকে সচেতন করবে।

জিনাত আরা বেগম: দুর্যোগ মোকাবিলায় বিভিন্ন সংস্থা কাজ করার পরও অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না। একটার পর অন্য আরেকটা দুর্যোগ এসে সবকিছু ওলট-পালট করে দিচ্ছে। দুর্যোগ-পূর্ববর্তী সময়ে দুর্যোগ মোকাবিলার বিষয়টি ভাবতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলা কর্মসূচি এমনভাবে নিতে হবে, যাতে এরা দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হতে পারে। একটা কেন্দ্রে এত মানুষ আসে যে নারীর জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকলেও কাউকে পৃথক করা যায় না। সবাই এক জায়গায় থাকতে গিয়ে কিশোরীরা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। একটি সংস্থার সহযোগিতায় সাতক্ষীরায় পানিবন্দী মানুষের জন্য ১২ হাজার ঘর করা হয়েছে। ঘরগুলো যাতে কিশোর-কিশোরীবান্ধব হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। তা না হলে কিশোর-কিশোরীদের বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থায় কিশোর-কিশোরীদের মতামত ও কথা বলার সুযোগ থাকতে হবে। তারা সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে না পারলেও তাদের সমস্যাগুলো তুলে ধরতে পারবে। তারা পরিদর্শক হিসেবে কাজ করবে। দুর্যোগ-পূর্ববর্তী সময়ে এ কাজগুলো করতে পারলে দুর্যোগ মোকাবিলায় সফল হওয়া সম্ভব।

ইখতিয়ার উদ্দিন খন্দকার: সাধারণত পরিবারগুলোতে কিশোর-কিশোরীদের অবহেলা করা হয়। তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। স্বাভাবিক ও দুর্যোগ অবস্থাতেই এরা ঝুঁকিপূর্ণ। শুধু কিশোর-কিশোরী নয়; শিশু, নারী, বৃদ্ধ—এরা সবাই ঝুঁকিপূর্ণ। সঠিকভাবে দুর্যোগ মোকাবিলা করতে না পারলে দীর্ঘ মেয়াদে দেশে দুর্যোগের প্রভাব থেকে যাবে। কারও একার পক্ষে দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। সরকার, এনজিও, সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ—প্রত্যেককে যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। মাত্র কয়েক বছর পরই এই কিশোর-কিশোরীরা দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করবে। দুর্যোগের সময় যদি তারা মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ জীবন বিপন্ন হবে। কোনো ক্ষেত্রেই তারা দেশের ও নিজের জন্য অবদান রাখতে পারবে না। সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে এদের রক্ষা করতে হবে। সরকার সবাইকে রক্ষার জন্য অনেক পদক্ষেপ ইতিমধ্যে নিয়েছে। এখন দরকার তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন। দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য ১৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবক আছেন। তাঁরা যদি কিশোর-কিশোরীদের দিকটি গুরুত্বসহকারে দেখেন, তাহলে অনেকটা সমাধান হতে পরে।

আশরাফ হোসেন: আমরা সবাই চাই কিশোর-কিশোরীবান্ধব দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা। মুখে যা-ই বলি না কেন, এখনো অধিকাংশ পরিবার কন্যাশিশু জন্ম নিলে খুশি হতে পারে না। পরিবার থেকে শুরু হয় অবহেলা। তারপর সর্বত্র। এমন বাস্তবতায় দুর্যোগের সময় কিশোরী প্রজননস্বাস্থ্য কতটা রক্ষা করা সম্ভব, সেটি একটি প্রশ্ন। এই সমস্যা মাথায় রেখে আমাদের সবকিছু করতে হবে। সংবিধানে নারীর অধিকারের কথা বলা আছে। পর্যাপ্ত সেবাদানকারী সংস্থা, জনবল ও আইন রয়েছে। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে আছে চরম অবহেলা। সঠিকভাবে প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আমাদের মানসিক অবস্থা এখনো পুুরুষবান্ধব। যত দিন পর্যন্ত এ জায়গায় পরিবর্তন আসবে না, তত দিন আইন, জনবল, সেবা—কোনো কিছুই কাজে আসবে না। আমি সামাজিক পরিবেশে নারীবান্ধব থাকি। নারীর পক্ষে কথা বলি। কিন্তু এর বাইরে গেলেই ভেতরের আমিটা বেরিয়ে আসে। আমরা যখন কথা বলি, আমাকে বাদ রেখে বলি। উপদেশ যা কিছু, সব আপনার জন্য। আমার জন্য কিছুই নয়। কর্মপরিকল্পনা এমনভাবে করতে হবে, যেখানে পুরুষ তার নিজের মধ্যে পরিবর্তন অনুভব করবে এবং পরিবর্তিত মানসিকতা নিয়ে সেবার জন্য এগিয়ে যাবে।

মেহতাব খানম: আমি খুবই হতাশ। আমার অভিজ্ঞতা নেতিবাচক। এসব শুনে নিজেরও অনেক সময় উঠে দাঁড়াতে কষ্ট হয়। দুর্যোগকবলিত বা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি মেয়ের ১৩-১৪ বছরে বিয়ে হচ্ছে। ২২-২৩ বছরে তিন-চারটি সন্তান হচ্ছে। তখন মনে হচ্ছে, মেয়েটির বয়স ৪০-৪২ বছর। তার স্বামী আবার বিয়ে করছে। সমাজের উঁচু থেকে নিচ পর্যন্ত কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। কোথাও দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন দেখছি না। গতকাল একটি মেয়ে এসেছে। মেয়েটি মারা যেতে চায়। তৃতীয়বার মৃত্যুর চেষ্টা করেও বেঁচে গেছে। ছোটবেলায় মাকে প্রচণ্ডভাবে বাবার হাতে নির্যাতিত হতে দেখেছে। মেয়েটি শহরে বাস করে। তাকেও ছোটবেলায় গ্রামে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে কাজগুলো সে কখনো করেনি, সেগুলো করতে হতো। যেমন, ধানের কাজ থেকে শুরু করে রাত-দিন ঘর-সংসারের সব কাজ। তার সঙ্গে ছিল বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন। মেয়েটির মানসিক অবস্থা বুঝতে পারি। এ রকম কত শত ঘটনা আমরা জানতে পারি না। নারীরা নিজেদের দুর্বল মনে করছে। কেউ তাকে ধর্ষণ করেছে বা খারাপ মন্তব্য করছে; সে ভাবছে নষ্ট হয়ে গেছে। মেয়েটি মোটেই এর জন্য দায়ী নয়। নারী পবিত্র। কখনো নষ্ট হয় না। গণমাধ্যম অত্যাচারিতকে তুলে ধরে। অত্যাচারীকে খুঁজে পায় না। মা-বাবাদের নিয়ে ঘন ঘন কর্মশালা করতে হবে। সবাই একসঙ্গে কাজ করলে হয়তো একদিন আসবে, যেদিন আর কোনো মেয়েকে কাঁদতে হবে না।

মো. নুরুল ইসলাম: আমরা সবাই আশা করি কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার সুরক্ষা হোক। এ জন্য অভিভাবক ও কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে তাঁদের ধারণা দিতে হবে। অভিভাবকদের যদি এ বিষয়ে যথেষ্ট ধারণা থাকে, তাহলে তাঁরা তাঁদের সন্তানদের বোঝাতে সক্ষম হবেন। দুর্যোগে কিশোর-কিশোরীদের জন্য আরও বেশি কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এমন একদিন নিশ্চয়ই আসবে, যেদিন এসব বিষয়ে আর আলোচনার প্রয়োজন হবে না।

সৈয়দা নবীন আরা: প্ল্যান বাংলাদেশ দীর্ঘদিন যাবৎ কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে। বরিশালের কিছু অঞ্চলে কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার বিষয়ক সমস্যাগুলো আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। আমরা আশা করব, সমাজের সব শ্রেণীর মানুষ এদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। সরকারি-বেসরকারি, এনজিও সবাই একসঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করলে নিশ্চয়ই এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব হবে। অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও আপনারা এসেছেন। আপনাদের সুচিন্তিত মতামত ও পরামর্শ আজকের গোলটেবিল আলোচনাকে সার্থক করেছে। প্ল্যান বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ।

আব্দুল কাইয়ুম: দুর্যোগে কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। আমাদের বড় ত্রুটি হলো, প্রথম দিকে এ বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এ ঘাটতি দূর করতে নীতিনির্ধারণী মহল সচেষ্ট হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.